স্বাস্থ্যসেবা-কাশি ও ঢাকার কাশি by প্রাণ গোপাল দত্ত
ঢাকা মানুষ আর ধুলার মহানগর। ঢাকা মহানগরে কত মানুষ বাস করে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে মানুষ এই শহরে গিজগিজ করছে। আমি নাক-কান-গলার চিকিৎসক। এই মহানগরের অনেকে তাই হাঁচি, কাশি বা সর্দি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে বা আমার চেম্বারে আসেন চিকিৎসা নিতে।
ঢাকা শহরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছি প্রায় ২৫ বছর। ইদানীং ঢাকা শহরের মানুষের হাঁচি, কাশি ও সর্দির উপসর্গগুলো লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। প্রতি তিনজন রোগীর একজন অনবরত সর্দি, হাঁচি অথবা কাশি সম্পর্কে তাঁদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন। তাঁদের বর্ণনা হলো, ঘুমাতে গেলে বা ঘুম থেকে উঠলে কারণ ছাড়াই অসংখ্য হাঁচি হয়, সঙ্গে নাক থেকে পানি ঝরতে থাকে।
কাশি অবচেতন মনে শ্বাসনালিকে নিরাপদ রাখার বিশেষ প্রক্রিয়া। শ্বাস বা কণ্ঠনালিকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত বস্তুর হাত থেকে রক্ষা করে কাশি। শ্বাসনালিকে সাধারণভাবে বলা হয় ওয়াচ ডগ। শ্বাসনালির নিচের অংশের এবং ফুসফুসের প্রদাহজনিত কারণে কাশি হয়ে থাকে। তবে কণ্ঠনালির কাশি শুধু প্রদাহের জন্য হয় তা নয়। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা বাতাস অথবা ধুলাবালুসহ দূষিত বাতাস শ্বাসনালিতে ঢুকলে কাশি হয়। কাশি কোনো রোগ নয়, বরং কাশি হলো রোগের উপসর্গ, কিন্তু শুকনো কাশির পরিণাম খারাপ হতে পারে; যেমন—মেয়েদের গর্ভপাত এবং নারী-পুরুষনির্বিশেষে বিভিন্ন ধরনের হার্নিয়া হতে পারে।
বর্ণনা দেওয়ার সময় রোগীরা বলেন ‘শুকনো কাশি’। কিছুই বের হয় না। বুকের পাঁজরে এবং তলপেটে ব্যথা হয়। নারী রোগীরা সংকোচ নিয়ে অন্য দুরবস্থার কথাও বলেন। Anti allergic ওষুধ দিলে কিছু উপকার হয়। কিন্তু বারবার এ উপসর্গ ফিরে আসছে। কাশির সঙ্গে কিছু বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যেমন—শ্বাসকষ্ট, কফ, কাশির সঙ্গে রক্তপাত ইত্যাদি। সাধারণ সর্দিজ্বর হলে সবারই কমবেশি কাশির ভাগ দেখা দেয়, কখনো কাশি, কখনো বা সামান্য কফ বের হয়। এ ধরনের কাশি অল্প কদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়।
সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি কাশি নিয়ে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি বলতে সাধারণত তিন সপ্তাহের বেশি দিনের কাশি। সাধারণত এ ধরনের কাশি হলে কিছু জিনিস গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করতে হয়। প্রথমত, কত দিন ধরে কাশি, দীর্ঘদিনের কাশি কিছু জটিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যেমন, যক্ষ্মা বা ফুসফুসের ক্যানসার। তবে সাধারণত এ ধরনের কাশির সঙ্গে রক্তপাত, শরীরের ওজন কমে যাওয়াসহ আরও অনেক লক্ষণ দেখা দেয়। এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে কাশি হওয়া মানেই এ ধরনের কোনো মারাত্মক রোগ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে হবে।
আগেই বলেছি, বায়ুদূষণের কারণে এখন ঘরে ঘরে কাশির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে Cough variant Asthma নামক এক ধরনের হাঁপানি রোগ হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগীর শুকনো কাশি হয় এবং ঠান্ডা এবং ধুলাবালুর সংস্পর্শে এলে কাশি বেড়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের হাঁপানির এমন বড় কারণ পরিবেশদূষণ।
অন্যদিকে যাঁরা ধূমপান করেন, সিগারেট বা তামাক সেবন করেন, তাঁরা ক্রনিক ব্রংকাইটিস-জাতীয় রোগ ভুগতে থাকেন। দীর্ঘদিন ধূমপান করার ফলে তাঁদের ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
এ ছাড়া নিউমোনিয়া হলেও কাশি দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা থাকতে পারে। আমাদের দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো যক্ষ্মা। যদি কোনো রোগীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি থাকে, তাহলে অবশ্যই কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কফ পরীক্ষা করানো উচিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে যদি কাশির সঙ্গে রক্তপাত হয়, তাহলে অবশ্যই তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
কাশিকে অবহেলা করা মোটেও উচিত নয়। একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাশির পেছনের লুকায়িত রোগটি ধরার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমেই নিশ্চিত হন যে এই কাশির পেছনে কোনো মারাত্মক রোগ আছে কি না। জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্তপাত—এসবই হলো মারাত্মক রোগের লক্ষণ। যদি আপনি ধূমপান করে থাকেন, তাহলে এখনই তা পরিহার করুন। ধুলাবালু, ধোঁয়া, ঠান্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পরিহার করুন।
এখনই যদি আমরা এই পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে না পারি, তাহলে কাশিসহ দেশের আরও অনেক সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দেবে, যা আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই বায়ুদূষণ রোধ কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার বিষয় নয়, বরং দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের কর্তব্য।
কিছু অসুখ বা ওষুধজনিত কারণেও কাশি হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পেটে এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, যাকে চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় Gastro-oesophagela reflux। রাতে ফ্ল্যাট হয়ে ঘুমালে এ উপসর্গের সৃষ্টি হয় বেশি। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহূত কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কাশির উদ্রেক হয়।
স্কুল-কলেজগামী টিনএজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। নাক-কান-গলার চিকিৎসকদের পক্ষে তাদের রোগ নিরূপণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কাশি। বিশেষ উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রীরা এর আশ্রয় নেয়।
তবে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আমার সহকর্মীদের কাছে পেটব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, চোখ ওঠা, ক্যানসার বা অন্য যেকোনো রোগের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীও হাঁচি-কাশির উপসর্গের কথা বলেন। কিন্তু বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে বললেই কাশি দেন। অধিকাংশ রোগী চিকিৎসকদের সামনে বসে ‘খুক’ ‘খুক’ করেন। আমি এর নাম দিয়েছি ‘ঢাকা কফ’ বা ঢাকা কাশি। ঢাকার আবহাওয়া বিশেষ চরিত্রের জন্য এটা হচ্ছে বলে আমার ধারণা।
ঢাকা শহরের বাতাসে এখন ভাসমান বস্তুকণার (সাসপেনডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারস—এসপিএম) পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে চার থেকে আট গুণ বেশি। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বলছে, যানবাহনের কারণে রাস্তার পাশে বায়ুদূষণ কয়েক গুণ বেশি। এখন ঢাকা শহরের কয়েকটি বড় রাস্তায় ওয়াসার পানির পাইপ বসানো হচ্ছে। ওই সব এলাকা কুয়াশার মতো ধুলায় ঢাকা থাকছে দিন-রাত। সারা শহরে বছর ভরে চলে ভবন নির্মাণের কাজ, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বালু আর সিমেন্ট। শহরের নানা জায়গায় রাস্তার পাশে ওয়ার্কশপ আর রঙের দোকান। আছে নানা শিল্পকারখানা। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কয়েক লাখ ধূমপায়ী—এসবই এসপিএমের উৎস।
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের আরেক কারণ এর জনসংখ্যা। সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বলে শহর এলাকায় তিন সপ্তাহের ওপর কাশি আছে এমন মানুষ দুই শতাংশ। এর একটি বড় অংশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। যক্ষ্মা ছাড়াও বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এমন জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ঢাকা শহরে অনেক বেশি। বাসে চড়লে, রাস্তায় দাঁড়ালে বা হাঁটতে থাকলে, চায়ের দোকান বা হোটেলে বসলে একজনের নিঃশ্বাস অন্যের গায়ে লাগে। এসপিএম ও নানা রোগের জীবাণু ঢাকা মহানগরের বায়ুদূষণকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটাই ঢাকা কফের কারণ। এটা কোনো বৈজ্ঞানিক বক্তব্য নয়; শত শত রোগী দেখার অভিজ্ঞতাই আমার এ বক্তব্যের ভিত্তি। আমি মনে করি, ঢাকা মহানগর নিয়ন্ত্রণের অতীত এক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
কাশি অবচেতন মনে শ্বাসনালিকে নিরাপদ রাখার বিশেষ প্রক্রিয়া। শ্বাস বা কণ্ঠনালিকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত বস্তুর হাত থেকে রক্ষা করে কাশি। শ্বাসনালিকে সাধারণভাবে বলা হয় ওয়াচ ডগ। শ্বাসনালির নিচের অংশের এবং ফুসফুসের প্রদাহজনিত কারণে কাশি হয়ে থাকে। তবে কণ্ঠনালির কাশি শুধু প্রদাহের জন্য হয় তা নয়। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা বাতাস অথবা ধুলাবালুসহ দূষিত বাতাস শ্বাসনালিতে ঢুকলে কাশি হয়। কাশি কোনো রোগ নয়, বরং কাশি হলো রোগের উপসর্গ, কিন্তু শুকনো কাশির পরিণাম খারাপ হতে পারে; যেমন—মেয়েদের গর্ভপাত এবং নারী-পুরুষনির্বিশেষে বিভিন্ন ধরনের হার্নিয়া হতে পারে।
বর্ণনা দেওয়ার সময় রোগীরা বলেন ‘শুকনো কাশি’। কিছুই বের হয় না। বুকের পাঁজরে এবং তলপেটে ব্যথা হয়। নারী রোগীরা সংকোচ নিয়ে অন্য দুরবস্থার কথাও বলেন। Anti allergic ওষুধ দিলে কিছু উপকার হয়। কিন্তু বারবার এ উপসর্গ ফিরে আসছে। কাশির সঙ্গে কিছু বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যেমন—শ্বাসকষ্ট, কফ, কাশির সঙ্গে রক্তপাত ইত্যাদি। সাধারণ সর্দিজ্বর হলে সবারই কমবেশি কাশির ভাগ দেখা দেয়, কখনো কাশি, কখনো বা সামান্য কফ বের হয়। এ ধরনের কাশি অল্প কদিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়।
সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি কাশি নিয়ে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি বলতে সাধারণত তিন সপ্তাহের বেশি দিনের কাশি। সাধারণত এ ধরনের কাশি হলে কিছু জিনিস গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করতে হয়। প্রথমত, কত দিন ধরে কাশি, দীর্ঘদিনের কাশি কিছু জটিল রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। যেমন, যক্ষ্মা বা ফুসফুসের ক্যানসার। তবে সাধারণত এ ধরনের কাশির সঙ্গে রক্তপাত, শরীরের ওজন কমে যাওয়াসহ আরও অনেক লক্ষণ দেখা দেয়। এটা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে কাশি হওয়া মানেই এ ধরনের কোনো মারাত্মক রোগ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সতর্ক হতে হবে।
আগেই বলেছি, বায়ুদূষণের কারণে এখন ঘরে ঘরে কাশির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে Cough variant Asthma নামক এক ধরনের হাঁপানি রোগ হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগীর শুকনো কাশি হয় এবং ঠান্ডা এবং ধুলাবালুর সংস্পর্শে এলে কাশি বেড়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের হাঁপানির এমন বড় কারণ পরিবেশদূষণ।
অন্যদিকে যাঁরা ধূমপান করেন, সিগারেট বা তামাক সেবন করেন, তাঁরা ক্রনিক ব্রংকাইটিস-জাতীয় রোগ ভুগতে থাকেন। দীর্ঘদিন ধূমপান করার ফলে তাঁদের ফুসফুস ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
এ ছাড়া নিউমোনিয়া হলেও কাশি দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা থাকতে পারে। আমাদের দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো যক্ষ্মা। যদি কোনো রোগীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি থাকে, তাহলে অবশ্যই কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কফ পরীক্ষা করানো উচিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে যদি কাশির সঙ্গে রক্তপাত হয়, তাহলে অবশ্যই তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
কাশিকে অবহেলা করা মোটেও উচিত নয়। একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাশির পেছনের লুকায়িত রোগটি ধরার চেষ্টা করতে হবে। প্রথমেই নিশ্চিত হন যে এই কাশির পেছনে কোনো মারাত্মক রোগ আছে কি না। জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্তপাত—এসবই হলো মারাত্মক রোগের লক্ষণ। যদি আপনি ধূমপান করে থাকেন, তাহলে এখনই তা পরিহার করুন। ধুলাবালু, ধোঁয়া, ঠান্ডা এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ পরিহার করুন।
এখনই যদি আমরা এই পরিবেশদূষণ বন্ধ করতে না পারি, তাহলে কাশিসহ দেশের আরও অনেক সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দেবে, যা আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই বায়ুদূষণ রোধ কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার বিষয় নয়, বরং দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের কর্তব্য।
কিছু অসুখ বা ওষুধজনিত কারণেও কাশি হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো পেটে এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, যাকে চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় Gastro-oesophagela reflux। রাতে ফ্ল্যাট হয়ে ঘুমালে এ উপসর্গের সৃষ্টি হয় বেশি। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ব্যবহূত কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কাশির উদ্রেক হয়।
স্কুল-কলেজগামী টিনএজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। নাক-কান-গলার চিকিৎসকদের পক্ষে তাদের রোগ নিরূপণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক কাশি। বিশেষ উদ্দেশ্যে ছাত্রছাত্রীরা এর আশ্রয় নেয়।
তবে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আমার সহকর্মীদের কাছে পেটব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, হূদেরাগ, ডায়াবেটিস, চোখ ওঠা, ক্যানসার বা অন্য যেকোনো রোগের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীও হাঁচি-কাশির উপসর্গের কথা বলেন। কিন্তু বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে বললেই কাশি দেন। অধিকাংশ রোগী চিকিৎসকদের সামনে বসে ‘খুক’ ‘খুক’ করেন। আমি এর নাম দিয়েছি ‘ঢাকা কফ’ বা ঢাকা কাশি। ঢাকার আবহাওয়া বিশেষ চরিত্রের জন্য এটা হচ্ছে বলে আমার ধারণা।
ঢাকা শহরের বাতাসে এখন ভাসমান বস্তুকণার (সাসপেনডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারস—এসপিএম) পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে চার থেকে আট গুণ বেশি। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বলছে, যানবাহনের কারণে রাস্তার পাশে বায়ুদূষণ কয়েক গুণ বেশি। এখন ঢাকা শহরের কয়েকটি বড় রাস্তায় ওয়াসার পানির পাইপ বসানো হচ্ছে। ওই সব এলাকা কুয়াশার মতো ধুলায় ঢাকা থাকছে দিন-রাত। সারা শহরে বছর ভরে চলে ভবন নির্মাণের কাজ, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বালু আর সিমেন্ট। শহরের নানা জায়গায় রাস্তার পাশে ওয়ার্কশপ আর রঙের দোকান। আছে নানা শিল্পকারখানা। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কয়েক লাখ ধূমপায়ী—এসবই এসপিএমের উৎস।
ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের আরেক কারণ এর জনসংখ্যা। সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বলে শহর এলাকায় তিন সপ্তাহের ওপর কাশি আছে এমন মানুষ দুই শতাংশ। এর একটি বড় অংশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। যক্ষ্মা ছাড়াও বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এমন জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ঢাকা শহরে অনেক বেশি। বাসে চড়লে, রাস্তায় দাঁড়ালে বা হাঁটতে থাকলে, চায়ের দোকান বা হোটেলে বসলে একজনের নিঃশ্বাস অন্যের গায়ে লাগে। এসপিএম ও নানা রোগের জীবাণু ঢাকা মহানগরের বায়ুদূষণকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটাই ঢাকা কফের কারণ। এটা কোনো বৈজ্ঞানিক বক্তব্য নয়; শত শত রোগী দেখার অভিজ্ঞতাই আমার এ বক্তব্যের ভিত্তি। আমি মনে করি, ঢাকা মহানগর নিয়ন্ত্রণের অতীত এক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments