সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং সংসদের সার্বভৌমত্ব by শাহ আহমদ রেজা
বহুদিন পর জাতীয় সংসদ সম্ভবত জমে উঠতে যাচ্ছে। এর একটি কারণ, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা যে কোনো সময় সংসদে ফিরে যেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ—পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল ২ ফেব্রুয়ারি খারিজ হয়ে গেছে।
রায় দুটিকে কেন্দ্র করে এখতিয়ার সম্পর্কিত বিতর্ক প্রাধান্যে এসেছে। বলা হচ্ছে, পঞ্চম সংশোধনীর মতো সংবিধানসংক্রান্ত সব বিষয়ে এখতিয়ার যেহেতু কেবল জাতীয় সংসদের, সেহেতু বিষয়টি নিয়ে সংসদের চলমান অধিবেশন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। মানুষেরও জানা দরকার, দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদ আসলে কতটা সার্বভৌম। কারণ, পঞ্চম সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছিল। এটা একটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’, সুতরাং বাতিল করতে হলেও আরেকটি ‘অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট’ই লাগবে। সেটা কীভাবে করা হয়, তা দেখার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে জনগণ।
এদিকে যে সংসদকে নিয়ে এত আগ্রহ, সেই নবম জাতীয় সংসদ এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছে। আসন বিন্যাসসহ ১০ দফা দাবিতে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অব্যাহত থাকায় সংসদ অনেকাংশে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। সরকারি দলের এমপিরাও অধিবেশনে ঠিকমতো হাজির থাকছেন না। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে সংসদের কোনো কোনো বৈঠকে প্রথম সারিতে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজনকে উপস্থিত দেখা গেছে। এমনকি যারা প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন তেমন পাঁচজনের মধ্যেও চারজনকে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। বৈঠক শুরু হতে দেরি হয়েছে বেশ কয়েকদিন। কোরাম সঙ্কটও হয়েছে। কিছু সদস্যকে শুধু ততক্ষণই বৈঠকে দেখা গেছে, যতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকেছেন। সব মিলিয়েই সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে বিরোধী দলের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও কয়েকটি মাত্র নয়। বড় কথা, অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিরোধী দলকে নিরুত্সাহিত করেছেন। যেমন—সংসদের সামনের সারিতে বিরোধী দলকে আসন দেয়ার প্রশ্নে ভাষণ দেয়ার সময় গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংখ্যার অনুপাতে বিরোধী দল সামনের সারিতে শতকরা বড়জোর ‘আড়াই থেকে পোনে তিনটি’ আসন পেতে পারে। সেখানে তাদের চারটি আসন দেয়া হয়েছে। এর বেশি দেয়া সম্ভব নয়। এতে আপত্তি উঠেছিল যুক্তিসঙ্গত কারণে। সে কারণ হলো, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী আসন বণ্টনসহ সংসদের ভেতরের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে শুধু স্পিকারের। কিন্তু শতকরা অংকের হিসাব শিখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী এ ‘রায়’ পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, বিরোধী দলকে চারটির বেশি আসন দেয়া সম্ভব নয়!
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরপর গত বছরের ১ মার্চ অনুষ্ঠিত অধিবেশনের কথাও উল্লেখ করা দরকার। আসনের প্রশ্ন মীমাংসা না হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় জীবনের কঠিন সঙ্কট ছিল বলেই বিরোধী এমপিরা সেদিন সংসদে গিয়েছিলেন। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার ভাষণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, খুনিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দেয়া। ঘাতকদের সঙ্গে আলোচনা এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছিলেন তিনি। জানতে চেয়েছিলেন, বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি?
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিরোধী দলের ‘রাজনৈতিক ইন্ধন’ থাকার অভিযোগ তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘মিউটিনি’ ঘটাতে যাদের উদ্যোগ ছিল তারা সফল হতে পারেনি বলেই তাদের ‘অন্তর্জ্বালা’! এ ঘটনার সূত্র ধরে ‘অন্য কিছু’ হয়নি বলে তারা নাকি ‘মনের দুঃখে’ অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন! কারও নাম উল্লেখ না করলেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বারবার ‘খেলছে’, সেই ‘খেলনেওয়ালারা’ই এবারও ‘খেলে’ গেছে! বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি—এ অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না যে, কাউকে ‘দাওয়াত’ দিতে হবে! যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা নাকি মনের টানেই ছুটে গিয়েছিলেন। কথাটা অবশ্য সম্পূর্ণ সত্য ছিল না। কারণ, দুই বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু ছাড়া অন্য কোনো দলের উল্লেখযোগ্য কাউকেই সেদিন ‘মনের টানে’ ছুটে যেতে দেখা যায়নি। যেমন—মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক এরশাদ গিয়েছিলেন তার ভাগ্নের খোঁজে—তাও ‘যমুনা’য় নয়, গিয়েছিলেন পিলখানায়। অর্থাত্ এরশাদও গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘ছুটে যাওয়াদের’ দলে ভেড়েননি। মাঝখান দিয়ে বিরোধী দলকে ‘ওনারা’ এবং ‘খেলনেওয়ালা’ বানাতে গিয়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার এবং সব পক্ষকে এক মঞ্চে টেনে আনার চমত্কার সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন শেখ হাসিনা।
সংসদকে কার্যকর করার এবং বিরোধী দলকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব সম্পর্কিত সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে গত ২০ জানুয়ারি সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কথা উল্লেখ করা যায়। এ ভাষণেও বিরোধী নেত্রীর প্রতি যথারীতি মারমুখী হয়ে উঠেছেন তিনি। সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল, এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশের প্রসঙ্গ টেনে আনা। অতীতের অনেক উপলক্ষের মতো জাতীয় সংসদের ওই ভাষণেও শেখ হাসিনা বলে বসেছেন, সেদিন নাকি একটি খালি কফিনকে কবর দেয়া হয়েছিল এবং কফিনে নাকি জিয়াউর রহমানের লাশই ছিল না! কবর দেয়ার আগে জিয়ার লাশ নাকি তার স্ত্রী-পুত্রসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়নি! পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ। এক বিবৃতিতে সাবেক এ সেনা অফিসার বলেছেন, তিনি নিজেই চট্টগ্রামের একটি কবর থেকে জিয়ার লাশ উদ্ধার করে এনেছিলেন। আঁচড়ানো চুলসহ জিয়ার লাশ কি অবস্থায় ছিল তারও কিছু বর্ণনা রয়েছে হান্নান শাহর বিবৃতিতে। হান্নান শাহ তখন যেহেতু চাকরিরত সেনা অফিসার ছিলেন, সেহেতু তার বক্তব্য অস্বীকার করার বা গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ সবই রয়েছে সেনাবাহিনীর রেকর্ডে। ওদিকে একই দিন দৈনিক আমার দেশ একটি ছবি ছেপেছে—যাতে দেখা গেছে, খালেদা জিয়া এবং অন্য কয়েকজন মহিলা জিয়ার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছেন। হান্নান শাহর বিবৃতি এবং মোনাজাতরত খালেদা জিয়ার ছবিই প্রমাণ করেছে, সংসদের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সত্য বলেননি। প্রশ্ন উঠেছে, এমনকি প্রয়োজন পড়েছিল যে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হঠাত্ জিয়াউর রহমানের লাশ ধরে টানাটানি করতে হয়েছে? পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেদিনের অধিবেশনে তেমন কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের লাশ সম্পর্কে এত কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছে সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের তেমন আগ্রহ নেই।
বিরোধী দলকে বাইরে রাখার মাধ্যমে শুধু নয়, অন্য কিছু কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও ক্ষমতাসীনদের একই উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটে চলেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে গত বছরের অক্টোবর অধিবেশনে স্পিকারের বিরুদ্ধে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিষোদ্গারের কথা উল্লেখ করা যায়। ১১ অক্টোবরের অধিবেশনে এমপিদের চোখে পড়ার মতো অনুপস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। পরদিনই লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং স্পিকারকে সংসদের ‘সার্ভেন্ট’ ও মাছের বাজারের ‘আড়তদার’ বানিয়ে ছেড়েছেন! কিন্তু জাতীয় সংসদের এবং স্পিকারের মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুতর হলেও মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্পিকারের সমর্থনে কিংবা লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি—এমনকি স্পিকারকে ‘সার্ভেন্ট’ বলার পরও। ফলে স্পিকার আবদুল হামিদ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। একদিন পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে অনেক কষ্টে শুধু বলেছিলেন, মন্ত্রীর বক্তব্যে তিনি ‘ক্ষুব্ধ’! অথচ স্পিকার আবদুল হামিদ কিন্তু কার্যপ্রণালী বিধিতে তাকে দেয়া ক্ষমতার ভিত্তিতে এবং সংসদের ‘শৃঙ্খলা ও ভব্যতা’ রক্ষার উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন। অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকী বুঝিয়ে ছেড়েছেন, সংসদে সামনের সারি ফাঁকা থাকলেও এবং উপস্থিত সদস্যরা গল্পগুজবে মেতে উঠলেও মাননীয় স্পিকার কিছুই বলতে পারবেন না। তাকে ‘সার্ভেন্ট’ তথা চাকর-বাকরের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে এবং কিছু বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
এখানে গত ২৭ জানুয়ারির একটি ঘটনারও উল্লেখ করা দরকার। সেদিনের অধিবেশনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারি দলের চিফ হুইপকে প্রধানমন্ত্রীর ‘পার্সোনাল স্টাফ’ বলায় তেতে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। সেনগুপ্তকে কষে ‘এক হাত’ নিয়েছেন তিনি। অথচ একই প্রধানমন্ত্রীকে কিন্তু স্পিকারের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি—এমনকি লতিফ সিদ্দিকী তাকে ‘সার্ভেন্ট’ বলার পরও!
এভাবে উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে এক কথায় বরং বলা যায়, শুরু থেকেই নবম জাতীয় সংসদকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে। বিরোধী দলকে উস্কানি দেয়ার কৌশল থেকে আসন বিন্যাস নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। ফলে বিরোধী দলের এমপিরা দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই অধিবেশন বর্জন করেছেন। মাঝখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর যোগ দিলেও বিরোধী দলের জন্য পরিবেশ তৈরি করা হয়নি। এমন অবস্থায় সরকারি দলের এমপিরা সংসদ ভবনকে জমজমাট করে রাখবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমন অবস্থাও দেখা যায়নি। বিরোধী দল কিন্তু অধিবেশনে যোগ দেয়ার, সব কার্যক্রমে অংশ নেয়ার এবং সংসদ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারি দলকে সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বারবার। অন্যদিকে সরকারি দল নিয়েছে বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে ঠেলে দেয়ার উস্কানিমূলক কৌশল। এ ব্যাপারে তারা আসন বিন্যাস থেকে সরাসরি নাম ধরে আক্রমণ করা পর্যন্ত অনেক কৌশলই প্রয়োগ করে চলেছেন। ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘দিনবদলের’ রাজনীতি শুরু হয়েছে সত্য, কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোভাবে ‘বদল’ ঘটার সময় এখনও আসেনি।
এদিকে বিরোধী দলবিহীন সংসদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে হতাশ করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী এমপিরা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকছেন না সেই মন্ত্রীরাও, প্রশ্নোত্তর পর্বে যাদের আগে থেকে থাকতে বলা হয়। মন্ত্রীরা উপস্থিত না থাকায় তাদের উদ্দেশে করা প্রশ্ন স্পিকারকে ‘পাস ওভার’ করতে হচ্ছে। কিন্তু তার পরও কিছুই বলতে পারবেন না স্পিকার। বললেই লতিফ সিদ্দিকীরা ধেয়ে যাবেন, স্পিকারকে ‘সার্ভেন্ট’ বানাবেন এবং তাকে সংসদীয় আচরণ ও কার্য পদ্ধতি শেখানোর চেষ্টা করবেন!
এভাবে অনুপস্থিতি ও কোরাম সঙ্কটের মাধ্যমে শুধু নয়, কথা ও কাজের মাধ্যমেও সংসদকে আকর্ষণহীন এবং কার্যত ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা নিয়ে জনগণের সচেতন অংশের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারির ওই মন্তব্যে ছিল গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানো’ বিষয়ক কিছু কথা। জনগণকে তিনি ‘সজাগ’ থাকতে বলেছিলেন। তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্য হলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেননি। ঠিক কোনো রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সমর্থন এবং সহযোগিতায় মইন উ’রা গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ সাহস ও সুযোগ পেয়েছিল—বহুল আলোচিত এবং এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সে প্রসঙ্গও স্মরণ করেছেন অনেকে। তারা বলেছেন, কেউ যাতে গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ সুযোগ না পায় সে আয়োজন নিশ্চিত করতে হলে সংসদকে কার্যকর করতে হবে, বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং গণতন্ত্রসম্মত আচরণের মাধ্যমে বিরোধী দলের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এমপিদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। এমপিরা যাতে টেন্ডারবাজি, ব্যবসা ও তদবির বাণিজ্য নয়ে ব্যস্ত না থাকেন এবং অধিবেশনকে ‘মাছের বাজার’ না বানিয়ে বসেন, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। না হলে জনগণ ‘সজাগ’ থাকলেও কোনো লাভ হবে না। গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ যারা, তারা ঠিকই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা চালাবে।
এমন এক আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদের কার্যক্রম গুরুত্ব অর্জন করেছে। এখন দেখার বিষয়, দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদ সত্যিই সার্বভৌম কি না এবং এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা ঠিক কোন ধরনের ভূমিকা পালন করেন।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
এদিকে যে সংসদকে নিয়ে এত আগ্রহ, সেই নবম জাতীয় সংসদ এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছে। আসন বিন্যাসসহ ১০ দফা দাবিতে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অব্যাহত থাকায় সংসদ অনেকাংশে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। সরকারি দলের এমপিরাও অধিবেশনে ঠিকমতো হাজির থাকছেন না। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে সংসদের কোনো কোনো বৈঠকে প্রথম সারিতে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজনকে উপস্থিত দেখা গেছে। এমনকি যারা প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন তেমন পাঁচজনের মধ্যেও চারজনকে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। বৈঠক শুরু হতে দেরি হয়েছে বেশ কয়েকদিন। কোরাম সঙ্কটও হয়েছে। কিছু সদস্যকে শুধু ততক্ষণই বৈঠকে দেখা গেছে, যতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকেছেন। সব মিলিয়েই সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে বিরোধী দলের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের আন্তরিকতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও কয়েকটি মাত্র নয়। বড় কথা, অনেক ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিরোধী দলকে নিরুত্সাহিত করেছেন। যেমন—সংসদের সামনের সারিতে বিরোধী দলকে আসন দেয়ার প্রশ্নে ভাষণ দেয়ার সময় গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংখ্যার অনুপাতে বিরোধী দল সামনের সারিতে শতকরা বড়জোর ‘আড়াই থেকে পোনে তিনটি’ আসন পেতে পারে। সেখানে তাদের চারটি আসন দেয়া হয়েছে। এর বেশি দেয়া সম্ভব নয়। এতে আপত্তি উঠেছিল যুক্তিসঙ্গত কারণে। সে কারণ হলো, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী আসন বণ্টনসহ সংসদের ভেতরের সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে শুধু স্পিকারের। কিন্তু শতকরা অংকের হিসাব শিখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী এ ‘রায়’ পর্যন্ত ঘোষণা করেছিলেন যে, বিরোধী দলকে চারটির বেশি আসন দেয়া সম্ভব নয়!
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরপর গত বছরের ১ মার্চ অনুষ্ঠিত অধিবেশনের কথাও উল্লেখ করা দরকার। আসনের প্রশ্ন মীমাংসা না হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় জীবনের কঠিন সঙ্কট ছিল বলেই বিরোধী এমপিরা সেদিন সংসদে গিয়েছিলেন। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার ভাষণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, খুনিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দেয়া। ঘাতকদের সঙ্গে আলোচনা এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছিলেন তিনি। জানতে চেয়েছিলেন, বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি?
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিরোধী দলের ‘রাজনৈতিক ইন্ধন’ থাকার অভিযোগ তুলে তিনি বলেছিলেন, ‘মিউটিনি’ ঘটাতে যাদের উদ্যোগ ছিল তারা সফল হতে পারেনি বলেই তাদের ‘অন্তর্জ্বালা’! এ ঘটনার সূত্র ধরে ‘অন্য কিছু’ হয়নি বলে তারা নাকি ‘মনের দুঃখে’ অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন! কারও নাম উল্লেখ না করলেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বারবার ‘খেলছে’, সেই ‘খেলনেওয়ালারা’ই এবারও ‘খেলে’ গেছে! বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি—এ অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না যে, কাউকে ‘দাওয়াত’ দিতে হবে! যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা নাকি মনের টানেই ছুটে গিয়েছিলেন। কথাটা অবশ্য সম্পূর্ণ সত্য ছিল না। কারণ, দুই বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু ছাড়া অন্য কোনো দলের উল্লেখযোগ্য কাউকেই সেদিন ‘মনের টানে’ ছুটে যেতে দেখা যায়নি। যেমন—মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক এরশাদ গিয়েছিলেন তার ভাগ্নের খোঁজে—তাও ‘যমুনা’য় নয়, গিয়েছিলেন পিলখানায়। অর্থাত্ এরশাদও গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘ছুটে যাওয়াদের’ দলে ভেড়েননি। মাঝখান দিয়ে বিরোধী দলকে ‘ওনারা’ এবং ‘খেলনেওয়ালা’ বানাতে গিয়ে পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার এবং সব পক্ষকে এক মঞ্চে টেনে আনার চমত্কার সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন শেখ হাসিনা।
সংসদকে কার্যকর করার এবং বিরোধী দলকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব সম্পর্কিত সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে গত ২০ জানুয়ারি সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কথা উল্লেখ করা যায়। এ ভাষণেও বিরোধী নেত্রীর প্রতি যথারীতি মারমুখী হয়ে উঠেছেন তিনি। সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল, এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশের প্রসঙ্গ টেনে আনা। অতীতের অনেক উপলক্ষের মতো জাতীয় সংসদের ওই ভাষণেও শেখ হাসিনা বলে বসেছেন, সেদিন নাকি একটি খালি কফিনকে কবর দেয়া হয়েছিল এবং কফিনে নাকি জিয়াউর রহমানের লাশই ছিল না! কবর দেয়ার আগে জিয়ার লাশ নাকি তার স্ত্রী-পুত্রসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়নি! পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ। এক বিবৃতিতে সাবেক এ সেনা অফিসার বলেছেন, তিনি নিজেই চট্টগ্রামের একটি কবর থেকে জিয়ার লাশ উদ্ধার করে এনেছিলেন। আঁচড়ানো চুলসহ জিয়ার লাশ কি অবস্থায় ছিল তারও কিছু বর্ণনা রয়েছে হান্নান শাহর বিবৃতিতে। হান্নান শাহ তখন যেহেতু চাকরিরত সেনা অফিসার ছিলেন, সেহেতু তার বক্তব্য অস্বীকার করার বা গ্রহণ না করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ সবই রয়েছে সেনাবাহিনীর রেকর্ডে। ওদিকে একই দিন দৈনিক আমার দেশ একটি ছবি ছেপেছে—যাতে দেখা গেছে, খালেদা জিয়া এবং অন্য কয়েকজন মহিলা জিয়ার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছেন। হান্নান শাহর বিবৃতি এবং মোনাজাতরত খালেদা জিয়ার ছবিই প্রমাণ করেছে, সংসদের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সত্য বলেননি। প্রশ্ন উঠেছে, এমনকি প্রয়োজন পড়েছিল যে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হঠাত্ জিয়াউর রহমানের লাশ ধরে টানাটানি করতে হয়েছে? পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেদিনের অধিবেশনে তেমন কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের লাশ সম্পর্কে এত কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছে সংসদকে কার্যকর করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের তেমন আগ্রহ নেই।
বিরোধী দলকে বাইরে রাখার মাধ্যমে শুধু নয়, অন্য কিছু কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও ক্ষমতাসীনদের একই উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটে চলেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে গত বছরের অক্টোবর অধিবেশনে স্পিকারের বিরুদ্ধে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিষোদ্গারের কথা উল্লেখ করা যায়। ১১ অক্টোবরের অধিবেশনে এমপিদের চোখে পড়ার মতো অনুপস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। পরদিনই লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং স্পিকারকে সংসদের ‘সার্ভেন্ট’ ও মাছের বাজারের ‘আড়তদার’ বানিয়ে ছেড়েছেন! কিন্তু জাতীয় সংসদের এবং স্পিকারের মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুতর হলেও মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্পিকারের সমর্থনে কিংবা লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি—এমনকি স্পিকারকে ‘সার্ভেন্ট’ বলার পরও। ফলে স্পিকার আবদুল হামিদ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। একদিন পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে অনেক কষ্টে শুধু বলেছিলেন, মন্ত্রীর বক্তব্যে তিনি ‘ক্ষুব্ধ’! অথচ স্পিকার আবদুল হামিদ কিন্তু কার্যপ্রণালী বিধিতে তাকে দেয়া ক্ষমতার ভিত্তিতে এবং সংসদের ‘শৃঙ্খলা ও ভব্যতা’ রক্ষার উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলেছিলেন। অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকী বুঝিয়ে ছেড়েছেন, সংসদে সামনের সারি ফাঁকা থাকলেও এবং উপস্থিত সদস্যরা গল্পগুজবে মেতে উঠলেও মাননীয় স্পিকার কিছুই বলতে পারবেন না। তাকে ‘সার্ভেন্ট’ তথা চাকর-বাকরের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে এবং কিছু বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
এখানে গত ২৭ জানুয়ারির একটি ঘটনারও উল্লেখ করা দরকার। সেদিনের অধিবেশনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারি দলের চিফ হুইপকে প্রধানমন্ত্রীর ‘পার্সোনাল স্টাফ’ বলায় তেতে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। সেনগুপ্তকে কষে ‘এক হাত’ নিয়েছেন তিনি। অথচ একই প্রধানমন্ত্রীকে কিন্তু স্পিকারের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি—এমনকি লতিফ সিদ্দিকী তাকে ‘সার্ভেন্ট’ বলার পরও!
এভাবে উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে এক কথায় বরং বলা যায়, শুরু থেকেই নবম জাতীয় সংসদকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে। বিরোধী দলকে উস্কানি দেয়ার কৌশল থেকে আসন বিন্যাস নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। ফলে বিরোধী দলের এমপিরা দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই অধিবেশন বর্জন করেছেন। মাঝখানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর যোগ দিলেও বিরোধী দলের জন্য পরিবেশ তৈরি করা হয়নি। এমন অবস্থায় সরকারি দলের এমপিরা সংসদ ভবনকে জমজমাট করে রাখবেন বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তেমন অবস্থাও দেখা যায়নি। বিরোধী দল কিন্তু অধিবেশনে যোগ দেয়ার, সব কার্যক্রমে অংশ নেয়ার এবং সংসদ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারি দলকে সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বারবার। অন্যদিকে সরকারি দল নিয়েছে বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে ঠেলে দেয়ার উস্কানিমূলক কৌশল। এ ব্যাপারে তারা আসন বিন্যাস থেকে সরাসরি নাম ধরে আক্রমণ করা পর্যন্ত অনেক কৌশলই প্রয়োগ করে চলেছেন। ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘দিনবদলের’ রাজনীতি শুরু হয়েছে সত্য, কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোভাবে ‘বদল’ ঘটার সময় এখনও আসেনি।
এদিকে বিরোধী দলবিহীন সংসদের প্রাত্যহিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই জনগণকে হতাশ করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী এমপিরা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকছেন না সেই মন্ত্রীরাও, প্রশ্নোত্তর পর্বে যাদের আগে থেকে থাকতে বলা হয়। মন্ত্রীরা উপস্থিত না থাকায় তাদের উদ্দেশে করা প্রশ্ন স্পিকারকে ‘পাস ওভার’ করতে হচ্ছে। কিন্তু তার পরও কিছুই বলতে পারবেন না স্পিকার। বললেই লতিফ সিদ্দিকীরা ধেয়ে যাবেন, স্পিকারকে ‘সার্ভেন্ট’ বানাবেন এবং তাকে সংসদীয় আচরণ ও কার্য পদ্ধতি শেখানোর চেষ্টা করবেন!
এভাবে অনুপস্থিতি ও কোরাম সঙ্কটের মাধ্যমে শুধু নয়, কথা ও কাজের মাধ্যমেও সংসদকে আকর্ষণহীন এবং কার্যত ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা নিয়ে জনগণের সচেতন অংশের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারির ওই মন্তব্যে ছিল গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানো’ বিষয়ক কিছু কথা। জনগণকে তিনি ‘সজাগ’ থাকতে বলেছিলেন। তাত্পর্যপূর্ণ মন্তব্য হলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেননি। ঠিক কোনো রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সমর্থন এবং সহযোগিতায় মইন উ’রা গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ সাহস ও সুযোগ পেয়েছিল—বহুল আলোচিত এবং এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সে প্রসঙ্গও স্মরণ করেছেন অনেকে। তারা বলেছেন, কেউ যাতে গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ সুযোগ না পায় সে আয়োজন নিশ্চিত করতে হলে সংসদকে কার্যকর করতে হবে, বিরোধী দলকে সংসদে ফিরিয়ে নিতে হবে এবং গণতন্ত্রসম্মত আচরণের মাধ্যমে বিরোধী দলের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এমপিদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। এমপিরা যাতে টেন্ডারবাজি, ব্যবসা ও তদবির বাণিজ্য নয়ে ব্যস্ত না থাকেন এবং অধিবেশনকে ‘মাছের বাজার’ না বানিয়ে বসেন, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। না হলে জনগণ ‘সজাগ’ থাকলেও কোনো লাভ হবে না। গণতন্ত্রের ‘ঘাড় মটকানোর’ যারা, তারা ঠিকই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা চালাবে।
এমন এক আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদের কার্যক্রম গুরুত্ব অর্জন করেছে। এখন দেখার বিষয়, দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদ সত্যিই সার্বভৌম কি না এবং এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা ঠিক কোন ধরনের ভূমিকা পালন করেন।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com
No comments