সংসদে বিরোধী দল-মন্দ ট্রাডিশনই চলবে?
দীর্ঘ এক বছর পর বিরোধী দলের সংসদে ফিরে যাওয়াকে আমরা স্বাগত জানাই। তারা সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে রোববার থেকে অধিবেশন কক্ষে হাজির হয়েছেন, নাকি জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা এবং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তুলে ধরার জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট হতে হয়তোবা দু'চারদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, জনগণ যা চায় সেটা দেখতে পায়নি। বরং যা তাদের আদৌ কাম্য নয়, সেটাই ঘটেছে এবং সেটা টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্যও হয়েছে অনেকের। প্রথমদিন অধিবেশনে কয়েকজন সংসদ সদস্য অশালীন ভাষা ব্যবহার করে বক্তব্য রেখেছেন, এমনকি একজন নারী সদস্য প্রতিপক্ষের একজনের আসনের দিকে তেড়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় দিনেও একই চিত্র_ একাধিক সদস্যের ভাণ্ডারে কেবলই কুরুচিপূর্ণ শব্দ। সংসদীয় গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরা প্রতিপক্ষের সমালোচনা করেন, কখনও কখনও তাতে থাকে হুল ফোটানো তীব্র যন্ত্রণা। এর জবাব দেওয়ার জন্য অন্যরা মুহূর্তে নিজের বাক্য-তূণ শানিত করে তোলেন। বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা গুণে সেটা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৯১ সাল থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের যে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা সূচিত হয়েছে তাতে বিরোধী পক্ষ বেশিরভাগ কার্যদিবসে সংসদে হাজিরই থাকে না। আর যখন বা কালেভদ্রে থাকে, সহনশীলতা যেন পালিয়ে বাঁচে। কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, অশালীন আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি সমানে চলতে থাকে। এ জন্য পরস্পরকে দায়ী করা হয়, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পাল্টানোর আন্তরিক চেষ্টা থাকে না। পরিণতিতে সংসদে দুর্বল পক্ষ ওয়াক আউট, যা সচরাচর দীর্ঘস্থায়ী হয়। দুই পক্ষের নেতারাই স্বীকার করেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এমন পরিস্থিতি শুভ নয়। কিন্তু 'সেই ট্রাডিশনই সমানে চলিতেছে...।' রোববার কয়েকজন সদস্য অসংসদীয় ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন এবং পরে স্পিকার তা এক্সপাঞ্জ করেছেন। কিন্তু সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ তা সরাসরি বেতার-টিভিতে শুনছেন। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে জনগণের কেমন ধারণা তৈরি হয়, সেটা সহজেই বোধগম্য। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে সমকাল এবং অন্যান্য সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য ও কলামে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয় তরফের কিছুসংখ্যক সদস্য যেন পণ করে আছেন_ একটুও বদলাবেন না তারা। এ থেকে এমন সংশয়ও কিন্তু হতে পারে যে, সরকার ও বিরোধী পক্ষে এমন প্রভাবশালী একটি মহল সক্রিয় যারা সংসদকে সক্রিয় দেখতে চায় না, সব পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চা ও অনুশীলনে তাদের প্রবল অনীহা। এমন ধারণা অমূলক হলেই ভালো। সংসদে দুই পক্ষ হাজির থাকলেই যা ঘটে, সেটা প্রত্যাশিত নয় এবং এর অবসানে কার্যকর উদ্যোগ চাই। আমরা শুভবুদ্ধির জন্য প্রত্যাশা করে চলেছি। কিন্তু সেটা যেহেতু ঘটছে না, সে কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চাই আরও কিছু সক্রিয় তৎপরতা। নইলে দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মুক্তি মিলবে না।
No comments