দূরের দূরবীনে-মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড দর্শন : আমরা কবে বড় হব? by অজয় দাশগুপ্ত

অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট খেলতে গেছে বাংলাদেশে। একচক্ষু অজি মিডিয়া এবার একটু হলেও নয়ন মেলবে। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। এত আধুনিক, এত চমৎকার, মাঝেমধ্যে এত নিরপেক্ষ_এর পরও কোথায় যেন সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এ দেশের মিডিয়া।


ইতিহাসও অতীতের দৃষ্টিকোণে একঘরে অথবা রক্তাক্ত অধ্যায়ের কারণেই হয়তোবা, আবার মনে হয় সে ভয় বা দুর্বলতা তো এত দীর্ঘকাল ছায়া ফেলে রাখার কথা নয়। তখন মনে হয়, গৌরব ও অহংকারের জায়গাটুকু আগলে রাখার কারণেই এই সীমাবদ্ধতা।
অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে গান্ধী, রুজভেল্ট, চার্চিল, সুকর্ন, ম্যান্ডেলা, টিটো এমনকি নেহরুর মতো দিকপাল কোনো নেতাও নেই, নেই বঙ্গবন্ধু বা তাঁর তুলনাযোগ্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। পরিশ্রম আর সীমিত জনবলের আধুনিক কৌশলেই আজ অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান শীর্ষে। ইতিহাস যেমন নেই, তেমনি নেই গান, নাটক, কবিতা, ছায়াছবি বা অন্য শিল্পের দীর্ঘ কোনো ঐতিহ্য। ঐতিহ্য তো দূর অস্ত, হাল আমলেও ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক কিছু চোখে পড়ে না। থিয়েটার, নাটক, গান ও কবিতা বাদ দিলে দৃশ্যমান শিল্পের জন্য এর একমাত্র গন্তব্য আমেরিকা! হলিউড-নির্ভর বিনোদনে মশগুল অস্ট্রেলিয়া 'অল দ্য রিভার্স রান'-এর মতো ধ্রুপদী সিরিয়াল নির্মাণও ভুলে গেছে। এ দেশে থ্রনটনের মতো শক্তিময়ী অভিনেত্রীর জৌলুস থাকলেও কদর নেই। যে কারণে উঠতি থেকে খ্যাতিমান, রাসেল বা নিকোল_সবার গন্তব্য ও লক্ষ্য হলিউড। পেছনে পড়ে থাকল ধু ধু মরু ও সবুজ ঘন ক্যাঙ্গারুর দেশ। প্রশান্ত পাড়ের দুই কোটি মানুষের আশা ও স্বপ্নের তীর্থ তাহলে কোথায়? কোথায় তার বেঁচে থাকার প্রেরণা?
হাত বাড়ালে খাঁটি দুধ, কাকচক্ষু জল, নীল জলের ছায়ায় বিলাসী জীবন। যৌবনের আহ্বান যেমন সত্য, তেমনি সত্য এর রেখে যাওয়া বেদনা-রেখা। বেদনাহীন জীবনের জন্য শুদ্ধতা বা বিশুদ্ধ জীবনচর্চার বিকল্প নেই। কোথা থেকে আসবে সেই শুদ্ধতা? রবীন্দ্রনাথ বা লালন শাহ নেই, নেই শেঙ্পিয়র বা জন কিটসের অনুভব, নেই মোপাসাঁ, শেকভ কিংবা পিকাসোর অনুপ্রেরণা। মোনালিসা নেই, নেই দ্য ভিঞ্চি এমনকি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সুলতানের মতো জাত শিল্পী। ভলগার উষ্ণতা, মেকংয়ের বিষাদ, গঙ্গার উত্তাল জোয়ার কিংবা রাইন বা নীলের ইতিহাসও নেই। বেচারি অস্ট্রেলিয়ার ধ্যান-জ্ঞান-তপস্যা তাই খেলাধুলা। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর আর কোনো দেশ এত কম জনসংখ্যার পরও এতটা আগুয়ান নয়। বিশ্বের এমন কোনো খেলা নেই যাতে অস্ট্রেলিয়া শীর্ষে নেই। সাঁতার, হকি, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন এমনকি ইদানীং সকারেও তার ভূমিকা ও অবদান চোখে পড়ার মতো।
ক্রিকেটের বেলায় অনুরাগ ও জৌলুস অস্ট্রেলিয়ার গর্বের ধন। এ দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান আইকন স্যার ডন ব্রাডম্যান। ক্রিকেট এ দেশকে যেমন পরিচিতি দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে মিশ্র সংস্কৃতি ও অন্যকে মেনে নেওয়ার তাগিদ। ওই যে মিডিয়ার কথা বলছিলাম, সে-ও এই ক্রিকেটের চাপে ধীরে ধীরে সহিষ্ণু ও সহ্যশীল হয়ে উঠছে। এক দশক আগেও এর অন্য রূপ দেখেছি। পাক-ভারত, সাউথ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে খেলার পরদিন কাগজ খুলে দেখি কোথাও কেউ নেই। কোনো খবর নেই। গোড়াতে অবাক হলেও পরে বুঝে নিয়েছি, খবর না থাকা বা খুব ছোটভাবে গুরুত্বহীন হয়ে এক কোণে পড়ে থাকার অর্থ, অস্ট্রেলিয়া জেতেনি। পরাজয় সহ্য না করার প্রাথমিক কারণ যা-ই হোক, পরের কারণটি কিঞ্চিৎ বর্ণবাদপ্রসূতও বটে। আশির দশকেও এ দেশে চামড়ার রঙে অভিবাসনের নীতি নির্ধারণের নিয়ম চালু ছিল। হোয়াইট পলিসির অস্ট্রেলিয়া সাধু-দরবেশ, গান্ধী বা ম্যান্ডেলার দেশের কাছে হারবে এবং তা খবর হবে? নৈব নৈবচ! আজ সে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। খোদ এসিজি বা এমসিজির খেলায়ও তেরঙা, লাল-সবুজ বা অন্য পতাকার ছড়াছড়ি। দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে অভ্যস্ত মিডিয়া মানছে, মানতে বাধ্য হচ্ছে। বলা বাহুল্য, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুর সঙ্গে টাইগারের লড়াইও এখন শিরোনাম। কেরি প্যাকারের বিশ্বনন্দিত স্পোর্টস চ্যানেল নাইনও মেতে উঠবে এই উৎসবে। আমাদের ক্রিকেট বাংলাদেশ ও তার ইমেজ রক্ষার আরো এক বিরল সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা কি পারব তার ভার বইতে?
দুই. ভার বহনের প্রসঙ্গ এল এ কারণে যে অপরিকল্পিত ধ্যান-ধারণা, ক্রিকেট ও উত্তেজনার মধ্যে পার্থক্যের বদলে উন্মাদনা_সব মিলিয়ে আমাদের চেহারাটা সুখকর কিছু নয়। মাসখানেক আগে মেলবোর্ন গিয়েছিলাম। সব কিছুর ভেতরও মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড দেখার কথা ভুলিনি। হোটেল ছেড়ে দেওয়ার সময় সকালবেলা দৌড়ালাম এমসিজি দর্শনে। শুধু মাঠ, নয়নাভিরাম ঘাসের কার্পেট। গ্রিক নাটকের দৃশ্যের মতো গ্যালারি আর বিস্তীর্ণ রাজ্যপাট দেখে চলে এলে যে কী ভুল হতো! যাওয়া অবধি ক্যানবেরায় বসবাসরত স্ত্রীর চিকিৎসক ভাইটির অবিরাম ফোন_'আর যাই করেন, এমসিজি ট্যুর না নিয়ে ফিরবেন না।' আমি ভাবি, এককালের ক্রিকেট খেলোয়াড়, এ দেশের চিকিৎসা পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যার স্বপ্ন আম্পায়ারিং, সে তো এ কথা বলতেই পারে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এড়িয়ে ভাগ্যিস ট্যুরটা নিয়েছিলাম। এমসিজি তখন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় আলীবাবার সিসিম ফাঁকের মতো খুলতে শুরু করেছে। কী নেই? মেলবোর্নের প্রথম ম্যাচ, ব্রাডম্যানের কীর্তিগাথা, রাগবি, সকার ফুটবল_যখন যা ঘটেছে সবই বন্দি হয়ে আছে। হয় ফটোফ্রেমে অথবা ভাস্কর্যে। ভেতরটা রহস্যপুরীর মতো। এত বিশাল, এত আধুনিক আর বর্ণাঢ্য, বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর। অনেকটা তরুণী-মনের মতো। হৃদয়ের এত ছোট জায়গাজুড়ে ভালোবাসা বা অন্য বিশালতার জগতের চেহারা বাইরে থেকে অদৃশ্য ও অবিশ্বাস্য। বেশ কয়েকটা দামি রেস্তোরাঁ আছে এর পেটে। চলছিল বিশাল পার্টি। কেউ একজন লম্বা রণ পায়ে দাঁড়িয়ে দেশীয় সার্কাসের ভঙ্গিতে মানুষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। এক একটি কাচের ঘরে চলছে জরুরি মিটিং অথবা অন্য কোনো গম্ভীরমুখো আলোচনা। লাইব্রেরির কথা না বললে বড় অন্যায় হবে। মূল ক্রিকেট নিয়ে এমন লাইব্রেরি? আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তিরিশের দশক থেকে যাবতীয় রেকর্ড, ক্রিকেটের নিয়মকানুন, হাল আমলের সার্কুলার_সবই নথিবন্দি। দর্শনের একটাই শর্ত, ছোঁয়া যাবে না, ধরাও যাবে না।
উপমহাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারও জ্বলজ্বল করছেন। কীর্তি ও রেকর্ডে দখল করে আছেন বিলবোর্ড, গ্যালারি অথবা গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালের অংশবিশেষ। ইমরান খান, কপিল দেব ও শচীন টেন্ডুলকার_এ তিনজনই আছেন শীর্ষে। শচীনের জায়গাটা অনন্য, কিঞ্চিৎ অসাধারণও বটে। ডন ব্রাডম্যান একমাত্র এ ক্রিকেটারকেই তাঁর জন্মদিনের অতিথি করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান, বোলার ও ক্রিকেটার যখন হোটেল রুমে ব্রাডম্যানের জন্মদিন উদ্যাপনে ব্যস্ত, শচীন তখন অন্দরমহলে, সঙ্গে ছিলেন শেন ওয়ার্ন। সেই দুর্লভ ছবি আছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি জুড়ে। উপমহাদেশের এই বিজয় দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে ভরে ওঠে প্রসন্নতায়। এর সিকি ভাগ দায়িত্ব বা ইতিহাস-মনোযোগিতা থাকলেও আমাদের জন্য দুর্ভাবনা থাকত না।
তিন. আমরা অন্য সব বিষয়ের মতো খেলাধুলাতেও উত্তেজনাপ্রবণ। জিতলে এতটাই উন্মাদিত যে দিনকে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে ফেলি। কোটি টাকা থেকে সাম্রাজ্য দানের মতো ব্যাপারেও পিছিয়ে থাকি না। একই দল, একই খেলোয়াড়কে হারার পর তুলোধুনো তো বটেই, তাঁদের জীবন, সংসার ও পরিবারকেও বিপন্ন করতে পিছপা নই আমরা। নেই রেকর্ড সুরক্ষা, মর্যাদা বা স্থান সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। রাজনীতির মতো জটিল বিষয় ঢুকে পড়লে যা হয়, তা-ই হচ্ছে। খেলাকে খেলার জায়গায় রাখা যায় না। সেলুনের সেই বহুশ্রুত গল্পটি দিয়েই শেষ করব_চুল কাটাতে গেছেন এক অধ্যাপক। চুল কাটার পর টাকা দিতে গেলে ক্ষৌরকার কিছুতেই তা নেবে না। সে জানাল_'এ হ্না আমি সামাজিক কাজ করছি, বিনা টাকায় চুল কাটছি।' পরদিন দরজা খুলে অবাক ক্ষৌরকার দেখে, দোরগোড়ায় সুদৃশ্য প্যাকেট মোড়ানো বই ও শুভেচ্ছা কার্ড। সেদিন চুল কাটতে এলেন আরেক ভদ্রলোক। পেশায় চাকরিজীবী। তিনিও টাকা দিতে ব্যর্থ হলেন। পরের দিন ভোরবেলা দরজা খুলে পাওয়া গেল একগুচ্ছ গোলাপ ও একটি ধন্যবাদ কার্ড। সেদিন চুল কাটাতে এলেন এক সংসদ সদস্য। টাকা নেবে না শুনে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। পরের দিন ভোরবেলা চেঁচামেচি আর হৈচৈ শুনে ক্ষৌরকার দরজা খুলতে গিয়ে দেখেন, সর্বনাশ! লম্বা লাইন। সবাই বলছে, এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন। মাগনা চুল কাটা বলে কথা! কী কাণ্ড, আমাদের সব কিছুতেই কেবল উন্মাদনা আর লম্বা-চওড়া লাইনের বাহুল্য।
চার. তাই আমাদের জাতীয় গৌরবের অন্যতম বাহন ক্রিকেটকে সব ধরনের ঝামেলামুক্ত রেখে সম্প্রীতির বাহন করে তুলতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের বেলায়ও। এবারের খেলা এ দেশে যে গুরুত্ব ও মর্যাদা বয়ে আনবে, তার সুরক্ষার দায়িত্বও আমাদের।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.