হলফনামা-‘বিচারের আগেই জিয়া তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন’ by লরেন্স লিফশুলজ
৩১ জানুয়ারি ২০১১ ১. আমার নাম লরেন্স লিফশুলজ। আমি আমেরিকার নাগরিক। পেশায় লেখক। যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের স্টোনি ক্রিকের বাসিন্দা আমি। ২. গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান একটি ই-মেইল বার্তার মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমাকে জানান, ১৯৭৬ সালে বিশেষ
সামরিক আদালতে কর্নেল আবু তাহেরের কথিত বিচার ও শাস্তি প্রদান প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপনের জন্য আমাকে ২৬ জানুয়ারির মধ্যে আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
৩. ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই অনুরোধটি পাওয়ার প্রত্যাশা করেছি। ঢাকায় আদালতকক্ষে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগকে আমি জীবনের অন্যতম সম্মানজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করি। আমার মতে, ঢাকায় ১৯৭৬ সালের জুন ও জুলাই মাসে একটি দুঃখজনক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনার হাতে গোনা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর একজন ছিলাম আমি। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন আমি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারাগারের চার দেয়ালের আড়ালে গোপনে আবু তাহের ও তাঁর সহকর্মীদের কথিত বিচার শুরুর দিন ছিল সেটি। সকালে আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, কারাগারের চারপাশে নিরাপত্তার এতটাই কড়াকড়ি ছিল, মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কারাগারের দেয়ালের পাশে মেশিনগান পোস্ট বসানো হয়েছিল। সেখান থেকে বন্দুকের নল বাইরের দিকে তাক করে ছিল। বন্দুকগুলো কী রক্ষা করছিল? গোপনীয়তা? কাদের গুলি করার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল? কেন বিচার আদালতের পরিবর্তে কারাগারে অনুষ্ঠিত হলো?
৪. ওই দিন কারাগারে একমাত্র নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, এটা আমার দায়িত্ব সবাইকে জানানো, আমি কী দেখেছি এবং ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে। একটি চিঠিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনকে আমি জানিয়েছি, এ মুহূর্তে আমার পক্ষে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব নয় এবং এর কারণও ব্যাখ্যা করেছি। তাই এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রমকে আর দেরি করিয়ে না দিতে আমি একটি হলফনামা দাখিল করছি।
৫. ১৯৭৬ সালে আমি হংকংভিত্তিক পত্রিকা ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলাম। আমার কর্মস্থল ছিল দিল্লি। এর দুই বছর আগে আমি ঢাকায় ছিলাম। তখন আমি পত্রিকাটির বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। তাই তখনকার বাংলাদেশের উত্তাল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি জানতাম এবং সেখানকার অনেক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।
৬. ১৯৭৬ সালের জুনে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় পৌঁছাই আমি। এর আগে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর আবু তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা হিসেবে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনা নিয়ে আমি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরেও আমি ঢাকায় এসেছিলাম।
৭. আমার বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্টের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক বৈধতাহীন একটি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সবচেয়ে মৌলিক বিষয়গুলোতে আবু তাহেরের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছিল কি না। কোন আইনি ভিত্তির ওপর ‘বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল-১’ স্থাপন করা হয়েছিল? যাঁরা ওই ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি নিতে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল? অথবা বাস্তবে বিচারকাজ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগ পর্যন্ত তাঁদের আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করা হয়? সাংবিধানিক বা নৈতিকভাবে ওই ট্রাইব্যুনালের কী অবস্থান রয়েছে একটি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার ব্যাপারে? কর্নেল ইউসুফ হায়দারের নেতৃত্বাধীন ওই আদালতকে খুব সাধারণভাবে একটি ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ হিসেবে অভিহিত করা যথার্থ হবে, যে আদালত পূর্বনির্ধারিত একটি দণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন?—এই প্রশ্নগুলো আমলে নেওয়া এবং এগুলোর উত্তর বের করা দরকার। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশের সংবিধানের আলোকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা দরকার।
৮. একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের কথা আমি আদালতের সামনে উপস্থাপনের প্রত্যাশা করছি। আমি মনে করি, এটা এসব প্রশ্নের উত্তর জানার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ১৯৭৬ সালের জুনের শুরুতে যখন আমি ঢাকায় পৌঁছাই, আমি জেনারেল মোহাম্মদ মঞ্জুরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁকে জানাই, আমি বাংলাদেশে। ওই সময় মঞ্জুর ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। এর আগে ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে নয়াদিল্লিতে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ওই সময় তিনি ভারতে বাংলাদেশের সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ এবং কীভাবে তাঁরা সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার হিসেবে পাকিস্তান থেকে পালিয়েছিলেন, তা নিয়ে আলাপ হয়।
৯. আবু তাহের ও মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন মঞ্জুর। যুদ্ধের অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা তিনজনই সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান।
১০. দুই বছর পর ১৯৭৬ সালের জুনে যখন মঞ্জুরকে টেলিফোনে জানালাম আমি ঢাকায়, শুনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। দ্রুত আমি বুঝতে পারলাম, তাঁর মনে অনেক কিছু জমা আছে। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি কাউকে পাঠাবেন যিনি আমাদের দুজনের দেখা করার ব্যবস্থা করবেন। তিনি চাচ্ছিলেন, সেনানিবাসে তাঁর সদর দপ্তরে রাতে তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করি। আমি রাত নয়টার দিকে সেখানে পৌঁছেছিলাম এবং সেখানে তিন ঘণ্টা ছিলাম।
১১. ওই রাতে জেনারেল মঞ্জুর তাহেরের বিষয়েই আমার সঙ্গে আলাপ করেন। ওই সময় তাহেরের কারাবন্দিত্বের মেয়াদ ছয় মাস পার হয়েছিল। মঞ্জুর আমাকে বলেছিলেন, বন্দিদশার বেশির ভাগ সময় তাহেরকে একা রাখা হয়েছিল। তিনি আমার সফর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি জানিয়েছিলাম, জুনের শেষ নাগাদ আমার যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আমার যাওয়া উচিত হবে না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, তাহেরকে বিচারের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন জিয়া। মঞ্জুর এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জিয়াকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জুনের শুরুতে মঞ্জুর অনিশ্চিত হয়ে পড়েন, তিনি এই বিচার-প্রক্রিয়া থামাতে পারবেন কি না। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমার ঢাকায় থাকা উচিত। তিনি বলেছিলেন, যদি কোনো বিচার অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তা কাউকে তুলে ধরতে হবে। আমি তাঁর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। আমি সফরসূচি পরিবর্তন করে ঢাকায় অবস্থান করি।
১২. ওই মাসে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ঢাকায় উত্তেজনা বেড়ে চলছিল। আমি জেনারেল জিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁর সহকারীরা আমাকে প্রশ্নের একটি তালিকা দিতে বলেন। ওই তালিকায় ফারাক্কা ব্যারাজসহ বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়। সেখানে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এবং আবু তাহেরের গ্রেপ্তারের বিষয়েও প্রশ্ন ছিল। জিয়ার কাছে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, তাহের এবং তাঁর নেতৃত্বে থাকা বাহিনী জিয়ার জীবন বাঁচিয়েছিল। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে কেন তিনি তাহেরকে আটক করেছেন এবং যারা আসলে তাঁকে (জিয়া) আটকের জন্য দায়ী, তাদের মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি দেননি জিয়া।
১৩. তাহেরের বিচার চলার মাঝামাঝি সময়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ৩০তম বার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক স্মরণসভায় আমি বক্তৃতা করি। সেখানে আমি বর্ণনা করেছিলাম, কীভাবে ওই বিচারের বিষয়ে পুরোপুরি সেন্সরশিপ আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়। (এ বিষয়ে ব্রিটেনভিত্তিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেন তিনি এবং সেগুলোর কপিও এই হলফনামায় যুক্ত করা হয়েছে বলে জানান।)
১৪. ১৯৭৬ সালের জুনের শুরুতে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরবর্তী ঘটনাবলি। সেনানিবাসে ওই রাতের বৈঠকে মঞ্জুর তাহেরের বিচার শুরু করা নিয়েই আশঙ্কা প্রকাশ করেননি বরং তাঁর ভয় ছিল, তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এর ইতি ঘটবে। আমি মনে করি না তৎকালীন পরিস্থিতিতে এমন কোনো পরিণতি কল্পনা করা সম্ভব ছিল। যা-ই হোক, ওই বিচারকাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর এক ব্যক্তির মাধ্যমে মঞ্জুর আমাকে একটি বার্তা পাঠান। ওই সময় আমি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে থাকতাম। মঞ্জুরের বার্তাবাহক আমাকে জানান, মঞ্জুর আমাকে জানাতে চেয়েছেন, তিনি ওই বিচার ঠেকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্পষ্টতই সেটি করার কোনো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। যদিও তিনি ওই সময় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছিলেন। তাহেরের বিচার নিয়ে তাঁর অবস্থান তাঁকে সামরিক বাহিনীতে চিহ্নিত করে ফেলেছিল ওই সব ব্যক্তির কাছে, যাঁরা তাহেরের মৃত্যু চেয়েছিলেন। যদিও আমাদের অনেকেই বিষয়টি সন্দেহ করেছিলাম, মঞ্জুরের প্রতিনিধি আমাকে বলেছিলেন, জেনারেল মঞ্জুর আমাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে বিষয়টি জানাতে চান তা হলো:
মঞ্জুর পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানতেন, কথিত ওই বিচার শুরু হওয়ার আগেই জিয়া ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হবে। ওই সময় জিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন দুজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাও এই বিষয়ে আমাকে নিশ্চিত করেছেন।
১৫. আইনি কাঠামোর আওতায় এ ধরনের একটি ঘটনাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারসংক্রান্ত পর্যালোচনায় আনার কী নিহিতার্থ থাকতে পারে? ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যা ঘটেছিল, তাকে কি আদৌ কোনো বিচার বলা যায়? বিচারের আগেই যদি মৃত্যুদণ্ডের ফয়সালা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হত্যাকে বৈধ করার কৌশলযন্ত্র হিসেবে বিচারবহির্ভূত কোনো শক্তি বিচার-প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ কে (যে ট্রাইব্যুনাল বসেছিল মাত্র একবার এবং পরবর্তীকালে যেটি আর কখনোই শুনানি আহ্বান করেনি) ট্রাইব্যুনাল না বলে সেটি কার্যত যা ছিল, তাকে সে নামেই আখ্যায়িত করা উচিত। বাস্তবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি একটি ব্যবস্থা, যেটা স্থাপন করা হয়েছিল নারী-পুরুষনির্বিশেষে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যু ও কারাদণ্ড দেওয়ার জন্য। আশার কথা হলো, ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকির কারণে অতীতে যে আতঙ্কের পরিবেশ ছিল, তা অনেকখানি কেটে গেছে; মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আজ বাংলাদেশের সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘনকারী সেই ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করার পথ খুঁজে পাবেন।
১৬. নির্মোহভাবে আমি বিশ্বাস করি, বিচার শুরুর আগেই এ রায় নির্ধারিত হয়েছিল। যে তথাকথিত রায়ে তাহেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, সে রায়কে বাতিল করার এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তখনই ছিল। তাহেরের ফাঁসিকে শুধু ‘বিচার বিভ্রাট’ বললেই যথেষ্ট হয় না, এটিকে ‘রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা উচিত। রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিকভাবে অতীতে সংঘটিত অপরাধের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উচিত জাতিকে এ ধরনের অপরাধের বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আধুনিক যুগে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশ এর নজির রেখেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটি হলো সুপ্রিম কোর্ট।
১৭. ওই ট্রাইব্যুনালে যাঁদের বিচার হয়েছিল তাঁদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দেওয়া হয়নি এবং আইনজীবী নিয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে। অত্যন্ত গোপনে এমন এক আদালতে এই বিচার হয়েছিল, যার কোনো আইনগত ভিত্তিই ছিল না। এই অবিচারের বিরুদ্ধে যাতে গণরোষ ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য গণমাধ্যমকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাহের ওই ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে তাঁর শেষ ভাষণে যা বলেছিলেন, তা যদি পরের দিন খবরের কাগজে প্রকাশিত হতো, তাহলে জণগণের মধ্যে কী ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হতো, কল্পনা করতে পারেন!
১৮. ওই আদালতে এমন এক ব্যক্তির গোপন বিচার হচ্ছিল, যিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন; দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়ে যিনি তাঁর বাঁ পা হারিয়েছিলেন এবং এই বীরত্বের জন্য যাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এ অবস্থায় কোনো আজগুবি কারণ দেখিয়ে যেকোনো আদালত তাহেরের এ মামলাকে বৈধ বিচার বলতে পারেন?
১৯. পাঁচ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বক্তৃতা করার সময় আমি নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণগুলো উল্লেখ করি:
‘এখন ৩০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কী ঘটেছে আমরা সবাই জানি। আজ আমরা তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী পালন করছি। আমার দৃষ্টিতে, এখনই সময় রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের উচিত প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডও ভুল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের রায় বাতিল করা উচিত এবং এমন একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত যে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল যে সরকার, তারা তাহেরের নাগরিক ও আইনগত অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছিল।...এই কাজ সুসম্পন্ন করার উপযুক্ত পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন রায় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে দেওয়া এবং এই মর্মে একটি সরকারি স্বীকৃতি যে আবু তাহেরের তথাকথিত পুরো বিচার-প্রক্রিয়াটি ছিল যথাযথ আইনগত কার্যপ্রণালির এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।...আমার নিজের মত হলো, ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ বিষয়ে নৈতিক ও নীতিগত পন্থায় ভূমিকা রাখবে। যে পর্যন্ত না তাহেরের মামলার রায় উল্টে যাচ্ছে, সে পর্যন্ত আমাদের বিরাম নেই। আমার বন্ধুরা, এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।’
২০. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, আপনাদের সামনে একটি বড় নৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। এই মামলার বিষয়ে আপনারা যে রায়ই দেবেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকবে। আমার বিবেচনায় তাহেরের এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংশ্লেষ রয়েছে। এই মামলার বাদীপক্ষ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এই মামলার বাদীপক্ষের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। আমাদের এবং বিশ্বের কাছ থেকে শ্রদ্ধা প্রাপ্য তাঁদের। তাঁদেরকে এই সম্মান জানানোর একটিমাত্র পথ রয়েছে, তা হলো তাঁদের সেই অনুভূতি দেওয়া যে দীর্ঘ তিন দশকের পথপরিক্রমার শেষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা আপনাদের দায়িত্ব।
২১. ইলেকট্রনিক মেইলে পাঠানো এই হলফনামা আমি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানের কার্যালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাখিল করছি। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এম কে রহমান আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ইলেকট্রনিক মেইলের পাশাপাশি কুরিয়ারের মাধ্যমেও এই হলফনামার নোটারি ও সত্যায়িত করা কপি ও সংযুক্তি পাঠানো হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শাব্বির চৌধুরী ঢাকায় পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে সেটা সুপ্রিম কোর্টের কাছে পৌঁছে দেবেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ঢাকায় আদালতের সামনে উপস্থিত হয়ে আমি নিজে হলফনামাটি উপস্থাপন করতে পারলাম না। এটা অত্যন্ত সম্মানের বিষয় হতো আমার জন্য, যা আমার বাকি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হয়ে থাকত।
স্বাক্ষর: লরেন্স লিফশুলজ
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: সারফুদ্দিন আহমেদ ও আরিফ মো. তারেক হাবিব
৩. ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই অনুরোধটি পাওয়ার প্রত্যাশা করেছি। ঢাকায় আদালতকক্ষে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগকে আমি জীবনের অন্যতম সম্মানজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করি। আমার মতে, ঢাকায় ১৯৭৬ সালের জুন ও জুলাই মাসে একটি দুঃখজনক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনার হাতে গোনা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর একজন ছিলাম আমি। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন আমি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারাগারের চার দেয়ালের আড়ালে গোপনে আবু তাহের ও তাঁর সহকর্মীদের কথিত বিচার শুরুর দিন ছিল সেটি। সকালে আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, কারাগারের চারপাশে নিরাপত্তার এতটাই কড়াকড়ি ছিল, মনে হচ্ছিল সেনাবাহিনী কোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। কারাগারের দেয়ালের পাশে মেশিনগান পোস্ট বসানো হয়েছিল। সেখান থেকে বন্দুকের নল বাইরের দিকে তাক করে ছিল। বন্দুকগুলো কী রক্ষা করছিল? গোপনীয়তা? কাদের গুলি করার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল? কেন বিচার আদালতের পরিবর্তে কারাগারে অনুষ্ঠিত হলো?
৪. ওই দিন কারাগারে একমাত্র নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, এটা আমার দায়িত্ব সবাইকে জানানো, আমি কী দেখেছি এবং ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে। একটি চিঠিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনকে আমি জানিয়েছি, এ মুহূর্তে আমার পক্ষে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব নয় এবং এর কারণও ব্যাখ্যা করেছি। তাই এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রমকে আর দেরি করিয়ে না দিতে আমি একটি হলফনামা দাখিল করছি।
৫. ১৯৭৬ সালে আমি হংকংভিত্তিক পত্রিকা ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলাম। আমার কর্মস্থল ছিল দিল্লি। এর দুই বছর আগে আমি ঢাকায় ছিলাম। তখন আমি পত্রিকাটির বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। তাই তখনকার বাংলাদেশের উত্তাল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি জানতাম এবং সেখানকার অনেক রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল।
৬. ১৯৭৬ সালের জুনে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় পৌঁছাই আমি। এর আগে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর আবু তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা হিসেবে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনা নিয়ে আমি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পরেও আমি ঢাকায় এসেছিলাম।
৭. আমার বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্টের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক বৈধতাহীন একটি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা সবচেয়ে মৌলিক বিষয়গুলোতে আবু তাহেরের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছিল কি না। কোন আইনি ভিত্তির ওপর ‘বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল-১’ স্থাপন করা হয়েছিল? যাঁরা ওই ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি নিতে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল? অথবা বাস্তবে বিচারকাজ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগ পর্যন্ত তাঁদের আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করা হয়? সাংবিধানিক বা নৈতিকভাবে ওই ট্রাইব্যুনালের কী অবস্থান রয়েছে একটি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার ব্যাপারে? কর্নেল ইউসুফ হায়দারের নেতৃত্বাধীন ওই আদালতকে খুব সাধারণভাবে একটি ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ হিসেবে অভিহিত করা যথার্থ হবে, যে আদালত পূর্বনির্ধারিত একটি দণ্ড বাস্তবায়ন করেছেন?—এই প্রশ্নগুলো আমলে নেওয়া এবং এগুলোর উত্তর বের করা দরকার। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশের সংবিধানের আলোকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করা দরকার।
৮. একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের কথা আমি আদালতের সামনে উপস্থাপনের প্রত্যাশা করছি। আমি মনে করি, এটা এসব প্রশ্নের উত্তর জানার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ১৯৭৬ সালের জুনের শুরুতে যখন আমি ঢাকায় পৌঁছাই, আমি জেনারেল মোহাম্মদ মঞ্জুরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁকে জানাই, আমি বাংলাদেশে। ওই সময় মঞ্জুর ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। এর আগে ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে নয়াদিল্লিতে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ওই সময় তিনি ভারতে বাংলাদেশের সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ এবং কীভাবে তাঁরা সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার হিসেবে পাকিস্তান থেকে পালিয়েছিলেন, তা নিয়ে আলাপ হয়।
৯. আবু তাহের ও মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন মঞ্জুর। যুদ্ধের অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা তিনজনই সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান।
১০. দুই বছর পর ১৯৭৬ সালের জুনে যখন মঞ্জুরকে টেলিফোনে জানালাম আমি ঢাকায়, শুনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। দ্রুত আমি বুঝতে পারলাম, তাঁর মনে অনেক কিছু জমা আছে। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি কাউকে পাঠাবেন যিনি আমাদের দুজনের দেখা করার ব্যবস্থা করবেন। তিনি চাচ্ছিলেন, সেনানিবাসে তাঁর সদর দপ্তরে রাতে তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করি। আমি রাত নয়টার দিকে সেখানে পৌঁছেছিলাম এবং সেখানে তিন ঘণ্টা ছিলাম।
১১. ওই রাতে জেনারেল মঞ্জুর তাহেরের বিষয়েই আমার সঙ্গে আলাপ করেন। ওই সময় তাহেরের কারাবন্দিত্বের মেয়াদ ছয় মাস পার হয়েছিল। মঞ্জুর আমাকে বলেছিলেন, বন্দিদশার বেশির ভাগ সময় তাহেরকে একা রাখা হয়েছিল। তিনি আমার সফর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি জানিয়েছিলাম, জুনের শেষ নাগাদ আমার যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার কথা রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আমার যাওয়া উচিত হবে না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, তাহেরকে বিচারের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন জিয়া। মঞ্জুর এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জিয়াকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জুনের শুরুতে মঞ্জুর অনিশ্চিত হয়ে পড়েন, তিনি এই বিচার-প্রক্রিয়া থামাতে পারবেন কি না। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমার ঢাকায় থাকা উচিত। তিনি বলেছিলেন, যদি কোনো বিচার অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তা কাউকে তুলে ধরতে হবে। আমি তাঁর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম। আমি সফরসূচি পরিবর্তন করে ঢাকায় অবস্থান করি।
১২. ওই মাসে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ঢাকায় উত্তেজনা বেড়ে চলছিল। আমি জেনারেল জিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁর সহকারীরা আমাকে প্রশ্নের একটি তালিকা দিতে বলেন। ওই তালিকায় ফারাক্কা ব্যারাজসহ বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়। সেখানে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এবং আবু তাহেরের গ্রেপ্তারের বিষয়েও প্রশ্ন ছিল। জিয়ার কাছে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, তাহের এবং তাঁর নেতৃত্বে থাকা বাহিনী জিয়ার জীবন বাঁচিয়েছিল। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে কেন তিনি তাহেরকে আটক করেছেন এবং যারা আসলে তাঁকে (জিয়া) আটকের জন্য দায়ী, তাদের মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি দেননি জিয়া।
১৩. তাহেরের বিচার চলার মাঝামাঝি সময়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ৩০তম বার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক স্মরণসভায় আমি বক্তৃতা করি। সেখানে আমি বর্ণনা করেছিলাম, কীভাবে ওই বিচারের বিষয়ে পুরোপুরি সেন্সরশিপ আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়। (এ বিষয়ে ব্রিটেনভিত্তিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেন তিনি এবং সেগুলোর কপিও এই হলফনামায় যুক্ত করা হয়েছে বলে জানান।)
১৪. ১৯৭৬ সালের জুনের শুরুতে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরবর্তী ঘটনাবলি। সেনানিবাসে ওই রাতের বৈঠকে মঞ্জুর তাহেরের বিচার শুরু করা নিয়েই আশঙ্কা প্রকাশ করেননি বরং তাঁর ভয় ছিল, তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে এর ইতি ঘটবে। আমি মনে করি না তৎকালীন পরিস্থিতিতে এমন কোনো পরিণতি কল্পনা করা সম্ভব ছিল। যা-ই হোক, ওই বিচারকাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর এক ব্যক্তির মাধ্যমে মঞ্জুর আমাকে একটি বার্তা পাঠান। ওই সময় আমি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে থাকতাম। মঞ্জুরের বার্তাবাহক আমাকে জানান, মঞ্জুর আমাকে জানাতে চেয়েছেন, তিনি ওই বিচার ঠেকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্পষ্টতই সেটি করার কোনো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। যদিও তিনি ওই সময় সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছিলেন। তাহেরের বিচার নিয়ে তাঁর অবস্থান তাঁকে সামরিক বাহিনীতে চিহ্নিত করে ফেলেছিল ওই সব ব্যক্তির কাছে, যাঁরা তাহেরের মৃত্যু চেয়েছিলেন। যদিও আমাদের অনেকেই বিষয়টি সন্দেহ করেছিলাম, মঞ্জুরের প্রতিনিধি আমাকে বলেছিলেন, জেনারেল মঞ্জুর আমাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে বিষয়টি জানাতে চান তা হলো:
মঞ্জুর পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানতেন, কথিত ওই বিচার শুরু হওয়ার আগেই জিয়া ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হবে। ওই সময় জিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন দুজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাও এই বিষয়ে আমাকে নিশ্চিত করেছেন।
১৫. আইনি কাঠামোর আওতায় এ ধরনের একটি ঘটনাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারসংক্রান্ত পর্যালোচনায় আনার কী নিহিতার্থ থাকতে পারে? ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যা ঘটেছিল, তাকে কি আদৌ কোনো বিচার বলা যায়? বিচারের আগেই যদি মৃত্যুদণ্ডের ফয়সালা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হত্যাকে বৈধ করার কৌশলযন্ত্র হিসেবে বিচারবহির্ভূত কোনো শক্তি বিচার-প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ কে (যে ট্রাইব্যুনাল বসেছিল মাত্র একবার এবং পরবর্তীকালে যেটি আর কখনোই শুনানি আহ্বান করেনি) ট্রাইব্যুনাল না বলে সেটি কার্যত যা ছিল, তাকে সে নামেই আখ্যায়িত করা উচিত। বাস্তবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি একটি ব্যবস্থা, যেটা স্থাপন করা হয়েছিল নারী-পুরুষনির্বিশেষে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মৃত্যু ও কারাদণ্ড দেওয়ার জন্য। আশার কথা হলো, ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকির কারণে অতীতে যে আতঙ্কের পরিবেশ ছিল, তা অনেকখানি কেটে গেছে; মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট আজ বাংলাদেশের সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘনকারী সেই ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল করার পথ খুঁজে পাবেন।
১৬. নির্মোহভাবে আমি বিশ্বাস করি, বিচার শুরুর আগেই এ রায় নির্ধারিত হয়েছিল। যে তথাকথিত রায়ে তাহেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, সে রায়কে বাতিল করার এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তখনই ছিল। তাহেরের ফাঁসিকে শুধু ‘বিচার বিভ্রাট’ বললেই যথেষ্ট হয় না, এটিকে ‘রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা উচিত। রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিকভাবে অতীতে সংঘটিত অপরাধের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার ক্ষমতা ও সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উচিত জাতিকে এ ধরনের অপরাধের বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আধুনিক যুগে জার্মানি, আর্জেন্টিনা, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশ এর নজির রেখেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটি হলো সুপ্রিম কোর্ট।
১৭. ওই ট্রাইব্যুনালে যাঁদের বিচার হয়েছিল তাঁদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দেওয়া হয়নি এবং আইনজীবী নিয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে। অত্যন্ত গোপনে এমন এক আদালতে এই বিচার হয়েছিল, যার কোনো আইনগত ভিত্তিই ছিল না। এই অবিচারের বিরুদ্ধে যাতে গণরোষ ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য গণমাধ্যমকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাহের ওই ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে তাঁর শেষ ভাষণে যা বলেছিলেন, তা যদি পরের দিন খবরের কাগজে প্রকাশিত হতো, তাহলে জণগণের মধ্যে কী ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হতো, কল্পনা করতে পারেন!
১৮. ওই আদালতে এমন এক ব্যক্তির গোপন বিচার হচ্ছিল, যিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন; দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়ে যিনি তাঁর বাঁ পা হারিয়েছিলেন এবং এই বীরত্বের জন্য যাঁকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। এ অবস্থায় কোনো আজগুবি কারণ দেখিয়ে যেকোনো আদালত তাহেরের এ মামলাকে বৈধ বিচার বলতে পারেন?
১৯. পাঁচ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বক্তৃতা করার সময় আমি নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণগুলো উল্লেখ করি:
‘এখন ৩০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কী ঘটেছে আমরা সবাই জানি। আজ আমরা তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী পালন করছি। আমার দৃষ্টিতে, এখনই সময় রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের উচিত প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডও ভুল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের রায় বাতিল করা উচিত এবং এমন একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত যে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল যে সরকার, তারা তাহেরের নাগরিক ও আইনগত অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছিল।...এই কাজ সুসম্পন্ন করার উপযুক্ত পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন রায় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে দেওয়া এবং এই মর্মে একটি সরকারি স্বীকৃতি যে আবু তাহেরের তথাকথিত পুরো বিচার-প্রক্রিয়াটি ছিল যথাযথ আইনগত কার্যপ্রণালির এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।...আমার নিজের মত হলো, ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ বিষয়ে নৈতিক ও নীতিগত পন্থায় ভূমিকা রাখবে। যে পর্যন্ত না তাহেরের মামলার রায় উল্টে যাচ্ছে, সে পর্যন্ত আমাদের বিরাম নেই। আমার বন্ধুরা, এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।’
২০. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, আপনাদের সামনে একটি বড় নৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। এই মামলার বিষয়ে আপনারা যে রায়ই দেবেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকবে। আমার বিবেচনায় তাহেরের এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংশ্লেষ রয়েছে। এই মামলার বাদীপক্ষ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন। এই মামলার বাদীপক্ষের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। আমাদের এবং বিশ্বের কাছ থেকে শ্রদ্ধা প্রাপ্য তাঁদের। তাঁদেরকে এই সম্মান জানানোর একটিমাত্র পথ রয়েছে, তা হলো তাঁদের সেই অনুভূতি দেওয়া যে দীর্ঘ তিন দশকের পথপরিক্রমার শেষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা আপনাদের দায়িত্ব।
২১. ইলেকট্রনিক মেইলে পাঠানো এই হলফনামা আমি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানের কার্যালয়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাখিল করছি। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এম কে রহমান আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ইলেকট্রনিক মেইলের পাশাপাশি কুরিয়ারের মাধ্যমেও এই হলফনামার নোটারি ও সত্যায়িত করা কপি ও সংযুক্তি পাঠানো হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শাব্বির চৌধুরী ঢাকায় পররাষ্ট্র দপ্তরের মাধ্যমে সেটা সুপ্রিম কোর্টের কাছে পৌঁছে দেবেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ঢাকায় আদালতের সামনে উপস্থিত হয়ে আমি নিজে হলফনামাটি উপস্থাপন করতে পারলাম না। এটা অত্যন্ত সম্মানের বিষয় হতো আমার জন্য, যা আমার বাকি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হয়ে থাকত।
স্বাক্ষর: লরেন্স লিফশুলজ
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: সারফুদ্দিন আহমেদ ও আরিফ মো. তারেক হাবিব
No comments