চিরতা ও মধুঃ বাঘ কেন লোকালয়ে by হাসান হাফিজ
সুন্দরবন আর সুন্দর নেই। প্রায়ই অসুন্দর কাণ্ডকারখানা ঘটছে সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায়। আসলে সুন্দরবনের কপালটাই খারাপ। কিছুকাল আগে তামাম দুনিয়ায় হৈ হৈ কাণ্ড ঘটে গেল। বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্ধারণ নিয়ে ছিল এই হুজ্জতটা। অল্পের জন্য চান্সটা হাতছাড়া হয়ে গেল আমাদের।
সুন্দরবন নানান কারণেই বিখ্যাত। প্রথমত এই বন হচ্ছে সর্ববৃহত্ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই বনে বাস করেন উনি। টাইগার, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাংলাদেশের জাতীয় পশু। ছড়াকারের ভাষায়, সোঁদর বনের বাঘ/ ভীষণ তাদের রাগ। এই ব্যাঘ্রকুলের শনির দশা চলছে ইদানীং। বেঘোরে প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাদের। ঘাতকের ভূমিকায় নেমেছে মানুষ। যারা নিজেরাই আহ্লাদ করে এই জন্তুটিকে ‘জাতীয় পশু’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। দুর্মুখেরা বলে, বাঘ ব্যাটাই হচ্ছে আসল কুফা। মানুষের শত্তুর। ঘাড় মটকে রক্ত খাচ্ছে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারদের নামের সঙ্গে নতুন তকমা যোগ হয়েছে। খেতাবটি হচ্ছে ‘মানুষখেকো’। যে বাঘের কপালে এই তকমা জুটেছে, তার মৃত্যুদণ্ড লেখা হয়ে গেছে।
টাইগার কেন কুফা শব্দ? বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের ডাকা হয় ‘টাইগার’ বলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে পারফরমেন্স, তাতে খোদ বাঘেরাও লজ্জা পায়। বনের গহীনে ওদের লুকিয়ে থাকতে হয়। উদ্দেশ্য, এই লজ্জা থেকে নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচানো। ক্রিকেটারদের ‘টাইগার’ বলে ডাকা তাই কতটা যৌক্তিক, এই প্রশ্নও উঠতে পারে।
গত কয়েকদিনের খবরের কাগজ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যাকাণ্ডের খবরে সয়লাব। ফলাও করে ছাপা হয়েছে এই সংবাদ। নিকট অতীতে চিড়িয়াখানায় ব্যাপক পশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সেই শোক আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। চিড়িয়াখানার চিড়িয়ারা গণহারে পটল তুলেছে। কারণ অজ্ঞাত। ময়নাতদন্তকারীরা গলদঘর্ম হয়েও কোনো কারণ বের করতে পারেননি। বলিহারি, সেই তদন্তকারীদের দক্ষতা ও মুন্সিয়ানা! তাদেরকে ধিক্কার। চিড়িয়াখানার ঢাউস সাইজের বহুত খাঁচা এখনও পর্যন্ত খালি। কবে টেন্ডার হবে, কবে নতুন চিড়িয়া আমদানি করা হবে আল্লা মালুম! বাঘেরা কিন্তু মনে গোপন এক প্রকার খেদ নিয়ে মরেছে। লোকালয়ে আসার অপরাধে কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বর্বর, এনালগ পদ্ধতিতে ওদের মারা হলো, তা রহস্যজনক। সে এক ষড়যন্ত্র। চেতনানাশক বুলেটে ডিজিটাল সিস্টেমে মারাই ছিল শ্রেয়।
বাঘ হত্যার (অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) খবরটা কিঞ্চিত্ পর্যালোচনা করে দেখব আমরা। খবরে বলা হয়েছে : সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উত্পাত বেড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ ও গরু-ছাগলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতে বন সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ২০১০ শুক্রবার সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার আবাদ চণ্ডিপুর গ্রামে প্রবেশ করা একটি বাঘকে গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে লোকালয়ে আসা পাঁচটি বাঘ মানুষের হাতে মারা পড়ল।
বাঘ কেন লোকালয়ে আসছে? কেন তাদের প্রাণ খোয়াতে হচ্ছে? এসব গণক্রসফায়ার বন্ধ হবে কবে? বঞ্চিত-লাঞ্ছিত অবলা প্রাণীদের এই প্রাণের দাবি কে বা কারা তুলবে? পশু ক্লেশ নিবারণী সমিতি বাংলাদেশে নেই। হয়তো দাতারা এই খাতে অর্থায়নে উত্সাহী নয়। সেজন্য এই সেক্টরে এনজিও কার্যক্রম বিকাশ লাভ করেনি। সুশীল (!) সমাজ নিজেদের স্বার্থজড়ানো মতলবী কিছু ইস্যু ছাড়া অন্যান্য প্রশ্নে রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ। আমরা দেখছি, ম্যানগ্রোভ বনে ‘ম্যান’ অর্থাত্ সশস্ত্র বনদস্যুদের বল্গাহীন দৌরাত্ম্য চলছে। সরকার মূক ও বধির। এর প্রতিবাদে বাঘ চলে যাচ্ছে লোকালয়ে। তাদের পুশব্যাক করতে হবে। তাহলে বাঘ-মানুষ দু’পক্ষই বাঁচবে। ফেস সেভিং হবে দু’ধরনের প্রাণীরই। লোকালয়ে বাঘ আসা বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারি আমরা। এসব সুপারিশ হচ্ছে :
১. বাঘের খাদ্য কমে যাচ্ছে। চোরা শিকারিরা হরিণ লোপাট করছে। হরিণ এখন গেরস্ত বাড়িতেই লালন-পালন করার অনুমতি দিয়েছে সদাশয় সরকার। উত্তম পদক্ষেপ। চোরা শিকারিদের ক্রসফায়ারে ফেলতে হবে।
২. মস্তিষ্ক বিকৃতিজনিত কারণে কোনো বাঘ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘মানুষখেকো’ হয়ে উঠলেও উঠতে পারে। ধীরস্থিরভাবে এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে।
৩. ‘মানুষখেকো’ বাঘ ঘটনাচক্রে লোকালয়ে এসে পড়লে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা চলবে না। তাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র বা মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে রোগী বাঘদের নিয়মিত থেরাপি দিতে হবে।
৪. সুন্দরবনের চারপাশে দ্রুতগতিতে সীমানা দেয়াল গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য টেন্ডার নিয়ে সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনের লাল্লু-পাঞ্জুদের মধ্যে যেন খুনোখুনি না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। দেয়ালের বদলে পড়শি ভারতের জজবায় অনুপ্রাণিত হয়ে রাতারাতি কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করা যেতে পারে।
৫. বাঘ মাংসাশী প্রাণী বলে নানা রকম সঙ্কটের উদ্ভব। তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করে দেখতে হবে। কোনো ধরনের পাইলট প্রকল্প নেয়া যায় কিনা, এ ব্যাপারে প্রাণীবিজ্ঞানীদের উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
টাইগার কেন কুফা শব্দ? বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের ডাকা হয় ‘টাইগার’ বলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যে পারফরমেন্স, তাতে খোদ বাঘেরাও লজ্জা পায়। বনের গহীনে ওদের লুকিয়ে থাকতে হয়। উদ্দেশ্য, এই লজ্জা থেকে নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচানো। ক্রিকেটারদের ‘টাইগার’ বলে ডাকা তাই কতটা যৌক্তিক, এই প্রশ্নও উঠতে পারে।
গত কয়েকদিনের খবরের কাগজ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হত্যাকাণ্ডের খবরে সয়লাব। ফলাও করে ছাপা হয়েছে এই সংবাদ। নিকট অতীতে চিড়িয়াখানায় ব্যাপক পশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সেই শোক আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। চিড়িয়াখানার চিড়িয়ারা গণহারে পটল তুলেছে। কারণ অজ্ঞাত। ময়নাতদন্তকারীরা গলদঘর্ম হয়েও কোনো কারণ বের করতে পারেননি। বলিহারি, সেই তদন্তকারীদের দক্ষতা ও মুন্সিয়ানা! তাদেরকে ধিক্কার। চিড়িয়াখানার ঢাউস সাইজের বহুত খাঁচা এখনও পর্যন্ত খালি। কবে টেন্ডার হবে, কবে নতুন চিড়িয়া আমদানি করা হবে আল্লা মালুম! বাঘেরা কিন্তু মনে গোপন এক প্রকার খেদ নিয়ে মরেছে। লোকালয়ে আসার অপরাধে কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বর্বর, এনালগ পদ্ধতিতে ওদের মারা হলো, তা রহস্যজনক। সে এক ষড়যন্ত্র। চেতনানাশক বুলেটে ডিজিটাল সিস্টেমে মারাই ছিল শ্রেয়।
বাঘ হত্যার (অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) খবরটা কিঞ্চিত্ পর্যালোচনা করে দেখব আমরা। খবরে বলা হয়েছে : সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উত্পাত বেড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ ও গরু-ছাগলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতে বন সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ২০১০ শুক্রবার সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার আবাদ চণ্ডিপুর গ্রামে প্রবেশ করা একটি বাঘকে গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে লোকালয়ে আসা পাঁচটি বাঘ মানুষের হাতে মারা পড়ল।
বাঘ কেন লোকালয়ে আসছে? কেন তাদের প্রাণ খোয়াতে হচ্ছে? এসব গণক্রসফায়ার বন্ধ হবে কবে? বঞ্চিত-লাঞ্ছিত অবলা প্রাণীদের এই প্রাণের দাবি কে বা কারা তুলবে? পশু ক্লেশ নিবারণী সমিতি বাংলাদেশে নেই। হয়তো দাতারা এই খাতে অর্থায়নে উত্সাহী নয়। সেজন্য এই সেক্টরে এনজিও কার্যক্রম বিকাশ লাভ করেনি। সুশীল (!) সমাজ নিজেদের স্বার্থজড়ানো মতলবী কিছু ইস্যু ছাড়া অন্যান্য প্রশ্নে রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ। আমরা দেখছি, ম্যানগ্রোভ বনে ‘ম্যান’ অর্থাত্ সশস্ত্র বনদস্যুদের বল্গাহীন দৌরাত্ম্য চলছে। সরকার মূক ও বধির। এর প্রতিবাদে বাঘ চলে যাচ্ছে লোকালয়ে। তাদের পুশব্যাক করতে হবে। তাহলে বাঘ-মানুষ দু’পক্ষই বাঁচবে। ফেস সেভিং হবে দু’ধরনের প্রাণীরই। লোকালয়ে বাঘ আসা বন্ধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারি আমরা। এসব সুপারিশ হচ্ছে :
১. বাঘের খাদ্য কমে যাচ্ছে। চোরা শিকারিরা হরিণ লোপাট করছে। হরিণ এখন গেরস্ত বাড়িতেই লালন-পালন করার অনুমতি দিয়েছে সদাশয় সরকার। উত্তম পদক্ষেপ। চোরা শিকারিদের ক্রসফায়ারে ফেলতে হবে।
২. মস্তিষ্ক বিকৃতিজনিত কারণে কোনো বাঘ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘মানুষখেকো’ হয়ে উঠলেও উঠতে পারে। ধীরস্থিরভাবে এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে।
৩. ‘মানুষখেকো’ বাঘ ঘটনাচক্রে লোকালয়ে এসে পড়লে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা চলবে না। তাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র বা মানসিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেখানে রোগী বাঘদের নিয়মিত থেরাপি দিতে হবে।
৪. সুন্দরবনের চারপাশে দ্রুতগতিতে সীমানা দেয়াল গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য টেন্ডার নিয়ে সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনের লাল্লু-পাঞ্জুদের মধ্যে যেন খুনোখুনি না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। দেয়ালের বদলে পড়শি ভারতের জজবায় অনুপ্রাণিত হয়ে রাতারাতি কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করা যেতে পারে।
৫. বাঘ মাংসাশী প্রাণী বলে নানা রকম সঙ্কটের উদ্ভব। তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা করে দেখতে হবে। কোনো ধরনের পাইলট প্রকল্প নেয়া যায় কিনা, এ ব্যাপারে প্রাণীবিজ্ঞানীদের উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
No comments