আনিসা ডুং by খসরু চৌধুরী

ছোট্ট ফুটফুটে আনিসা নামের মেয়েটি আমাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। মাত্র বছর দুই আগেও ভালোভাবে কথা বলতে পারত না। সকাল হলেই ছোট্ট ছোট্ট হাতে আমাদের টিনের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে ডাকত—এই, এই।
দুই বছরে বেশ একটু বড় হয়েছে।


এখন সময় পেলেই বা যখন মন চায় চলে আসে আমাদের বাড়ি। দৌড়ায় বাড়িজুড়ে। বেশি আদর পেলে কথা বলে নাকি সুরে, আর আমাকে ডাকে দাদু বলে। আমি তাকে ডাকি ডুং বলে। এ কথা সবার জানা যে কম বয়সে সব শিশুর মাথা ঘন ঘন ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। একদম প্রথম থেকে আনিসার মাথা ন্যাড়া করে দিতাম নাপিতের বদলে আমি। তো, নওগাঁতে ন্যাড়া মাথাকে বলে ডুংগিমাথা। সেই ডুংগি থেকেই আদরে আরও সংক্ষিপ্ত করে আমি আনিসাকে ডাকি ‘ডুং’।
এবার ঈদের দিন সকালবেলা ঈদগাহ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় আনিসা এসে হাজির তার মা রাবেয়ার হাত ধরে। ধবধবে মেয়েটিকে খুব সুন্দর লাগছে লাল টুকটুকে জামায়! কিন্তু কান্নায় ভরে আছে দুই চোখ। কী ব্যাপার!
রাবেয়ার বর্ণনায় জানা গেল, সকাল থেকে সে জেদ ধরেছে, তার বাবা-চাচাদের সঙ্গে ঈদগাহ যাবে। কিন্তু তারা কিছুতেই নিয়ে যাবে না। কারণ মেয়ে সঙ্গে নিয়ে গেলে ঝামেলা। তার বাবা আলম সরদার দুই চাচা ফিটু আর ইমনকে নিয়ে চলে গেছে ঈদগাহ। তার পর থেকেই শুরু হয়েছে আনিসার কান্না।
‘এই ডুং, চল, আমি তোকে নিয়ে যাব।’ বললাম।
‘সত্যি ঈদগাহ নিয়ে যাবেন, দাদু?’ মুহূর্তে কান্না রূপান্তরিত হলো হাসিতে। ছোট্ট হাতে চোখ থেকে কান্নার দাগ মুছে ফেলছে আনিসা।
‘হ্যাঁ।’
ওরা দুই বোন। কোনো ভাই নেই। বড় বোনের নাম অহ্নি, গয়েশপুর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী।
আমাদের বাড়ির লোহার গেট খুলে বাইরে বেরোতে বেরোতে বললাম, ‘অহ্নি কী করছে রে, ডুং?’
‘কাঁজ কঁরিচ্চে।’ আদর পেয়ে স্বর নাকি হয়ে গেল আনিসার।
পা বাড়ালাম ঈদগাহর দিকে। আমার হাত ধরে এগিয়ে চলল আনিসা। চারপাশে নেমেছে মানুষের ঢল। সবাই দ্রুতপায়ে চলেছে ঈদগাহর উদ্দেশে।
ঈদগাহ পৌঁছে বসতেই সামনের সারির মোসফিকুর পেছন ফিরে কপট আপত্তির সুর তুলল, ‘আরে, আরে, ঈদগায় মেয়েমানুষ কেন!’
মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল আনিসা। আমি বললাম, ‘আরে বাবা, এখনো খুবই ছোট, মেয়েমানুষ হয়ে ওঠেনি!’
‘তা ঠিক, তা ঠিক।’ হাসতে লাগল মোসফিকুর।
নামাজ শুরু হলো। নামাজের মাঝপথে ফিসফিস করে আনিসা বলল, ‘অ দাদু, খিদা লাগিচে।’
কথা বলার উপায় নেই। নামাজ শেষ হলে খাস নওগাঁর ভাষায় আনিসা আবার বলল, ‘অ দাদু, সত্যি কচোঁ, মোক খুব খিদা লাগিচে।’
ওদিকে মৌলভি সাহেব খুতবা শুরু করেছেন। আনিসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘ডুং বাবু, খুব ভালো মেয়ে, এই তো এখনই নামাজ শেষ হবে আর আমরা বাড়ি যাব।’
আদরের পরিমাণ খুব বেশি হলে আনিসার নাকি সুরের পাশাপাশি আবার যোগ হয় ‘তুই’। সেটা যোগ হতে মোটেও দেরি হলো না।
উঠে দাঁড়িয়ে আনিসা বলল, ‘অঁ দাঁদু, তুঁই ভাঁবিচু মুঁই মিছা কঁথা কঁচোঁ? সঁকাল থাঁকে কিঁচ্চু খাঁওনি।’ তার পরও আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনিসা বলল, ‘বিশ্বাস হঁচে নাঁ? মোঁর প্যাঁট দ্যাঁখ দিঁনি।’ অকাট্য প্রমাণস্বরূপ এবার ফ্রক ওপরে তুলে নিজের ছোট্ট পেটটা আমাকে দেখিয়ে দিল আনিসা। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল খুতবা আর মোনাজাত।
‘এবার চল, নামাজ শেষ।’ উঠে দাঁড়ালাম আমি। একলাফে আমার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরল আনিসা ডুং।

No comments

Powered by Blogger.