প্রতিক্রিয়া-পাকিস্তানের ব্যাপারে আমাদের দায়দায়িত্ব আছে by শান্তনু মজুমদার
গত ১৭ মে আনিসুল হকের ‘হাজার শোকর, আমরা পাকিস্তানি নই’ এবং ২১ মে সোহরাব হাসানের ‘বাংলাদেশ-বিদ্বেষী কাদির খান ও পাকিস্তানের পরবর্তী অভ্যুত্থান’ শীর্ষক লেখা দুটিতে পাকিস্তানের পাক থেকে আমরা মুক্ত হতে পারায় যথার্থভাবেই শোকর প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৭১-এ ওরা, শামসুর রাহমানের ভাষায়, ‘আমাদের বুকের ভেতর ভয়ানক
কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে; মগজের কোষে কোষে পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনের লাশ। ওরা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে’। রাহমান নেকড়ের চেয়ে অধিক সেই পশুদের অভিশাপ দিয়েছেন। আর হক ও হাসান ওদের থেকে দূরে থাকতে পারায় শোকর প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, হিংস্র, ব্যর্থ, নিমজ্জমান পাকিস্তান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারাটাই সব নয়।
প্রথম কথা, পাকিস্তান এই উপমহাদেশেই অবস্থিত এবং আমাদের প্রতিবেশী। এই রাষ্ট্রটিতে অরাজকতা অব্যাহত থাকলে তার প্রভাব থেকে আমরা একেবারে মুক্ত থাকব, তা ভাবার অবকাশ নেই। আর ভ্রূণাবস্থা থেকেই মিথ্যা ও ভুলে ভরপুর পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করার নীতির মধ্যে আমাদের কোনো লাভও নেই। একে যত দূরে ঠেলে দেওয়া হবে ততই এটি আরও অজানা, আরও অচেনা এক ঝুঁকিতে পরিণত হতে থাকবে। সেনায়িত সমাজ, ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিশেষ এজেন্সি, পারমাণবিক বোমাগুলোর সুস্থ-নিরাপদ হাতে থাকার ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হতে থাকা ভয়াবহ পাকিস্তান থেকে ‘এক শ হাত দূরে থাকুন’ পলিসি নিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। সন্দেহ নেই, ওরা আমাদের সঙ্গে একাত্তরে যা করেছে এবং এখন পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা না করে, আমাদের সম্পদ ফিরিয়ে না দিয়ে যে ধরনের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে চলেছে, তার পরও ওদের মন থেকে বুকে টেনে নেওয়াটা ভ্রান্ত ‘দ্বিজাতিতত্ত্বপ্রেমী’ লোকজন ছাড়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তান নামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকে দেখতে হবে মানসিক ভারসাম্যহীন-বিকারগ্রস্ত-অচল একজন রোগীর মতো করে। এটি থেকে দূরে থাকা নয়, এটিকে পরিত্যাগ করা নয়, বরং এই ব্যবস্থাটিকে সারিয়ে তোলা, সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তার মহত্ত্বের প্রমাণ দিতে পারে এবং নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে।
সার্ক অঞ্চলের বাস্তবতা বিবেচনায় ধরলেও বাংলাদেশেরই উচিত পাকিস্তানকে সারিয়ে তোলায় অগ্রসর হওয়া। পাকিস্তানের জন্মবৈরী ভারতের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। কেননা বিশ্ব-মুরব্বিদের সঙ্গে অধুনা ব্যাপক দোস্তালির সুবাদে সুবিধাজনক পর্যায়ে থাকলেও কাশ্মীর বা মাওবাদী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন, দরিদ্র সাধারণ মানুষের পরিবর্তে করপোরেট-মাল্টিন্যাশনালের জন্য সেবাদানে ক্রমশ উন্মুক্ত হয়ে ওঠা ভারতের নিজের রেকর্ড প্রকৃত বিচারে খুব একটা সুবিধাজনক নয়; আর পরস্পরের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তানের ঘোরতর সন্দেহের কথা বলাই বাহুল্য। আফগানিস্তানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক বর্তমানে খুব খারাপ। আর পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশীকে সারিয়ে তোলার প্রয়াস নেওয়ার যোগ্যতা আফগানিস্তানের কোনো অর্থেই নেই। শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানের ভালো বন্ধু হলেও এসব ঝামেলায় যাবে না; যেতে চাইলেও খুব একটা কলকে পাবে বলে মনে হয় না। অন্য প্রতিবেশীরাও পাকিস্তান-প্রবলেমের সুরাহায় বড় কোনো ভূমিকা পালনের মতো অবস্থায় নেই। রইল বাকি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কি ধোয়া তুলসী পাতা? একেবারেই নয়। তবে পাকিস্তানের রোগ সারাইয়ে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে—এই হচ্ছে কথা। কারণ এই দেশটিকে বাংলাদেশ হাড়ে হাড়ে চেনে। এর জন্মবৃত্তান্ত, সমস্যার ইতিবৃত্ত বাংলাদেশের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বাংলাদেশ জানে, সাতচল্লিশে কীভাবে উদার রাজনীতি ও রাজনীতিকের মুণ্ডপাতের মধ্য দিয়ে দেশটির যাত্রা শুরু হয়, কীভাবে যাত্রা শুরুর কিছু দিন যেতে না-যেতে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সেনাতন্ত্রকে সম্মানের সঙ্গে বিশেষ জায়গা করে দেওয়া হয়। আর রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহার? সে তো জন্মের আগে থেকেই। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর—বাঙালি এসব দেখেছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে এই প্রতিটি অজ্ঞজনোচিত সিদ্ধান্ত জন্ম থেকে পাকিস্তানকে কুরে কুরে খাচ্ছে; এখন একেবারে শেষ করে দেওয়ার উপক্রম করেছে।
পাকিস্তানের অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশ কী করতে পারে? প্রথম কথা হচ্ছে, সাধারণ পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আলাদা কিন্তু বিস্তারিত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশেষত বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্তের ব্যাপারে জনগণকে পিলে চমকে দেওয়ার মতো মিথ্যায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এটা ভাঙতে হবে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সমাজে রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতা আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। খালি রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পাকিস্তান আজ যে পাকে প্রায় নিমজ্জিত, সেই পাকের জন্য পাকিস্তানি সমাজের অভ্যন্তরে প্রেম আছে। ভাবতে দোষ কী যে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরের সত্যি কাহিনিগুলো অনবরত অবগত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সমাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্র—যা তারা দেখেনি কখনো, তার জন্য আকুতি তৈরি হবে ভেতর থেকে। ব্যাধি-নিরাময় প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পাকিস্তানিদের আরও জানানো যায় আমাদের একাত্তর-পরবর্তী গণ-আন্দোলনের ইতিহাস—সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, নির্বাচিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক অতীতে পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের আন্দোলনের কথা বাদ দিলে নাগরিক সমাজের অতি-উজ্জ্বল ভূমিকাসম্পন্ন গণ-আন্দোলন, যা কিনা বলা চলে উদারনৈতিক নামে পরিচিত পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণভোমরা, পাকিস্তানে কোথায়? অথচ এটা বাংলাদেশের জন্য নিয়মিত বিরতিতে সংঘটিত হতে থাকা একটি শুভ প্রবণতা। আলোচ্য ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য পাকিস্তানের ইংরেজি মিডিয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়া, পাকিস্তানিদের ইংরেজি ভাষার ব্লগগুলোতে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রকাশ্য রেখে সক্রিয় হওয়ার কথা ভাবা যায়।
আরেকটা কাজ করা দরকার। প্রবাসী-অভিবাসী বাঙালিরা এটা করতে পারেন খুব ভালোভাবে। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে বাতচিতের সময় বড়ভাইসুলভ ভাব দেখায়; এ ছাড়া তারা উর্দু জবান ব্যবহার করে। পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের এতে খুব আহ্লাদ হয়। আর অন্যরা, দেশের বাইরে একাধিক জায়গায় দেখেছি, নিতান্ত ভদ্রতাবশত এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সামনাসামনি কিছু বলেন না। অবস্থাটা পাল্টাতে হবে। পাকিস্তানিদের স্পষ্ট করে সামনাসামনি বলতে হবে যে বাঙালির সঙ্গে উর্দুতে নয়, পারলে বাংলায়, না পারলে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। মনে করিয়ে দিতে হবে যে অর্জনের দিক থেকে কিংবা বিশ্ব-পর্যায়ে ব্র্যান্ডিংয়ের দিক থেকে নিজেকে বড় ভাই ভাবার চার আনা যোগ্যতা নেই পাকিস্তানের। এ কথা শুনে প্রথম প্রথম ওদের অনেকে তেড়ে আসতে পারে। তবে সেটিও দেখতে হবে পাকিস্তানের জাতীয় জীবনকে আক্রান্ত করা রোগের প্রকোপ হিসেবে। রোগীকে ভালো করে তোলার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন একজন দক্ষ সার্জনের মতো দৃঢ়তার সঙ্গে, স্থিরতার সঙ্গে বোঝানো হলে পাকিস্তানিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
পাকিস্তানের সুস্থতায় সহায়তাদানে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবাধিকার সংগঠনগুলোও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বছরব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডে বেশি করে পাকিস্তানি মানুষজনকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। আসমা জাহাঙ্গীর, হামিদ মিরের মতো হাতেগোনা যে কয়জন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির নাম সারা দুনিয়া জানে, শুধু তাঁরা নন, সুযোগ উন্মুক্ত করুন সাধারণ পাকিস্তানিদের জন্য। তারা নিয়মিত আসুক, থাকুক সুস্থতার সংস্পর্শে। জেনে যাক যে বোমা খাওয়া ছাড়া নামাজ পড়া যায়, কবিতা শোনা যায়। জাতীয় কবিতা পরিষদের বার্ষিক উৎসবে আসুক না কেন, বেলুচিস্তান কি সিন্ধুর মফস্বলের অখ্যাত জনা কয় কবি? রাষ্ট্র-নির্মাতাদের আদি পাপে জর্জরিত প্রায় ১৮ কোটি মানুষে সমৃদ্ধ পাকিস্তান সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের দায়িত্বের পেছনে আরও একটা কারণ আছে। ইতিহাসের বই খুলে বসি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিমসহ আরও সব নাম। পাকিস্তান নামের বিশ্বের জন্য অধুনা অতি বিপজ্জনক ব্যবস্থাটি জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি নেতৃত্বের বিশাল ভূমিকা কে পারে ভুলে যেতে?
এখন ডুবতে বসেছে বলে বসে বসে পাকিস্তান নামের দেশটির ডুবে যেতে দেখাটা মানবিক নয়, আর আমাদের জন্য বা পুরো অঞ্চলের শান্তি-স্থিতিশীলতার স্বার্থানুকূল নয়। মানবিকতা হোক আর স্বার্থের ব্যাপার হোক, তা নিহিত আছে জন্ম থেকে অসুস্থ পাকিস্তানকে সুস্থ করে তোলার মধ্যে। আর বাংলাদেশ যদি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা হবে আনন্দের।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম কথা, পাকিস্তান এই উপমহাদেশেই অবস্থিত এবং আমাদের প্রতিবেশী। এই রাষ্ট্রটিতে অরাজকতা অব্যাহত থাকলে তার প্রভাব থেকে আমরা একেবারে মুক্ত থাকব, তা ভাবার অবকাশ নেই। আর ভ্রূণাবস্থা থেকেই মিথ্যা ও ভুলে ভরপুর পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করার নীতির মধ্যে আমাদের কোনো লাভও নেই। একে যত দূরে ঠেলে দেওয়া হবে ততই এটি আরও অজানা, আরও অচেনা এক ঝুঁকিতে পরিণত হতে থাকবে। সেনায়িত সমাজ, ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের বিশেষ এজেন্সি, পারমাণবিক বোমাগুলোর সুস্থ-নিরাপদ হাতে থাকার ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হতে থাকা ভয়াবহ পাকিস্তান থেকে ‘এক শ হাত দূরে থাকুন’ পলিসি নিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। সন্দেহ নেই, ওরা আমাদের সঙ্গে একাত্তরে যা করেছে এবং এখন পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা না করে, আমাদের সম্পদ ফিরিয়ে না দিয়ে যে ধরনের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে চলেছে, তার পরও ওদের মন থেকে বুকে টেনে নেওয়াটা ভ্রান্ত ‘দ্বিজাতিতত্ত্বপ্রেমী’ লোকজন ছাড়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তান নামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকে দেখতে হবে মানসিক ভারসাম্যহীন-বিকারগ্রস্ত-অচল একজন রোগীর মতো করে। এটি থেকে দূরে থাকা নয়, এটিকে পরিত্যাগ করা নয়, বরং এই ব্যবস্থাটিকে সারিয়ে তোলা, সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তার মহত্ত্বের প্রমাণ দিতে পারে এবং নিজ স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে।
সার্ক অঞ্চলের বাস্তবতা বিবেচনায় ধরলেও বাংলাদেশেরই উচিত পাকিস্তানকে সারিয়ে তোলায় অগ্রসর হওয়া। পাকিস্তানের জন্মবৈরী ভারতের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। কেননা বিশ্ব-মুরব্বিদের সঙ্গে অধুনা ব্যাপক দোস্তালির সুবাদে সুবিধাজনক পর্যায়ে থাকলেও কাশ্মীর বা মাওবাদী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন, দরিদ্র সাধারণ মানুষের পরিবর্তে করপোরেট-মাল্টিন্যাশনালের জন্য সেবাদানে ক্রমশ উন্মুক্ত হয়ে ওঠা ভারতের নিজের রেকর্ড প্রকৃত বিচারে খুব একটা সুবিধাজনক নয়; আর পরস্পরের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তানের ঘোরতর সন্দেহের কথা বলাই বাহুল্য। আফগানিস্তানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক বর্তমানে খুব খারাপ। আর পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশীকে সারিয়ে তোলার প্রয়াস নেওয়ার যোগ্যতা আফগানিস্তানের কোনো অর্থেই নেই। শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানের ভালো বন্ধু হলেও এসব ঝামেলায় যাবে না; যেতে চাইলেও খুব একটা কলকে পাবে বলে মনে হয় না। অন্য প্রতিবেশীরাও পাকিস্তান-প্রবলেমের সুরাহায় বড় কোনো ভূমিকা পালনের মতো অবস্থায় নেই। রইল বাকি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কি ধোয়া তুলসী পাতা? একেবারেই নয়। তবে পাকিস্তানের রোগ সারাইয়ে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে—এই হচ্ছে কথা। কারণ এই দেশটিকে বাংলাদেশ হাড়ে হাড়ে চেনে। এর জন্মবৃত্তান্ত, সমস্যার ইতিবৃত্ত বাংলাদেশের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বাংলাদেশ জানে, সাতচল্লিশে কীভাবে উদার রাজনীতি ও রাজনীতিকের মুণ্ডপাতের মধ্য দিয়ে দেশটির যাত্রা শুরু হয়, কীভাবে যাত্রা শুরুর কিছু দিন যেতে না-যেতে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সেনাতন্ত্রকে সম্মানের সঙ্গে বিশেষ জায়গা করে দেওয়া হয়। আর রাষ্ট্রকর্মে ধর্মের ব্যবহার? সে তো জন্মের আগে থেকেই। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর—বাঙালি এসব দেখেছে। লক্ষ করলেই দেখা যাবে যে এই প্রতিটি অজ্ঞজনোচিত সিদ্ধান্ত জন্ম থেকে পাকিস্তানকে কুরে কুরে খাচ্ছে; এখন একেবারে শেষ করে দেওয়ার উপক্রম করেছে।
পাকিস্তানের অস্তিত্বের সংকটে বাংলাদেশ কী করতে পারে? প্রথম কথা হচ্ছে, সাধারণ পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে আলাদা কিন্তু বিস্তারিত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশেষত বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্তের ব্যাপারে জনগণকে পিলে চমকে দেওয়ার মতো মিথ্যায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এটা ভাঙতে হবে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সমাজে রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতা আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। খালি রাষ্ট্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পাকিস্তান আজ যে পাকে প্রায় নিমজ্জিত, সেই পাকের জন্য পাকিস্তানি সমাজের অভ্যন্তরে প্রেম আছে। ভাবতে দোষ কী যে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরের সত্যি কাহিনিগুলো অনবরত অবগত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সমাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্র—যা তারা দেখেনি কখনো, তার জন্য আকুতি তৈরি হবে ভেতর থেকে। ব্যাধি-নিরাময় প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পাকিস্তানিদের আরও জানানো যায় আমাদের একাত্তর-পরবর্তী গণ-আন্দোলনের ইতিহাস—সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, নির্বাচিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক অতীতে পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের আন্দোলনের কথা বাদ দিলে নাগরিক সমাজের অতি-উজ্জ্বল ভূমিকাসম্পন্ন গণ-আন্দোলন, যা কিনা বলা চলে উদারনৈতিক নামে পরিচিত পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাণভোমরা, পাকিস্তানে কোথায়? অথচ এটা বাংলাদেশের জন্য নিয়মিত বিরতিতে সংঘটিত হতে থাকা একটি শুভ প্রবণতা। আলোচ্য ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য পাকিস্তানের ইংরেজি মিডিয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়া, পাকিস্তানিদের ইংরেজি ভাষার ব্লগগুলোতে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রকাশ্য রেখে সক্রিয় হওয়ার কথা ভাবা যায়।
আরেকটা কাজ করা দরকার। প্রবাসী-অভিবাসী বাঙালিরা এটা করতে পারেন খুব ভালোভাবে। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে বাতচিতের সময় বড়ভাইসুলভ ভাব দেখায়; এ ছাড়া তারা উর্দু জবান ব্যবহার করে। পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের এতে খুব আহ্লাদ হয়। আর অন্যরা, দেশের বাইরে একাধিক জায়গায় দেখেছি, নিতান্ত ভদ্রতাবশত এই ব্যাপারগুলো নিয়ে সামনাসামনি কিছু বলেন না। অবস্থাটা পাল্টাতে হবে। পাকিস্তানিদের স্পষ্ট করে সামনাসামনি বলতে হবে যে বাঙালির সঙ্গে উর্দুতে নয়, পারলে বাংলায়, না পারলে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। মনে করিয়ে দিতে হবে যে অর্জনের দিক থেকে কিংবা বিশ্ব-পর্যায়ে ব্র্যান্ডিংয়ের দিক থেকে নিজেকে বড় ভাই ভাবার চার আনা যোগ্যতা নেই পাকিস্তানের। এ কথা শুনে প্রথম প্রথম ওদের অনেকে তেড়ে আসতে পারে। তবে সেটিও দেখতে হবে পাকিস্তানের জাতীয় জীবনকে আক্রান্ত করা রোগের প্রকোপ হিসেবে। রোগীকে ভালো করে তোলার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন একজন দক্ষ সার্জনের মতো দৃঢ়তার সঙ্গে, স্থিরতার সঙ্গে বোঝানো হলে পাকিস্তানিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
পাকিস্তানের সুস্থতায় সহায়তাদানে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মানবাধিকার সংগঠনগুলোও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। বছরব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডে বেশি করে পাকিস্তানি মানুষজনকে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। আসমা জাহাঙ্গীর, হামিদ মিরের মতো হাতেগোনা যে কয়জন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির নাম সারা দুনিয়া জানে, শুধু তাঁরা নন, সুযোগ উন্মুক্ত করুন সাধারণ পাকিস্তানিদের জন্য। তারা নিয়মিত আসুক, থাকুক সুস্থতার সংস্পর্শে। জেনে যাক যে বোমা খাওয়া ছাড়া নামাজ পড়া যায়, কবিতা শোনা যায়। জাতীয় কবিতা পরিষদের বার্ষিক উৎসবে আসুক না কেন, বেলুচিস্তান কি সিন্ধুর মফস্বলের অখ্যাত জনা কয় কবি? রাষ্ট্র-নির্মাতাদের আদি পাপে জর্জরিত প্রায় ১৮ কোটি মানুষে সমৃদ্ধ পাকিস্তান সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে বাংলাদেশের দায়িত্বের পেছনে আরও একটা কারণ আছে। ইতিহাসের বই খুলে বসি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিমসহ আরও সব নাম। পাকিস্তান নামের বিশ্বের জন্য অধুনা অতি বিপজ্জনক ব্যবস্থাটি জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি নেতৃত্বের বিশাল ভূমিকা কে পারে ভুলে যেতে?
এখন ডুবতে বসেছে বলে বসে বসে পাকিস্তান নামের দেশটির ডুবে যেতে দেখাটা মানবিক নয়, আর আমাদের জন্য বা পুরো অঞ্চলের শান্তি-স্থিতিশীলতার স্বার্থানুকূল নয়। মানবিকতা হোক আর স্বার্থের ব্যাপার হোক, তা নিহিত আছে জন্ম থেকে অসুস্থ পাকিস্তানকে সুস্থ করে তোলার মধ্যে। আর বাংলাদেশ যদি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা হবে আনন্দের।
শান্তনু মজুমদার: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments