বহে কাল নিরবধি-রাত্রি এখনো বাকি by এম আবদুল হাফিজ

প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঘূর্ণিবার্তা যা তিউনিসিয়ার জাইন এল আবিদিন ও মিসরের হোসনি মুবারককে কুপোকাত করেছে, তা কিন্তু এখনো অব্যাহত। সারা আরব বিশ্বই এখন বিপ্লবের জোয়ারে ভাসছে। ভাসছে উপকূলীয় ইয়েমেন ও বাহরাইন থেকে মাগরিবের মরক্কো ও আলজেরিয়া।


সেখান থেকে আরো দক্ষিণে সুদান ও জিরুতি। এক দেশের আন্দোলন-বিক্ষোভ অন্য দেশেও উসকে দিচ্ছে বিক্ষোভ-বিপ্লব। একই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ ফ্লাশ পয়েন্ট লিবিয়া। সেখানকার মুয়াম্মার গাদ্দাফি অভূতপূর্ব এবং প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখোমুখি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে সে প্রতিরোধ জনপ্রিয়।
গাদ্দাফি ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন প্রায় ৬০০ কিলোমিটার ভূখণ্ড বিদ্রোহীদের কাছে হারিয়েছেন। হারিয়েছেন ভূমধ্যসাগরীয় বৃহৎ শহর মিসরাতা এবং বেনগাজি। যেগুলো বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে। গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর অংশবিশেষ বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বেশ কজন মন্ত্রী এবং কূটনীতিক গাদ্দাফির পক্ষ ত্যাগ করেছেন। ১৯৬৯ সাল থেকে গাদ্দাফির সরকার ক্ষমতাসীন।
শুরুর দিকে যখন বিদ্রোহীদের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল, তখনো বিক্ষোভের বিরুদ্ধে গাদ্দাফির প্রতিক্রিয়া ছিল বর্বর। এর ফলে অন্তত এক হাজারের অধিক লিবীয়র প্রাণহানি ঘটে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় 'শেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত বিদ্রোহ দমনে লড়ে যাব' বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তের অভিযোগ এনেছেন। তাদের র‌্যাডিক্যাল ইসলামিস্ট এবং আমেরিকান এজেন্ট বলে গালাগালি করেছেন। তিনি এ হুমকিও দিয়েছেন যে (তাদের দমনে) প্রয়োজনে লিবিয়া জ্বলবে। তবে গাদ্দাফির এসব উচ্চারণ শুধু তাঁর হতাশারই বহিঃপ্রকাশ। আসলে এখন তাঁর সমর্থনের ভিত অত্যন্ত দুর্বল। ইত্যবসরে তাঁর প্রতিপক্ষ শক্তি ক্রমেই ত্রিপোলিকে ঘিরে ফেলছে। গাদ্দাফির পতন বা পলায়ন এখন সময়ের ব্যাপার।
তবে গাদ্দাফি-উত্তর পরিবৃত্তকালও সহজ হবে না। ৬৫ লাখ অধিবাসী অধ্যুষিত লিবিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল নেই। নেই কোনো ট্রেড ইউনিয়ন বা সুশীল সমাজ জাতীয় সংগঠন। কিন্তু এ দেশটিই হলো আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি উৎপাদক। এখানেই রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম জ্বালানি মজুদ, যার পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন ব্যারেল। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট অব লিবিয়া জাতীয় একটি গোষ্ঠী দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে, যার উদ্দেশ্য হবে বিলুপ্ত রাজতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং এর মাধ্যমে একটি পশ্চিমা সমর্থক জ্বালানিনীতির প্রবর্তন ঘটানো।
যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধবিমান এবং বিমানবাহীর জাহাজগুলো ইতিমধ্যেই লিবিয়ার সনি্নকটে নিয়ে আসছে। ৪০ জন নব্য রক্ষণশীল, যাঁরা নিকট অতীতে 'নিউ অ্যামেরিকান সেঞ্চুরি'র প্রকল্প তৈরি করেছিলেন, তাঁরাই এখন একটি পরিবর্তিত ব্যানারে (ফরেন পলিসি ইনিশিয়েটিভ) দাবি তুলেছেন যে গাদ্দাফিকে উৎখাত করতে প্রেসিডেন্ট ওবামা সত্বর লিবিয়াতে 'সামরিক হস্তক্ষেপ' করুক।
আশ্চর্য যে এই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এমন জরুরি মানবিক আবেদন আসেনি যখন ২০০৯ সালে ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করেছিল; যাতে শত শত বেসামরিক গাজাবাসী নিহত হয়। এমন কোনো আবেদন সৌদি আরব, কুয়েত ও বাহরাইনের মতো মার্কিন অনুগত স্বৈরশাসকদের উৎখাতের জন্যও আসেনি। যদিও সেসব দেশের অধিবাসীও মৌলিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার। তবু ভালো যে লিবিয়ার বিদ্রোহীরাও কোনো বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপের ঘোরবিরোধী।
প্রতিটি দেশের সামাজিক ও গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য থাকে। লিবিয়ায়ও তা আছে। লিবীয়রা প্রচণ্ডভাবে নিজ নিজ উপজাতীয় পরিচিতিতে পরিচিত থাকতে চায়। এমনই পনেরোটি উপজাতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে গাদ্দাফির নিজস্ব উপজাতি আল-কাদাফা। পর্যবেক্ষকদের মতে, আল-কাদাফার আনুগত্যই গাদ্দাফির টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর অত্যন্ত অনুগত তিন হাজার যোদ্ধা-সংবলিত বিপ্লবী গার্ড, যাদেরকে তাঁর আল-কাদাফা উপজাতি থেকে নেওয়া হয়েছে, তাদের ওপরই নির্ভর করবেন। অবশ্য যদি সাম্প্রতিক প্রবণতা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনকে কিছু গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার থাকে, তবে তাঁর উপজাতীয় গার্ডদের আনুগত্য নির্ভরযোগ্য নাও হতে পারে। অনেক অঞ্চলে, যেখানে বিশ্বস্ত যোদ্ধাদের বিদ্রোহ দমনে পাঠানো হয়েছিল তাদের অনেকেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এমনটা ঘটা একেবারে অকারণ নয়। গাদ্দাফির লিবিয়া আসলেই দুঃশাসনের একটি জঘন্যতম দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া দেশটিতে ছিল অন্যান্য আরব দেশের মতো ভিন্ন মতাবলম্বীদের জন্য কঠিনতম নির্যাতন। গাদ্দাফি রাজতন্ত্র উৎখাতের পর যখন লিবিয়ার জ্বালানি জাতীয়করণ করেন, তখন তাঁর কিছুটা জনপ্রিয়তা ছিল। তিনি আরব জাতীয়তাবাদ ও প্যান-আফ্রিকান সংহতির প্রবক্তা হিসেবেও একসময় অনেক বাহবা পেয়েছিলেন। কিন্তু গাদ্দাফি সেসব গ্রহণযোগ্যতা নিজেই বিনষ্ট করেছেন।
বিশাল জ্বালানি সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এক-তৃতীয়াংশ লিবিয়াবাসী বেকার। পরবর্তী সময়ে গাদ্দাফি বিশ্বায়িত অর্থনীতির নিও-লিবারেল ধারাকে বেছে নেন। এতে করে দেশের কী মঙ্গল হয়েছে কেউ জানে না, তবে লিবিয়াবাসী হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে গাদ্দাফি আমেরিকার প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। মার্কিনিদের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি স্তম্ভ। উইকিলিকস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ত্রিপোলিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁকে 'র‌্যাডিক্যাল ইসলামকে প্রতিহত করতে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি' বলেছেন।
এতদসত্ত্বেও গাদ্দাফিকে আগে বা পরে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। অনেকের প্রবল আশা যে তা সত্বরই হবে। এমন বাস্তবতা স্বৈরাচারী আরব সরকারগুলোকে স্পষ্ট সংকেত পাঠাবে যে গাদ্দাফির বৈশিষ্ট্যসূচক স্থূলশক্তি কোনো শাসকের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে না। হোসনি মুবারক যদিও তাঁর আর্মিকে সংযত রেখেছিলেন, কিন্তু শেষের দিকে ২ ফেব্রুয়ারিতে যখন তাঁর সৈন্যদের তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন, তাঁর পতন ত্বরান্বিত হয়। গাদ্দাফির জন্য হম্বিতম্বি করার চেয়ে উত্তম হতো যদি গণরোষ এড়াতে সময় থাকতেই তিনি বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি সরকার গঠন করতেন।
সমস্যা যে এখন তেমনটি করা ক্রমবর্ধমানভাবে কঠিন হয়ে পড়ছে, যদিও তা অসম্ভব নয়। পশ্চিম এশিয়া বা উত্তর আফ্রিকা, যেখানেই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ গণতন্ত্র বা দায়বদ্ধ সরকারের জন্য জনপ্রিয় আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে বা জনগণ কর্মসংস্থান বা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সোচ্চার হয়েছে, সেখানে জরুরি ভিত্তিতে একটি ব্যাপকভিত্তিক সরকারের অধিষ্ঠান সম্পূর্ণ না হলে আংশিক প্রত্যুত্তর তো হতেই পারে।
তবে আশার কথা, আরব স্বৈরশাসকরা গোঁড়ামির যে আবর্তে যুগ যুগ ধরে সমাজকে নিক্ষেপ করে রেখেছিল, তা থেকে সমাজ বেরিয়ে আসছে। এখন আরব সমাজে সবার মধ্যেই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, গণতন্ত্রের লিপ্সা ও স্বৈরাচারবিরোধিতা এবং যদিও কোনো কোনো মহল, বিশেষ করে পশ্চিমারা সন্দিগ্ধ যে আরব বিশ্বের 'লৌহমানব'দের পতন হলে সবচেয়ে লাভবান হবে মিসরের 'ব্রাদারহুড' বা এমনকি আল-কায়েদা_এমন ধারণা অতিরঞ্জিত।
ব্রাদারহুড মোটামুটিভাবে মধ্যপন্থী এবং অহিংস সংগঠন বা গণতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী। মিসরের মুবারকবিরোধী অভ্যুত্থানে এই সংগঠন ছিল চারটি সমমানের প্রচেষ্টার অন্যতম। অন্যদের অন্তর্ভুক্ত ছিল তরুণ সমাজ, কট্টর বামপন্থী এবং দুর্নীতি ও অনিশ্চয়তা-কবলিত রুষ্ট মধ্যবিত্তরা। কোনো পর্যায়ে ব্রাদারহুড এই আন্দোলনের কৃতিত্ব ও গৌরব এককভাবে দাবি করেনি। আর আল-কায়েদা?
এরা আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করেনি। যদিও ওসামা এবং তাঁর সহকারী আয়মন জওয়াহিরি সাধারণভাবে আরব শাসকগোষ্ঠীকে বরাবরই অনৈসলামিক অভিহিত করেছেন। একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মুবারকের পতন ৩০ বছর ধরে জওয়াহিরির লক্ষ্য হলেও তিনি তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন।
এখন তো বাস্তবে একটি অহিংস, ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলেই মিসর মুবারক অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারল। আরব বিশ্বের সর্বগ্রাসী বিক্ষোভ অভ্যুত্থানের কোনো ফায়দাই আল-কায়েদা নিতে পারল না। পারল না সন্ত্রাসকে বেগবান করে, তার কৃতিত্ব ভাণ্ডারজাত করতে। পক্ষান্তরে প্রমাণিত হলো যে আরব তরুণদের কাছে আল-কায়েদার কোনো আবেদনই নেই। আল-কায়েদার জিহাদি মতাদর্শের জন্য এটি কৌশলগত পরাজয়।
জিহাদি ইসলামের পরিবেষ্টন আজকের আরব সমাজের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ দ্রুত গণতন্ত্রায়ন এবং মৌলিক অধিকার অর্জন। কী করে তা পূর্ণমাত্রায় অর্জিত হবে, বিক্ষোভরত আরবরাও তা স্পষ্ট জানে না। তবে লাতিন আমেরিকার বিগত যুগের সামাজিক আন্দোলন, যা ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও চিলিতে গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করেছিল, সেটি একটি মডেল হতে পারে। এককালের সামরিক স্বৈরশাসন-কবলিত ওই দেশগুলোও আরব দেশগুলোর অনুরূপ ছিল।
তবে যদি গণতান্ত্রিক হয়েও স্ট্যাটাসকো-পন্থীরাই আরব বিশ্বে ক্ষমতার দণ্ড হাতে তুলে নেয়, তা হবে আরবদের জন্য আরেক মাত্রার পরাজয়। আরব বিশ্ব স্বৈরশাসকমুক্ত হলেও সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না। তা হবে একটি দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন। তাই ভোরের আভাস দেখা গেলেও আরব বিশ্বে 'রাত্রি এখনো বাকি।'

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.