বিবেকের ফেরিওয়ালা by স্বপন ধর

যতীন সরকার একজন মার্কসবাদী চিন্তক। একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে তার খ্যাতিও কম নয়। এই যে তার খ্যাতি তা তাকে পঁচাত্তর বছর বয়সে তিলে তিলে অর্জন করতে হয়েছে। 'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র'_ সেই ছাত্রত্ব তার আজও ঘোচেনি। অন্যের প্রতি তার দায় কতটুকু তা তিনি জানেন।

ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীর বাইরে থেকে তিনি নিতান্ত মফস্বলেও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে চলেছেন। তিনি যেন সমাজে বিবেকের ফেরিওয়ালা। সমাজের সব স্তরে তার নিরঙ্কুশ আসা-যাওয়া। অর্জিত বিদ্যার প্রতিটি কণা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নূ্যনতম কার্পণ্য নেই তার । বক্তব্যে তিনি অতুলনীয়। লক্ষ্যে স্থির থেকে অনলবর্ষী বক্তব্য সমাজের কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তোলেন। এখানেই তার অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে পার্থক্য। তিনি বহু গ্রন্থ লিখেছেন এবং তার গ্রন্থ সুপাঠ্য। শুধু সুপাঠ্য নয়, দিকনির্দেশনায় বেদবাক্য। তিনি যে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তা বাংলা ও বাঙালির অতীতের ধ্যানে-জ্ঞানে-কর্মে-চিন্তায় খুঁজে পান। তার বহু কৃতিত্বের একটি, বাঙালিদের পাকিস্তানি দ্বিজাতিতত্ত্বের জোশ থেকে বের করার চেষ্টা এবং তাদের মানবিক ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস। জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে এবং অন্ধ বিশ্বাস ও নিয়তিবাদের প্রতি আস্থা থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছেন। আজও এ বয়সে একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে অন্যকে যুক্তিবাদী করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাই তিনি আমাদের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। যারা যতীন সরকারের প্রকৃত গুণের খবর রাখেন তারা তার প্রতি মোহাবিষ্ট হবেন_ এটিই স্বাভাবিক। আর যারা কাছে থেকেও তার গুণের খবর রাখেন না তারা বড় হতভাগা। অতি সহজেই তার সঙ্গে মেশা যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কি ছাত্র, কি শিক্ষক_ সবাই বন্ধু তার। নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের নাক উঁচা স্বভাবের বিপরীতধর্মী তিনি। তার বাসায় গেলে আপ্যায়নে যেমন তিনি ব্যস্ত হন তেমনি তার সদ্য প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত লেখা পাঠ করে শোনানোর জন্যও ব্যগ্র হয়ে ওঠেন।
মননশীল লেখক তিনি। অসুস্থ শরীরে একের পর এক লিখে চলেছেন। এটি তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা। অধ্যয়নে কোনো ক্লান্তি নেই। যেমন পড়ছেন তেমনি লিখছেন। সংগঠন করেছেন। গড়েছেনও। ময়মনসিংহ উদীচীর 'মুক্তবাতায়ন' তার নিজস্ব চিন্তার ফল। তিনি ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা যাওয়ার পরও ধরে রেখেছিলেন এ পাঠচক্রটি। প্রধান আলোচক থাকতেন তিনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলতেন সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। এক-একটা অনুষ্ঠান হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারের মতো।
আশা-নিরাশার দোলাচলে তিনি দোলেন না। তাই তিনি সমাজের মানুষকে তার কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে তোলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানে তিনি অনস্বীকার্য। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখের পথে চলছেন স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে। ছোট গণ্ডি থেকে বৃহৎ গণ্ডির দিকে যাওয়ার যে শিক্ষার লক্ষ্য তা তিনি নিজ জীবনে যেমন গ্রহণ করেছেন তেমনি অন্যের জীবনেও গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। নারী-পুরুষের ব্যবধান ঘোচানো, অসাল্ফপ্রদায়িক সমাজ গঠনের জন্য তার বক্তব্য যুগোপযোগী। ক্লাসরুম থেকে বটতলা কিংবা টাউন হল থেকে পাবলিক হলে বক্তব্যে বক্তব্যে জনগণকে জাগিয়ে তোলেন তিনি। তিনি যখন রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কে বলেন, 'বৈজ্ঞনিক আস্তিকতা ছিল তার সত্তার গভীরে প্রোথিত। তাই সংশয় ও হতাশা কখনও তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি দুঃখে অনুদ্বিগ্ন ও সুখে বিগতস্পৃহ।' এ বক্তব্য তার বেলাতেও শতভাগ প্রযোজ্য। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সংগঠক ছিলেন ভারতের মেঘালয়ে। দুইবার তিনি উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হয়ে প্রমাণ করেছেন মফস্বলে থাকলেও যোগ্যতায় তিনি কারও চেয়ে কম নন। তিনি বিদেশে গিয়েছেন। সেখানে উদীচীর পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বিরল সম্মান বহন করে এনেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিখণ্ডিত হলেও তিনি তার বিশ্বাসে অটুট ছিলেন। পাভলবীয় মনস্তত্ত্ব এবং মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের উদৃব্দতি তুলে ধরে নিরাশাবাদীদের মনে আশা জাগিয়ে তুলেছেন। তার বিচরণ পরিধি গাছতলা থেকে যেমন পাঁচতলা, বস্তি থেকে তেমনি নগর পর্যন্ত বিস্তৃত। শিক্ষক-কেরানি থেকে আমলা-মন্ত্রী যেখানেই তিনি মুখ খুলেছেন সেখানেই তার বাগ্মীগুণ জ্বলে উঠেছে। তিনি আসলে আপামর মানুষের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকের শিক্ষক। এ জন্য যারা তাকে গণশিক্ষক বলেন তারা মোটেও ভুল বলেন না। তার স্বাধীনতা পদক পাওয়ার ক্ষেত্রেও গণশিক্ষাদানের ভূমিকা ছিল। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি প্রকৃতির শিক্ষা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কারকে স্ববিরোধিতায় গুলিয়ে ফেলেন না। তার পঁচাত্তরের অসুস্থ শরীরেও নিরলস পাঠ গ্রহণ আমাদের বিস্মিত করে। বিস্মিত করে, তার সুললিত বক্তব্যের সফল দিকনির্দেশনা।

স্বপন ধর : ছড়াকার
 

No comments

Powered by Blogger.