প্রতিক্রিয়া-গোয়েন্দা বিভাগের কাছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি by ওয়ালিউল্লাহ
স্বাধীনতার ৪০ বছরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের দোরগোড়ায় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা পৌঁছায়নি। জনপ্রতিনিধিরা সমস্যাগুলোর সমাধান না দিয়ে অতীতমুখী সমস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যে দেশকে সাংঘর্ষিক পর্যায়ে নিয়ে
গেছেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১/১১ অধ্যায় রচিত হয়েছিল। ১/১১-এর শাসনামলের সমালোচনায় বিদগ্ধজন মুখর হলেও রাজনীতি কেন ঐক্যের আলো দেখাতে পারল না, তা খতিয়ে দেখেননি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একনায়কতন্ত্রের ছায়া পড়লেই স্বৈরশাসন আর গণতন্ত্রের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়।
পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে ধর্ম পাকিস্তানের দুই অংশকে ধরে রাখতে পারেনি। গণতন্ত্রের অবর্তমানে সামরিক শাসনের ওপর ভর করে পাকিস্তান চলছিল বলেই ভেঙে গেল দেশটি। বিভেদ, মতপার্থক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে আক্রান্ত হয়েও বহু ভাষাভাষী ও ধর্ম-বর্ণের দেশ ভারত কিন্তু অখণ্ডতা বজায় রেখেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বেশ কটি ঘটনা এই রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। একটি নির্বাচিত সরকারকে কয়েক বছরের মাথায় বিদায় নিতে হয়েছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। স্বাধীন দেশে সবে গড়ে ওঠা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কিছু উচ্ছৃৃঙ্খল সদস্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ দেশে হত্যার রাজনীতি সহজতর হলো। পরবর্তীকালে জেলখানায় চার নেতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ আরও একটি শোকাবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ বছরটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু ঘটে একদল সেনাসদস্যের আক্রমণে। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য এ হত্যাকাণ্ডগুলোতে জড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমালোচনার মুখে পড়ে যায়।
ভারত ও পাকিস্তানেও সরকারপ্রধানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে প্রাণ দেন। সে দেশে র-এর মতো দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধীকে রক্ষা করতে পারেনি। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মতো সংস্থা বিভিন্ন সময় তাদের কর্মতৎপরতার জন্য আলোচিত হয়েছে। এই সংস্থার গোয়েন্দা কার্যক্রম কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল হলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেককে ভাবিয়ে তুলেছিল। সামরিক প্রেসিডেন্ট মোশাররফের প্রাণহানির চেষ্টা গোয়েন্দারা ব্যর্থ করে দেয়। বেনজির ভুট্টোর রাজনীতির যবনিকাপাত হয়েছে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার মাধ্যমে। সন্ত্রাসবাদ দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকর ভূমিকা তাদের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে সে দেশের জনগণকে আস্থাহীন করে তোলে, কিন্তু সংস্থাগুলোর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেনি সে দেশের গণমাধ্যম।
আমাদের দেশের বিশ্লেষকেরা কোনো ঘটনা ঘটে গেলে গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে, নির্বাচিত সরকারের আমলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র। দেশের স্পর্শকাতর সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের কর্ণধারদের প্রণীত দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোনো কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। সামরিক বা অসামরিক সরকারের আমলে ডিজিএফআইয়ের কার্যক্রম রাষ্ট্রের কর্ণধারদের নির্দেশ ছাড়া পরিচালিত হয়েছে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এবং এর কার্যক্রমের পরিধি নিয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের সর্্বোচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করে থাকে। ডিজিএফআই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম দেখভাল করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ইচ্ছায় এর কার্যক্রম পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ মামলা, কর্নেল তাহের হত্যা মামলা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে যে তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতার কথা প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্ণধারদের অগোচরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হলো, তা সবাইকে বিস্মিত করে।
উল্লেখ্য, এ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীও বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইয়ের কার্যক্রম নিয়ে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ডিজিএফআই সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইয়ের সহায়তা সরকারের জন্য অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলের বিরোধের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, আইন বিশেষজ্ঞ, দলীয় সংস্কারবাদীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তখন সরকারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।
বিভিন্ন পেশাজীবীর মতো গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশি প্রশিক্ষণগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে যে দেশ আয়োজন করে তার চাহিদা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারলেও অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়োগিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরঞ্জাম ও পরিবর্তনশীল অবস্থার কারণে প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই তথ্যপ্রবাহের যুগে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কার্যক্রমও গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আধুনিক বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে পেশাদারি গোয়েন্দা বাহিনী অপেশাদারি গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে একটি নীরব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অপেশাদারি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য-উপাত্ত অনেক সময় পেশাদারি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যস্ত করে তুললেও অনেক তথ্যই হারিয়ে যায় সময়ের আবর্তে। অনেক ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যর্থতা বা দিকনির্দেশনা না পাওয়ার ফলে কষ্টার্জিত গোয়েন্দা তথ্য বাক্সবন্দী হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা প্রভাবিত গোয়েন্দা তথ্য কাঙ্ক্ষিত গোয়েন্দা তথ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের গোয়েন্দা তথ্য গ্রহণে অপরিমিত জ্ঞান, অনভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার অভাবের ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। গোয়েন্দা উপাত্ত প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা বাহিনী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। এটা সবার জানা আছে, অনেক ক্ষেত্রে মিত্র রাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধার এবং শত্রু রাষ্ট্রের স্বার্থহানির জন্য গোয়েন্দা বাহিনী ব্যবহূত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে বেগবান করতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশকে আজ বিশ্ব গোয়েন্দা বলয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে পাকিস্তানের মতো অস্থিতিশীল না হলেও এ দেশে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকানো কখনোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয় বলেই গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের আনুকূল্য বা আশীর্বাদের কারণে ডিজিএফআইকে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং এর অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারকেই নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করতে হবে। যত দিন ক্ষমতায় থাকা এবং আরোহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত না হবে, যত দিন ব্যক্তিস্বার্থ রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বিপন্ন না করবে, তত দিন বিধিবহির্ভূতভাবে গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
মনে রাখতে হবে, গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত প্রদান গোয়েন্দা সংস্থার কার্যবিধির মধ্যে পড়লেও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের দিকনির্দেশনা ছাড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। গোয়েন্দা কার্যক্রম সব পক্ষকে খুশি করবে, এ কথা ভাবার অবকাশ নেই। অনেক মহাপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পিত না হলে এর ফল ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দা সংস্থার সব কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, যাঁরা ইন্টেলিজেন্স ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন। এঁদের কর্মপরিধি, জবাবদিহি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের মতো দেশে গোয়েন্দা কার্যক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাগ্য বিপন্ন হয় সরকার পরিবর্তনের ফলে। যার ফলে স্পর্শকাতর সংস্থাগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অনেক ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত পেশাগত ফল তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মবিধি দেশের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রণীত হলেও দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা হুমকি, নাশকতা মোকাবিলা করার জন্য গোয়েন্দা বাহিনীকে শক্তিশালী করা জরুরি। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হলে গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে পেশাদারি তৈরি করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব এর অবস্থান সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করা। তখন আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সম্মিলন ঘটবে।
লে. কর্নেল ওয়ালিউল্লাহ (অব.): সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে ধর্ম পাকিস্তানের দুই অংশকে ধরে রাখতে পারেনি। গণতন্ত্রের অবর্তমানে সামরিক শাসনের ওপর ভর করে পাকিস্তান চলছিল বলেই ভেঙে গেল দেশটি। বিভেদ, মতপার্থক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে আক্রান্ত হয়েও বহু ভাষাভাষী ও ধর্ম-বর্ণের দেশ ভারত কিন্তু অখণ্ডতা বজায় রেখেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বেশ কটি ঘটনা এই রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। একটি নির্বাচিত সরকারকে কয়েক বছরের মাথায় বিদায় নিতে হয়েছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। স্বাধীন দেশে সবে গড়ে ওঠা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কিছু উচ্ছৃৃঙ্খল সদস্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করল। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ দেশে হত্যার রাজনীতি সহজতর হলো। পরবর্তীকালে জেলখানায় চার নেতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ আরও একটি শোকাবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ বছরটি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু ঘটে একদল সেনাসদস্যের আক্রমণে। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য এ হত্যাকাণ্ডগুলোতে জড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমালোচনার মুখে পড়ে যায়।
ভারত ও পাকিস্তানেও সরকারপ্রধানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে প্রাণ দেন। সে দেশে র-এর মতো দক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধীকে রক্ষা করতে পারেনি। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মতো সংস্থা বিভিন্ন সময় তাদের কর্মতৎপরতার জন্য আলোচিত হয়েছে। এই সংস্থার গোয়েন্দা কার্যক্রম কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফল হলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেককে ভাবিয়ে তুলেছিল। সামরিক প্রেসিডেন্ট মোশাররফের প্রাণহানির চেষ্টা গোয়েন্দারা ব্যর্থ করে দেয়। বেনজির ভুট্টোর রাজনীতির যবনিকাপাত হয়েছে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার মাধ্যমে। সন্ত্রাসবাদ দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওই দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থার কার্যকর ভূমিকা তাদের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে সে দেশের জনগণকে আস্থাহীন করে তোলে, কিন্তু সংস্থাগুলোর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেনি সে দেশের গণমাধ্যম।
আমাদের দেশের বিশ্লেষকেরা কোনো ঘটনা ঘটে গেলে গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে, নির্বাচিত সরকারের আমলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র। দেশের স্পর্শকাতর সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের কর্ণধারদের প্রণীত দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোনো কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। সামরিক বা অসামরিক সরকারের আমলে ডিজিএফআইয়ের কার্যক্রম রাষ্ট্রের কর্ণধারদের নির্দেশ ছাড়া পরিচালিত হয়েছে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এবং এর কার্যক্রমের পরিধি নিয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাষ্ট্রের সর্্বোচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করে থাকে। ডিজিএফআই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম দেখভাল করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ইচ্ছায় এর কার্যক্রম পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ মামলা, কর্নেল তাহের হত্যা মামলা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে যে তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে, তাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্টতার কথা প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্ণধারদের অগোচরে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হলো, তা সবাইকে বিস্মিত করে।
উল্লেখ্য, এ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীও বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইয়ের কার্যক্রম নিয়ে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ডিজিএফআই সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইয়ের সহায়তা সরকারের জন্য অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দলের বিরোধের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, আইন বিশেষজ্ঞ, দলীয় সংস্কারবাদীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তখন সরকারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।
বিভিন্ন পেশাজীবীর মতো গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশি প্রশিক্ষণগুলো সমঝোতার ভিত্তিতে যে দেশ আয়োজন করে তার চাহিদা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারলেও অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়োগিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরঞ্জাম ও পরিবর্তনশীল অবস্থার কারণে প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই তথ্যপ্রবাহের যুগে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কার্যক্রমও গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আধুনিক বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে পেশাদারি গোয়েন্দা বাহিনী অপেশাদারি গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে একটি নীরব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। অপেশাদারি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য-উপাত্ত অনেক সময় পেশাদারি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যস্ত করে তুললেও অনেক তথ্যই হারিয়ে যায় সময়ের আবর্তে। অনেক ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যর্থতা বা দিকনির্দেশনা না পাওয়ার ফলে কষ্টার্জিত গোয়েন্দা তথ্য বাক্সবন্দী হয়ে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা প্রভাবিত গোয়েন্দা তথ্য কাঙ্ক্ষিত গোয়েন্দা তথ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের গোয়েন্দা তথ্য গ্রহণে অপরিমিত জ্ঞান, অনভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতার অভাবের ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। গোয়েন্দা উপাত্ত প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা বাহিনী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। এটা সবার জানা আছে, অনেক ক্ষেত্রে মিত্র রাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধার এবং শত্রু রাষ্ট্রের স্বার্থহানির জন্য গোয়েন্দা বাহিনী ব্যবহূত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে বেগবান করতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশকে আজ বিশ্ব গোয়েন্দা বলয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে পাকিস্তানের মতো অস্থিতিশীল না হলেও এ দেশে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকানো কখনোই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয় বলেই গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময়ে সরকারের আনুকূল্য বা আশীর্বাদের কারণে ডিজিএফআইকে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং এর অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারকেই নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করতে হবে। যত দিন ক্ষমতায় থাকা এবং আরোহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত না হবে, যত দিন ব্যক্তিস্বার্থ রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে বিপন্ন না করবে, তত দিন বিধিবহির্ভূতভাবে গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
মনে রাখতে হবে, গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত প্রদান গোয়েন্দা সংস্থার কার্যবিধির মধ্যে পড়লেও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের দিকনির্দেশনা ছাড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। গোয়েন্দা কার্যক্রম সব পক্ষকে খুশি করবে, এ কথা ভাবার অবকাশ নেই। অনেক মহাপরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পিত না হলে এর ফল ব্যর্থ হতে বাধ্য। বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দা সংস্থার সব কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, যাঁরা ইন্টেলিজেন্স ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন। এঁদের কর্মপরিধি, জবাবদিহি গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করে থাকে। আমাদের মতো দেশে গোয়েন্দা কার্যক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাগ্য বিপন্ন হয় সরকার পরিবর্তনের ফলে। যার ফলে স্পর্শকাতর সংস্থাগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে অনেক ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। ফলে কাঙ্ক্ষিত পেশাগত ফল তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মবিধি দেশের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রণীত হলেও দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা হুমকি, নাশকতা মোকাবিলা করার জন্য গোয়েন্দা বাহিনীকে শক্তিশালী করা জরুরি। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে হলে গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে পেশাদারি তৈরি করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব এর অবস্থান সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করা। তখন আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সম্মিলন ঘটবে।
লে. কর্নেল ওয়ালিউল্লাহ (অব.): সাবেক সেনা কর্মকর্তা।
No comments