কেমন আছো বাংলাদেশ? by মাহবুব মিঠু
বুধবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাংলানিউজের খবরটি পড়েই চমকে উঠি। ইলিয়াস আলীকে কাল রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও আজকের এই লেখাটা কাল না লিখে অপেক্ষা করতে থাকি। বাংলানিউজের খবরটি যেনো ভুল হয়। এমন যেন হয়- ইলিয়াস আলী কাল রাতে কোন বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন।
আড্ডা দিতে গিয়ে ভুলে পরিবারকে ফোন করা হয়নি। হয়তো অন্য কোনো কারণে ঐ রাতে বাসায় ফিরতে পারেনি। একটু বেলা করে সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাসায় ফিরবে।
কিছুতেই ভাবতে পারছিলাম না যে, এই যুগে একটা দেশের, একটা বড় দলের জাতীয় পর্যায়ের এক নেতাকে, সংসদ সদস্যকে এভাবে ধরে নিয়ে গুম করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলানিউজের খবরই সত্য হলো। ইলিয়াস আলী কাল বাড়ি ফেরেননি। হয়তো কোনদিন ফিরবেন কিনা বলা যায় না। জানে আলম কিংবা আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে অপহৃত আরো অনেকের মতো চিরকালের মতোই হয়তো হারিয়ে গেল এক তরুণ নেতা।
ইলিয়াস আলীর রাজনীতি শুরু হয় সেই আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতি মধ্র দিয়ে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আরো অনেকের মতো তিনিও শরীক ছিলেন। তিনি ‘হচ্ছেন’ সিলেট অঞ্চলের এক প্রতিশ্রুতিবান নেতা।
বিএনপিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার পরে দলে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশের রাজনীতির চিরাচরিত মারকুটে সরকার বিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে দল জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে ঝুঁকতে থাকে। প্রতিপক্ষের প্রতি অশালীন ভাষা প্রয়োগের মাত্রা কমতে থাকে। জামায়াতের বাড়াবাড়ি বেশ সুন্দরভাবে সামলানো হচ্ছিল। মির্জা ফখরুলের এই সদাশয় ভদ্রতা দলের ভিতরেও অনেকের পছন্দ ছিল না। সেই গ্রুপটার চাপ ছিল দলকে কঠোর আন্দোলনে নেবার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞ মির্জা ফখরুল সে পথ মাড়াননি। কিন্তু এমন গুম/হত্যায় বিএনপি কী করবে?
কি কারণ থাকতে পারে ইলিয়াস আলীকে সম্ভাব্য গুম করার পেছনে?
কেউ কেউ বলছে, সুরঞ্জিতের দুর্নীতি নিয়ে সরকার ভয়ংকরভাবে ফেঁসে গেছে। আলোচনাটা ভিন্ন দিকে ঘোরানোর জন্য দরকার নতুন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটানো। যাতে করে জনগণের দৃষ্টিটা অন্যত্র সরানো যায়। এটা অবিশ্বাস্য না হলেও খুব বেশি জোরালো না।
আরো একটি দুর্বল যুক্তি বাতাসে উড়ে উড়ে চলছে। দলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাল পদে যাবার জন্য নাকি ইলিয়াস আলী নিজেই আত্মগোপনে গেছেন। ইলিয়াস আলী নিশ্চয়ই জানতেন যে, এ ঘটনা ঘটালে প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। পুরো দল এখন এর সংগে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে, সারা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। আইন শৃংখলা বাহিনীরও নিশ্চয়ই সতর্ক নজর থাকবে। সব কিছু সামাল দিয়ে এই নাটকের শুভ এবং সফল সমাপ্তি তিনি কিভাবে করবেন? আবারো জনসমক্ষে ফিরে এসে তিনি কি বলবেন? তাই অনেকে এই যুক্তিটাকে সরকারের মোড় ঘুরিয়ে সামাল দেবার কৌশল বলেই মনে করছেন।
তবে ইদানিং সিলেটে দুটো বড় ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সাথে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত থাকার জন্য ইলিয়াসের নামও শোনা যায়। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আন্দোলন করার ফলে তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন। তাছাড়া সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন সক্রিয় সদস্য। সিলেট ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ইলিয়াস গ্রুপেরই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে এক গ্রুপের একজন সদস্য নিহত হয়। তারই জের ধরে অপর গ্রুপের দুই নেতাকে ঢাকা থেকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা কিছুদিন আগে তুলে নিয়ে গেছে বলে জোর সন্দেহ আছে। কিন্তু কোনো বাহিনী সেটা স্বীকার করেনি। অনেকেই বলাবলি করছেন, হয়তো একই ধারাবাহিকতায় সেই মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ইলিয়াস আলীকেও তুলে নিয়ে গেছে আইন শৃংখলা বাহিনী।
বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, মামলার আসামিদের সাদা পোশাকের বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে আদালতে হাজির না করে চুপচাপ থাকছে। কিন্তু কেন? স্বীকারোক্তি আদায়ে নির্যাতন করতে গিয়ে কিংবা নির্যাতন করে ইচ্ছেমতো বলাতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তার দায় এড়ানো যাবে? এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সবোর্চ্চ আদালতকে বরাবর নিরব থাকতে দেখেছি। আরেকটি বিষয় উদ্বেগের সংগে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, দেশের মধ্যে চলতে থাকা অব্যাহত গুম এবং খুনের ব্যাপারে গত বেশ কয়েকমাস ধরে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলো সন্দেহজনকভাবে নিরব। যদিও মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান মাঝে মাঝেই অর্থহীন আস্ফালন করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেরই আশংকা, এটা আইন শৃংখলা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের কাজ। বিরোধীদলীয় নেত্রীও বলেছেন, এটা র্যাব করেছে এবং অনেকেই ইলিয়াসকে তুলে নিতে দেখেছে। তিনি হুশিয়ারিও দেন যে, এই সরকারই শেষ নয়। আগামীতে সরকারের পতন ঘটলে চৌধুরী আলমসহ আরো যাদেরকে গুম এবং হত্যা করা হয়েছে, তার সংগে জড়িত সকল ব্যক্তির বিচার হবে। তিনি বিগত দিনের হত্যাকাণ্ডগুলোর সংগে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলেও দাবি করেন।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্য করা গেছে যে, ১/১১ এর ভূত থেকে যেন কিছুতেই নিজেদের মুক্ত করতে পারছে না। প্রশাসনের উপরে হয় তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, নয়তো সেই ১/১১ এর মতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। মঈনউদ্দিন-মাসুদ গংরা যেভাবে রাজনীতিকদের নির্যাতন করতো ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে, শুরু থেকেই সরকার সেটাকেই অনুসরণ করে আসছিল। সর্বশেষ ইলিয়াস আলীকে ধরে নিয়ে গুম করে দেওয়ার ঘটনাটাও তারই অংশ হতে পারে।
র্যাবকে অস্ত্র দিয়ে, তথাকথিক সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করেছে বিশ্বের দুই বড় পরাশক্তি। তাদের সন্ত্রাস বিরোধী প্রশিক্ষণের মূল কৌশলই হলো সন্দেহভাজন হলেই ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে, নির্যাতনের মাধ্যমে শায়েস্তা করা। অন্ততঃ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা সেটাই দেখতে পাই। অভিযুক্ত সন্ত্রাসীর সাথে অনেক নিরপরাধ মুসলমানদের ধরে নিয়ে পাশ্চাত্যের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে জঘন্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। এদের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে র্যাব। সরকার সেটা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে বিরোধী দলকে দমনের কাজে।
কি নির্মম পরিহাস! এই র্যাবকে সৃষ্টি করেছিল আজকের বিরোধী দল। আজ তাদেরই নেতা কর্মী এদের নির্যাতনের শিকার। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলে আইন বহির্ভূত হত্যার সংগে জড়িত এই বিশেষ বাহিনীকে প্রত্যাহার করবে না।
মাত্র গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুন হয়ে গেছে দেশে। নরসিংদীর লোকমান থেকে শুরু করে সাগর-রুনী কিংবা সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার খুন হওয়া , কোনটারই কিনারা করতে পারেনি আইন শৃংখলা বাহিনী। দূতাবাস কর্মচারীর হত্যার জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির সম্মুখীন। সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের ধরার ব্যপারে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাগাড়ম্বরকে খেলো করে দিয়ে আদালতে পুলিশ সাফ বলে এসেছে যে, তারা ব্যর্থ। অথচ এরই মধ্যে সরকার আদালতকে ব্যবহার করে সমালোচনার পথ অনেকটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘চা বটিকা’ বেশ কাজে দিয়েছে। বাহ্যত সাংবাদিকদের আন্দোলনে আগের মতো স্বতঃস্ফুর্ততা নেই। মন্ত্রীর চা এতো মিষ্টি এবং স্বাদের ছিল যে, সাংবাদিক নেতারা তাদের দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে যান। আন্দোলনকে পিছিয়ে দেন, যার অর্থ হলো ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসা। অথবা নিদেনপক্ষে আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়া। অথচ এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার পরপর ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে আসামি গ্রেফতারের’ কথা বলে ক’দিন পরেই ‘সাংবাদিকদের চাপে বলতে বাধ্য হয়েছি’ বলে চাতুরিপনা করে আগের কথা প্রত্যাহার করে নেন। সাংবাদিক নেতারা মন্ত্রির বাড়ীতে চা খেয়ে আন্দোলন-বিচ্যুত হয়ে আবারো তার প্রতারণার শিকার হলেন।
সর্বশেষ সংযোজন ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা। তার খোঁজ পাওয়া না গেলে বিরোধী দল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে। অনেকেই বলছে, এখনই সময়। না হলে ইলিয়াস আলী অন্তর্ধান ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সরকারের এজেন্টরা বিরোধী দলের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের মনে ‘গুম আতংক’ পাইয়ে দেবে। এভাবে সরকারের শেষের বছরে বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলন জমে ওঠার যে সম্ভাবনা থাকে সেটাকে দমিয়ে দেবে। অন্যদিকে, ইলিয়াস আলীকে গুম করে হজম করতে পারলে সরকারি দলের কর্মী দ্বারা, মনোবলে চিড় ধরা বিরোধী দলের কর্মী সমর্থকদের উপর চড়াও হতে সাহায্য করবে। তারা রাস্তায় দাঁড়াতেই পারবে না। তাই এ মুহুর্তে কঠিন আন্দোলনে না যাবার পক্ষপাতি অনেক নেতাও নাকি মত পাল্টে ফেলে কঠোর আন্দোলনে যাবার কথা ভাবছেন।
কিন্তু বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আগে থেকেই দলের ভিতরেই সংশয় ছিল। বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকেই ড্রইংরুমে টিভি দেখা তুখোড় আন্দোলনকারী হিসেবেই অনেকে জানে। পদ পাবার সময় না আসা পর্যন্ত বিরোধী দলের বিলাসী নেতারা পুলিশের ধাওয়া খেতে চান না। সরকার পতনের আরো প্রায় দুই বছর বাকী আছে। এই মুহুর্তে ইলিয়াস আলীর জন্য রোদে পুড়ে আন্দোলন করার মতো নেতা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। যদিও প্রতিপক্ষের নির্যাতনের শিকার মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা উন্মুখ হয়ে আছে আন্দোলনের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে নেতাদের পিছটানের জন্য পিছিয়ে আসলে ভবিষ্যতে রাজপথে কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
তাছাড়া বিএনপির উপরে ফোঁড়ার মতো জেকে আছে জামায়াত। জনমতকে বুঝতে পেরে বিএনপির কোনো নেতা এখন আর বক্তৃতায় যুদ্ধপরাধীদের বিষয়ে তেমন কিছু বলছে না। আগে যেমন বলতেন ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরাও চাই’ এখন তাও বলেন না। বরং জোটের সম্মিলিত আন্দোলনে সুযোগ পেলেই জামায়াত শিবিরের কর্মীরা সামনের জায়গা দখল করে তাদের যুদ্ধপরাধী নেতাদের মুক্তির দাবি করে বসছে।
জামায়াতকে এই কাজ থেকে ফেরানো না গেলে তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশকে আন্দোলনে পাওয়া যাবে না। এবং সেক্ষেত্রে যদি জামায়াত কৌশলে তাদের মূল এজেন্ডাকে আন্দোলনের সামনে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে একটা স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের ছন্দ পতন ঘটতে পারে।
ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া ঘটনা নিয়ে সারা বাংলাদেশ বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল যখন জ্বলছে তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা নিচ্ছিলেন তথাকথিত ‘সমুদ্রবিজয়’ উপলক্ষে। সুরঞ্জিত সেনের কথিত দুর্নীতি বিষয়ক আলোচনায় যখন সমগ্র বাংলাদেশ ছি: ছি: করছে তখন তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিরোধী দলের প্রতি বিষোদগার করে চলেছেন। সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের তদন্তের ব্যর্থতা স্বীকার করে যখন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আদালত থেকে ফিরছে তখন তিনি অকপটে বলছেন, ‘বাংলাদেশ হবে বিশ্বের মডেল’!
কিসের মডেল? নিজের মানুষ সীমান্তে খুন হলেও না দেখার ভান করে প্রতিবেশীর সংগে বন্ধুত্ব রক্ষার নির্লজ্জ মডেল? গুম করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায় কিভাবে তার মডেল? কিভাবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মন্ত্রীকে পদত্যাগের নাটক করে বাঁচানো যায় তার মডেল? নাকি ক্রসফায়ারের মডেল?
দেশে মাটি কাঁপিয়ে ক’দিন পরপর ভূমিকম্প, মাটির উপরে প্রাত্যহিক অপহরণ, হত্যা এবং গুম, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের ছেড়ে দেওয়া, সীমান্তে মানুষ হত্যাসহ পাশবিক নির্যাতন। কেমন আছো বাংলাদেশ?
mahalom72@msn.com
কিছুতেই ভাবতে পারছিলাম না যে, এই যুগে একটা দেশের, একটা বড় দলের জাতীয় পর্যায়ের এক নেতাকে, সংসদ সদস্যকে এভাবে ধরে নিয়ে গুম করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলানিউজের খবরই সত্য হলো। ইলিয়াস আলী কাল বাড়ি ফেরেননি। হয়তো কোনদিন ফিরবেন কিনা বলা যায় না। জানে আলম কিংবা আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে অপহৃত আরো অনেকের মতো চিরকালের মতোই হয়তো হারিয়ে গেল এক তরুণ নেতা।
ইলিয়াস আলীর রাজনীতি শুরু হয় সেই আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতি মধ্র দিয়ে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আরো অনেকের মতো তিনিও শরীক ছিলেন। তিনি ‘হচ্ছেন’ সিলেট অঞ্চলের এক প্রতিশ্রুতিবান নেতা।
বিএনপিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার পরে দলে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশের রাজনীতির চিরাচরিত মারকুটে সরকার বিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে দল জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকে ঝুঁকতে থাকে। প্রতিপক্ষের প্রতি অশালীন ভাষা প্রয়োগের মাত্রা কমতে থাকে। জামায়াতের বাড়াবাড়ি বেশ সুন্দরভাবে সামলানো হচ্ছিল। মির্জা ফখরুলের এই সদাশয় ভদ্রতা দলের ভিতরেও অনেকের পছন্দ ছিল না। সেই গ্রুপটার চাপ ছিল দলকে কঠোর আন্দোলনে নেবার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞ মির্জা ফখরুল সে পথ মাড়াননি। কিন্তু এমন গুম/হত্যায় বিএনপি কী করবে?
কি কারণ থাকতে পারে ইলিয়াস আলীকে সম্ভাব্য গুম করার পেছনে?
কেউ কেউ বলছে, সুরঞ্জিতের দুর্নীতি নিয়ে সরকার ভয়ংকরভাবে ফেঁসে গেছে। আলোচনাটা ভিন্ন দিকে ঘোরানোর জন্য দরকার নতুন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটানো। যাতে করে জনগণের দৃষ্টিটা অন্যত্র সরানো যায়। এটা অবিশ্বাস্য না হলেও খুব বেশি জোরালো না।
আরো একটি দুর্বল যুক্তি বাতাসে উড়ে উড়ে চলছে। দলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাল পদে যাবার জন্য নাকি ইলিয়াস আলী নিজেই আত্মগোপনে গেছেন। ইলিয়াস আলী নিশ্চয়ই জানতেন যে, এ ঘটনা ঘটালে প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। পুরো দল এখন এর সংগে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে, সারা দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। আইন শৃংখলা বাহিনীরও নিশ্চয়ই সতর্ক নজর থাকবে। সব কিছু সামাল দিয়ে এই নাটকের শুভ এবং সফল সমাপ্তি তিনি কিভাবে করবেন? আবারো জনসমক্ষে ফিরে এসে তিনি কি বলবেন? তাই অনেকে এই যুক্তিটাকে সরকারের মোড় ঘুরিয়ে সামাল দেবার কৌশল বলেই মনে করছেন।
তবে ইদানিং সিলেটে দুটো বড় ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সাথে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত থাকার জন্য ইলিয়াসের নামও শোনা যায়। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আন্দোলন করার ফলে তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন। তাছাড়া সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম একজন সক্রিয় সদস্য। সিলেট ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ইলিয়াস গ্রুপেরই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে এক গ্রুপের একজন সদস্য নিহত হয়। তারই জের ধরে অপর গ্রুপের দুই নেতাকে ঢাকা থেকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা কিছুদিন আগে তুলে নিয়ে গেছে বলে জোর সন্দেহ আছে। কিন্তু কোনো বাহিনী সেটা স্বীকার করেনি। অনেকেই বলাবলি করছেন, হয়তো একই ধারাবাহিকতায় সেই মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ইলিয়াস আলীকেও তুলে নিয়ে গেছে আইন শৃংখলা বাহিনী।
বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, মামলার আসামিদের সাদা পোশাকের বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে আদালতে হাজির না করে চুপচাপ থাকছে। কিন্তু কেন? স্বীকারোক্তি আদায়ে নির্যাতন করতে গিয়ে কিংবা নির্যাতন করে ইচ্ছেমতো বলাতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তার দায় এড়ানো যাবে? এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং সবোর্চ্চ আদালতকে বরাবর নিরব থাকতে দেখেছি। আরেকটি বিষয় উদ্বেগের সংগে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, দেশের মধ্যে চলতে থাকা অব্যাহত গুম এবং খুনের ব্যাপারে গত বেশ কয়েকমাস ধরে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলো সন্দেহজনকভাবে নিরব। যদিও মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান মাঝে মাঝেই অর্থহীন আস্ফালন করছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেরই আশংকা, এটা আইন শৃংখলা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের কাজ। বিরোধীদলীয় নেত্রীও বলেছেন, এটা র্যাব করেছে এবং অনেকেই ইলিয়াসকে তুলে নিতে দেখেছে। তিনি হুশিয়ারিও দেন যে, এই সরকারই শেষ নয়। আগামীতে সরকারের পতন ঘটলে চৌধুরী আলমসহ আরো যাদেরকে গুম এবং হত্যা করা হয়েছে, তার সংগে জড়িত সকল ব্যক্তির বিচার হবে। তিনি বিগত দিনের হত্যাকাণ্ডগুলোর সংগে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলেও দাবি করেন।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্য করা গেছে যে, ১/১১ এর ভূত থেকে যেন কিছুতেই নিজেদের মুক্ত করতে পারছে না। প্রশাসনের উপরে হয় তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, নয়তো সেই ১/১১ এর মতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। মঈনউদ্দিন-মাসুদ গংরা যেভাবে রাজনীতিকদের নির্যাতন করতো ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে, শুরু থেকেই সরকার সেটাকেই অনুসরণ করে আসছিল। সর্বশেষ ইলিয়াস আলীকে ধরে নিয়ে গুম করে দেওয়ার ঘটনাটাও তারই অংশ হতে পারে।
র্যাবকে অস্ত্র দিয়ে, তথাকথিক সন্ত্রাসবিরোধী প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করেছে বিশ্বের দুই বড় পরাশক্তি। তাদের সন্ত্রাস বিরোধী প্রশিক্ষণের মূল কৌশলই হলো সন্দেহভাজন হলেই ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে, নির্যাতনের মাধ্যমে শায়েস্তা করা। অন্ততঃ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা সেটাই দেখতে পাই। অভিযুক্ত সন্ত্রাসীর সাথে অনেক নিরপরাধ মুসলমানদের ধরে নিয়ে পাশ্চাত্যের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে জঘন্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। এদের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে র্যাব। সরকার সেটা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে বিরোধী দলকে দমনের কাজে।
কি নির্মম পরিহাস! এই র্যাবকে সৃষ্টি করেছিল আজকের বিরোধী দল। আজ তাদেরই নেতা কর্মী এদের নির্যাতনের শিকার। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় এলে আইন বহির্ভূত হত্যার সংগে জড়িত এই বিশেষ বাহিনীকে প্রত্যাহার করবে না।
মাত্র গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর খুন হয়ে গেছে দেশে। নরসিংদীর লোকমান থেকে শুরু করে সাগর-রুনী কিংবা সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তার খুন হওয়া , কোনটারই কিনারা করতে পারেনি আইন শৃংখলা বাহিনী। দূতাবাস কর্মচারীর হত্যার জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির সম্মুখীন। সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের ধরার ব্যপারে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাগাড়ম্বরকে খেলো করে দিয়ে আদালতে পুলিশ সাফ বলে এসেছে যে, তারা ব্যর্থ। অথচ এরই মধ্যে সরকার আদালতকে ব্যবহার করে সমালোচনার পথ অনেকটা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘চা বটিকা’ বেশ কাজে দিয়েছে। বাহ্যত সাংবাদিকদের আন্দোলনে আগের মতো স্বতঃস্ফুর্ততা নেই। মন্ত্রীর চা এতো মিষ্টি এবং স্বাদের ছিল যে, সাংবাদিক নেতারা তাদের দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে যান। আন্দোলনকে পিছিয়ে দেন, যার অর্থ হলো ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসা। অথবা নিদেনপক্ষে আন্দোলনকে দুর্বল করে দেওয়া। অথচ এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার পরপর ‘২৪ ঘন্টার মধ্যে আসামি গ্রেফতারের’ কথা বলে ক’দিন পরেই ‘সাংবাদিকদের চাপে বলতে বাধ্য হয়েছি’ বলে চাতুরিপনা করে আগের কথা প্রত্যাহার করে নেন। সাংবাদিক নেতারা মন্ত্রির বাড়ীতে চা খেয়ে আন্দোলন-বিচ্যুত হয়ে আবারো তার প্রতারণার শিকার হলেন।
সর্বশেষ সংযোজন ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা। তার খোঁজ পাওয়া না গেলে বিরোধী দল সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে। অনেকেই বলছে, এখনই সময়। না হলে ইলিয়াস আলী অন্তর্ধান ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সরকারের এজেন্টরা বিরোধী দলের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের মনে ‘গুম আতংক’ পাইয়ে দেবে। এভাবে সরকারের শেষের বছরে বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলন জমে ওঠার যে সম্ভাবনা থাকে সেটাকে দমিয়ে দেবে। অন্যদিকে, ইলিয়াস আলীকে গুম করে হজম করতে পারলে সরকারি দলের কর্মী দ্বারা, মনোবলে চিড় ধরা বিরোধী দলের কর্মী সমর্থকদের উপর চড়াও হতে সাহায্য করবে। তারা রাস্তায় দাঁড়াতেই পারবে না। তাই এ মুহুর্তে কঠিন আন্দোলনে না যাবার পক্ষপাতি অনেক নেতাও নাকি মত পাল্টে ফেলে কঠোর আন্দোলনে যাবার কথা ভাবছেন।
কিন্তু বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আগে থেকেই দলের ভিতরেই সংশয় ছিল। বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকেই ড্রইংরুমে টিভি দেখা তুখোড় আন্দোলনকারী হিসেবেই অনেকে জানে। পদ পাবার সময় না আসা পর্যন্ত বিরোধী দলের বিলাসী নেতারা পুলিশের ধাওয়া খেতে চান না। সরকার পতনের আরো প্রায় দুই বছর বাকী আছে। এই মুহুর্তে ইলিয়াস আলীর জন্য রোদে পুড়ে আন্দোলন করার মতো নেতা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। যদিও প্রতিপক্ষের নির্যাতনের শিকার মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা উন্মুখ হয়ে আছে আন্দোলনের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে নেতাদের পিছটানের জন্য পিছিয়ে আসলে ভবিষ্যতে রাজপথে কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
তাছাড়া বিএনপির উপরে ফোঁড়ার মতো জেকে আছে জামায়াত। জনমতকে বুঝতে পেরে বিএনপির কোনো নেতা এখন আর বক্তৃতায় যুদ্ধপরাধীদের বিষয়ে তেমন কিছু বলছে না। আগে যেমন বলতেন ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরাও চাই’ এখন তাও বলেন না। বরং জোটের সম্মিলিত আন্দোলনে সুযোগ পেলেই জামায়াত শিবিরের কর্মীরা সামনের জায়গা দখল করে তাদের যুদ্ধপরাধী নেতাদের মুক্তির দাবি করে বসছে।
জামায়াতকে এই কাজ থেকে ফেরানো না গেলে তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশকে আন্দোলনে পাওয়া যাবে না। এবং সেক্ষেত্রে যদি জামায়াত কৌশলে তাদের মূল এজেন্ডাকে আন্দোলনের সামনে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে একটা স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের ছন্দ পতন ঘটতে পারে।
ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া ঘটনা নিয়ে সারা বাংলাদেশ বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল যখন জ্বলছে তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনা নিচ্ছিলেন তথাকথিত ‘সমুদ্রবিজয়’ উপলক্ষে। সুরঞ্জিত সেনের কথিত দুর্নীতি বিষয়ক আলোচনায় যখন সমগ্র বাংলাদেশ ছি: ছি: করছে তখন তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিরোধী দলের প্রতি বিষোদগার করে চলেছেন। সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের তদন্তের ব্যর্থতা স্বীকার করে যখন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আদালত থেকে ফিরছে তখন তিনি অকপটে বলছেন, ‘বাংলাদেশ হবে বিশ্বের মডেল’!
কিসের মডেল? নিজের মানুষ সীমান্তে খুন হলেও না দেখার ভান করে প্রতিবেশীর সংগে বন্ধুত্ব রক্ষার নির্লজ্জ মডেল? গুম করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায় কিভাবে তার মডেল? কিভাবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা মন্ত্রীকে পদত্যাগের নাটক করে বাঁচানো যায় তার মডেল? নাকি ক্রসফায়ারের মডেল?
দেশে মাটি কাঁপিয়ে ক’দিন পরপর ভূমিকম্প, মাটির উপরে প্রাত্যহিক অপহরণ, হত্যা এবং গুম, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের ছেড়ে দেওয়া, সীমান্তে মানুষ হত্যাসহ পাশবিক নির্যাতন। কেমন আছো বাংলাদেশ?
mahalom72@msn.com
No comments