ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ও ১৯৫২ by তৃপ্তি বালা

তিনি কেবলই একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের সূচনালগ্নে কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনে শহীদ হন ৮৫ বছর বয়সী মহীরুহসম এ মানুষটি। '৭১-এর ২৯ মার্চ কুমিল্লার বাড়ি থেকে তাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়।


অসমর্থিত সূত্র মতে, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১-এ তিনি শহীদ হন। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালি তথা বাংলাভাষী এ রাষ্ট্রটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষাসৈনিকের নাম। আজ এই যে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, মাতৃভাষার সেই অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার পথিকৃৎতুল্য ভূমিকাটি অনস্বীকার্য। ১৯৪৮-এ পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেসদলীয় সদস্য হিসেবে গণপরিষদে ব্যবহৃত ভাষা বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটি তুলেছিলেন এবং যুক্তি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিটিও উপস্থাপন করেছিলেন তিনিই। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটেছিল। সেদিন গণপরিষদ অধিবেশনের শুরুতে আলোচনার সূত্রপাত করে পূর্ব বাংলার কংগ্রেসদলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন :Mr. President, Sir, I move : “That in sub-rule (1) of rule 29, after the word ‘English’ in line 2, the words ‘or Bengalee’ be inserted তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা হলেও সমগ্র পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালি। অথচ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে তা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। শ্রী দত্ত একথা উল্লেখ করতেও ভোলেননি যে, আজ গণপরিষদে যে ভাষায় বিতর্ক চলছে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন : ্তুঝরৎ, যিধঃ ংযড়ঁষফ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব? ঞযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব ংযড়ঁষফ নব ঃযব খধহমঁধমব যিরপয রং ঁংবফ নু ঃযব সধলড়ৎরঃু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব.্থ
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণদাবিটি তুঙ্গে ওঠে ঠিক চার বছর পর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে। সেদিন গণপরিষদে তার ওই অকাট্য ভাষ্যই যে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার বীজ বুনে দিয়েছিল, পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সামরিক জান্তারা তা ভোলেনি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালির ওপর সামরিক জান্তারা যে নির্দয় ক্ষোভ-আক্রোশ নিয়ে আঘাত হেনেছিল তারই নির্দয়তম শিকার হয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ৪১টি বছর পার হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামী সৈনিক, দেশপ্রেমিক, অকুতোভয়-নির্ভীক-প্রাজ্ঞ জাতীয় নেতার তালিকায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক উজ্জ্বল নাম। জাতি হিসেবে দেশ মায়ের যোগ্য সন্তানদের স্মরণ, হৃদয়াসনে অধিষ্ঠিত করা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। নয়তো মানুষ হিসেবে জাতিগত পরিচয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। বৈষম্য-বিভেদ সব ভুলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একদিন সবাই মিলে যে বাঙালি রাষ্ট্রটির স্বপ্ন দেখেছিলাম, তারই এক পথিকৃৎ সূর্যসন্তানকে স্মরণ, গৌরবদান ধর্ম-বর্ণ সবকিছুর ঊধর্ে্বই বিবেচিত হওয়া কর্তব্য। অত্যন্ত গর্হিত এবং বেদনার যে, আজ পর্যন্ত এ বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ এ তো প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, তিনিই পাকিস্তান-রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা-আন্দোলনের প্রবর্তক। বাংলা ভাষা তথা বাংলাভাষী এ রাষ্ট্রটির মহান এই স্বপ্নদ্রষ্টা-সৈনিকের নামে বাংলাভাষা চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হোক, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি রক্ষায় সেই জোর দাবিটি জানাই আজ। মনে করি, এ আমাদের মনুষ্য জন্মের দায়, ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব।

No comments

Powered by Blogger.