যুক্তি তর্ক গল্প-‘প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’ রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা চাই by আবুল মোমেন

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সচেতন মানুষের মনে শঙ্কা দানা বাঁধছে। রাজনীতিতে যে ভাবাদর্শিক টানাপোড়েন আছে, তা মানুষ জানে এবং এর ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক জীবনে যে গভীর সংকট তৈরি হয়, তাও মানুষের জানা আছে। ফলে আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলে তার মনে খটকা লাগবেই।


আমরা বুঝি, এগিয়ে যেতে হলে দেশ ও জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক মতাদর্শের পথে আনতে হবে। সেই মতাদর্শের জন্ম হয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে এবং দুই দশকের সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে কোটি মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আর মোটা দাগে সেই আদর্শ হলো গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ, গরিবমুখী রাজনীতি ও অর্থনীতি।
স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে নানা মাত্রিক সংকট দেখা দিলেও পঁচাত্তরের পর থেকেই দেশকে তার আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। সোজা কথায় বলা যায়, বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর অপকৌশল নেওয়া হয়। এর ফলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে, সমাজে ও রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি চালু হয়, যা পরিণতিতে কট্টর জঙ্গিবাদীদের উত্থানে সহায়ক হয়, যুগপৎ রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্রিমিনালাইজেশন হয়, সিভিল প্রশাসনের ওপর সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, আমলাতন্ত্র অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের ঘাতক-দালালেরা রাজনীতিসহ সর্বত্র পুনর্বাসিত হয়, এমনকি ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যায়। বলা যায়, প্রায় বাংলাদেশের কবর রচনার মতো ঘটনা হয়েছিল। একসময় বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনদের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়, বাংলা ভাষা-সাহিত্যে ধর্মীয় বিভাজন টানার পাকিস্তানি ধারা অনুসরণ করা হয়, ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে, তখন ৭ মার্চের ভাষণ শোনা যেত না, জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, বেতার-টিভিতে পাকিস্তানি ধর্মান্ধতার প্রকোপ দেখা যেতে থাকে। বলা যায়, বহু বছর পর, মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে দেশের তরুণ সমাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা দেখিয়েছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি একটি আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্নেও আস্থা রেখেছিল বলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে।
এই তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, গল্পে-ইতিহাসে পড়ে-শুনে তারা ইতিহাসের এই গৌরবময় অধ্যায়ের উত্তরাধিকারী হতে উৎসাহিত হয়েছে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, এই তরুণেরা—যারা ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে—কেউই সরাসরি কোনো ছাত্রসংগঠন বা রাজনৈতিক দল করে না। তাদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করে নিজেদের অবস্থান ঠিক করেছে, তারাই কিন্তু মতামত তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় আধুনিক। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যেসব সামন্ততান্ত্রিক উপাদান আছে, তা এদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। তারা গণতন্ত্র বলতে সত্যিকারের গণতন্ত্রই বুঝবে; তেমনি প্রশাসনে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও ঢিলেমি, দুর্নীতির সংস্কৃতি এবং অনুদার দলবাজি ও দখলবাজি-টেন্ডারবাজির সংস্কৃতিও তাদের হতাশ করবে।
অর্থাৎ যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও একটি সতেজ মন নিয়ে ২০০৮ সালে এই বিশাল নব্য ভোটার মহাজোটকে ভোট দিয়েছিল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখেছিল, তাদের সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাচ্ছে এবং আস্থাও টলে যাচ্ছে। আমি বলি না, তারা এখনই শেখ হাসিনার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসছে বা খালেদা জিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ছে; বলা যাবে না যে আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আর বিএনপির দিকে আগ্রহী হচ্ছে। না, এখনই তা হচ্ছে না। কিন্তু তাদের সমর্থনের দৃঢ়তা, প্রত্যাশার জোর কমে আসছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনই এ বিষয়ে সতর্ক না হলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে দেরি হবে না।
আমরা যখন সরকারের দুই বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকাই এবং তা বিশ্লেষণ করি, তখন ২০০৮-এর অবস্থা যে পাল্টাচ্ছে, সেটুকু সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝতে পারি। দলীয় কোন্দল, একাধিক প্রার্থী, বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়গুলো সত্যি, তবে এ থেকে ভোটারের মনের গতি-প্রকৃতির সবটা বোঝা যাচ্ছে, এমন ভাবা ঠিক হবে না। পৌর নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের দুটি উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, বিরোধী দলের ভালো ফলাফলের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। আর তাতে প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগেরই বিজয় হয়েছে। এ কথার মধ্যে সত্য কিছু নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তার পরও বলব, এতে সবটা সত্য ধরা পড়ে না, ভোটারের আশাভঙ্গের আলামতও কিছু ধরে নিতে হবে।
আর ক্ষমতায় দুই বছর কেটে যাওয়ার পর সরকারের পারফরম্যান্স আসলে প্রতিদিনই ভোটাররা মূল্যায়ন করতে থাকে। এ বছরটি তাই সরকারের জন্য অগ্নিপরীক্ষার বছর। ফলে কতকগুলো দুর্বলতা চিহ্নিত করে শিগগিরই তা কাটানোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
প্রথমত, সরকার ও দল (আওয়ামী লীগ) সম্পূর্ণত এক ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সুপার পাওয়ারফুল নেতায় পরিণত হয়েছেন। এটি রাজনীতি, দল, গণতন্ত্র, সরকার—কারও জন্যই ভালো নয়। তিনি নিঃসঙ্গ; এবং কিছু উপদেষ্টা ও আমলার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছেন।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অনেকটাই অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। দলীয় বিভিন্ন পদে যাঁদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তিনি মাহবুব উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান যে-ই হোন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার স্নেহভাজন মুখপাত্র হিসেবেই পরিচিত হচ্ছেন। এঁদের নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ের পুরোনো নেতা-কর্মীরা মানেন না, তাঁরা মনে করেন, এঁরা শেখ হাসিনার পুতুল মাত্র। ফলে এঁদের পক্ষে পৌর নির্বাচনের সময় সৃষ্ট কোন্দল বন্ধ করা বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিরস্ত করা সম্ভব হয়নি। এঁরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের বেপরোয়া কর্মীদেরও শান্ত করতে পারেননি। মতপার্থক্য বা কোনো কারণে নেত্রীর অসন্তুষ্টি থাকলেও জননেতা হিসেবে আদৃত দলীয় নেতাদের, যেমন—তোফায়েল-রাজ্জাক-সুরঞ্জিত-নাসিম প্রমুখের গুরুত্ব বহাল রাখা দরকার।
তৃতীয়ত, মহাজোটের ঐক্য বজায় রাখার গুরুত্ব যেন সরকার অনুধাবন করছে না। জাতীয় ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি এবং তা রক্ষার জন্য মহাজোটকে রক্ষা করা যে জরুরি এবং এর মাধ্যমে নাগরিক সমাজে ঐক্যের প্রক্রিয়া বিস্তার ও জোরদার করার কাজ অব্যাহত রাখা দরকার ছিল, তা-ও খেয়াল করা হচ্ছে না।
চতুর্থত, দুদককে দুর্বল করে, মানবাধিকার কমিশনকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে, টিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানকে হয়রানির মধ্যে ফেলে সরকার তার অসহিষ্ণু রূপ ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার প্রবণতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, যা নতুন প্রজন্ম ও নাগরিক সমাজ পছন্দ করছে না।
পঞ্চমত, ড. ইউনূসের প্রতি বৈরিতার ভূমিকা নিয়ে একদিকে সরকারের ক্ষুদ্রতা ও অনুদারতা প্রকাশ পাচ্ছে, আর অন্যদিকে নিজ দেশের বিশাল ভাবমূর্তির একজন মানুষকে জয় করার মতো সামর্থ্যের পরিচয় দিতে পারছে না। ড. ইউনূসের যেমন রয়েছে সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি, তেমনি রয়েছে আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে দেশের হয়ে নেগোশিয়েট করার দক্ষতা ও ক্ষমতা। দেশ তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ষষ্ঠত, সরকার দ্রব্যমূল্য ও জ্বালানি খাত সম্পর্কে সচেতনতার প্রমাণ দিলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর সঙ্গে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ভুল করে সচেতন-সমর্থক মানুষকে রীতিমতো ফাঁপরে ফেলে দিচ্ছে। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু নগর নির্মাণের উদ্যোগ এ রকমই একটি নজির।
শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে, কিন্তু এর ফল পেতে সময় লাগবে। তা ছাড়া পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা নিয়ে সরকার-ছাত্র-অভিভাবকদের উৎসাহ সত্ত্বেও বলব, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও সবার জন্য শিক্ষা এতে নিশ্চিত হবে না। ফলে প্রাথমিক উৎসাহের পর আমরা যখন মূল্যায়নে বসব, তখন এই বিরাট কর্মযজ্ঞ থেকে ইতিবাচক ফল না-ও আসতে পারে। ফলাফল ভালো দেখানোর জন্য ঢালাওভাবে সব বিষয়ে যে গ্রেস দেওয়ার রীতি চালু হয়েছে বলে শুনছি, তাতে এই আশঙ্কা ব্যক্ত না করে পারছি না। এসবই তরুণ ও সচেতন নাগরিক সমাজকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যা বুঝতে হবে, তা হলো ইতিহাস তাঁর ওপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়েছে। কেবল একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী মাত্র নন তিনি। একটি জাতি প্রায় তিন যুগ ধরে বিপথগামী হওয়ার পর অনেক মাশুল দিয়ে সঠিক পথে ফিরে এসে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। এ কাজে তাঁকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। কেবল নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন, এটি নয়। এ হলো ভারতের জওহরলাল নেহরুর মতো কাজ, মিসরের নাসেরের মতো কাজ বা ঘানার নক্রমার মতো কাজ। নেহরু টানা ১৬ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত শাসন করেছেন, নাসের ১৫ বছর মিসর এবং নক্রমাও এভাবেই দীর্ঘ সময় ঘানার রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। এভাবে ধারাবাহিকতা না থাকলে ভ্রান্তি ও বিকৃতির নানা জঞ্জাল সাফ করে দেশকে সঠিক পথে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা বস্তুতপক্ষে ২০০৯ থেকে নতুনভাবে আবার যাত্রা শুরু করেছি। সে যাত্রাপথে হোঁচট খেতে চাই না, বারবার ইতিহাসের ঘূর্ণিজালে আটকে থাকতে চাই না, জঙ্গিবাদ আর দুর্নীতির ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে চাই না।
শেখ হাসিনা ইতিহাসের এই দায় নেবেন কি না এবং ঐতিহাসিক দায় পালন করবেন কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘ সময় জাতি ও দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে তাঁর কাছ থেকে যেমন বাকসংযম চাই, তেমনি চাই দূরদর্শী নেতৃত্ব। সে জন্য তাঁর মধ্যে চাই ধৈর্য ও প্রজ্ঞা, দৃঢ়তার সঙ্গে ঔদার্যের মিশ্রণ, প্রকৃত বন্ধু এবং কাজের মানুষকে চেনা ও কাজে লাগানোর ক্ষমতা, উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয়ের দক্ষতা। আর সর্বোপরি চাই, সরকার ও দল-মহাজোটকে সচল-সক্রিয় রাখার মতো গতিশীল নেতৃত্ব। তৈরি করতে হবে নির্ভরযোগ্য সহকর্মী, সহযাত্রী ও সহকর্মীর দল। আর দিনে দিনে এই সমর্থন-ভিত্তিটা বাড়িয়ে যেতে হবে। বিভক্ত, বিপর্যস্ত, সমস্যাগ্রস্ত জাতিকে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়, কীভাবে যথাসময় নিজে ক্ষমতা থেকে সরে এসেও অভিভাবকীয় ভূমিকায় থেকে জাতির অগ্রযাত্রায় দায়িত্ব পালন করা যায়, তা সম্প্রতি দেখিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি আজ বিশ্ববাসীর নেতা, অভিভাবক। এটি একটি দৃষ্টান্ত—অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর মানুষ তাঁকে মহৎ নেতার মর্যাদা দিয়েছে, ইতিহাস তাঁকে গৌরবময় স্থানে রাখছে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।’ সেই সূত্র টেনে বলব, আমরা চাই নিছক প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.