জাতিগত দাম্ভিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা by স্বাধীন সেন
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পগুলোতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য খোঁজার বাসনা ছিল অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। তবে হাজার বছরের বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনা ও আহ্বান দিন দিন প্রবল হয়ে উঠেছে।
গত এক দশকে জাতীয়তাবাদী অতীত গৌরবের দম্ভকে পণ্য হিসেবে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে প্রবল মিডিয়া ও করপোরেট-সিভিল-মিলিটারি পুঁজি। বাঙালি জাতির দম্ভের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনাসঞ্জাত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর্যুক্ত মতামত এহেন পরিস্থিতির মধ্যেই
তৈরি হওয়া বলে আমি ঠাহর করি
গত বছরের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের আদিবাসী বিতর্ক প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করেন। ওই মন্তব্য করতে গিয়ে এই ভূখণ্ডের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিদের প্রাচীনত্বর প্রমাণ হিসেবে উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নস্থানটির উল্লেখ করেন। তার দাবি অনুযায়ী, উয়ারি-বটেশ্বর থেকেই চার হাজার বছর আগে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির মধ্যে বাঙালি জাতি যে সবচেয়ে প্রাচীন_ সে কথার পক্ষে প্রত্নতাত্তি্বক প্রমাণ দেওয়ার বাসনা হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। বাঙালি জাতির প্রাচীনত্ব প্রমাণকারী এ বক্তব্য প্রদান এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন 'আদিবাসী'র সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের নিপীড়িত আদিবাসীরা লড়াই করছে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভূমির ওপর বাঙালিদের দখল প্রতিষ্ঠা করা আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন ও আধিপত্যের অন্যতম শর্ত। তাদের ওপর বাঙালিদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অন্যতম দাবি হলো ভূমির ওপর তাদের হক কায়েম করা।
ভূখণ্ড বা ভূমির ওপর হক কায়েম করা অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আদিবাসীদের লড়াইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালিরা তাদের ভূমি রাষ্ট্রীয়-সিভিল-মিলিটারি-করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন উপায়ে দখল করছে। এই ভূখণ্ডে কোন জাতি সবচেয়ে আগে এসেছে, কোন জাতি সবচেয়ে প্রাচীন_ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্র নিচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীবর্গ নিচ্ছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত দিলেন এমন সময়ে, যখন আদিবাসী পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ আদৌ জরুরি নয়। বরং জরুরি হলো বৈষম্য ও নিপীড়নের শর্তগুলোকে চিহ্নিত করে পারস্পরিক সম্মান সৃষ্টির শর্তগুলো তৈরিতে মনোযোগী হওয়া। আর এখানেই বিপজ্জনকভাবে রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী কট্টর জাতীয়তাবাদী দম্ভ আর প্রত্নতত্ত্ব চর্চার মাধ্যমে ঐতিহ্য নির্মাণের গাঁটছড়া বেঁধেছে বাংলাদেশে।
জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় অনেক চিন্তকই দেখিয়েছেন যে, জাতীয়তাবাদের ভূমিকা সবসময়, সব স্থানে মুক্তি দায়ী নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের বিজয় হয়েছে। অনেকেই যেমন দাবি করেন, এই বিজয় তেমন করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অসারতার প্রামাণ্য নয়। বরং আমার মতে, এ বিজয় একটি জাতীয়তাবাদের আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠার পরিণাম, ওই আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের লড়াইয়ের জয়। উপনিবেশের বিরুদ্ধে, আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদ ঐক্য, দ্রোহ আর মুক্তির অন্যতম শর্ত হতে পারে। সতর্ক না থাকলে একই জাতীয়তাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জাতিবর্গের ওপর, অধস্তন লিঙ্গ ও বিভিন্ন বর্গের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণ হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, শ্রেণী ও লিঙ্গের মানুষের অন্তর্ভুক্তিনির্ভর ঐক্যের মাধ্যমে জারিত হয়। আবার, একই চৈতন্যে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়, লিঙ্গের মানুষ প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তাদের সামষ্টিক পরিচয় খারিজ হয়ে প্রবল জাতির দাম্ভিক পরিচয়ে আত্মসাৎকৃত হয়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিসরে যে জাতীয়তাবাদ প্রবল পরাক্রমশালী; আন্তর্জাতিক পরিসরে সেই জাতীয়তাবাদই দুর্বল, প্রান্তিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আমি যেভাবে পাঠ করি, তাতে এক সময়ের লড়াকু জাতীয়তাবাদ যে বিজয়ের পরে আধিপত্যবাদী ও নিপীড়নমূলক হয়ে উঠবে; সেই জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধের নয় বলেই আমার মনে হয়।
প্রত্নতত্ত্ব চর্চা, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, আত্মপরিচয়ের লড়াই আর জাতিরাষ্ট্র_ এর একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে থাকার ঐতিহ্য অনেক পুরনো। এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, জাতি নামের একটি সমষ্টির ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ আপাদমস্তক আধুনিক সময়ের ঘটনা হলেও, এই সমষ্টির ন্যায্যতা ও জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ঐতিহ্যের দ্বারস্থ হতেই হয়। জাতির ধারণার প্রবক্তাদের বারবার প্রমাণ করতে হয় যে, জাতির আধুনিক কল্পনার সূত্রপাত বহু বছর আগে। হাজার হাজার বছর আগে। প্রবল আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে হাজার হাজার বছরের গৌরব, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির যাচনা করা কৌশলগতভাবে হয়তো আপাত নির্দোষ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ওই একই যাচনাকে কোনো সংখ্যালঘু জাতি, শ্রেণী, ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের পরিচয়কে ঐতিহ্যগতভাবেই নিকৃষ্ট, পিছিয়ে-পড়া (উপ) জাতি হিসেবে খাড়া করানোর বাসনায় রূপান্তরের চর্চা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই বাসনা দম্ভ সৃজন করে।
এহেন দম্ভকে বস্তুগত নিদর্শনের নিরিখে জায়েজ করে তুলতে প্রত্নতত্ত্ব অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এর ধ্রুপদী উদাহরণ হচ্ছে নাৎসি জার্মান জাতীয়তাবাদের হাজার বছরের গৌরব ও শৌর্যের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্তি্বক গবেষণা ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের ব্যবহার। গুস্তাফ কোসিনা ১৮৯৫ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলে অতীত মানব বসতির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনকে বিভিন্ন শ্রেণীতে/প্রত্নতাত্তি্বক সংস্কৃতিতে ভাগ করেন। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে, নিদর্শনের এসব শ্রেণী/সংস্কৃতি অতীতের বিভিন্ন জাতি বা নরগোষ্ঠীকে উপস্থাপন করে। তার এই গবেষণার দুটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা ছিল। প্রথমত, নিদর্শনের বিভিন্ন শ্রেণী কোন কোন স্থানে পাওয়া যাচ্ছে সেটি বিস্তারিত করলেন; দ্বিতীয়ত, সরাসরি বংশলতিকানির্ভর পদ্ধতিতে ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো-জার্মান আর্য নরগোষ্ঠী থেকে আধুনিক জার্মান মহাশক্তিধর/সুপার নরগোষ্ঠীর 'শিকড়ের সন্ধান' করলেন। তিনি আরও দেখালেন, কীভাবে এই নরগোষ্ঠী শৌর্য-বীর্যের মাধ্যমে অন্যান্য 'দুর্বল' নরগোষ্ঠীকে পরাভূত করে নিজেদের বসতি ও প্রভাব বলয়ের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। থার্ড রাইখের অন্যতম মতাদর্শিক স্তম্ভ হয়ে ওঠে কোসিনার 'আর্য জার্মান বিশুদ্ধ জাতি'র ধারণা। হিমলার প্রতিষ্ঠা করলেন জার্মান পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার/উবঁঃপযবং অযহবহবৎনব নামে সংগঠন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন পোল্যান্ড, রাশিয়ার দক্ষিণাংশ ও ককেশাস অঞ্চল প্রাগৈতিহাসিককালে জার্মান জাতির পূর্বপুরুষদের দখলে ছিল। তারা আরও প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন দোলনি ভেস্তনিস নামক প্রত্নস্থানে পাওয়া ভেনাস মূর্তির সঙ্গে ইহুদি নারীদের এবং তুলনামূলক 'আদিম' হটেনটট নারীদের শারীরিক গঠনের সাদৃশ্য রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্বের এমন জাতিগত আদিকল্পের উদাহরণ আধুনিক সময়ে অসংখ্য। রোডেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনে এই আদিকল্প যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনই ছিল স্লাভনিক অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ে। অধুনা আরেকটি ভয়ঙ্কর উদাহরণ হচ্ছে ইসরায়েলের জায়নবাদী জাতীয়তাবাদের শিকড় অনুসন্ধানে, আর বিভিন্ন বিতর্কিত ভূখণ্ডে ইহুদি জাতির পূর্বপুরুষদের দখলদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনকে ব্যবহার করায়। কোন ভূমির ওপর ইসরায়েলি জাতির অধিকার ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবেই বেশি_ সেটা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের উপস্থিতি/অনুপস্থিতির ভিত্তিতে প্রমাণ করায়। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, যেভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদী প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্প ইহুদিদের পিছিয়ে পড়া, নর-বর্ণগতভাবেই দুর্বল হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে, ঠিক একইভাবে আজ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় প্রত্নতাত্তি্বক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সুসংগঠিত প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অধীনস্ততার ঐতিহ্য নির্মাণ করছে। এক সময়ের জাতিগত আদিকল্পভিত্তিক প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পের ভিক্টিম এখন নিজেই ফিলিস্তিনিদের আর এক দাম্ভিক ঐতিহ্যের ভিক্টিম বানাচ্ছে। আজ যেমন এক সময়ের ভিক্টিম বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভিক্টিম বানাচ্ছে আদিবাসীদের।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পগুলোতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য খোঁজার বাসনা ছিল অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। তবে হাজার বছরের বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনা ও আহ্বান দিন দিন প্রবল হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে জাতীয়তাবাদী অতীত গৌরবের দম্ভকে পণ্য হিসেবে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে প্রবল মিডিয়া ও করপোরেট-সিভিল-মিলিটারি পুঁজি। বাঙালি জাতির দম্ভের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনাসঞ্জাত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর্যুক্ত মতামত এহেন পরিস্থিতির মধ্যেই তৈরি হওয়া বলে আমি ঠাহর করি। উয়ারি-বটেশ্বর হোক বা মহাস্থানগড় হোক; প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন বা প্রত্নস্থানের সঙ্গে কোনো জাতিকে সম্পর্কিত করা অসম্ভব ও পদ্ধতিগতভাবে ভ্রান্ত। পদ্ধতি হিসেবে এ প্রচেষ্টা খুবই বিপজ্জনক। মুক্তিযুদ্ধের বাসনা এমনভাবে বদলে যাওয়া প্রবল হতাশার, বেদনার। আমার প্রত্যাশা, একটি বহু স্তরবিশিষ্ট ও গৌরব-অগৌরব নির্বিশেষ ঐতিহ্য প্রত্নতত্ত্ব চর্চার মধ্য দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করা হোক; এই অতীত কেবল সমৃদ্ধি বা গৌরবের দম্ভকে নয়; এই ঐতিহ্য বিভেদ-সংঘাত-বৈষম্য-সমঝোতাসহ জীবনযাপন প্রণালির সামগ্রিকতাকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে।
স্বাধীন সেন :শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা
তৈরি হওয়া বলে আমি ঠাহর করি
গত বছরের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের আদিবাসী বিতর্ক প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য করেন। ওই মন্তব্য করতে গিয়ে এই ভূখণ্ডের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিদের প্রাচীনত্বর প্রমাণ হিসেবে উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নস্থানটির উল্লেখ করেন। তার দাবি অনুযায়ী, উয়ারি-বটেশ্বর থেকেই চার হাজার বছর আগে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির মধ্যে বাঙালি জাতি যে সবচেয়ে প্রাচীন_ সে কথার পক্ষে প্রত্নতাত্তি্বক প্রমাণ দেওয়ার বাসনা হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা বিবেচনা করতে পারি। বাঙালি জাতির প্রাচীনত্ব প্রমাণকারী এ বক্তব্য প্রদান এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন 'আদিবাসী'র সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের নিপীড়িত আদিবাসীরা লড়াই করছে। বাংলাদেশে আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভূমির ওপর বাঙালিদের দখল প্রতিষ্ঠা করা আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন ও আধিপত্যের অন্যতম শর্ত। তাদের ওপর বাঙালিদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অন্যতম দাবি হলো ভূমির ওপর তাদের হক কায়েম করা।
ভূখণ্ড বা ভূমির ওপর হক কায়েম করা অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আদিবাসীদের লড়াইয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। কারণ সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে বাঙালিরা তাদের ভূমি রাষ্ট্রীয়-সিভিল-মিলিটারি-করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন উপায়ে দখল করছে। এই ভূখণ্ডে কোন জাতি সবচেয়ে আগে এসেছে, কোন জাতি সবচেয়ে প্রাচীন_ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্র নিচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীবর্গ নিচ্ছেন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত দিলেন এমন সময়ে, যখন আদিবাসী পরিচয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ আদৌ জরুরি নয়। বরং জরুরি হলো বৈষম্য ও নিপীড়নের শর্তগুলোকে চিহ্নিত করে পারস্পরিক সম্মান সৃষ্টির শর্তগুলো তৈরিতে মনোযোগী হওয়া। আর এখানেই বিপজ্জনকভাবে রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী কট্টর জাতীয়তাবাদী দম্ভ আর প্রত্নতত্ত্ব চর্চার মাধ্যমে ঐতিহ্য নির্মাণের গাঁটছড়া বেঁধেছে বাংলাদেশে।
জাতীয়তাবাদের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় অনেক চিন্তকই দেখিয়েছেন যে, জাতীয়তাবাদের ভূমিকা সবসময়, সব স্থানে মুক্তি দায়ী নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের বিজয় হয়েছে। অনেকেই যেমন দাবি করেন, এই বিজয় তেমন করে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অসারতার প্রামাণ্য নয়। বরং আমার মতে, এ বিজয় একটি জাতীয়তাবাদের আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠার পরিণাম, ওই আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের লড়াইয়ের জয়। উপনিবেশের বিরুদ্ধে, আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদ ঐক্য, দ্রোহ আর মুক্তির অন্যতম শর্ত হতে পারে। সতর্ক না থাকলে একই জাতীয়তাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জাতিবর্গের ওপর, অধস্তন লিঙ্গ ও বিভিন্ন বর্গের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণ হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, শ্রেণী ও লিঙ্গের মানুষের অন্তর্ভুক্তিনির্ভর ঐক্যের মাধ্যমে জারিত হয়। আবার, একই চৈতন্যে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায়, লিঙ্গের মানুষ প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তাদের সামষ্টিক পরিচয় খারিজ হয়ে প্রবল জাতির দাম্ভিক পরিচয়ে আত্মসাৎকৃত হয়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, জাতিরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিসরে যে জাতীয়তাবাদ প্রবল পরাক্রমশালী; আন্তর্জাতিক পরিসরে সেই জাতীয়তাবাদই দুর্বল, প্রান্তিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আমি যেভাবে পাঠ করি, তাতে এক সময়ের লড়াকু জাতীয়তাবাদ যে বিজয়ের পরে আধিপত্যবাদী ও নিপীড়নমূলক হয়ে উঠবে; সেই জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা মুক্তিযুদ্ধের নয় বলেই আমার মনে হয়।
প্রত্নতত্ত্ব চর্চা, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, আত্মপরিচয়ের লড়াই আর জাতিরাষ্ট্র_ এর একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে থাকার ঐতিহ্য অনেক পুরনো। এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, জাতি নামের একটি সমষ্টির ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ আপাদমস্তক আধুনিক সময়ের ঘটনা হলেও, এই সমষ্টির ন্যায্যতা ও জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ঐতিহ্যের দ্বারস্থ হতেই হয়। জাতির ধারণার প্রবক্তাদের বারবার প্রমাণ করতে হয় যে, জাতির আধুনিক কল্পনার সূত্রপাত বহু বছর আগে। হাজার হাজার বছর আগে। প্রবল আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে হাজার হাজার বছরের গৌরব, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির যাচনা করা কৌশলগতভাবে হয়তো আপাত নির্দোষ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ওই একই যাচনাকে কোনো সংখ্যালঘু জাতি, শ্রেণী, ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের পরিচয়কে ঐতিহ্যগতভাবেই নিকৃষ্ট, পিছিয়ে-পড়া (উপ) জাতি হিসেবে খাড়া করানোর বাসনায় রূপান্তরের চর্চা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই বাসনা দম্ভ সৃজন করে।
এহেন দম্ভকে বস্তুগত নিদর্শনের নিরিখে জায়েজ করে তুলতে প্রত্নতত্ত্ব অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এর ধ্রুপদী উদাহরণ হচ্ছে নাৎসি জার্মান জাতীয়তাবাদের হাজার বছরের গৌরব ও শৌর্যের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্তি্বক গবেষণা ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের ব্যবহার। গুস্তাফ কোসিনা ১৮৯৫ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলে অতীত মানব বসতির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনকে বিভিন্ন শ্রেণীতে/প্রত্নতাত্তি্বক সংস্কৃতিতে ভাগ করেন। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন যে, নিদর্শনের এসব শ্রেণী/সংস্কৃতি অতীতের বিভিন্ন জাতি বা নরগোষ্ঠীকে উপস্থাপন করে। তার এই গবেষণার দুটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা ছিল। প্রথমত, নিদর্শনের বিভিন্ন শ্রেণী কোন কোন স্থানে পাওয়া যাচ্ছে সেটি বিস্তারিত করলেন; দ্বিতীয়ত, সরাসরি বংশলতিকানির্ভর পদ্ধতিতে ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো-জার্মান আর্য নরগোষ্ঠী থেকে আধুনিক জার্মান মহাশক্তিধর/সুপার নরগোষ্ঠীর 'শিকড়ের সন্ধান' করলেন। তিনি আরও দেখালেন, কীভাবে এই নরগোষ্ঠী শৌর্য-বীর্যের মাধ্যমে অন্যান্য 'দুর্বল' নরগোষ্ঠীকে পরাভূত করে নিজেদের বসতি ও প্রভাব বলয়ের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। থার্ড রাইখের অন্যতম মতাদর্শিক স্তম্ভ হয়ে ওঠে কোসিনার 'আর্য জার্মান বিশুদ্ধ জাতি'র ধারণা। হিমলার প্রতিষ্ঠা করলেন জার্মান পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার/উবঁঃপযবং অযহবহবৎনব নামে সংগঠন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন পোল্যান্ড, রাশিয়ার দক্ষিণাংশ ও ককেশাস অঞ্চল প্রাগৈতিহাসিককালে জার্মান জাতির পূর্বপুরুষদের দখলে ছিল। তারা আরও প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন দোলনি ভেস্তনিস নামক প্রত্নস্থানে পাওয়া ভেনাস মূর্তির সঙ্গে ইহুদি নারীদের এবং তুলনামূলক 'আদিম' হটেনটট নারীদের শারীরিক গঠনের সাদৃশ্য রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্বের এমন জাতিগত আদিকল্পের উদাহরণ আধুনিক সময়ে অসংখ্য। রোডেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনে এই আদিকল্প যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনই ছিল স্লাভনিক অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ে। অধুনা আরেকটি ভয়ঙ্কর উদাহরণ হচ্ছে ইসরায়েলের জায়নবাদী জাতীয়তাবাদের শিকড় অনুসন্ধানে, আর বিভিন্ন বিতর্কিত ভূখণ্ডে ইহুদি জাতির পূর্বপুরুষদের দখলদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনকে ব্যবহার করায়। কোন ভূমির ওপর ইসরায়েলি জাতির অধিকার ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ঐতিহাসিকভাবেই বেশি_ সেটা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের উপস্থিতি/অনুপস্থিতির ভিত্তিতে প্রমাণ করায়। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, যেভাবে জার্মান জাতীয়তাবাদী প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্প ইহুদিদের পিছিয়ে পড়া, নর-বর্ণগতভাবেই দুর্বল হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে, ঠিক একইভাবে আজ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল রাষ্ট্রীয় প্রত্নতাত্তি্বক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সুসংগঠিত প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অধীনস্ততার ঐতিহ্য নির্মাণ করছে। এক সময়ের জাতিগত আদিকল্পভিত্তিক প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পের ভিক্টিম এখন নিজেই ফিলিস্তিনিদের আর এক দাম্ভিক ঐতিহ্যের ভিক্টিম বানাচ্ছে। আজ যেমন এক সময়ের ভিক্টিম বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভিক্টিম বানাচ্ছে আদিবাসীদের।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত প্রত্নতাত্তি্বক প্রকল্পগুলোতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য খোঁজার বাসনা ছিল অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। তবে হাজার বছরের বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনা ও আহ্বান দিন দিন প্রবল হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে জাতীয়তাবাদী অতীত গৌরবের দম্ভকে পণ্য হিসেবে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে প্রবল মিডিয়া ও করপোরেট-সিভিল-মিলিটারি পুঁজি। বাঙালি জাতির দম্ভের শিকড় অনুসন্ধানের বাসনাসঞ্জাত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর্যুক্ত মতামত এহেন পরিস্থিতির মধ্যেই তৈরি হওয়া বলে আমি ঠাহর করি। উয়ারি-বটেশ্বর হোক বা মহাস্থানগড় হোক; প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন বা প্রত্নস্থানের সঙ্গে কোনো জাতিকে সম্পর্কিত করা অসম্ভব ও পদ্ধতিগতভাবে ভ্রান্ত। পদ্ধতি হিসেবে এ প্রচেষ্টা খুবই বিপজ্জনক। মুক্তিযুদ্ধের বাসনা এমনভাবে বদলে যাওয়া প্রবল হতাশার, বেদনার। আমার প্রত্যাশা, একটি বহু স্তরবিশিষ্ট ও গৌরব-অগৌরব নির্বিশেষ ঐতিহ্য প্রত্নতত্ত্ব চর্চার মধ্য দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করা হোক; এই অতীত কেবল সমৃদ্ধি বা গৌরবের দম্ভকে নয়; এই ঐতিহ্য বিভেদ-সংঘাত-বৈষম্য-সমঝোতাসহ জীবনযাপন প্রণালির সামগ্রিকতাকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবে।
স্বাধীন সেন :শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা
No comments