সমসময়-ভারতের দুর্নীতিগ্রস্ত বর্তমান শাসকদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করা ঠিক হবে কি? by আতাউস সামাদ
আসমুদ্রহিমাচল। দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা থেকে উত্তরে কাশ্মীর। বিশাল এই ভূখণ্ডজুড়ে আমাদের প্রতিবেশী ভারত। বিশালত্ব ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্বে জ্ঞানেগুণে ভারতের অবস্থান সুউচ্চে। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দর্শনের ধারায় প্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ভারতের অর্জন সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র দেশ ভারত। দেশটির ১২১ কোটি ২ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৭১ কোটি ৭০ লাখ ভোটার। ভারতের ভোটারের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ক'টির সব ভোটারের যোগফলের চেয়ে বেশি। সূত্র ইন্টারনেট। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে খোলামেলা ও নিয়মিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে পাশ্চাত্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ও গণমাধ্যম জগৎগুলোতে ভারত খুব প্রশংসা কুড়াচ্ছিল, যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছিলেন যে, বিশ্বে সবচেয়ে গরিব লোক এ দেশটিতে থাকে সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই হুশিয়ারিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি যারা দুনিয়াকে শাসায় বা মনে করে চালায় এমন লোকেরা। ফলে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীও ভারতের শাসক ও ধনীদের খুশি করতে এবং তাদের পথে চলতে, বলতে গেলে দৃষ্টিকটুভাবেই অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা আমাদের একটু ক্ষান্ত দিলে ভালো হয়। কারণ, ভারতে হিমলায়তুল্য দুর্নীতি নিয়ে এখন একটা টালমাটাল অবস্থা চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফর নিয়ে বাংলাদেশে একটা হাইপ বা হৈচৈ (এমনকি ব্যগ্রতা) সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু কোথা থেকে আন্না হাজারে নামে এক বৃদ্ধ এসে সবার নজর কেড়ে নিলেন। তার দ্বন্দ্বটা যে এখন ডা. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গেও। ভারতে দুর্নীতিবিরোধীদের কপালে সাধারণত নিগ্রহ এবং পতনই জুটে থাকে। প্রাণও যায়। তবে সে কথা নিয়ে আর কিছু বলার আগে ভারতে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয় তার সামান্য একটু নেওয়া যাক। মাস কয়েক আগে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকগুলোতে বিদেশিদের যে গোপন অ্যাকাউন্ট আছে তিনি তার বিবরণ পেয়েছেন। এর মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা সর্বাধিক। আর তাদের যে পরিমাণ অর্থ এভাবে জমা আছে তা ভারতে ফেরত গেলে তার ওপর যে কর আরোপিত হবে শুধু সেই আয় দিয়েই ভারত সরকার তার এক বছরের বাজেটের অর্থায়ন করতে পারবে (অর্থাৎ ভারত সরকার এক বছর কোনো ট্যাক্স আদায় না করলেও তাদের চলে যাবে)। গত ১৬ আগস্ট ঢাকার আমার দেশ পত্রিকা ভারত ও বিদেশের বিভিন্ন সূত্র এবং প্রকাশনা থেকে সংগ্রহ করে যে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে আছে যে, মানি লন্ডারিং করে কেবল সুইস ব্যাংকগুলোতে ভারতীয় দুর্নীতিবাজরা যে অর্থ গচ্ছিত রেখেছে তার অঙ্ক হচ্ছে এক হাজার চারশ' ছাপ্পান্ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার [১ বিলিয়ন=১০০ কোটি]। এখানে উল্লেখ করা উচিত, পাচার করা টাকার মোট পরিমাণ কত সুইস ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন সেটা মোটামুটি জানিয়ে দিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সে হিসাব আমলে নিয়েছেন। এদিকে জার্মান সরকারও তার দেশে ভারতীয়দের রাখা টাকার হিসাব ভারত সরকারকে জানিয়েছে। তারা এসব অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে ২৫ জনের নাম ভারত সরকারকে দিয়েছে। ভারত সরকার অনেক তাগিদের পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টকে সেই নামগুলো দিয়েছে; কিন্তু ড. মনমোহন সিং আদালতকে সেগুলো প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন এই বলে যে, তাহলে জার্মান সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করা হবে।
ইতিমধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে, বিদেশে কালো টাকার অধিকারী ভারতীয়দের মধ্যে সবাই যে ব্যবসায়ী তা নয়, তাদের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক আমলারা আছেন এবং আরও আছেন অনেক রাজনীতিবিদ। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকেই ভারতে গুজব ছিল, ভারতীয় কংগ্রেস বিদেশে তহবিল গড়ে রেখেছে সাধারণ নির্বাচনে কাজে লাগানোর জন্য।
এখন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ভারতীয় অর্থ পাচারকারীদের নাম প্রকাশিত হতে না দিতে_ তার ফলে ভারতেরই জনগণের মনে সন্দেহ জেগেছে যে, তিনি নিজেই দুর্নীতিমুক্ত নন, তার দল কংগ্রেস তো নয়ই। এই যে সমাজসেবার জন্য রাষ্ট্রীয় উচ্চ সম্মান (পদ্মভূষণ) অর্জনকারী আন্না হাজারে দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোর আইন করার দাবিতে দ্বিতীয় দফা অনশন শুরু করতে গেলেই তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তার ফলে মনমোহন সিংয়ের সরকারের দুর্নীতিপরায়ণতার সন্দেহ দৃঢ়তর হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় দেওয়া ভাষণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্বীকার করে নেন যে, দুর্নীতি এখন ভারতের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। সরকার এটা দূর করার ব্যবস্থা নিচ্ছে ও নেবে, তবে সময় লাগবে। তিনি এই সঙ্গে বলেন যে, অনশন করে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। তার বক্তৃতার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে, অনশন-প্রতিবাদ করে যদি দুর্নীতি বন্ধ না-ই করা যাবে, তাহলে অনশনকারীদের জেলে পাঠানো কেন? হতে পারে ড. মনমোহন সিং যদি দুর্নীতিগ্রস্ত না-ও হন তবুও তিনি দুর্নীতিবাজদের হাতে বন্দি। তাদের বিরুদ্ধে গেলে তিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবেন, যেমন অর্থমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল আরেক মিস্টার ক্লিন ভিপি সিংকে। রাজীব গান্ধীর বন্ধু ভিপি সিং আয়কর ফাঁকিদাতাদের ধরতে গিয়ে যাদের অফিসে বা বাড়িতে কর কর্মকর্তাদের অভিযান চালাতে দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন ধীরুভাই আম্বানী এবং অমিতাভ বচ্চন (সূত্র : ইন্টারনেট)। আগে কিছু শিল্পপতি ছিলেন। তাদের চাপে ভিপি সিংকে বিসর্জন দেন রাজীব গান্ধী। শেষ পর্যন্ত রাজীবকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে অভিহিত হতে হয়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিল এ জন্য। এখন আন্না হাজারের গ্রেফতারের পর ভারতজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে মনমোহন সিং সরকারের বিরুদ্ধে। এখানে বাংলাদেশি হিসেবে আমাদেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনার আছে বলে মনে করি। আমাদের দেশটাকে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের অধীন করে দেওয়ার কাজে জগৎশেঠ (যার অর্থ বিশ্বজয়ী ব্যবসায়ী) নামে এক ব্যবসায়ীর ভূমিকা ছিল। ভারতের ধনিক-বণিক সমাজে জগৎশেঠ-জাতীয় দুর্বৃত্ত আছে বহু। ভারতের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রে ব্রিটিশ-চরিত্র অনুসারী আধিপত্যবাদী বর্তমান ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করতেই আমাদের সাবধান থাকা অতি প্রয়োজন। এদিক থেকে আমার মনে হয়, ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তিটি এখন না করা উচিত। আর এই ট্রানজিট তো বিশেষ ধরনের এক দেশের এক জায়গা থেকে সেই দেশেরই আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য। কুচক্রী দুর্নীতিপরায়ণরা এমন একটা চুক্তিকে আমাদের পথঘাট দখলে রাখার তথা আমাদের সার্বভৌমত্ব হরণ করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে কি-না বা করতে পারবে কি-না সেই বিষয়টি খুবই ভালোভাবে পরখ করার দরকার আগে। এ ব্যাপারে জনমত যাচাইও প্রয়োজন। আমাদের সরকারকে অনুরোধ, ট্রানজিট নিয়ে তাড়াহুড়া করবেন না। আর এখন পর্যন্ত চুক্তির শর্তগুলো প্রকাশ করছেন না কেন? সেটা করুন। জনগণ দেখুক কাজটা ভালো হচ্ছে না খারাপ?
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ইতিমধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি মন্তব্য করেছেন যে, বিদেশে কালো টাকার অধিকারী ভারতীয়দের মধ্যে সবাই যে ব্যবসায়ী তা নয়, তাদের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক আমলারা আছেন এবং আরও আছেন অনেক রাজনীতিবিদ। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকেই ভারতে গুজব ছিল, ভারতীয় কংগ্রেস বিদেশে তহবিল গড়ে রেখেছে সাধারণ নির্বাচনে কাজে লাগানোর জন্য।
এখন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ভারতীয় অর্থ পাচারকারীদের নাম প্রকাশিত হতে না দিতে_ তার ফলে ভারতেরই জনগণের মনে সন্দেহ জেগেছে যে, তিনি নিজেই দুর্নীতিমুক্ত নন, তার দল কংগ্রেস তো নয়ই। এই যে সমাজসেবার জন্য রাষ্ট্রীয় উচ্চ সম্মান (পদ্মভূষণ) অর্জনকারী আন্না হাজারে দুর্নীতি দমনের জন্য কঠোর আইন করার দাবিতে দ্বিতীয় দফা অনশন শুরু করতে গেলেই তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তার ফলে মনমোহন সিংয়ের সরকারের দুর্নীতিপরায়ণতার সন্দেহ দৃঢ়তর হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় দেওয়া ভাষণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্বীকার করে নেন যে, দুর্নীতি এখন ভারতের উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা। সরকার এটা দূর করার ব্যবস্থা নিচ্ছে ও নেবে, তবে সময় লাগবে। তিনি এই সঙ্গে বলেন যে, অনশন করে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। তার বক্তৃতার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে, অনশন-প্রতিবাদ করে যদি দুর্নীতি বন্ধ না-ই করা যাবে, তাহলে অনশনকারীদের জেলে পাঠানো কেন? হতে পারে ড. মনমোহন সিং যদি দুর্নীতিগ্রস্ত না-ও হন তবুও তিনি দুর্নীতিবাজদের হাতে বন্দি। তাদের বিরুদ্ধে গেলে তিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবেন, যেমন অর্থমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল আরেক মিস্টার ক্লিন ভিপি সিংকে। রাজীব গান্ধীর বন্ধু ভিপি সিং আয়কর ফাঁকিদাতাদের ধরতে গিয়ে যাদের অফিসে বা বাড়িতে কর কর্মকর্তাদের অভিযান চালাতে দিয়েছিলেন তার মধ্যে ছিলেন ধীরুভাই আম্বানী এবং অমিতাভ বচ্চন (সূত্র : ইন্টারনেট)। আগে কিছু শিল্পপতি ছিলেন। তাদের চাপে ভিপি সিংকে বিসর্জন দেন রাজীব গান্ধী। শেষ পর্যন্ত রাজীবকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে অভিহিত হতে হয়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিল এ জন্য। এখন আন্না হাজারের গ্রেফতারের পর ভারতজুড়ে আন্দোলন হচ্ছে মনমোহন সিং সরকারের বিরুদ্ধে। এখানে বাংলাদেশি হিসেবে আমাদেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনার আছে বলে মনে করি। আমাদের দেশটাকে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের অধীন করে দেওয়ার কাজে জগৎশেঠ (যার অর্থ বিশ্বজয়ী ব্যবসায়ী) নামে এক ব্যবসায়ীর ভূমিকা ছিল। ভারতের ধনিক-বণিক সমাজে জগৎশেঠ-জাতীয় দুর্বৃত্ত আছে বহু। ভারতের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রে ব্রিটিশ-চরিত্র অনুসারী আধিপত্যবাদী বর্তমান ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে যে কোনো চুক্তি করতেই আমাদের সাবধান থাকা অতি প্রয়োজন। এদিক থেকে আমার মনে হয়, ভারতের সঙ্গে প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তিটি এখন না করা উচিত। আর এই ট্রানজিট তো বিশেষ ধরনের এক দেশের এক জায়গা থেকে সেই দেশেরই আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য। কুচক্রী দুর্নীতিপরায়ণরা এমন একটা চুক্তিকে আমাদের পথঘাট দখলে রাখার তথা আমাদের সার্বভৌমত্ব হরণ করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে কি-না বা করতে পারবে কি-না সেই বিষয়টি খুবই ভালোভাবে পরখ করার দরকার আগে। এ ব্যাপারে জনমত যাচাইও প্রয়োজন। আমাদের সরকারকে অনুরোধ, ট্রানজিট নিয়ে তাড়াহুড়া করবেন না। আর এখন পর্যন্ত চুক্তির শর্তগুলো প্রকাশ করছেন না কেন? সেটা করুন। জনগণ দেখুক কাজটা ভালো হচ্ছে না খারাপ?
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments