কলেরা নিয়ে লুকোচুরি
বাংলাদেশে একদিকে কলেরা নিয়ে লুকোচুরি খেলা হচ্ছে, অন্যদিকে সমস্যার প্রকৃত সমাধানের দিকে না গিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কলেরা ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। এর কোনোটিই আমাদের কাম্য নয়। ৭ এপ্রিল ২০১১ কালের কণ্ঠে এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের চিংড়ি বা হিমায়িত মাছ এবং শাকসবজি রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে_এই আশঙ্কায় কলেরার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও এত দিন তা স্বীকার করা হতো না। অন্যদিকে সরকার স্বীকার না করলেও স্বাস্থ্য খাতের কিছু এনজিও বরাবরই গণমাধ্যমে কলেরার অস্তিত্বের কথা বলে আসছে। এখন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেই তা স্বীকার করছে এবং একই সঙ্গে দুই লাখ মানুষের ওপর একটি বিদেশি কম্পানির প্রস্তুত ভ্যাকসিন পরীক্ষার অনুমতিও দিয়েছে। এতে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন। রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে পারে_এটা একটা খোঁড়া যুক্তি। মূলত চিংড়ি রপ্তানি হয় উন্নত দেশগুলোয়। সেসব দেশের ক্রেতারা সরকারের প্রেসনোট দেখে পণ্য কেনে না। তাদের তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার মতো অনেক মাধ্যম আছে। তার ওপর সেসব দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই তারা পণ্য কেনে ও বাজারজাত করে। আর বিদেশি কম্পানির ভ্যাকসিন পরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়ার আগে ভ্যাকসিনের কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা আমাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কমিটির মাধ্যমে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। শুধু সে বিষয়টি উপেক্ষাই করা হয়নি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরই অধীন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে এই ট্রায়াল প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে কলেরাসহ বিভিন্ন রোগজীবাণু নিয়ে গবেষণা ও ট্রায়াল প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুবের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলা যায়, পরিবেশগত কারণেই এ দেশে কলেরার জীবাণু থাকাটা স্বাভাবিক। পানিবাহিত এ রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার। অথচ গ্রামবাংলায় স্যানিটারি ল্যাট্রিন এখনো খুবই কম। ফলে রোগজীবাণু বৃষ্টিতে ধুয়ে জলাধারের পানি নষ্ট করে। তার ওপর দেশব্যাপী ফুটিয়ে পানি পান করার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। অনেক গ্রাম আছে যেখানে সাধারণের ব্যবহারের জন্য একটি নলকূপ পর্যন্ত নেই। কাজেই জীবাণু ছড়ানো বন্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা এবং সাধারণের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। আরো একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় কলেরা মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। কারণ উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পানিতে ব্যাপক হারে প্লাংকটন জন্মাবে, যেগুলো কলেরার জীবাণু টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত উপযোগী স্থান। এ ছাড়া একই কারণে দেশে বন্যার প্রাদুর্ভাবও বেশি হবে। তাই উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারা দেশে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। এমনভাবে সেগুলো স্থাপন করতে হবে যাতে সাধারণ বন্যায় সেগুলো ডুবে না যায়। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
No comments