অবৈধ আবাসন প্রকল্প-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন by সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
অবৈধ ও অননুমোদিত আবাসন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক বেশ কিছুদিনের। এই বিতর্ক ভিন্ন মাত্রা পায় যখন বছর দেড়েক আগে প্রতাপশালী এক আবাসন ব্যবসায়ী সচিবালয়ে বসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে রীতিমতো অপমান করেন। তাঁর আবদার, আইন বা মাস্টারপ্ল্যানে যা-ই থাকুক না কেন, ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়া বা বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্পকে
বৈধতা দিতে হবে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর এই আবাসন ব্যবসায়ীর এমন আচরণে সংসদে পর্যন্ত নিন্দার ঝড় বইলেও সব রাজনৈতিক সরকারের সময়েই তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
ঠিক একইভাবে অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের অন্য সব উদ্যোক্তাও রয়ে যান আইনের ঊর্ধ্বে। আবাসন সমস্যার সমাধানের নামে ঢাকার সব নিম্নাঞ্চল ও জলাশয় ভরাট করে এবং অন্যের জমি জোর করে দখল করে প্লট-বাণিজ্যে লিপ্ত এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২৫০-এর বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এঁদের হাতেই যেন জিম্মি দেশের লাখ লাখ মানুষ। নানা চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে তাদের বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা হয় এমন প্রকল্পে, যার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আইন দ্বারা পরিচালিত হলে এরূপ প্রকল্পকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও চলছে অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের রমরমা বাণিজ্য। কখনো নিজের নামে, কখনো বা পরিবারের অন্য কারও নামে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের নামকরণ করা হয়। আবার পরিবেশবাদীদের তোপের মুখে পড়লে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব নামও দেওয়া হয়ে থাকে এসব প্রকল্পের। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বেসরকারি আবাসন প্রকল্প ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পই এখনো পানির নিচে। তবু মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান ঘটাচ্ছে—এই অজুহাতে বেআইনিভাবে চলছে কৃষিজমি আর জলাশয়ের শ্রেণী পরিবর্তন। একজনের জমি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে অন্যজনের আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাও আবার পানিতে। নিরাপদ বাসস্থান পাওয়ার জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে এই পর্যায়ের ছিনিমিনি খেলার আয়োজন বোধহয় আমাদের দেশেই সম্ভব।
এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে জনগণ অন্তত দুটি জনস্বার্থমূলক আইন পেয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ২০০০ সালের মহানগর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদে অনুমোদিত রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০। আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রবল আপত্তির মুখেও এ আইন পাস করে সরকার জননন্দিত হয়েছিল। পরিবেশ ও ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায় এ আইনের একটি বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনের স্পষ্ট বিধান হচ্ছে, কোনো বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের উদ্যোক্তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু বা অননুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচার বা বিক্রয় করতে পারবে না। এই বিধান ভঙ্গকারী অনূর্ধ্ব ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
কিন্তু কিছু কিছু আবাসন প্রকল্পের মালিক ধর্মের কাহিনি শোনেন না এবং তাঁদের আওয়াজও হয় বড় গলার। নতুবা আইনের এমন স্পষ্ট ও কঠোর বিধান পাশ কাটিয়ে তাঁরা এমন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে কীভাবে তাঁদের অনুমোদনহীন, অবৈধ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন? জলাশয়ে বাস্তবায়নাধীন এসব প্রকল্পে তাঁদের বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগের যে তথ্য জনসমক্ষে দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে রাজস্ব বা আয়কর বিভাগ অবগত কি না? আর অবগত হলে রাজস্বের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক মনে হয় জেনেও না জানার ভান করে বসে আছে।
গত ১৬ জুন মহামান্য হাইকোর্ট রিহ্যাব কর্তৃক আয়োজিত ১৬-১৯ জুন, ২০১১ আবাসন মেলায় অননুমোদিত ও অবৈধ আবাসন প্রকল্পের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ‘আদালতের আদেশের প্রত্যায়িত কপি পাওয়া যায়নি’—এই অজুহাতে কোনো স্টল বন্ধ করেনি রাজউক! বহুল প্রচারিত এই আদেশ সম্পর্কে অবগত হওয়া রাজউকের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে গড়িমসি জবাবদিহির দাবি রাখে। তা ছাড়া রাজউক সময়ে সময়ে অবৈধ প্রকল্পের তালিকা প্রকাশ করলেও আইন প্রয়োগ করতে আদালতের নির্দেশের কপি কেন প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। রাজউকের অনিচ্ছা ও ব্যর্থতার কারণেই রিহ্যাব মেলায় অবৈধ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলো। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যদিও প্রতিমন্ত্রী অবৈধ প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের ভূমিদস্যুতা ও চোরের মতন পালিয়ে বেড়ানোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর দায় কে নেবে—আইন ভঙ্গকারী আবাসন শিল্পপতিরা, নাকি সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং নগরের এক কোটি ২০ লাখ মানুষ? সরকার তার প্রণীত আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে আইন ভঙ্গকারীরা শাস্তির মুখোমুখি হতেন।
আইনের স্পষ্ট বিধান ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রিহ্যাব মেলায় কীভাবে অবৈধ প্রকল্প ঠাঁই পেল, সে বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আবাসন মেলার কোনো পণ্য নয়, এটি জনগণের মৌলিক অধিকার—এ উপলব্ধি থেকে তদন্ত হলে দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা যাবে। আর তা না হলে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ও রাজউকের হুঁশিয়ারি অনর্থক বাগাড়ম্বরে পরিণত হবে। জনস্বার্থে এমন ‘চোর-পুলিশ’ খেলার ইতি টানা জরুরি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
ঠিক একইভাবে অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের অন্য সব উদ্যোক্তাও রয়ে যান আইনের ঊর্ধ্বে। আবাসন সমস্যার সমাধানের নামে ঢাকার সব নিম্নাঞ্চল ও জলাশয় ভরাট করে এবং অন্যের জমি জোর করে দখল করে প্লট-বাণিজ্যে লিপ্ত এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২৫০-এর বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এঁদের হাতেই যেন জিম্মি দেশের লাখ লাখ মানুষ। নানা চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে তাদের বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা হয় এমন প্রকল্পে, যার কোনো আইনগত বৈধতা নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আইন দ্বারা পরিচালিত হলে এরূপ প্রকল্পকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও চলছে অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের রমরমা বাণিজ্য। কখনো নিজের নামে, কখনো বা পরিবারের অন্য কারও নামে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের নামকরণ করা হয়। আবার পরিবেশবাদীদের তোপের মুখে পড়লে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব নামও দেওয়া হয়ে থাকে এসব প্রকল্পের। হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বেসরকারি আবাসন প্রকল্প ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পই এখনো পানির নিচে। তবু মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধান ঘটাচ্ছে—এই অজুহাতে বেআইনিভাবে চলছে কৃষিজমি আর জলাশয়ের শ্রেণী পরিবর্তন। একজনের জমি জোরপূর্বক কেড়ে নিয়ে অন্যজনের আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাও আবার পানিতে। নিরাপদ বাসস্থান পাওয়ার জনগণের মৌলিক অধিকার নিয়ে এই পর্যায়ের ছিনিমিনি খেলার আয়োজন বোধহয় আমাদের দেশেই সম্ভব।
এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে জনগণ অন্তত দুটি জনস্বার্থমূলক আইন পেয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ২০০০ সালের মহানগর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদে অনুমোদিত রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০। আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রবল আপত্তির মুখেও এ আইন পাস করে সরকার জননন্দিত হয়েছিল। পরিবেশ ও ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায় এ আইনের একটি বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনের স্পষ্ট বিধান হচ্ছে, কোনো বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের উদ্যোক্তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু বা অননুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচার বা বিক্রয় করতে পারবে না। এই বিধান ভঙ্গকারী অনূর্ধ্ব ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
কিন্তু কিছু কিছু আবাসন প্রকল্পের মালিক ধর্মের কাহিনি শোনেন না এবং তাঁদের আওয়াজও হয় বড় গলার। নতুবা আইনের এমন স্পষ্ট ও কঠোর বিধান পাশ কাটিয়ে তাঁরা এমন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে কীভাবে তাঁদের অনুমোদনহীন, অবৈধ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন? জলাশয়ে বাস্তবায়নাধীন এসব প্রকল্পে তাঁদের বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগের যে তথ্য জনসমক্ষে দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে রাজস্ব বা আয়কর বিভাগ অবগত কি না? আর অবগত হলে রাজস্বের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক মনে হয় জেনেও না জানার ভান করে বসে আছে।
গত ১৬ জুন মহামান্য হাইকোর্ট রিহ্যাব কর্তৃক আয়োজিত ১৬-১৯ জুন, ২০১১ আবাসন মেলায় অননুমোদিত ও অবৈধ আবাসন প্রকল্পের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ‘আদালতের আদেশের প্রত্যায়িত কপি পাওয়া যায়নি’—এই অজুহাতে কোনো স্টল বন্ধ করেনি রাজউক! বহুল প্রচারিত এই আদেশ সম্পর্কে অবগত হওয়া রাজউকের দায়িত্ব এবং এই দায়িত্ব পালনে গড়িমসি জবাবদিহির দাবি রাখে। তা ছাড়া রাজউক সময়ে সময়ে অবৈধ প্রকল্পের তালিকা প্রকাশ করলেও আইন প্রয়োগ করতে আদালতের নির্দেশের কপি কেন প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। রাজউকের অনিচ্ছা ও ব্যর্থতার কারণেই রিহ্যাব মেলায় অবৈধ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলো। মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যদিও প্রতিমন্ত্রী অবৈধ প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের ভূমিদস্যুতা ও চোরের মতন পালিয়ে বেড়ানোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর দায় কে নেবে—আইন ভঙ্গকারী আবাসন শিল্পপতিরা, নাকি সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং নগরের এক কোটি ২০ লাখ মানুষ? সরকার তার প্রণীত আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে আইন ভঙ্গকারীরা শাস্তির মুখোমুখি হতেন।
আইনের স্পষ্ট বিধান ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রিহ্যাব মেলায় কীভাবে অবৈধ প্রকল্প ঠাঁই পেল, সে বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আবাসন মেলার কোনো পণ্য নয়, এটি জনগণের মৌলিক অধিকার—এ উপলব্ধি থেকে তদন্ত হলে দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা যাবে। আর তা না হলে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ও রাজউকের হুঁশিয়ারি অনর্থক বাগাড়ম্বরে পরিণত হবে। জনস্বার্থে এমন ‘চোর-পুলিশ’ খেলার ইতি টানা জরুরি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
No comments