আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭২)-ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে by আলী যাকের
কোনো দিন নিমতলা শ্মশানে গিয়ে মরা পোড়ানো দেখি। মাঝেমধ্যে এসপ্লানেডে গিয়ে সরিসৃপের মতো ট্রামগুলোর আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ করি। হঠাৎ একদিন ওই পার্ক সার্কাস ময়দানে বসেই মনে হয়, একি করছি আমি? আমার দেশ আজ শত্রুকবলিত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
মানুষের সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আর প্রায় নির্লিপ্ত আমি কিনা ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছি কলকাতায়? পরদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হই সার্কাস এভিনিউতে। বাংলাদেশ মিশনে। পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে দূর থেকে দেখি। অনেক ছাত্র নেতা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় মত্ত। আমি কী করব? কার সঙ্গে কথা বলব? আমার কোথায় যাওয়া উচিত? এসব ভাবতে ভাবতে যখন মিশনের সিংহদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসছি, তখন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায় আমার ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে। মাহমুদ, সগীর, লুৎফর ও ইকবাল। ২৮ মার্চ ঢাকায় কারফিউ শিথিল করার পর শেষ দেখা ওদের সঙ্গে। এরপর ওরা যে কোথায় ছিটকে পড়ল সে খবর পাইনি। ওরা সবাই দলবেঁধে চলে এসেছে একসঙ্গে। ওরাও ভাবছে কী করা যায়? পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করি সার্কাস এভিনিউ থেকে লোয়ার সার্কুলার রোড হয়ে গড়ের মাঠের দিকে। পথে বাংলাদেশের অনেক মানুষকে দেখতে পাই। কেউ পরিচিত, কেউ অর্ধপরিচিত। যতই দিন যেতে থাকে ততই একটা ব্যাপার নজরে পড়ে। সারা কলকাতা শহরে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে বাংলাদেশের লোকের সাক্ষাৎ মেলে না।
ক্রমে অনেক নতুন নতুন কলকাতাবাসীর সঙ্গে পরিচয় হয়। নাচোল বিদ্রোহের সেই বীরকন্যা ইলা মিত্র, তাঁর স্বামী এবং সহযাত্রী রমেন মিত্র। এ দম্পতি মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস ধরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য করে এসেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের, শরণার্থীদের। ইলা মিত্রের ভাই ডক্টর নৃপেন সেন। বাংলাদেশবাসী কারও রোগ-জরায় একবার নৃপেনদার কাছে গিয়ে পড়তে পারলেই কলকাতার পিজি হাসপাতালে একটা সিট বরাদ্দ হয়ে যেত। পিজির বড় ডাক্তার ছিলেন তিনি। ঔপন্যাসিক দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু কী সিংহ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন বাঙালিদের জন্য। লেক টাউনের সেই লাইব্রেরিয়ান এবং তাঁর স্কুলশিক্ষক স্ত্রী-দম্পতির কথা মনে পড়ে গেল। ছোট দুটি ঘরের ফ্ল্যাটে তাদের বাস। সুদীর্ঘ ৯ মাস তাঁরা তাঁদের শোওয়ার ঘরটি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে। পাঁচ-ছয়টি ছেলের একটি দল আসত। দু-তিন দিন থাকত। এরপর প্রশিক্ষণ নিতে চলে যেত। আবার আরেকটি নতুন দল আসত। গৃহকর্তা ও কর্ত্রী থাকতেন খাবার ঘরে। মনে পড়ে প্রসুন বসু, মানিক সেন ও রনমিত্র সেনের কথা। মুক্তিযুদ্ধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে যাঁরা প্রায় সার্বক্ষণিক শ্রম দিয়েছেন। ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণির কথাও কি ভোলা যায়? যেখানে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী স্কোয়াড নিয়মিত মহড়া দিত? সেখানে এক মহিলা ছিলেন। সবাই তাঁকে দিদি বলে ডাকত। দিনের পর দিন যিনি স্কোয়াডের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির সুখ-দুঃখের খোঁজ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ব্যক্তি ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র সেনের কথা ভোলা যায় কী করে? বাবার মতো স্নেহে যিনি অকৃপণভাবে প্রত্যেক বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন। জাস্টিস মাসুদ আরেক শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব, যাঁর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আরেকটি ক্যাম্প।
হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ বন্ধু যে কখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে চলে এলাম, টের পাইনি। সারাটা পথ সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, সবার মনেই প্রচণ্ড এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। প্রত্যেকের মনেই হাজার চিন্তা জট পাকাচ্ছিল। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে পারছিল না। হঠাৎ ইকবাল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আট ফুট উঁচু ভিতের ওপর প্রায় টারজান কায়দায় লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল, 'আ-মি যু-দ্ধে যা-চ্ছি, কা-ল-ই!' বেচারা ইকবাল। এর মাস খানিক পরই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে দর্শনার অদূরে ওর প্রথম অপারেশনেই। অকথ্য অত্যাচার পাকিস্তানিরা করেছিল ওর ওপর। সেই চিহ্ন আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ইকবাল। দেহের সর্বত্র পোড়া সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন খবর বের করার জন্য এ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিল পাকিস্তান বাহিনী।
ইকবালের ওই চিৎকার একেবারে হৃদয়ের ভেতরে অনুরণনের সৃষ্টি করেছিল আমাদের চার বন্ধুর। লুৎফর, সগীর, মাহমুদ এবং আমার। আমাদের প্রত্যেকেরই মনে যুদ্ধে যাওয়ার অদম্য বাসনা। এ সময় যুদ্ধরত বাংলাদেশি বাহিনীকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর ওপর দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্মুখ সমরে নিয়োজিত করার। আর গণবাহিনীর ওপর দায়িত্ব ছিল দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। অথবা যে পথে পাকিস্তানিদের রসদ সরবরাহ করা হয় সে পথ বন্ধ করে দেওয়া। ইকবাল এসবের ধার ধারে না। যেমন করে হোক সে যুদ্ধ করবেই। চলে যায় সে বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে। কিভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়- এ নিয়ে যখন আমরা পরিকল্পনা করছি, ঠিক সেই সময় কলকাতার পার্ক সার্কাসের কংগ্রেস এক্সিবিশন রোডের শামসি রেস্তোরাঁর সামনে হঠাৎ করেই আমার দেখা হয়ে যায় আলমগীর কবিরের সঙ্গে। সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক, আলমগীর কবির। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। প্রায় ঘনিষ্ঠতাই বলা যায়। সাংবাদিকতা ছাড়াও শিল্পসম্মত হ্রস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কথাও ভাবছিলেন তিনি। শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ক্রমে অনেক নতুন নতুন কলকাতাবাসীর সঙ্গে পরিচয় হয়। নাচোল বিদ্রোহের সেই বীরকন্যা ইলা মিত্র, তাঁর স্বামী এবং সহযাত্রী রমেন মিত্র। এ দম্পতি মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস ধরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সাহায্য করে এসেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের, শরণার্থীদের। ইলা মিত্রের ভাই ডক্টর নৃপেন সেন। বাংলাদেশবাসী কারও রোগ-জরায় একবার নৃপেনদার কাছে গিয়ে পড়তে পারলেই কলকাতার পিজি হাসপাতালে একটা সিট বরাদ্দ হয়ে যেত। পিজির বড় ডাক্তার ছিলেন তিনি। ঔপন্যাসিক দ্বীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু কী সিংহ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন বাঙালিদের জন্য। লেক টাউনের সেই লাইব্রেরিয়ান এবং তাঁর স্কুলশিক্ষক স্ত্রী-দম্পতির কথা মনে পড়ে গেল। ছোট দুটি ঘরের ফ্ল্যাটে তাদের বাস। সুদীর্ঘ ৯ মাস তাঁরা তাঁদের শোওয়ার ঘরটি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে। পাঁচ-ছয়টি ছেলের একটি দল আসত। দু-তিন দিন থাকত। এরপর প্রশিক্ষণ নিতে চলে যেত। আবার আরেকটি নতুন দল আসত। গৃহকর্তা ও কর্ত্রী থাকতেন খাবার ঘরে। মনে পড়ে প্রসুন বসু, মানিক সেন ও রনমিত্র সেনের কথা। মুক্তিযুদ্ধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াডের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে যাঁরা প্রায় সার্বক্ষণিক শ্রম দিয়েছেন। ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণির কথাও কি ভোলা যায়? যেখানে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী স্কোয়াড নিয়মিত মহড়া দিত? সেখানে এক মহিলা ছিলেন। সবাই তাঁকে দিদি বলে ডাকত। দিনের পর দিন যিনি স্কোয়াডের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির সুখ-দুঃখের খোঁজ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ব্যক্তি ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র সেনের কথা ভোলা যায় কী করে? বাবার মতো স্নেহে যিনি অকৃপণভাবে প্রত্যেক বাঙালিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, উপদেশ ও পরামর্শ দিয়েছেন। জাস্টিস মাসুদ আরেক শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব, যাঁর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আরেকটি ক্যাম্প।
হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ বন্ধু যে কখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে চলে এলাম, টের পাইনি। সারাটা পথ সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, সবার মনেই প্রচণ্ড এক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। প্রত্যেকের মনেই হাজার চিন্তা জট পাকাচ্ছিল। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে পারছিল না। হঠাৎ ইকবাল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আট ফুট উঁচু ভিতের ওপর প্রায় টারজান কায়দায় লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বলল, 'আ-মি যু-দ্ধে যা-চ্ছি, কা-ল-ই!' বেচারা ইকবাল। এর মাস খানিক পরই পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে দর্শনার অদূরে ওর প্রথম অপারেশনেই। অকথ্য অত্যাচার পাকিস্তানিরা করেছিল ওর ওপর। সেই চিহ্ন আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ইকবাল। দেহের সর্বত্র পোড়া সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন খবর বের করার জন্য এ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিল পাকিস্তান বাহিনী।
ইকবালের ওই চিৎকার একেবারে হৃদয়ের ভেতরে অনুরণনের সৃষ্টি করেছিল আমাদের চার বন্ধুর। লুৎফর, সগীর, মাহমুদ এবং আমার। আমাদের প্রত্যেকেরই মনে যুদ্ধে যাওয়ার অদম্য বাসনা। এ সময় যুদ্ধরত বাংলাদেশি বাহিনীকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর ওপর দায়িত্ব বর্তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্মুখ সমরে নিয়োজিত করার। আর গণবাহিনীর ওপর দায়িত্ব ছিল দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানিদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। অথবা যে পথে পাকিস্তানিদের রসদ সরবরাহ করা হয় সে পথ বন্ধ করে দেওয়া। ইকবাল এসবের ধার ধারে না। যেমন করে হোক সে যুদ্ধ করবেই। চলে যায় সে বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে। কিভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়- এ নিয়ে যখন আমরা পরিকল্পনা করছি, ঠিক সেই সময় কলকাতার পার্ক সার্কাসের কংগ্রেস এক্সিবিশন রোডের শামসি রেস্তোরাঁর সামনে হঠাৎ করেই আমার দেখা হয়ে যায় আলমগীর কবিরের সঙ্গে। সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক, আলমগীর কবির। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেও আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। প্রায় ঘনিষ্ঠতাই বলা যায়। সাংবাদিকতা ছাড়াও শিল্পসম্মত হ্রস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কথাও ভাবছিলেন তিনি। শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন।
(চলবে.....)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments