স্মরণ-আমরা তাঁকে মনে রাখব by সৈয়দা শামসে আরা হোসেন
আমাদের সমাজে কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা ব্যক্তিজীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট না হয়ে অন্যের বিষয় নিয়ে ভাবেন। এই ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিরা জীবনের মহত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিবেদিত থাকেন। দেশ, জনগণ, সমাজের প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিদের কর্মপ্রয়াস, সচেতন মানসিকতা
আর দায়িত্ব, কর্তব্যবোধের ফলে জনগণের চলার সঠিক পথ নির্ণীত হয়। আমার এই ভাবনাগুলো প্রয়াত ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের জীবন ও কর্মকে স্মরণ করে মনে হয়েছে। সদালাপী, উদার চিত্তের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর জীবনাচরণ সাধারণ ছিল এবং সহজ আন্তরিকতায় মানুষকে গ্রহণ করতে পারতেন। তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলি তাঁকে ছাত্র আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দেলনে তাঁর ভূমিকার জন্য পরবর্তী সময় ভাষাসৈনিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সাংস্কৃতিক ও সংগীতচর্চায় ছিল গভীর আকর্ষণ। পেশায় ছিলেন আইনজীবী, তাঁর স্বভাবে ছিল স্নেহ বাৎসল্য; ব্যক্তিগত গুণাবলির কারণে জড়িয়ে ছিলেন বহুমাত্রিক কাজে, তাঁর পরিচিতির পরিসর ছিল সুবিস্তৃত। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮০ সালে। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ ঢাকার গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে কলেজে এলেন। আমি অধ্যক্ষ ছিলাম। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থাপনার নীতিনির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত কলেজ গভর্নিং বডিতে ছিলেন তিনি। কলেজের একাডেমিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিধি ও আইন অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হতো। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ শক্ত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হোক—এ বিষয়ে সবার সাহায্য-সহযোগিতার আবেদন তিনি রাখতেন। কলেজের অনুষ্ঠানগুলোয় বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রতিবার তাঁকে বলতে শুনেছি যে বিরাট আয়তন ও বিপুল জন-অধ্যুষিত রমনার মধ্যস্থলে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ মেয়েদের উচ্চশিক্ষার একমাত্র বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রমনা এলাকার পশ্চিম সীমানায় রয়েছে সরকারি ইডেন কলেজ, এলাকার বাইরে দক্ষিণে রয়েছে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, রমনার পূর্ব ও উত্তর দিকে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বেসরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজকে গড়ে তোলার প্রয়োজন সম্পর্কে সবার প্রতি আহ্বান জানাতেন।
এখন থেকে ৩০ বছর আগে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার যে পরিস্থিতি ছিল, সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরে তিনি বক্তব্য দিতেন। সে সময় মেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কয়েকটি হাতেগোনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। উচ্চশিক্ষা, ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সহশিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরের শর্ত সাপেক্ষে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ সকালের দিকে দুই ঘণ্টা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ক্লাস শুরু করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মতিয়ার রহমান কলেজ কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিউ বেইলি রোডে পাশাপাশি দুটি পৃথক প্রাঙ্গণ কলেজ প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দানের নির্দেশ দেন। একটি প্রাঙ্গণ প্রায় এক বিঘা জমি, একটি দ্বিতল ভবনসহ পাওয়ায় ২৫ এপ্রিল ১৯৭২ সালে তাৎক্ষণিক কলেজের কার্যক্রম এই জায়গায় শুরু করা হয়। কলেজের এই স্থাপনায় ক্লাস শুরুর ইতিহাস একটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত, এখানে সে বিষয় কিছু উল্লেখ করছি না। বরাদ্দপ্রাপ্ত অপর অংশটি ১ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের বিরাট প্রাঙ্গণ। ১৯৭৪ সালে নির্মাণকাজ শুরুর দিন জনৈক ব্যক্তি জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করায় জমি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
এই মামলায় নিম্ন আদালতে কলেজের পক্ষে রায় হয়। বাদীপক্ষ ১৯৮০ সালে হাইকোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। এখন থেকে ৩০ বছর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ছিল। হাইকোর্টে মামলা চালানোর আর্থিক ব্যয় বহন করার সামর্থ্য একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গভর্নিং বডির সভায় এই মামলা নিয়ে আমার অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা, অপারগতা জানাতে গাজীউল হক সাহেব এ মামলার দায়িত্বভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। হাইকোর্টের পর বাদীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। এই মামলারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন গাজীউল হক । ১৯৮২ সালের ২০ অক্টোবর কলেজ জমির মালিকানা লাভ করে। নিউ বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের ১০ তলা একাডেমিক ভবন যে উচ্চতা নিয়ে অবস্থান করছে তার এবং মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অব্যাহত সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে, তার মূলে আইনজীবী গাজীউল হকের অবদান অবিস্মরণীয়। কলেজের এই মামলা পরিচালনার জন্য তিনি কোনো অর্থ গ্রহণ করেননি। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের গভীর সংকট ও সমস্যা দূর করে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারে যে অবদান রেখেছেন, সে সম্পর্কে কোনো সময় এ পর্যন্ত উল্লেখ করার আমার সুযোগ হয়নি। ২০০৯ সালের ১৮ জুন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রয়াত ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের মরদেহ কিছু সময়ের জন্য রাখা হয়েছিল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্য। সেদিন সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনেকেই তাঁর জীবনকর্ম, অবদানকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমি অন্তিম শয়ানে শায়িত কর্মসাধক গাজীউল হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে।
আজ ১৭ জুন তাঁর পরলোকগমনের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে আমার গভীর কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করে তাঁর স্মৃতিকে স্মরণ করছি এই লেখার মাধ্যমে।
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে শিক্ষানুরাগী ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের নাম ও স্মৃতি।
সৈয়দা শামসে আরা হোসেন
সাবেক অধ্যক্ষ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা।
এখন থেকে ৩০ বছর আগে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার যে পরিস্থিতি ছিল, সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরে তিনি বক্তব্য দিতেন। সে সময় মেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কয়েকটি হাতেগোনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। উচ্চশিক্ষা, ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সহশিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরের শর্ত সাপেক্ষে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ সকালের দিকে দুই ঘণ্টা ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ক্লাস শুরু করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মতিয়ার রহমান কলেজ কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিউ বেইলি রোডে পাশাপাশি দুটি পৃথক প্রাঙ্গণ কলেজ প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দানের নির্দেশ দেন। একটি প্রাঙ্গণ প্রায় এক বিঘা জমি, একটি দ্বিতল ভবনসহ পাওয়ায় ২৫ এপ্রিল ১৯৭২ সালে তাৎক্ষণিক কলেজের কার্যক্রম এই জায়গায় শুরু করা হয়। কলেজের এই স্থাপনায় ক্লাস শুরুর ইতিহাস একটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত, এখানে সে বিষয় কিছু উল্লেখ করছি না। বরাদ্দপ্রাপ্ত অপর অংশটি ১ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের বিরাট প্রাঙ্গণ। ১৯৭৪ সালে নির্মাণকাজ শুরুর দিন জনৈক ব্যক্তি জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করায় জমি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
এই মামলায় নিম্ন আদালতে কলেজের পক্ষে রায় হয়। বাদীপক্ষ ১৯৮০ সালে হাইকোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে। এখন থেকে ৩০ বছর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ছিল। হাইকোর্টে মামলা চালানোর আর্থিক ব্যয় বহন করার সামর্থ্য একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গভর্নিং বডির সভায় এই মামলা নিয়ে আমার অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা, অপারগতা জানাতে গাজীউল হক সাহেব এ মামলার দায়িত্বভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। হাইকোর্টের পর বাদীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। এই মামলারও দায়িত্ব গ্রহণ করেন গাজীউল হক । ১৯৮২ সালের ২০ অক্টোবর কলেজ জমির মালিকানা লাভ করে। নিউ বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের ১০ তলা একাডেমিক ভবন যে উচ্চতা নিয়ে অবস্থান করছে তার এবং মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অব্যাহত সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে, তার মূলে আইনজীবী গাজীউল হকের অবদান অবিস্মরণীয়। কলেজের এই মামলা পরিচালনার জন্য তিনি কোনো অর্থ গ্রহণ করেননি। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের গভীর সংকট ও সমস্যা দূর করে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারে যে অবদান রেখেছেন, সে সম্পর্কে কোনো সময় এ পর্যন্ত উল্লেখ করার আমার সুযোগ হয়নি। ২০০৯ সালের ১৮ জুন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রয়াত ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের মরদেহ কিছু সময়ের জন্য রাখা হয়েছিল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্য। সেদিন সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অনেকেই তাঁর জীবনকর্ম, অবদানকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। আমি অন্তিম শয়ানে শায়িত কর্মসাধক গাজীউল হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে।
আজ ১৭ জুন তাঁর পরলোকগমনের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে আমার গভীর কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করে তাঁর স্মৃতিকে স্মরণ করছি এই লেখার মাধ্যমে।
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে শিক্ষানুরাগী ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের নাম ও স্মৃতি।
সৈয়দা শামসে আরা হোসেন
সাবেক অধ্যক্ষ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা।
No comments