চারদিক-মরুকরণের পদধ্বনি শুনি by শিখ্তী সানী
রুক্ষ ভূমি—শুষ্ক ও প্রাণহীন, হারিয়ে গেছে মাটির উর্বরতার স্তর। সেখানে যেন রাজ্য গড়ে তুলেছে পাথরশক্ত মাটির আস্তর। সেই রাজ্যকে জয় করে সবুজ উদ্ভিদের আলোতে দৃষ্টি মেলা দুষ্কর। খরা ও মরুকরণের প্রভাবে মাটি হারিয়ে ফেলে তার উৎপাদন বৈশিষ্ট্য। উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য পড়ে যায় অস্তিত্বের সংকটে।
শরীফুজ্জামান রাজশাহীর বিল এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৩ সালে। বিল এলাকায় কেবল জেলে হয়ে জীবন চলে না। আগের মতো মাছ নেই। শুকিয়ে যাচ্ছে বিল। অল্প কিছু জমি ছিল। আবাদ হয় না তেমন। ফি-বছর খরা লেগেই থাকে, কামাই নেই। তাই ঢাকায় ভাসমান হয়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা। তাঁর গ্রামের বহু মানুষ স্থিত হয়েছে ঢাকায়। ঢাকার ভাসমান মানুষের মধ্যে আরেকজন সবজিবিক্রেতা সালাম মিয়া। বয়স ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। যশোরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চৌগাছার কৃষক সালাম মিয়া জানেন শুকিয়ে গেছে জমি। বাতাস হয়ে গেছে উষ্ণ। পানি নেই, তাই আবাদ নেই। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, উত্তর-পশ্চিম যশোর এলাকা, পাবনা, বগুড়ার পশ্চিমাঞ্চল এবং দিনাজপুরের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জানে মাটির প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছে। তারা জানে না আবহাওয়ার বিরূপ এই আচরণ এবং মরুকরণের শিকার এ অঞ্চলগুলো আমাদের কঠিন ভবিষ্যতের হাতছানি দিয়ে যায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মরুকরণের ভয়ংকর শিকার। মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলেও কয়েক দশক থেকে পরিবেশবিজ্ঞানীরা মরুকরণের প্রবণতা লক্ষ করে আসছেন। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদ-নদীর পাললিক মাটি এসে বাংলাদেশ নামের এই বদ্বীপ গড়ে তুলেছে। ৭০০ ছোট-বড় নদী এবং ভারসাম্যপূর্ণ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকলেও নানা কারণে বাংলাদেশে মরুকরণ বেড়েই চলেছে। প্রকৃতির রুক্ষ আচরণ, গ্রিনহাউস গ্যাস ও বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত কৃষিকাজ এবং মানুষের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড মাটির উর্বরতাশক্তির ক্রমাগত হ্রাস ঘটায়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি নদী এবং ফারাক্কা বাঁধকে ঘিরে পানির অসম বণ্টন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মাটিকে করে তুলেছে শুষ্ক। বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্রমাগত পরিবর্তন অবস্থার মারাত্মক অবনতি ডেকে এনেছে। এতে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, ভূপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের এলাকাগুলোতে মাটিতে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততা। বাংলাদেশের ২২ ইঞ্চি ও ২৬ ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে একে চারটি জলমগ্ন এলাকায় ভাগ করা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, মূল মধ্যভূমি ও পূর্বাঞ্চল। তবু বৃষ্টিপাতের বিঘ্নতা এবং আবহাওয়ার ক্রমাগত পরিবর্তন ২৯ হাজার বর্গমাইলজুড়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণের প্রভাবকে ত্বরান্বিত করছে। বছরে চার-ছয় মাস এ অঞ্চলে খরা মৌসুম চলতে থাকে। একই জমিতে বারবার একই ফসল উৎপাদনে বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চলে মাটি তার ঊর্ধ্বস্তরকে হারিয়ে ফেলেছে। চিংড়ি চাষে অধিক লাভের আশায় দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকায় ধানিজমিতে চিংড়ির চাষ চলছে। এতে জমিতে ধীরে ধীরে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। অধিক নলকূপ স্থাপন ও সবুজ বিপ্লবের প্রকল্প বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পানির স্তরকে নামিয়ে দিয়েছে। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা নেমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে ১৯৬০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ছোট-বড় আকারে খরা দেখা দিয়েছে ১৯ বার, যা ৪৭ শতাংশ এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ৫৩ শতাংশ জনসংখ্যাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯০৭-২০০৪ সময়ের মধ্যে সাইক্লোন আঘাত হানে মোট ১৩৭ বার এবং ৬৪টি ছোট-বড় আকারে বন্যা দেখা দেয়, ভূমিকম্পের সংখ্যা ছয়টি। এসবের আঘাতে ভূমি হয়ে গেছে দুর্বল, সহজেই হারিয়ে গেছে উর্বর স্তর।
মরুকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃতির বাস্তুসংস্থান। এই শৃঙ্খলে দেখা যায় পরিবর্তন; যা উদ্ভিদ, প্রাণিবৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মরুকরণের প্রভাবে বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে উদ্ভিদের পরিমাণ কমে গেছে ভয়ংকর হারে। অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে জীববৈচিত্র্য। অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃক্ষের বিনাশ, উর্বর মাটিতে গবাদিপশুর চারণভূমি, অপরিকল্পিত কৃষিকাজ বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ হ্রাস করছে। মধুপুরের ভাওয়ালগড় যেমন মরুকরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি সুন্দরবনের মাটিতে প্রবেশ করছে লবণাক্ততা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আজ ঝুঁকির মুখে। মরুকরণের সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতার এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবর্তন বিগত ১০০ বছরে গন্ডার, বন্য ষাঁড়, নেকড়ে, নানা জাতের হরিণকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১২৯টি প্রজাতি আজ বিলুপ্তির হুমকিতে। বর্তমানে তা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। মরুকরণে মানুষের অভিবাসনের হার বাড়ছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে অভিবাসনের মানুষ এসে বসবাস শুরু করছে। আগামীকাল ১৭ জুন মরুকরণ প্রতিরোধে জাতিসংঘের কনভেনশন দিবস। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা কি বাংলাদেশে মরুকরণের মারাত্মক ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি করতে পারছি?
শিখ্তী সানী
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে ১৯৬০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ছোট-বড় আকারে খরা দেখা দিয়েছে ১৯ বার, যা ৪৭ শতাংশ এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ৫৩ শতাংশ জনসংখ্যাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯০৭-২০০৪ সময়ের মধ্যে সাইক্লোন আঘাত হানে মোট ১৩৭ বার এবং ৬৪টি ছোট-বড় আকারে বন্যা দেখা দেয়, ভূমিকম্পের সংখ্যা ছয়টি। এসবের আঘাতে ভূমি হয়ে গেছে দুর্বল, সহজেই হারিয়ে গেছে উর্বর স্তর।
মরুকরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃতির বাস্তুসংস্থান। এই শৃঙ্খলে দেখা যায় পরিবর্তন; যা উদ্ভিদ, প্রাণিবৈচিত্র্য ও মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মরুকরণের প্রভাবে বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে উদ্ভিদের পরিমাণ কমে গেছে ভয়ংকর হারে। অস্তিত্বের সংকটে ধুঁকছে জীববৈচিত্র্য। অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃক্ষের বিনাশ, উর্বর মাটিতে গবাদিপশুর চারণভূমি, অপরিকল্পিত কৃষিকাজ বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ হ্রাস করছে। মধুপুরের ভাওয়ালগড় যেমন মরুকরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি সুন্দরবনের মাটিতে প্রবেশ করছে লবণাক্ততা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আজ ঝুঁকির মুখে। মরুকরণের সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতার এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবর্তন বিগত ১০০ বছরে গন্ডার, বন্য ষাঁড়, নেকড়ে, নানা জাতের হরিণকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১২৯টি প্রজাতি আজ বিলুপ্তির হুমকিতে। বর্তমানে তা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। মরুকরণে মানুষের অভিবাসনের হার বাড়ছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে অভিবাসনের মানুষ এসে বসবাস শুরু করছে। আগামীকাল ১৭ জুন মরুকরণ প্রতিরোধে জাতিসংঘের কনভেনশন দিবস। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা কি বাংলাদেশে মরুকরণের মারাত্মক ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি করতে পারছি?
শিখ্তী সানী
No comments