গদ্যকার্টুন-দয়া করে অপ্রাপ্তবয়স্করা এই লেখা পড়বেন না by আনিসুল হক
রোববার আমি গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলে। ফেরার পথে গাড়িতে খেলার ধারাবিবরণী শোনার জন্য রেডিও অন করলাম। বাংলাদেশ বেতার কিছুক্ষণ ভারত-পাকিস্তানের খেলা প্রচার করে চলে গেল মহান জাতীয় সংসদের কার্যক্রমের সরাসরি প্রচারে। হাইওয়েতে গাড়ি চলছে।
ড্রাইভারকে বলব, রেডিও কেন্দ্র বদলে খেলারটা দিতে, সাহস পাই না। হঠাৎ যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যায়।
এর চেয়ে অ্যাকসিডেন্ট হওয়াই বোধ হয় ভালো ছিল। যা শুনলাম, তাতে শরীরের ওপর দিয়ে যায়নি বটে, কানের ওপর দিয়ে, সেই সুবাদে রুচির ওপর দিয়ে যেন স্টিমরোলার চলে গেল।
বিএনপিদলীয় একজন সদস্যা যা বলেছেন, তার সবই আমি শুনেছি। ভালো যে টেলিভিশনের সামনে ছিলাম না, তা হলে তাকে দেখতেও হতো। তিনি কী কী বলেছেন, তা আমি আরেকবার বলতে পারব না। আমার পক্ষে সম্ভব না। এসব কথা প্রথম আলোর মতো পত্রিকায় ছাপা উচিতও না। আমার ধারণা, প্রথম আলো কাগজটা ভদ্রলোকেরাই পড়েন। আমার লেখা আবার শিশু-কিশোরেরাও পড়ে বলে জানি।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা এ বক্তব্য সরাসরি শোনেননি, তাঁদের আমি বোঝাব কেমন করে যে তিনি কী বলে থাকতে পারেন।
আচ্ছা, আকারে-ইঙ্গিতে বলি।
ধরা যাক, ক হলেন একজন পুরুষ। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। আগে খুবই ক্ষমতাধর ছিলেন।
খ হলেন একজন নারী। তিনি এখন খুবই ক্ষমতাশালী।
তিনি বলছেন, খ ক-এর কেবল কোলে নয়, আর কোথায় কোথায় বসেছিলেন...
নাহ্, আমার পক্ষে এসব কথা লেখা সম্ভব নয়। এতটুকুন লিখেই খুবই মর্মপীড়া হচ্ছে।
কাগজে পড়লাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, এ ভাষা তো নিষিদ্ধ পল্লিতেও বেমানান।
মাননীয় সংসদ সদস্যদের করজোড়ে কি একটা নিবেদন করতে পারি, নিষিদ্ধ পল্লি তো নিষিদ্ধই। সেখানে কী বলা হয়, না বলা হয়, তা রেডিও-টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয় না। অসম্পাদিত অবস্থায় সরাসরি তা দেশের আপামর মানুষের কাছে কখনোই পৌঁছায় না। কিন্তু মহান জাতীয় সংসদে কোনো সদস্য যা বলেন, তা সরাসরি প্রচার করা হয়। রেডিওতে শোনা যায়, টেলিভিশনে শোনা ও দেখা যায়। আপনাদের বাসায় কি শিশু-কিশোর নেই? আপনাদের বাসায় কি ময়-মুরব্বি নেই?
বিএনপির ওই নারী সংসদ সদস্য যা বলেছেন, তা যদি তাঁর সন্তান-ভাগনে-ভাগনিরা শুনে ফেলে? যদি তাঁর মা-খালারা শোনেন? যদি তাঁর বাবা-চাচারা শোনেন?
২
বিএনপির একজন সংসদ সদস্য, যার নাম আমি মনে রাখারও প্রয়োজন বোধ করি না, তার মুখে এসব কথা শুনে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার কাছে অরুচিকর, অরাজনৈতিক, অনভিপ্রেত বলে মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এটা সভ্যতার সঙ্গে যায় না, ভদ্রতা-শিষ্টতা-শালীনতার সঙ্গে তো নয়ই। সভ্যতার সঙ্গে কিন্তু রেখে-ঢেকে চলার একটা সম্পর্ক আছে। মানুষ বনে ছিল। কোনো পোশাক পরতে জানত না। প্রথম দিকে সে গাছের ছালবাকল, লতাপাতা দিয়ে অঙ্গ ঢেকে রাখতে শুরু করে, পশুর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতে শেখে, তারপর কাপড় আবিষ্কার করে। আপনি কোথায় কী বলবেন, কোথায় কী করবেন, এসব মেনে চলাও সভ্যতারই অংশ। যে কথা ইয়ার-দোস্তরা বলাবলি করে, তা কেউ প্রার্থনাসভায় বলবে না, জনসভায়ও বলবে না। সব প্রাণীকেই কতগুলো প্রাকৃতিক জৈবিক কাজ প্রতিদিন করতে হয়, সেসব বিষয়ে আমরা গোপনীয়তা বজায় রেখেই চলি। এটাই সভ্যতা।
৩
বিএনপির একজন সংসদ সদস্য, যার নাম আমি গতকালই প্রথম জানলাম এবং আগামীকাল মনে রাখব বলে মনে করি না, তার মুখে এসব শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, আমার লজ্জাবোধ হয়েছে। আমি আসলে এসব নিয়ে কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি।
কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় পদে আছেন, অনেক বড় যাঁর মর্যাদা, আর স্থান, যিনি আমাদের সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অকারণ, অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে থাকেন, তখন অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কীই বা বলার থাকে।
বিরোধী দলের তৃতীয় সারির নেতার মুখে যা মানায় না, সরকারি দলের প্রথম সারির নেতার মুখে তার এক শতাংশ কথাও কি কেউ আশা করে?
৪
এসব বলে কি জনপ্রিয়তা বাড়ে?
নীরবতা হীরন্ময়। কথা কম বলুন, বিষোদ্গার কম করুন, কথা বলতে হলে মিষ্টি করে হেসে বলুন।
কাকের কর্কশ স্বর বিষ লাগে কানে,
কোকিল অখিল প্রিয় সুমধুর গানে।
৫
২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একজন নেত্রী কী অসাধারণ পরিমিতিবোধই না প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি কথা কম বলেছিলেন এবং তাঁর ভোট অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
এখন তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন।
জরিপ বলছে, তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে।
আশা করি, নিজের ভালোটা অন্তত এঁরা বুঝবেন। জনগণের ভালো পরে করুন, আগে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট হোন। দয়া করে, কুৎসা, ব্যক্তিগত কাদা-ছোড়াছুড়ি, মন্ত্রীর ভাষায় ‘নিষিদ্ধ পল্লিতেও বেমানান’ কথাবার্তা বলা বন্ধ করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এর চেয়ে অ্যাকসিডেন্ট হওয়াই বোধ হয় ভালো ছিল। যা শুনলাম, তাতে শরীরের ওপর দিয়ে যায়নি বটে, কানের ওপর দিয়ে, সেই সুবাদে রুচির ওপর দিয়ে যেন স্টিমরোলার চলে গেল।
বিএনপিদলীয় একজন সদস্যা যা বলেছেন, তার সবই আমি শুনেছি। ভালো যে টেলিভিশনের সামনে ছিলাম না, তা হলে তাকে দেখতেও হতো। তিনি কী কী বলেছেন, তা আমি আরেকবার বলতে পারব না। আমার পক্ষে সম্ভব না। এসব কথা প্রথম আলোর মতো পত্রিকায় ছাপা উচিতও না। আমার ধারণা, প্রথম আলো কাগজটা ভদ্রলোকেরাই পড়েন। আমার লেখা আবার শিশু-কিশোরেরাও পড়ে বলে জানি।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, আপনারা যারা এ বক্তব্য সরাসরি শোনেননি, তাঁদের আমি বোঝাব কেমন করে যে তিনি কী বলে থাকতে পারেন।
আচ্ছা, আকারে-ইঙ্গিতে বলি।
ধরা যাক, ক হলেন একজন পুরুষ। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। আগে খুবই ক্ষমতাধর ছিলেন।
খ হলেন একজন নারী। তিনি এখন খুবই ক্ষমতাশালী।
তিনি বলছেন, খ ক-এর কেবল কোলে নয়, আর কোথায় কোথায় বসেছিলেন...
নাহ্, আমার পক্ষে এসব কথা লেখা সম্ভব নয়। এতটুকুন লিখেই খুবই মর্মপীড়া হচ্ছে।
কাগজে পড়লাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, এ ভাষা তো নিষিদ্ধ পল্লিতেও বেমানান।
মাননীয় সংসদ সদস্যদের করজোড়ে কি একটা নিবেদন করতে পারি, নিষিদ্ধ পল্লি তো নিষিদ্ধই। সেখানে কী বলা হয়, না বলা হয়, তা রেডিও-টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয় না। অসম্পাদিত অবস্থায় সরাসরি তা দেশের আপামর মানুষের কাছে কখনোই পৌঁছায় না। কিন্তু মহান জাতীয় সংসদে কোনো সদস্য যা বলেন, তা সরাসরি প্রচার করা হয়। রেডিওতে শোনা যায়, টেলিভিশনে শোনা ও দেখা যায়। আপনাদের বাসায় কি শিশু-কিশোর নেই? আপনাদের বাসায় কি ময়-মুরব্বি নেই?
বিএনপির ওই নারী সংসদ সদস্য যা বলেছেন, তা যদি তাঁর সন্তান-ভাগনে-ভাগনিরা শুনে ফেলে? যদি তাঁর মা-খালারা শোনেন? যদি তাঁর বাবা-চাচারা শোনেন?
২
বিএনপির একজন সংসদ সদস্য, যার নাম আমি মনে রাখারও প্রয়োজন বোধ করি না, তার মুখে এসব কথা শুনে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার কাছে অরুচিকর, অরাজনৈতিক, অনভিপ্রেত বলে মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এটা সভ্যতার সঙ্গে যায় না, ভদ্রতা-শিষ্টতা-শালীনতার সঙ্গে তো নয়ই। সভ্যতার সঙ্গে কিন্তু রেখে-ঢেকে চলার একটা সম্পর্ক আছে। মানুষ বনে ছিল। কোনো পোশাক পরতে জানত না। প্রথম দিকে সে গাছের ছালবাকল, লতাপাতা দিয়ে অঙ্গ ঢেকে রাখতে শুরু করে, পশুর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ করতে শেখে, তারপর কাপড় আবিষ্কার করে। আপনি কোথায় কী বলবেন, কোথায় কী করবেন, এসব মেনে চলাও সভ্যতারই অংশ। যে কথা ইয়ার-দোস্তরা বলাবলি করে, তা কেউ প্রার্থনাসভায় বলবে না, জনসভায়ও বলবে না। সব প্রাণীকেই কতগুলো প্রাকৃতিক জৈবিক কাজ প্রতিদিন করতে হয়, সেসব বিষয়ে আমরা গোপনীয়তা বজায় রেখেই চলি। এটাই সভ্যতা।
৩
বিএনপির একজন সংসদ সদস্য, যার নাম আমি গতকালই প্রথম জানলাম এবং আগামীকাল মনে রাখব বলে মনে করি না, তার মুখে এসব শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, আমার লজ্জাবোধ হয়েছে। আমি আসলে এসব নিয়ে কথা বলতেও লজ্জা পাচ্ছি।
কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় পদে আছেন, অনেক বড় যাঁর মর্যাদা, আর স্থান, যিনি আমাদের সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি যখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অকারণ, অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে থাকেন, তখন অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কীই বা বলার থাকে।
বিরোধী দলের তৃতীয় সারির নেতার মুখে যা মানায় না, সরকারি দলের প্রথম সারির নেতার মুখে তার এক শতাংশ কথাও কি কেউ আশা করে?
৪
এসব বলে কি জনপ্রিয়তা বাড়ে?
নীরবতা হীরন্ময়। কথা কম বলুন, বিষোদ্গার কম করুন, কথা বলতে হলে মিষ্টি করে হেসে বলুন।
কাকের কর্কশ স্বর বিষ লাগে কানে,
কোকিল অখিল প্রিয় সুমধুর গানে।
৫
২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত একজন নেত্রী কী অসাধারণ পরিমিতিবোধই না প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি কথা কম বলেছিলেন এবং তাঁর ভোট অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
এখন তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন।
জরিপ বলছে, তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে।
আশা করি, নিজের ভালোটা অন্তত এঁরা বুঝবেন। জনগণের ভালো পরে করুন, আগে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট হোন। দয়া করে, কুৎসা, ব্যক্তিগত কাদা-ছোড়াছুড়ি, মন্ত্রীর ভাষায় ‘নিষিদ্ধ পল্লিতেও বেমানান’ কথাবার্তা বলা বন্ধ করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments