পারিবারিক নির্যাতন-রুমানা, আপনার যন্ত্রণা আমাদেরও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মনজুর হাসপাতালে জীবন নিয়ে লড়ছেন। লড়ছেন পৃথিবীর আলো নতুন করে দেখার জন্য। আমরা ঘৃণা জানাই সেই নিপীড়কের প্রতি, যে ক্ষতবিক্ষত করেছে আমাদের সহকর্মীকে, যে অমানবিকতায় মুচড়ে গেছে আমাদের হূদয়। আমরা গভীরভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ।
রুমানার স্বামী তাঁকে যেভাবে নির্যাতন করেছে তা শুনে যেকোনো সংবেদনশীল মানুষেরই হূৎস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। যাঁরা গণমাধ্যমে রুমানার সাক্ষাৎকার দেখেছেন অথবা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন সেই নির্যাতন কত ভয়াবহ! এমন নির্যাতনের কথা মানুষ কল্পনা করতে পারে না, বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য সেই ভয়ংকর অত্যাচারই করা হয়েছে এই শিক্ষকের ওপর। এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও আক্রান্ত বোধ করছি। রুমানার ওপর যে আঘাত করা হয়েছে, আমরা মনে করি, এই আঘাত আমাদের সবার ওপরই হয়েছে। এই ঘটনায় সারা দেশের মানুষই বেদনার্ত, স্তম্ভিত। জীবন ভাগ করার অভিপ্রায় নিয়ে যাকে বিয়ে করেছিলেন রুমানা, সেই স্বামীর হাতেই নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দুটো চোখের আলো ফিরে পাওয়ার আশায় এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুধু চোখেই নয়, নাকে-মুখে নির্যাতনের চিহ্ন বহন করছেন আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুর।
আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত যে নির্যাতক সাইদ হাসান এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। ৫ জুন এই বর্বর ঘটনাটি ঘটে এবং এর পরের দিন অর্থাৎ ৬ জুন রুমানার বাবা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মনজুর ধানমন্ডি থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা করেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, আসামি সাইদ হাসান এখনো ‘পলাতক’। মামলা দায়েরের পর প্রায় ১০ দিন অতিবাহিত হলেও আসামিকে কেন ধরা যাচ্ছে না? তাহলে পুলিশ কি যথেষ্ট তৎপর নয়? আসামিপক্ষের রয়েছে রাজনৈতিক জোর। রুমানার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উচ্চপর্যায়ের তদবির রয়েছে আসামির পক্ষে এবং তাদের জোরে আসামিপক্ষ রুমানার পরিবারকে প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেওয়ার। এমনকি তারা হাসপাতালের ক্যাবিনে ফোন করেও রুমানার পরিবারকে ভয় দেখাচ্ছে। রুমানার একমাত্র সন্তানকে নিয়েও নানা হুমকি দিচ্ছে। শরীরের ক্ষতের সঙ্গে রুমানা শঙ্কিত নিজের ও পরিবারের এবং তাঁর একমাত্র সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ, আসামি এখনো বাইরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী রুমানা কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছিলেন ২০১০ সালে। গত মাসের মাঝামাঝি গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি দেশে আসেন পিএইচডি স্কলারশিপ নিশ্চিত করেই। আর দেশে এসেই এই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি চোখে দেখতে পাবেন কিনা অনিশ্চিত। একজন মেধাবী শিক্ষকের এ করুণ পরিণতি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আসামিদের দাপট এতটাই যে রুমানার বাবা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে, আদরের নাতনিকে নিয়ে। সহকর্মী হিসেবে আমাদের কষ্টও কম নয়। আমরা রুমানার কষ্ট দেখছি, তাঁর পরিবারের ছটফটানি দেখছি, আর দাবি করছি, আসামিকে অচিরেই ধরা হোক। আমরা চাই আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
রুমানার কষ্ট নিয়ে যখন আমরা যাপিত জীবনের বন্ধ্যত্বকে আলিঙ্গন করে চলছি, ঠিক সেই সময়ই পত্রিকার পাতায় স্বামীর নির্যাতনে আরও কয়েকজন নারীর মৃত্যু আমাদের চোখ বন্ধ করা শিউরে ওঠার অনুভূতি তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানাসহ সব শ্রেণীর নারীই বাংলাদেশের পুরুষাধিপত্যের নির্যাতনের শিকার হয়ে পত্রিকায় একই কাতারে হাজির হয়। আর আমরা পাঠক হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে সেই ঘটনাগুলোকে এক বুক কষ্ট, হতাশা এবং ক্রোধ নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বকে অতিক্রম করার চেষ্টা করি। আমাদের কিছুই করার নেই? আছে, অবশ্যই আছে। রুমানাকে বলতে চাই, আপনি একা নন, আপনার যন্ত্রণা আমাদেরও, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় আপনার পাশে আছে, আছে এ দেশের বিবেকবান মানুষেরা। লড়বে সবাই।
আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, পারিবারিক নির্যাতন কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং একে সেভাবেই পাঠ করা প্রয়োজন। বিয়ে সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নকে ‘বৈধতা’ দেওয়া হয়; যে কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন স্বামী নিজেকে তার স্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাশালী ভাবে। সমাজ পুরুষাধিপত্যকে এভাবেই নিশ্চিত করেছে। আমরা চাই প্রতিটি পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার অংশগ্রহণ।
এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক আমরা লক্ষ করছি। দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী রাজনৈতিক দল তথা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পায় এবং তাদের সমর্থন নিয়ে আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। যে কারণে সুবিচার পাওয়া অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়ে। যাঁরা যে কারণেই আসামিদের সহায়তা করেন, তাঁদের একবারের জন্য হলেও মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার পরিবারের যেকোনো নারীসদস্যই এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে। এই সমাজ, রাষ্ট্রে আমার-আপনার ঘনিষ্ঠ যে কেউই এমন নৃশংসতার শিকার হতে পারে। কেউ নিরাপদ নই। না ঘরে, না বাইরে। আর নির্যাতক অনেক ঘরেই থাকতে পারে। তাই যাঁরা নির্যাতকের পক্ষ নিচ্ছেন, তাঁরা আসলে সমাজে এ ধরনের নির্যাতনেরই পথ তৈরি করছেন।
আমরা লড়তে চাই আমাদের সহকর্মীর জন্য, সব নির্যাতিত নারীর জন্য। আসামিকে দ্রুত ধরার জন্য, সরকারের সব মহল থেকে সর্বোচ্চ তৎপরতা গ্রহণ করার জন্য আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে কঠোর শাস্তি। অপরাধী যেন কোনোভাবেই রেহাই না পায়। এই ঘটনার বিচার করতেই হবে। তা না হলে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার দায় কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
লেখকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অধিকারকর্মী।
আমরা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত যে নির্যাতক সাইদ হাসান এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। ৫ জুন এই বর্বর ঘটনাটি ঘটে এবং এর পরের দিন অর্থাৎ ৬ জুন রুমানার বাবা অবসরপ্রাপ্ত মেজর মনজুর ধানমন্ডি থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা করেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, আসামি সাইদ হাসান এখনো ‘পলাতক’। মামলা দায়েরের পর প্রায় ১০ দিন অতিবাহিত হলেও আসামিকে কেন ধরা যাচ্ছে না? তাহলে পুলিশ কি যথেষ্ট তৎপর নয়? আসামিপক্ষের রয়েছে রাজনৈতিক জোর। রুমানার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, উচ্চপর্যায়ের তদবির রয়েছে আসামির পক্ষে এবং তাদের জোরে আসামিপক্ষ রুমানার পরিবারকে প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেওয়ার। এমনকি তারা হাসপাতালের ক্যাবিনে ফোন করেও রুমানার পরিবারকে ভয় দেখাচ্ছে। রুমানার একমাত্র সন্তানকে নিয়েও নানা হুমকি দিচ্ছে। শরীরের ক্ষতের সঙ্গে রুমানা শঙ্কিত নিজের ও পরিবারের এবং তাঁর একমাত্র সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে। কারণ, আসামি এখনো বাইরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী রুমানা কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছিলেন ২০১০ সালে। গত মাসের মাঝামাঝি গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি দেশে আসেন পিএইচডি স্কলারশিপ নিশ্চিত করেই। আর দেশে এসেই এই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি চোখে দেখতে পাবেন কিনা অনিশ্চিত। একজন মেধাবী শিক্ষকের এ করুণ পরিণতি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আসামিদের দাপট এতটাই যে রুমানার বাবা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে, আদরের নাতনিকে নিয়ে। সহকর্মী হিসেবে আমাদের কষ্টও কম নয়। আমরা রুমানার কষ্ট দেখছি, তাঁর পরিবারের ছটফটানি দেখছি, আর দাবি করছি, আসামিকে অচিরেই ধরা হোক। আমরা চাই আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
রুমানার কষ্ট নিয়ে যখন আমরা যাপিত জীবনের বন্ধ্যত্বকে আলিঙ্গন করে চলছি, ঠিক সেই সময়ই পত্রিকার পাতায় স্বামীর নির্যাতনে আরও কয়েকজন নারীর মৃত্যু আমাদের চোখ বন্ধ করা শিউরে ওঠার অনুভূতি তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানাসহ সব শ্রেণীর নারীই বাংলাদেশের পুরুষাধিপত্যের নির্যাতনের শিকার হয়ে পত্রিকায় একই কাতারে হাজির হয়। আর আমরা পাঠক হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে সেই ঘটনাগুলোকে এক বুক কষ্ট, হতাশা এবং ক্রোধ নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বকে অতিক্রম করার চেষ্টা করি। আমাদের কিছুই করার নেই? আছে, অবশ্যই আছে। রুমানাকে বলতে চাই, আপনি একা নন, আপনার যন্ত্রণা আমাদেরও, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় আপনার পাশে আছে, আছে এ দেশের বিবেকবান মানুষেরা। লড়বে সবাই।
আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, পারিবারিক নির্যাতন কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং একে সেভাবেই পাঠ করা প্রয়োজন। বিয়ে সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতন ও নিপীড়নকে ‘বৈধতা’ দেওয়া হয়; যে কারণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন স্বামী নিজেকে তার স্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাশালী ভাবে। সমাজ পুরুষাধিপত্যকে এভাবেই নিশ্চিত করেছে। আমরা চাই প্রতিটি পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার অংশগ্রহণ।
এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক আমরা লক্ষ করছি। দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী রাজনৈতিক দল তথা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন পায় এবং তাদের সমর্থন নিয়ে আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। যে কারণে সুবিচার পাওয়া অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়ে। যাঁরা যে কারণেই আসামিদের সহায়তা করেন, তাঁদের একবারের জন্য হলেও মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনার পরিবারের যেকোনো নারীসদস্যই এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে। এই সমাজ, রাষ্ট্রে আমার-আপনার ঘনিষ্ঠ যে কেউই এমন নৃশংসতার শিকার হতে পারে। কেউ নিরাপদ নই। না ঘরে, না বাইরে। আর নির্যাতক অনেক ঘরেই থাকতে পারে। তাই যাঁরা নির্যাতকের পক্ষ নিচ্ছেন, তাঁরা আসলে সমাজে এ ধরনের নির্যাতনেরই পথ তৈরি করছেন।
আমরা লড়তে চাই আমাদের সহকর্মীর জন্য, সব নির্যাতিত নারীর জন্য। আসামিকে দ্রুত ধরার জন্য, সরকারের সব মহল থেকে সর্বোচ্চ তৎপরতা গ্রহণ করার জন্য আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে কঠোর শাস্তি। অপরাধী যেন কোনোভাবেই রেহাই না পায়। এই ঘটনার বিচার করতেই হবে। তা না হলে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার দায় কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
লেখকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অধিকারকর্মী।
No comments