সেই রাতে রূপসী বাংলায় ইলিয়াসের বৈঠক, বাসার সামনে যুবকদের মহড়া-নিখোঁজ-রহস্যের সম্ভাব্য কারণ 'গোয়েন্দা সাবোটাজ' বা সিলেট বিএনপিতে বিরোধ by পারভেজ খান
সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সরকার নিজেই বিব্রত বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, প্রতিমন্ত্রীর কথার ভেতরেই গোয়েন্দা তদন্তের একটি ক্লু আছে।
তাঁরাও মনে করেন, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে বা বিপর্যস্ত করে তুলতে সরকারের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা একটি প্রতিপক্ষ শক্তি এ ঘটনা ঘটিয়েছে। হতে পারে এই শক্তি কোনো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও। সেই সঙ্গে সিলেটে নিজ দলের অভ্যন্তরীণ কোনো বিরোধ নিয়েও ইলিয়াস আলী অপহৃত হয়ে থাকতে পারেন। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরো বলেন, মূলত এই দুটি সম্ভাব্য কারণকে প্রাধান্য দিয়েই তাঁরা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। আর র্যাব সূত্র বলেছে, সম্ভাব্য অনেক জায়গায় তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। যেকোনো মুহূর্তে নাটকীয় কোনো খবর বেরিয়ে আসতে পারে বলে র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
পুলিশের গুলশান ডিভিশনের উপকমিশনার লুৎফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা থানায় যে জিডি করেছেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, মঙ্গলবার রাতে ইলিয়াস আলী এবং তাঁর গাড়িচালক বাসা থেকে বের হয়ে যান। এ সময় গাড়িতে আর কেউ ছিলেন না। তবে কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে, ওই সময় গাড়িতে আরো দুজন ছিলেন। আবার মোটরসাইকেলে করেও কয়েকজন ইলিয়াস আলীর সঙ্গে বের হয়ে আসেন। সব তথ্যই পুলিশ যাচাই-বাছাই করে দেখছে।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ইলিয়াস আলী ওই রাতেই রূপসী বাংলা হোটেলে (সাবেক শেরাটন) তাঁর কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে কারা ছিলেন, সেই তালিকাও সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ইতিমধ্যে কথাও হয়েছে। সেই সূত্র মতে রাত আনুমানিক ১২টা পর্যন্ত তাঁরা ওই হোটেলে ছিলেন এবং এরপর সেখান থেকে ইলিয়াস আলী বাসার উদ্দেশে বের হয়ে যান। সম্ভবত বাসায় ফেরার পথেই সেখানে ওত পেতে থাকা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন তিনি। কিংবা এমনও হতে পারে, তাঁকে অনুসরণ করে এসেই সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। ইলিয়াস আলীকে বহনকারী গাড়িটির পেছনের বাম্পার এবং আরো কিছু অংশ আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাই এমনও হতে পারে যে ঘটনার সময় পেছন থেকে অপহরণকারীদের গাড়ি ইলিয়াস আলীর গাড়িকে আঘাত করে। এতে সংগত কারণেই ইলিয়াস তাঁর গাড়ি থামিয়ে নেমে আসবেন। আর এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল অপহরণকারীরা। তা ছাড়া রাত ১২টার পরে ওই সড়কে সাধারণের যাতায়াতও কম। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কাজেই সব কিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, একটা নাটক তৈরি করে তারই ফাঁকে অপহরণ করা হয়েছে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালককে। চালককেও অপহরণ করা থেকে ধরে নেওয়া হচ্ছে, অপহরণকারীরা দুজনেরই পূর্ব-পরিচিত। চালককে না নিয়ে গেলে ঘটনার সাক্ষী থেকে যেত।
জানা গেছে, ইলিয়াস আলীর ব্যক্তিগত গাড়ি দুটি এবং চালকও দুজন। নিখোঁজ হয়েছেন চালক আনসার। আরেক চালকের নাম তাজউদ্দিন। একজন ইলিয়াস আলীর গাড়ি চালালে আরেকজন তাঁর স্ত্রী লুনার গাড়ি চালান। গতকাল বিকেলে আরেক চালক তাজউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, পাপ্পু নামের এক ব্যক্তি ইলিয়াস আলীর পরিবারের অনেকেরই ঘনিষ্ঠ। নিখোঁজ চালক আনসারের সঙ্গেও পাপ্পুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। চালক আনসার মঙ্গলবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে পাপ্পুর মোবাইলে ফোন করে তাঁর মোবাইলে কিছু টাকা ফ্লেক্সিলোড করে পাঠাতে বলেন। কিন্তু রাতে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আর টাকা পাঠাতে পারেননি।
গোয়েন্দা তৎপরতা : সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এর আগেও ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম এবং যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেন নিখোঁজ হন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট হলেও ওই দুজন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী ছিলেন। ফলে তাঁদের নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপটে নানান কারণ থাকতে পারে। সেই দুটি ঘটনাও তদন্তাধীন। কিন্তু ইলিয়াস আলী একজন সাবেক এমপি এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। তাই তাঁর নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর সে কারণেই খবরটি জানার পর মুহূর্ত থেকে সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থা একাধিক টিম গঠন করে মাঠে নেমে পড়েছে। সারা দেশে কর্তব্যরত পুলিশসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ-রহস্য বের করার জন্য।
কর্মকর্তারা আরো জানান, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরেও একটি চক্র থাকে যারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একটি মৌলবাদী চক্র যে সক্রিয়, সেটাও সুস্পষ্ট। তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মতো বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টির অপচেষ্টা বা পাঁয়তারা করেও ধরা পড়েছে। ফলে তাদের অবস্থান যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে এখনো আছে, সেটা নিশ্চিত। এই চক্রও সরকারকে এ মুহূর্তে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে এই সম্ভাবনার নানান দিকও খুঁটিয়ে দেখছেন।
পাশাপাশি সিলেটে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তাঁর নিজ দলের বেশ কয়েকজনের বিরোধ ছিল। বলা চলে, সিলেটে ইলিয়াস আলীকে কেন্দ্র করে এক ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা চলছিল। এর ওপর গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে ইফতেখার আহমেদ দিনার ও জুনেদ আহমদ নামে সিলেট ছাত্রদলের দুজন নেতা-কর্মী নিখোঁজ হন। তাঁরা ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ঘটনার সঙ্গে ওই দুজনের নিখোঁজ ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটাও গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন। উল্লেখ্য, ইলিয়াস আলী সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি।
পুলিশের গুলশান ডিভিশনের উপকমিশনার লুৎফর রহমান গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে জানান, নানা সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই তাঁরা তদন্ত করে যাচ্ছেন। সংগ্রহ করছেন তথ্য-উপাত্ত। তবে প্রকৃত ঘটনাটি কী, তা এখনো বলার মতো পর্যায়ে আসেনি।
সরেজমিন সিলেট হাউস : বনানীর আমতলী রেলক্রসিংয়ের অদূরে (২/১ নম্বর রোডে) সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজকে হাতের বাঁয়ে রেখে সড়ক ধরে এগিয়ে কিছু দূর গেলেই ডানের এক গলি। গলিতে ঢুকতেই বাঁয়ে 'সিলেট হাউস'। গলির প্রবেশপথে ডানে একটি চায়ের দোকান। স্থানীয় লোকজনের মতে, প্রতিদিন ইলিয়াস আলীর বাড়িতে আসা লোকজনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে দোকানটি। গতকাল সকালে সিলেট হাউসে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কেউ নেই। বাড়ির সামনেটাও ফাঁকা। দোকানে বসে ছিলেন তিন-চারজন।
চায়ের দোকানে বসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক এই প্রতিবেদককে বলেন, মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে তিনি বাসার সামনেই ছিলেন। নেতার কাছে অনেক লোকজনই এসেছেন এবং দেখা করে চলে গেছেন। তবে রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নেতা শুধু চালককে নিয়েই বের হয়ে যান। তবে রওনা দেওয়ার পথে গাড়িতে বসেও তিনি জানালা খুলে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় জটলাও ছিল। ফলে এ কারণে হয়তো দূর থেকে দেখে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, নেতার সঙ্গে গাড়িতে অন্য লোক ছিল।
ওই যুবক আরো বলেন, একটি বিষয় ঘটনার রাতে তাঁর নজরে সেভাবে না এলেও এখন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রাত পৌনে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলে করে কয়েক যুবক এই রাস্তা ধরে কয়েকবার যাওয়া-আসা করেছে। তারা নেতার বাসার সামনে গলির মাথায় এসে একবার মোটরসাইকেল থামিয়ে সিগারেটও খায়। যুবকদের একজন কারো সঙ্গে চাপাস্বরে মোবাইল ফোনে কথাও বলে। এরপর তাদের আর দেখা যায়নি। তবে রাত ১২টার দিকে তাদের আরেকবার দেখা যায় ইলিয়াস আলীর বাসার সামনে দিয়ে আমতলীর দিকে যেতে। তারা কয়েকবার ইলিয়াস আলীর বাড়ির দিকেও বাঁকা চোখে তাকিয়েছে। তখন এটিকে স্বাভাবিক মনে হলেও এখন বারবার সেই যুবকদের চেহারা তাঁর চোখে ভেসে উঠছে।
র্যাবও তৎপর : র্যাবের মিডিয়া উইংসের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু র্যাব নয়, তাঁর জানা মতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সব সংস্থাই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরাও সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি রাখছেন। চালাচ্ছেন বিশেষ পদ্ধতির অভিযান।
সোহায়েল আরো বলেন, ওই দিন ইলিয়াস আলীর বাসায় কারা এসেছেন, কাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও দেখা হয়েছে এবং রূপসী বাংলা হোটেলের বৈঠকে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে কারা ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব থেকেও অনেক তথ্য বের হয়ে আসতে পারে বলে তিনি জানান।
র্যাবের আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই নিখোঁজ ঘটনায় ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে যতটা সহযোগিতা পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা ছুটে বেড়াচ্ছেন আদালতে। আসলে আদালতে ছোটাছুটির চেয়ে সবার আগে দরকার ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার। ফলে র্যাবের কাছে মনে হচ্ছে, এই নিখোঁজ-রহস্যের কিছুটা ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যেও থাকতে পারে।
লুনার ভাষ্য : এ ব্যাপারে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, র্যাব-পুলিশের সহায়তা চান বলেই তিনি থানায় জিডি করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আইনের সহায়তা চান বলেই আদালতে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্তরা যে সহায়তা চাচ্ছেন, সেটাই করা হচ্ছে।
তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, 'ইলিয়াস রাজনীতি করেন, কিন্তু আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমি ইলিয়াস আলীর স্ত্রী। আমি জানতে চাই, আমার স্বামী কোথায় আছেন, কেমন আছেন। আমি তাকে দেখতে চাই। আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব তাকে উদ্ধার করা হোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার এটাই চাওয়া।'
আইজিপি বলেন... : পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে পুলিশের একাধিক টিম গঠন করে মাঠে নামানো হয়েছে। কাজ করছে পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব। ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তবে এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করাটাই এখন বড় কাজ আর সেটা হলেই সব রহস্য বের হয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশের গুলশান ডিভিশনের উপকমিশনার লুৎফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা থানায় যে জিডি করেছেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, মঙ্গলবার রাতে ইলিয়াস আলী এবং তাঁর গাড়িচালক বাসা থেকে বের হয়ে যান। এ সময় গাড়িতে আর কেউ ছিলেন না। তবে কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে, ওই সময় গাড়িতে আরো দুজন ছিলেন। আবার মোটরসাইকেলে করেও কয়েকজন ইলিয়াস আলীর সঙ্গে বের হয়ে আসেন। সব তথ্যই পুলিশ যাচাই-বাছাই করে দেখছে।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ইলিয়াস আলী ওই রাতেই রূপসী বাংলা হোটেলে (সাবেক শেরাটন) তাঁর কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে কারা ছিলেন, সেই তালিকাও সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ইতিমধ্যে কথাও হয়েছে। সেই সূত্র মতে রাত আনুমানিক ১২টা পর্যন্ত তাঁরা ওই হোটেলে ছিলেন এবং এরপর সেখান থেকে ইলিয়াস আলী বাসার উদ্দেশে বের হয়ে যান। সম্ভবত বাসায় ফেরার পথেই সেখানে ওত পেতে থাকা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন তিনি। কিংবা এমনও হতে পারে, তাঁকে অনুসরণ করে এসেই সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। ইলিয়াস আলীকে বহনকারী গাড়িটির পেছনের বাম্পার এবং আরো কিছু অংশ আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাই এমনও হতে পারে যে ঘটনার সময় পেছন থেকে অপহরণকারীদের গাড়ি ইলিয়াস আলীর গাড়িকে আঘাত করে। এতে সংগত কারণেই ইলিয়াস তাঁর গাড়ি থামিয়ে নেমে আসবেন। আর এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল অপহরণকারীরা। তা ছাড়া রাত ১২টার পরে ওই সড়কে সাধারণের যাতায়াতও কম। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কাজেই সব কিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, একটা নাটক তৈরি করে তারই ফাঁকে অপহরণ করা হয়েছে ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালককে। চালককেও অপহরণ করা থেকে ধরে নেওয়া হচ্ছে, অপহরণকারীরা দুজনেরই পূর্ব-পরিচিত। চালককে না নিয়ে গেলে ঘটনার সাক্ষী থেকে যেত।
জানা গেছে, ইলিয়াস আলীর ব্যক্তিগত গাড়ি দুটি এবং চালকও দুজন। নিখোঁজ হয়েছেন চালক আনসার। আরেক চালকের নাম তাজউদ্দিন। একজন ইলিয়াস আলীর গাড়ি চালালে আরেকজন তাঁর স্ত্রী লুনার গাড়ি চালান। গতকাল বিকেলে আরেক চালক তাজউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, পাপ্পু নামের এক ব্যক্তি ইলিয়াস আলীর পরিবারের অনেকেরই ঘনিষ্ঠ। নিখোঁজ চালক আনসারের সঙ্গেও পাপ্পুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। চালক আনসার মঙ্গলবার রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে পাপ্পুর মোবাইলে ফোন করে তাঁর মোবাইলে কিছু টাকা ফ্লেক্সিলোড করে পাঠাতে বলেন। কিন্তু রাতে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আর টাকা পাঠাতে পারেননি।
গোয়েন্দা তৎপরতা : সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এর আগেও ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম এবং যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেন নিখোঁজ হন। রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট হলেও ওই দুজন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী ছিলেন। ফলে তাঁদের নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপটে নানান কারণ থাকতে পারে। সেই দুটি ঘটনাও তদন্তাধীন। কিন্তু ইলিয়াস আলী একজন সাবেক এমপি এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। তাই তাঁর নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর সে কারণেই খবরটি জানার পর মুহূর্ত থেকে সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থা একাধিক টিম গঠন করে মাঠে নেমে পড়েছে। সারা দেশে কর্তব্যরত পুলিশসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ-রহস্য বের করার জন্য।
কর্মকর্তারা আরো জানান, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরেও একটি চক্র থাকে যারা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একটি মৌলবাদী চক্র যে সক্রিয়, সেটাও সুস্পষ্ট। তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মতো বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টির অপচেষ্টা বা পাঁয়তারা করেও ধরা পড়েছে। ফলে তাদের অবস্থান যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে এখনো আছে, সেটা নিশ্চিত। এই চক্রও সরকারকে এ মুহূর্তে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে এই সম্ভাবনার নানান দিকও খুঁটিয়ে দেখছেন।
পাশাপাশি সিলেটে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তাঁর নিজ দলের বেশ কয়েকজনের বিরোধ ছিল। বলা চলে, সিলেটে ইলিয়াস আলীকে কেন্দ্র করে এক ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা চলছিল। এর ওপর গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে ইফতেখার আহমেদ দিনার ও জুনেদ আহমদ নামে সিলেট ছাত্রদলের দুজন নেতা-কর্মী নিখোঁজ হন। তাঁরা ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ঘটনার সঙ্গে ওই দুজনের নিখোঁজ ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটাও গোয়েন্দারা তদন্ত করে দেখছেন। উল্লেখ্য, ইলিয়াস আলী সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি।
পুলিশের গুলশান ডিভিশনের উপকমিশনার লুৎফর রহমান গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে জানান, নানা সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই তাঁরা তদন্ত করে যাচ্ছেন। সংগ্রহ করছেন তথ্য-উপাত্ত। তবে প্রকৃত ঘটনাটি কী, তা এখনো বলার মতো পর্যায়ে আসেনি।
সরেজমিন সিলেট হাউস : বনানীর আমতলী রেলক্রসিংয়ের অদূরে (২/১ নম্বর রোডে) সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজকে হাতের বাঁয়ে রেখে সড়ক ধরে এগিয়ে কিছু দূর গেলেই ডানের এক গলি। গলিতে ঢুকতেই বাঁয়ে 'সিলেট হাউস'। গলির প্রবেশপথে ডানে একটি চায়ের দোকান। স্থানীয় লোকজনের মতে, প্রতিদিন ইলিয়াস আলীর বাড়িতে আসা লোকজনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে দোকানটি। গতকাল সকালে সিলেট হাউসে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কেউ নেই। বাড়ির সামনেটাও ফাঁকা। দোকানে বসে ছিলেন তিন-চারজন।
চায়ের দোকানে বসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক এই প্রতিবেদককে বলেন, মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে তিনি বাসার সামনেই ছিলেন। নেতার কাছে অনেক লোকজনই এসেছেন এবং দেখা করে চলে গেছেন। তবে রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নেতা শুধু চালককে নিয়েই বের হয়ে যান। তবে রওনা দেওয়ার পথে গাড়িতে বসেও তিনি জানালা খুলে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় জটলাও ছিল। ফলে এ কারণে হয়তো দূর থেকে দেখে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, নেতার সঙ্গে গাড়িতে অন্য লোক ছিল।
ওই যুবক আরো বলেন, একটি বিষয় ঘটনার রাতে তাঁর নজরে সেভাবে না এলেও এখন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। রাত পৌনে ৯টার দিকে মোটরসাইকেলে করে কয়েক যুবক এই রাস্তা ধরে কয়েকবার যাওয়া-আসা করেছে। তারা নেতার বাসার সামনে গলির মাথায় এসে একবার মোটরসাইকেল থামিয়ে সিগারেটও খায়। যুবকদের একজন কারো সঙ্গে চাপাস্বরে মোবাইল ফোনে কথাও বলে। এরপর তাদের আর দেখা যায়নি। তবে রাত ১২টার দিকে তাদের আরেকবার দেখা যায় ইলিয়াস আলীর বাসার সামনে দিয়ে আমতলীর দিকে যেতে। তারা কয়েকবার ইলিয়াস আলীর বাড়ির দিকেও বাঁকা চোখে তাকিয়েছে। তখন এটিকে স্বাভাবিক মনে হলেও এখন বারবার সেই যুবকদের চেহারা তাঁর চোখে ভেসে উঠছে।
র্যাবও তৎপর : র্যাবের মিডিয়া উইংসের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, শুধু র্যাব নয়, তাঁর জানা মতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারের সব সংস্থাই ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরাও সারা দেশে গোয়েন্দা নজরদারি রাখছেন। চালাচ্ছেন বিশেষ পদ্ধতির অভিযান।
সোহায়েল আরো বলেন, ওই দিন ইলিয়াস আলীর বাসায় কারা এসেছেন, কাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও দেখা হয়েছে এবং রূপসী বাংলা হোটেলের বৈঠকে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে কারা ছিলেন, তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব থেকেও অনেক তথ্য বের হয়ে আসতে পারে বলে তিনি জানান।
র্যাবের আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই নিখোঁজ ঘটনায় ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে যতটা সহযোগিতা পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা ছুটে বেড়াচ্ছেন আদালতে। আসলে আদালতে ছোটাছুটির চেয়ে সবার আগে দরকার ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার। ফলে র্যাবের কাছে মনে হচ্ছে, এই নিখোঁজ-রহস্যের কিছুটা ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যেও থাকতে পারে।
লুনার ভাষ্য : এ ব্যাপারে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনার কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, র্যাব-পুলিশের সহায়তা চান বলেই তিনি থানায় জিডি করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আইনের সহায়তা চান বলেই আদালতে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্তরা যে সহায়তা চাচ্ছেন, সেটাই করা হচ্ছে।
তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, 'ইলিয়াস রাজনীতি করেন, কিন্তু আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমি ইলিয়াস আলীর স্ত্রী। আমি জানতে চাই, আমার স্বামী কোথায় আছেন, কেমন আছেন। আমি তাকে দেখতে চাই। আমি চাই যত দ্রুত সম্ভব তাকে উদ্ধার করা হোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার এটাই চাওয়া।'
আইজিপি বলেন... : পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সারা দেশে পুলিশের একাধিক টিম গঠন করে মাঠে নামানো হয়েছে। কাজ করছে পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব। ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তবে এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করাটাই এখন বড় কাজ আর সেটা হলেই সব রহস্য বের হয়ে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
No comments