রাজনীতি-হরতাল নয়, সমস্যার সমাধান সমঝোতায় by আবদুল মান্নান
বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের ডাকা টানা ৩৬ ঘণ্টার একটি অর্থহীন এবং চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী হরতাল শেষ হলো গত সোমবার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রয়োজনে তারা ৭২ ঘণ্টা বা এক সপ্তাহরও হরতাল দিতে পারেন।
চাই কি, বছরের বাকি সময়ের জন্য তামাম বাংলাদেশকে বন্ধ করে দিতে পারেন। ৫ জুন বিএনপি ও তাদের মিত্ররা মিলে আরেকটি দেশব্যাপী সকাল-সন্ধা হরতাল ডেকেছিল। সে সময় কারণ হিসেবে বলেছিল, তারা এই হরতাল ডাকছে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার দাবিতে। উল্লেখ্য, দেশের উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে সংবিধান থেকে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিত করা হয়েছে। এর বিকল্প কিছু চিন্তা করতে হলে তা করার এখতিয়ার একমাত্র সংসদের। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বিএনপির সংসদে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তারা রাস্তায় এ সমস্যার সমাধান করতে চায়। যদিও তারা এটাও জানে, যখন ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছিল, তখন বিষয়টার একপ্রকার সুরাহা হয়েছিল জাতীয় সংসদেই এবং সেই সংসদ ছিল একটি একদলীয় সংসদ, যা গঠিত হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের এক তামাশাপূর্ণ নির্বাচনে, যে নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল বর্জন করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতাল কোনো নতুন বিষয় নয়। এখন হরতাল অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে অনেক হরতাল হয়েছে। সবচেয়ে সফল হরতাল হয়েছে ঊনসত্তর ও সত্তরে। বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না, সারা দেশে কেমন করে কোনো একটি রিকশায় আগুন না দিয়েও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১০০ ভাগ সফল হরতাল করা সে সময় সম্ভব ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ডাকা হরতাল অথবা ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ডাকা হরতালগুলোরও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ছিল। কারণ, ইস্যুগুলো জাতীয় ছিল। এটা বলার অর্থ এই নয় যে বিএনপির হরতালে জাতীয় ইস্যু নেই। তফাতটা হচ্ছে, তারা এটাকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
৫ তারিখের হরতালের পূর্ব রাতে বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোগুলোতে অবধারিতভাবে প্রাধান্য পেয়েছে পরদিনের হরতাল। এরই মধ্যে হরতাল ‘সফল’ করার জন্য ঢাকা শহরে প্রায় ১৫টি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি সঞ্চালক উত্থাপন করলে এক আলোচক তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে গোয়েন্দা ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। জানালেন, পোড়ানো দুটি বাসের মধ্যে একটি দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল রাজউকের পাশে আর অন্যটি ভিন্ন রুটের বাস হওয়া সত্ত্বেও কী কারণে মিরপুরে গিয়েছিল? ইঙ্গিতটা আসলে ‘বজ্জাত’ আওয়ামী লীগের সরকারের লোকজনের দিকে। বাসগুলোকে ওই জায়গায় নিয়ে গিয়ে বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তারা তাতে আগুন দিয়েছে। এবারের হরতালকে কেন্দ্র করে ১৩টির মতো বাস পোড়ানো হয়েছে। আলোচকের কথা শুনে মনে পড়ল, একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সংসদে সরকারি দলের আলোচনা প্রসঙ্গ। একেবারে রাখঢাখ না করেই তারা বলেছিল, আসলে এই বোমাবাজির সঙ্গে আওয়ামী লীগ জড়িত। তারাই সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নিজেরাই বোমাবাজি করেছে। শুধু বলতে বাকি ছিল শেখ হাসিনা তাঁর হাতব্যাগের মধ্যে বোমা নিয়ে গিয়ে দলীয় ক্যাডারদের হাতে দিয়ে বলেছে, যাও, এগুলো আমাদের ওপর ছুড়ে মারো। ৫ তারিখের হরতাল প্রত্যাহার করার জন্য দেশের শীর্ষ বণিক সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা বিএনপির কাছে আবেদন করেছিলেন। এতে আলোচক অবাক হয়েছেন। কারণ, তাঁর ভাষায় ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। পরদিন দেখি, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক হাজার একজন শিক্ষক হরতালের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। সে ব্যাপারে পরবর্তীকালে ওই আলোচক বা অন্য কাউকে আলোচনা করতে শুনিনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যেমন সব সময় হরতালের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অনেক জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে। আমি নিজে এ রকম একাধিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তবে আলাদা করে কোনো একটি হরতালের পক্ষে স্বাক্ষর করেছি বলে মনে হয় না। অবশ্য হরতাল হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার যে ক্ষতি হয়, তা পুষিয়ে নিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের; বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হরতালের কারণে না হওয়া ক্লাসসমূহ সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হয়। বেসরকারি স্কুলগুলোতেও একই ব্যবস্থা।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির হাতিয়ার আওয়ামী লীগই অনেকটা আগ বাড়িয়ে বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু না থাকলেও বিএনপি-জামায়াত জোট বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য একটা ইস্যু খুঁজে বের করতই। বিএনপির ইস্যু প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে খালেদা জিয়ার দুই ছেলের বিরুদ্ধেই আদালতে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা চলছে। ইতিমধ্যে আরাফাত রহমান কোকো যে অন্যায়ভাবে জার্মানির সিমেন্স কোম্পানি থেকে কোটি টাকার উৎকোচ গ্রহণ করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রমাণিত। তারেক জিয়ার মামলাটি বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা এবং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির অনেক রাঘববোয়াল ফেঁসে যেতে পারেন। জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। সুতরাং উভয় দলকেই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। যদি ধরে নিই, সরকারি দল বিএনপির দাবি অনুযায়ী সংসদে একটি বিল এনে নতুন করে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পাস করাল, তাহলে কি বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলন বন্ধ হবে? কেউ যদি এমনটি মনে করে থাকেন, তাহলে বলতে হবে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অবধারিতভাবে তারপর এসে যাবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি। এর আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদে যাওয়ার শর্ত হিসেবে বলেছিলেন, সরকার যদি খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করে, তাহলে তাঁরা সংসদে যাবেন। তারও আগে তাঁরা কখনো আট দফা, কখনো ১০ দফা আর কখনো ১২ দফা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, এগুলো হলো সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত। আসল কথা হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। না করার কারণ, ক্ষমতায় থেকেই দলটির জন্ম। ধরে নিয়েছিল দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকা যাবে। তা না হওয়ায় তাদের যত অসুবিধা। বিগত সময়েও বিএনপি ক্ষমতা হারিয়ে একই আচরণ করেছিল।
একদল মানুষ ইতিমধ্যে হিসাব-নিকাশ কষা শুরু করে দিয়েছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে। একদল বলছে, বাংলাদেশে পর পর দুবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার নজির নেই। এবার তার কেন ব্যত্যয় ঘটবে? এমন এক বিশ্বাসী আমার পাড়ার ফটোকপির দোকানদার। সে আমার কাছে জানতে চায়, খালেদা জিয়া যে ঘোষণা করেছেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের সব কাজ বেআইনি ঘোষণা করবেন, তা কি সত্য? তাকে বলেছি, সত্য হওয়ার কথা। কারণ, খালেদা জিয়া কথার নড়চড় করেন না। আগামীবার তাঁর দল ক্ষমতায় এলে পদ্মার ওপর সেতু প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নেওয়া বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য নির্মাণাধীন উড়ালসেতু, ঢাকা-চট্টগ্রামের চার লেনবিশিষ্ট সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, একই রুটে রেলের ডাবল লাইন প্রকল্প, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে করা দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি, যার মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিও আছে, এই মেয়াদে নতুন নতুন যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে, সবই বন্ধসহ সব সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে। দোকানদার বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ, সে পদ্মার ওপারে বাস করে এবং সব সময় স্বপ্ন দেখেছে পদ্মার ওপর একটা সেতু। আমার এক তরুণ বন্ধু জানতে চায়, সত্যি সত্যি যদি সামনের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হবে? তার বাবাকে একাত্তরে আলবদররা তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল। তাকে বলি, স্বাভাবিক নিয়মেই বিচার বন্ধ হয়ে যাবে এবং হয়তো একাত্তরের আলবদরের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ আদালত যে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছেন, তার তিনটি অংশ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বেআইনি। দ্বিতীয়ত, জনগণ ও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তা দুই মেয়াদে রাখা যেতে পারে এবং সর্বশেষ এই ব্যবস্থা থেকে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাদ দেওয়া উচিত। বিশ্লেষকদের এই তিনটির কোনটি রায় আর কোনটি পর্যবেক্ষণ, তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। বিএনপি বলছে, উচ্চ আদালতের রায় সংসদ মানতে বাধ্য নয়। খালেদা জিয়া বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। তবে তাঁরা আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি খায়রুল হককে চান না। কাকে চান তা-ও পরিষ্কার বলছেন না। রায়ের পরের অংশ যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে তো বিচারকদের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান খুঁজতে হবে। তাহলে তো পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন, যেটা করতে পারে একমাত্র সংসদ। এই ইস্যুতে কেন বিএনপি সংসদে যাবে না? প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী তো বিএনপিকে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে সংসদে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন, সামনের বার আবারও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে এসে সরকার গঠন করতে হবে। তবে তা সহজ নাও হতে পারে। সম্ভাব্য কঠিন কাজটা সহজ করতে হলে আওয়ামী লীগের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দূরদর্শী স্টেটসম্যানের পরিচয় দিতে হবে এবং তা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। তবে একটি কথা সবার মনে রাখা ভালো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সমস্যার সমাধান একমাত্র সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় সংসদেই সমাধান সম্ভব। তা না হলে অযথা সংঘাত অনিবার্য। এতে দেশ, জনগণ ও রাজনীতির ক্ষতি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতাল কোনো নতুন বিষয় নয়। এখন হরতাল অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে অনেক হরতাল হয়েছে। সবচেয়ে সফল হরতাল হয়েছে ঊনসত্তর ও সত্তরে। বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না, সারা দেশে কেমন করে কোনো একটি রিকশায় আগুন না দিয়েও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১০০ ভাগ সফল হরতাল করা সে সময় সম্ভব ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ডাকা হরতাল অথবা ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ডাকা হরতালগুলোরও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ছিল। কারণ, ইস্যুগুলো জাতীয় ছিল। এটা বলার অর্থ এই নয় যে বিএনপির হরতালে জাতীয় ইস্যু নেই। তফাতটা হচ্ছে, তারা এটাকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
৫ তারিখের হরতালের পূর্ব রাতে বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোগুলোতে অবধারিতভাবে প্রাধান্য পেয়েছে পরদিনের হরতাল। এরই মধ্যে হরতাল ‘সফল’ করার জন্য ঢাকা শহরে প্রায় ১৫টি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি সঞ্চালক উত্থাপন করলে এক আলোচক তার সরাসরি উত্তর না দিয়ে গোয়েন্দা ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। জানালেন, পোড়ানো দুটি বাসের মধ্যে একটি দাঁড়ানো অবস্থায় ছিল রাজউকের পাশে আর অন্যটি ভিন্ন রুটের বাস হওয়া সত্ত্বেও কী কারণে মিরপুরে গিয়েছিল? ইঙ্গিতটা আসলে ‘বজ্জাত’ আওয়ামী লীগের সরকারের লোকজনের দিকে। বাসগুলোকে ওই জায়গায় নিয়ে গিয়ে বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তারা তাতে আগুন দিয়েছে। এবারের হরতালকে কেন্দ্র করে ১৩টির মতো বাস পোড়ানো হয়েছে। আলোচকের কথা শুনে মনে পড়ল, একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সংসদে সরকারি দলের আলোচনা প্রসঙ্গ। একেবারে রাখঢাখ না করেই তারা বলেছিল, আসলে এই বোমাবাজির সঙ্গে আওয়ামী লীগ জড়িত। তারাই সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নিজেরাই বোমাবাজি করেছে। শুধু বলতে বাকি ছিল শেখ হাসিনা তাঁর হাতব্যাগের মধ্যে বোমা নিয়ে গিয়ে দলীয় ক্যাডারদের হাতে দিয়ে বলেছে, যাও, এগুলো আমাদের ওপর ছুড়ে মারো। ৫ তারিখের হরতাল প্রত্যাহার করার জন্য দেশের শীর্ষ বণিক সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা বিএনপির কাছে আবেদন করেছিলেন। এতে আলোচক অবাক হয়েছেন। কারণ, তাঁর ভাষায় ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। পরদিন দেখি, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক হাজার একজন শিক্ষক হরতালের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। সে ব্যাপারে পরবর্তীকালে ওই আলোচক বা অন্য কাউকে আলোচনা করতে শুনিনি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যেমন সব সময় হরতালের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে, তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অনেক জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে। আমি নিজে এ রকম একাধিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তবে আলাদা করে কোনো একটি হরতালের পক্ষে স্বাক্ষর করেছি বলে মনে হয় না। অবশ্য হরতাল হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার যে ক্ষতি হয়, তা পুষিয়ে নিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের; বিশেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হরতালের কারণে না হওয়া ক্লাসসমূহ সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হয়। বেসরকারি স্কুলগুলোতেও একই ব্যবস্থা।
কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির হাতিয়ার আওয়ামী লীগই অনেকটা আগ বাড়িয়ে বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবটা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু না থাকলেও বিএনপি-জামায়াত জোট বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য একটা ইস্যু খুঁজে বের করতই। বিএনপির ইস্যু প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে খালেদা জিয়ার দুই ছেলের বিরুদ্ধেই আদালতে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা চলছে। ইতিমধ্যে আরাফাত রহমান কোকো যে অন্যায়ভাবে জার্মানির সিমেন্স কোম্পানি থেকে কোটি টাকার উৎকোচ গ্রহণ করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রমাণিত। তারেক জিয়ার মামলাটি বাংলাদেশের আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা এবং একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির অনেক রাঘববোয়াল ফেঁসে যেতে পারেন। জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। সুতরাং উভয় দলকেই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। যদি ধরে নিই, সরকারি দল বিএনপির দাবি অনুযায়ী সংসদে একটি বিল এনে নতুন করে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পাস করাল, তাহলে কি বিএনপি-জামায়াতের সরকারবিরোধী আন্দোলন বন্ধ হবে? কেউ যদি এমনটি মনে করে থাকেন, তাহলে বলতে হবে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। অবধারিতভাবে তারপর এসে যাবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি। এর আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংসদে যাওয়ার শর্ত হিসেবে বলেছিলেন, সরকার যদি খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার করে, তাহলে তাঁরা সংসদে যাবেন। তারও আগে তাঁরা কখনো আট দফা, কখনো ১০ দফা আর কখনো ১২ দফা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, এগুলো হলো সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পূর্বশর্ত। আসল কথা হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। না করার কারণ, ক্ষমতায় থেকেই দলটির জন্ম। ধরে নিয়েছিল দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকা যাবে। তা না হওয়ায় তাদের যত অসুবিধা। বিগত সময়েও বিএনপি ক্ষমতা হারিয়ে একই আচরণ করেছিল।
একদল মানুষ ইতিমধ্যে হিসাব-নিকাশ কষা শুরু করে দিয়েছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে। একদল বলছে, বাংলাদেশে পর পর দুবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার নজির নেই। এবার তার কেন ব্যত্যয় ঘটবে? এমন এক বিশ্বাসী আমার পাড়ার ফটোকপির দোকানদার। সে আমার কাছে জানতে চায়, খালেদা জিয়া যে ঘোষণা করেছেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের সব কাজ বেআইনি ঘোষণা করবেন, তা কি সত্য? তাকে বলেছি, সত্য হওয়ার কথা। কারণ, খালেদা জিয়া কথার নড়চড় করেন না। আগামীবার তাঁর দল ক্ষমতায় এলে পদ্মার ওপর সেতু প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নেওয়া বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য নির্মাণাধীন উড়ালসেতু, ঢাকা-চট্টগ্রামের চার লেনবিশিষ্ট সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, একই রুটে রেলের ডাবল লাইন প্রকল্প, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে করা দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি, যার মধ্যে জনশক্তি রপ্তানিও আছে, এই মেয়াদে নতুন নতুন যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে, সবই বন্ধসহ সব সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাবে। দোকানদার বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ, সে পদ্মার ওপারে বাস করে এবং সব সময় স্বপ্ন দেখেছে পদ্মার ওপর একটা সেতু। আমার এক তরুণ বন্ধু জানতে চায়, সত্যি সত্যি যদি সামনের বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কী হবে? তার বাবাকে একাত্তরে আলবদররা তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল। তাকে বলি, স্বাভাবিক নিয়মেই বিচার বন্ধ হয়ে যাবে এবং হয়তো একাত্তরের আলবদরের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে উচ্চ আদালত যে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছেন, তার তিনটি অংশ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বেআইনি। দ্বিতীয়ত, জনগণ ও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তা দুই মেয়াদে রাখা যেতে পারে এবং সর্বশেষ এই ব্যবস্থা থেকে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাদ দেওয়া উচিত। বিশ্লেষকদের এই তিনটির কোনটি রায় আর কোনটি পর্যবেক্ষণ, তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে। বিএনপি বলছে, উচ্চ আদালতের রায় সংসদ মানতে বাধ্য নয়। খালেদা জিয়া বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। তবে তাঁরা আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি খায়রুল হককে চান না। কাকে চান তা-ও পরিষ্কার বলছেন না। রায়ের পরের অংশ যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে তো বিচারকদের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান খুঁজতে হবে। তাহলে তো পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন, যেটা করতে পারে একমাত্র সংসদ। এই ইস্যুতে কেন বিএনপি সংসদে যাবে না? প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী তো বিএনপিকে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে সংসদে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন, সামনের বার আবারও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে এসে সরকার গঠন করতে হবে। তবে তা সহজ নাও হতে পারে। সম্ভাব্য কঠিন কাজটা সহজ করতে হলে আওয়ামী লীগের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দূরদর্শী স্টেটসম্যানের পরিচয় দিতে হবে এবং তা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। তবে একটি কথা সবার মনে রাখা ভালো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সমস্যার সমাধান একমাত্র সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় সংসদেই সমাধান সম্ভব। তা না হলে অযথা সংঘাত অনিবার্য। এতে দেশ, জনগণ ও রাজনীতির ক্ষতি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments