বাজেট-রোমান্টিকতা ও বাস্তবতার সংঘর্ষ by মোহীত উল আলম
বাজেট ২০১১-১২ সংসদে পেশ করা হলো ৯ জুন। আয় দেখানো হয়েছে ১১৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যয় ১৬৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেলাতে হবে ৪৫ হাজার কোটি টাকার। এই সামান্য উপরি-দেখার ওপর ভর করে বাজেট সম্পর্কে নিতান্ত কিছু ব্যক্তিগত অভিমত পেশ করতে চাই।
ঘাটতি বাজেট পেশ করার কারণে রাষ্ট্রীয় বাজেটে একটি পারিবারিক চেহারা ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের ছোট-বড় সব পরিবারই প্রায় ঘাটতি বাজেটের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রামে ব্যস্ত। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’-এর গল্পটা তো আছেই, আরও আছে সৎভাবে জীবন যাপনের কষ্ট। কারণ সৎভাবে জীবন যাপন করতে গেলে ঘাটতি বাজেট পূরণের সুযোগ থাকে না। এখন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক এই ঘাটতি বাজেট পূরণের সংগ্রামে রাষ্ট্রও শরিক হলো। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র কীভাবে যুদ্ধটা চালায়।
অর্থনীতি যে কয়েকটি ভুল কথা শেখায়, তার মধ্যে একটি হলো ইংরেজিতে—‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’। কাপড়ের পরিমাণ অনুযায়ী গায়ের কোটটি কাটো। আসলে কথাটি হওয়া উচিত ছিল—‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর সাইজ’। নিজের গতর অনুযায়ী কোটটি কাটো। গতরের অর্থনৈতিক পরিভাষা হলো প্রয়োজন বা নিডস।
‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’ কথাটি ধারণা করি পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের চিন্তা থেকে এসেছে, যেটার মূল প্রেরণা আসছে খ্রিষ্টীয় পিউরিটান মিশনারিদের প্রচারণা থেকে, যাঁরা এ কথা জোরেশোরে বলতেন যে ‘আর্ন ইয়োর ব্রেড বাই ইয়োর সোয়েট’। ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা উপার্জন করো। পিউরিটান-ধর্মীয় এই চিন্তারই অন্যতম প্রবক্তা, অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকান মনীষী, কৃচ্ছ্রতার সাধক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর পুয়োর রিচার্ডস অ্যালম্যানাক গ্রন্থে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারী অর্থনৈতিক আয়-ব্যয়ের ওপর বহু নীতিকথার প্রবচন সংগ্রহ করলেন, যার মধ্যে কতগুলো এখনো পৃথিবীব্যাপী আদৃত। যেমন: ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড়’; ‘একটি টাকা বাঁচানো মানে একটি টাকা উপার্জন করা’; ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখো না’ ইত্যাদি।
ফ্রাঙ্কলিনের সংগৃহীত ওপরের নীতিকথাগুলোর একটিই নৈতিক উদ্দেশ্য, যেটি বাংলায় হলো ‘চাদরের বাইরে পা টেনো না’ অথবা ‘ঋণ করে ঘি খেয়ো না’। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক সভ্যতায়, যা এখানে এসে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে, তাতেও একই কথা বলা হয়েছে যে কৃচ্ছ্রতা সাধন করো। আয়ের চেয়ে ব্যয় কমাও। সংযম, সংযম আরও সংযম। ইংরেজ আমলে ভারতীয় বাঙালি বাবুরা এই শিক্ষাটা ভালো করে গিলেছিলেন। তাঁরা রাইটারস বিল্ডিংয়ে সারা দিন কলম পিষতেন আর বিকেলে ট্রামে করে বাড়ি ফেরার সময় ভাড়া এক পয়সা বাড়ল কি বাড়ল না, তা নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতেন। পরবর্তী সময়ে ক্যারিবিয়ান নোবেল পুরস্কৃত সাহিত্যিক ভি এস নৈপাল যখন তাঁর পূর্বপুরুষের দেশ ভারত ভ্রমণ করলেন এবং সেই অভিজ্ঞতার ওপর দ্য উন্ডেড সিভিলাইজেশন নামক একটি মারাত্মক বই লিখলেন, সেখানে এক জায়গায় মন্তব্য করলেন: কলকাতার বাবুরা এক টাকা উপার্জন করেন আর চারআনা খরচ করেন। বাকি বারোআনা তাঁরা সঞ্চয় করেন, সঞ্চয়ের নেশায়।
নৈপাল যে জিনিসটির সমালোচনা করেছেন, সেটি হচ্ছে, সঞ্চয়কেই জীবন যাপনের মূল উদ্দেশ্য মনে করা হয়েছে। জীবনকে নানা দিক থেকে বঞ্চিত করে শুধু ট্রাংকভর্তি টাকা জমিয়ে তারপর ইহলোক ত্যাগ করার সময় তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন—এ রকম বহু বৃদ্ধ লোকের গল্প গ্রামাঞ্চলে পাওয়া যায়। শহরেও।
টাকার দুটো গল্প আছে: একটি অনুৎপাদনশীল, আরেকটি উৎপাদনশীল। বলা বাহুল্য, নৈপাল অনুৎপাদনশীলভাবে টাকা জমানোর অভ্যাস দেখে রেগে গিয়েছিলেন।
নৈপালের মতো খেপেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রীও। তাই তিনি একটা বিরাট ঘাটতি বাজেট দিয়ে জাতিকে আহ্বান করছেন, নেমে পড়ো ঘাটতি বাজেট পূরণে। পুরোপুরি একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আহ্বান। এ জন্যই এই বাজেটটা আমার পছন্দ হয়েছে।
‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’ প্রবচনে আমার আপত্তি এ জন্য যে, এখানে মানুষের উদ্যমকে স্বীকার করা হয়নি। আগেই বলেছি যে ধর্মগুলোর মধ্যেও এ কথার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু এই কথায় পরিশ্রমের স্বীকৃতি থাকলেও উদ্যম বা স্বপ্নের স্বীকৃতি নেই।
শুধু পরিশ্রম করে কেরানি হওয়া যায়, শ্রমিক হওয়া যায়, চাষা হওয়া যায় কিন্তু উৎপাদক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজসংস্কারক হওয়া যায় না। উদ্যম, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উদ্ভাবনীশক্তি না থাকলে টাকাকে শুধু টাকা হিসেবে দেখার বাস্তব মানসিকতা তৈরি হয়, কিন্তু টাকাকে স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরি হবে না।
আমেরিকার ফ্রন্টিয়ার বিস্তারনির্ভর সভ্যতার ইতিহাসবিদ ফ্রেডারিক জ্যাকসন টার্নারের ইতিহাসগ্রন্থ পাঠ করে জানা যায়, আমেরিকায় বহু ছোট ছোট শহর তৈরি হয়েছে কেবল ব্যক্তির একক উদ্যম থেকে। এ রকম ঘটনা অনেক হয়েছে যে একজন অভিযাত্রী হাঁটতে হাঁটতে টেক্সাস মরু অঞ্চলে এসে পৌঁছালেন এবং ক্যাকটাস-গুল্ম আচ্ছাদিত মরুময় প্রান্তর দেখে অভিভূত হয়ে ভাবলেন, আরে! এখানে তো চমৎকার একটা শহর তৈরি করা যায়। তাই হলো। আমেরিকা উদ্যমী লোক ও স্বপ্নবাজদের দেশ। সেখানে সম্ভবত আড়াই থেকে তিন হাজার ছোট শহর বা স্মল টাউন আছে, যেগুলোর পেছনের ইতিহাসে অবদান আছে কোনো একক ব্যক্তির উদ্যমী নিবেদন। অনেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি পদ্মা নদীর মাঝির হুসেন আলীকে ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে দেখতে পছন্দ করে, কিন্তু আসলে সে-ই তো কলম্বাসের বাঙালি সংস্করণ। আজকের বাংলাদেশে যে ভূমিদস্যু, চরদস্যু, নদীদস্যু বা পাহাড় ও বনদস্যু দিয়ে দেশ ছেয়ে গেছে, এরা সবাই তো হুসেন আলীর বংশধর। এদের উদ্যম, পরিশ্রম ও স্বপ্ন আছে, নেই শুধু অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খলা আনয়ন করাই সরকারের কাজ।
সপ্তাহ খানেক আগে ইত্তেফাক পত্রিকায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কলামে একটি পর্যালোচনা পড়ে জানলাম, যেকোনো অর্থনৈতিক প্রণালীর ব্যর্থতা হচ্ছে দারিদ্র্য উৎপাদনের মুখগুলো বন্ধ করতে না পারা। সেলিমের ধারণা হলো, উৎপাদনের পুঁজি, প্রযুক্তি ও জায়গা যত দিন শ্রমিক-কৃষকের আয়ত্তাধীন না হবে, তত দিন দারিদ্র্য উৎপাদনের মুখগুলো বন্ধ করা যাবে না।
এ কথার মধ্যে ফাঁক হলো, উদ্যমযুক্ত পরিশ্রমের কথাটির জায়গা নেই। মানুষ গরিব, মানুষ ধনী—এ রকম শ্রেণীপরিচয় অবশ্যই আছে, কিন্তু মানুষের আরেকটি পরিচয় হলো, তার জিনগত বৈশিষ্ট্য বা ডিএনএর গঠনপ্রণালী। এই কথা বলার মধ্যে একটু ঝুঁকি আছে, কারণ কথাটি কোনো বাম-আদর্শী রাজনৈতিক চিন্তার আওতায় পড়বে না, বরঞ্চ পড়বে মানুষের চারিত্র্য গঠনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সমাজ নিরীক্ষণে আমরা যদি বলি যে এক শ্রেণীর লোক সব সময় আরেক শ্রেণীর লোককে শোষণ করছে, তা হলে মুদ্রার একটি দিকের কথা বললাম মাত্র। তার চেয়েও বড় কথা হলো, দারিদ্র্য সৃষ্টি যেমন সরকার করায় বা শাসকশ্রেণী করায় বা বিত্তবানশ্রেণী করায়, তেমনি ব্যক্তি নিজের বা গোষ্ঠীগত উদ্যমের বা উদ্যম-প্রযুক্ত পরিশ্রমের অভাবেও দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শী অর্থনৈতিক আলোচনায় হরহামেশা ব্যক্তির নিজস্ব চারিত্রিক মাত্রাটাকে গৌণ করে দেখা হয়, যেটি আবার সমাজবিষয়ক সাহিত্যপাঠে করা হয় না।
পরিবারের যে ছেলে নিরুদ্যমী, তাকে আমেরিকায় পাঠিয়েও দেখা যায় যে সে বাপের টাকা নষ্ট করে কিছু করতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছে। যে ছেলে উদ্যমী, সে রিকশাওয়ালার ছেলে হলেও একদিন শিল্পপতি হয়েছে—এ রকম বহু দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেও আছে। ব্যাপারটা হচ্ছে বৃত্ত ভাঙার। মানবিক জঙ্গম সমাজে কোনো পরিচয়ই স্থায়ী নয়। সাংস্কৃতিকভাবে তেমন না হলেও অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীপরিচয় বদলায় মানুষ। সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণীপরিচয় বদলাতে পুরুষাণুক্রমে সময় লাগলেও অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণী বদলাতে সময় লাগে না। আজকের বাংলাদেশ এরই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট আমার এ জন্য পছন্দ হয়েছে যে জাতিকে উদ্যমী ও পরিশ্রমী হওয়া ছাড়া এই ঘাটতি পূরণের কোনো উপায় নেই। কিন্তু বড় প্রশ্নটি আসবে, উদ্যমকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সংকট তৈরি হবে প্রধানত পরিবেশগত। তা-ও দুর্নীতির মাধ্যমে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এখন বিশ্বব্যাপী অন্যতম স্লোগান। বাংলাদেশ আল গোরের প্রামাণিক চলচ্চিত্র অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ অনুযায়ী সবচেয়ে বিষম হুমকির মধ্যে আছে। বলা হচ্ছে, আগামী ৫০ বছরে বিশ্ব উষ্ণতার প্রভাবে এর দক্ষিণাঞ্চল সম্পূর্ণ সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত হবে।
তাই ঘাটতি বাজেট পূরণের লক্ষ্যে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে কীভাবে মানুষের উদ্যমকে প্রশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। অর্থাৎ, দুর্নীতি রোধপূর্বক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাটা কোথায় অবস্থিত হবে, এটা সরকারকে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্ণয় করতে হবে। যেমন ঢাকা হলো একটি উদাহরণ। ঢাকা নগর ও চারপাশের জলাশয়গুলো অক্ষুণ্ন রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য রাখতে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে জনবহুলতার চাপ কমানোর জন্য আবাসনশিল্পের বিকাশকেও মসৃণ রাখতে হবে। আরেকটা উদাহরণ হলো জাহাজশিল্প। পরিবেশদূষণ রোধ করতে জাহাজভাঙা শিল্পকে নিবৃত্ত করা দরকার। কিন্তু জাহাজ ভাঙার ওপর রাশ টানার কারণে লৌহ, রড ও ইস্পাতশিল্প কাঁচামাল সংকটে পড়ে গেছে। এতে এই পেশার শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তার চেয়েও সমস্যায় পড়েছে আবাসনশিল্প। কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এই শিল্পটা প্রচুর ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট চিন্তায় অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রয়োগের ক্ষেত্রটি হতে হবে এমন, যেন এটা দুর্নীতির বিকাশ ঘটাবে না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উদ্যম ও উৎপাদনশীলতাকে বিকশিত করতে সাহায্য করবে।
অর্থাৎ, রোমান্টিকতা বা স্বপ্নবাজিতার অবকাশ রাখতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে পা থাকতে হবে মাটিতে।
কঠিন পরীক্ষা অবশ্যই।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও প্রধান,
ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
অর্থনীতি যে কয়েকটি ভুল কথা শেখায়, তার মধ্যে একটি হলো ইংরেজিতে—‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’। কাপড়ের পরিমাণ অনুযায়ী গায়ের কোটটি কাটো। আসলে কথাটি হওয়া উচিত ছিল—‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর সাইজ’। নিজের গতর অনুযায়ী কোটটি কাটো। গতরের অর্থনৈতিক পরিভাষা হলো প্রয়োজন বা নিডস।
‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’ কথাটি ধারণা করি পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের চিন্তা থেকে এসেছে, যেটার মূল প্রেরণা আসছে খ্রিষ্টীয় পিউরিটান মিশনারিদের প্রচারণা থেকে, যাঁরা এ কথা জোরেশোরে বলতেন যে ‘আর্ন ইয়োর ব্রেড বাই ইয়োর সোয়েট’। ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা উপার্জন করো। পিউরিটান-ধর্মীয় এই চিন্তারই অন্যতম প্রবক্তা, অষ্টাদশ শতাব্দীর আমেরিকান মনীষী, কৃচ্ছ্রতার সাধক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর পুয়োর রিচার্ডস অ্যালম্যানাক গ্রন্থে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে শুদ্ধাচারী অর্থনৈতিক আয়-ব্যয়ের ওপর বহু নীতিকথার প্রবচন সংগ্রহ করলেন, যার মধ্যে কতগুলো এখনো পৃথিবীব্যাপী আদৃত। যেমন: ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড়’; ‘একটি টাকা বাঁচানো মানে একটি টাকা উপার্জন করা’; ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখো না’ ইত্যাদি।
ফ্রাঙ্কলিনের সংগৃহীত ওপরের নীতিকথাগুলোর একটিই নৈতিক উদ্দেশ্য, যেটি বাংলায় হলো ‘চাদরের বাইরে পা টেনো না’ অথবা ‘ঋণ করে ঘি খেয়ো না’। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক সভ্যতায়, যা এখানে এসে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে, তাতেও একই কথা বলা হয়েছে যে কৃচ্ছ্রতা সাধন করো। আয়ের চেয়ে ব্যয় কমাও। সংযম, সংযম আরও সংযম। ইংরেজ আমলে ভারতীয় বাঙালি বাবুরা এই শিক্ষাটা ভালো করে গিলেছিলেন। তাঁরা রাইটারস বিল্ডিংয়ে সারা দিন কলম পিষতেন আর বিকেলে ট্রামে করে বাড়ি ফেরার সময় ভাড়া এক পয়সা বাড়ল কি বাড়ল না, তা নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতেন। পরবর্তী সময়ে ক্যারিবিয়ান নোবেল পুরস্কৃত সাহিত্যিক ভি এস নৈপাল যখন তাঁর পূর্বপুরুষের দেশ ভারত ভ্রমণ করলেন এবং সেই অভিজ্ঞতার ওপর দ্য উন্ডেড সিভিলাইজেশন নামক একটি মারাত্মক বই লিখলেন, সেখানে এক জায়গায় মন্তব্য করলেন: কলকাতার বাবুরা এক টাকা উপার্জন করেন আর চারআনা খরচ করেন। বাকি বারোআনা তাঁরা সঞ্চয় করেন, সঞ্চয়ের নেশায়।
নৈপাল যে জিনিসটির সমালোচনা করেছেন, সেটি হচ্ছে, সঞ্চয়কেই জীবন যাপনের মূল উদ্দেশ্য মনে করা হয়েছে। জীবনকে নানা দিক থেকে বঞ্চিত করে শুধু ট্রাংকভর্তি টাকা জমিয়ে তারপর ইহলোক ত্যাগ করার সময় তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন—এ রকম বহু বৃদ্ধ লোকের গল্প গ্রামাঞ্চলে পাওয়া যায়। শহরেও।
টাকার দুটো গল্প আছে: একটি অনুৎপাদনশীল, আরেকটি উৎপাদনশীল। বলা বাহুল্য, নৈপাল অনুৎপাদনশীলভাবে টাকা জমানোর অভ্যাস দেখে রেগে গিয়েছিলেন।
নৈপালের মতো খেপেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রীও। তাই তিনি একটা বিরাট ঘাটতি বাজেট দিয়ে জাতিকে আহ্বান করছেন, নেমে পড়ো ঘাটতি বাজেট পূরণে। পুরোপুরি একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আহ্বান। এ জন্যই এই বাজেটটা আমার পছন্দ হয়েছে।
‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’ প্রবচনে আমার আপত্তি এ জন্য যে, এখানে মানুষের উদ্যমকে স্বীকার করা হয়নি। আগেই বলেছি যে ধর্মগুলোর মধ্যেও এ কথার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু এই কথায় পরিশ্রমের স্বীকৃতি থাকলেও উদ্যম বা স্বপ্নের স্বীকৃতি নেই।
শুধু পরিশ্রম করে কেরানি হওয়া যায়, শ্রমিক হওয়া যায়, চাষা হওয়া যায় কিন্তু উৎপাদক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজসংস্কারক হওয়া যায় না। উদ্যম, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উদ্ভাবনীশক্তি না থাকলে টাকাকে শুধু টাকা হিসেবে দেখার বাস্তব মানসিকতা তৈরি হয়, কিন্তু টাকাকে স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরি হবে না।
আমেরিকার ফ্রন্টিয়ার বিস্তারনির্ভর সভ্যতার ইতিহাসবিদ ফ্রেডারিক জ্যাকসন টার্নারের ইতিহাসগ্রন্থ পাঠ করে জানা যায়, আমেরিকায় বহু ছোট ছোট শহর তৈরি হয়েছে কেবল ব্যক্তির একক উদ্যম থেকে। এ রকম ঘটনা অনেক হয়েছে যে একজন অভিযাত্রী হাঁটতে হাঁটতে টেক্সাস মরু অঞ্চলে এসে পৌঁছালেন এবং ক্যাকটাস-গুল্ম আচ্ছাদিত মরুময় প্রান্তর দেখে অভিভূত হয়ে ভাবলেন, আরে! এখানে তো চমৎকার একটা শহর তৈরি করা যায়। তাই হলো। আমেরিকা উদ্যমী লোক ও স্বপ্নবাজদের দেশ। সেখানে সম্ভবত আড়াই থেকে তিন হাজার ছোট শহর বা স্মল টাউন আছে, যেগুলোর পেছনের ইতিহাসে অবদান আছে কোনো একক ব্যক্তির উদ্যমী নিবেদন। অনেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি পদ্মা নদীর মাঝির হুসেন আলীকে ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে দেখতে পছন্দ করে, কিন্তু আসলে সে-ই তো কলম্বাসের বাঙালি সংস্করণ। আজকের বাংলাদেশে যে ভূমিদস্যু, চরদস্যু, নদীদস্যু বা পাহাড় ও বনদস্যু দিয়ে দেশ ছেয়ে গেছে, এরা সবাই তো হুসেন আলীর বংশধর। এদের উদ্যম, পরিশ্রম ও স্বপ্ন আছে, নেই শুধু অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খলা আনয়ন করাই সরকারের কাজ।
সপ্তাহ খানেক আগে ইত্তেফাক পত্রিকায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কলামে একটি পর্যালোচনা পড়ে জানলাম, যেকোনো অর্থনৈতিক প্রণালীর ব্যর্থতা হচ্ছে দারিদ্র্য উৎপাদনের মুখগুলো বন্ধ করতে না পারা। সেলিমের ধারণা হলো, উৎপাদনের পুঁজি, প্রযুক্তি ও জায়গা যত দিন শ্রমিক-কৃষকের আয়ত্তাধীন না হবে, তত দিন দারিদ্র্য উৎপাদনের মুখগুলো বন্ধ করা যাবে না।
এ কথার মধ্যে ফাঁক হলো, উদ্যমযুক্ত পরিশ্রমের কথাটির জায়গা নেই। মানুষ গরিব, মানুষ ধনী—এ রকম শ্রেণীপরিচয় অবশ্যই আছে, কিন্তু মানুষের আরেকটি পরিচয় হলো, তার জিনগত বৈশিষ্ট্য বা ডিএনএর গঠনপ্রণালী। এই কথা বলার মধ্যে একটু ঝুঁকি আছে, কারণ কথাটি কোনো বাম-আদর্শী রাজনৈতিক চিন্তার আওতায় পড়বে না, বরঞ্চ পড়বে মানুষের চারিত্র্য গঠনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সমাজ নিরীক্ষণে আমরা যদি বলি যে এক শ্রেণীর লোক সব সময় আরেক শ্রেণীর লোককে শোষণ করছে, তা হলে মুদ্রার একটি দিকের কথা বললাম মাত্র। তার চেয়েও বড় কথা হলো, দারিদ্র্য সৃষ্টি যেমন সরকার করায় বা শাসকশ্রেণী করায় বা বিত্তবানশ্রেণী করায়, তেমনি ব্যক্তি নিজের বা গোষ্ঠীগত উদ্যমের বা উদ্যম-প্রযুক্ত পরিশ্রমের অভাবেও দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শী অর্থনৈতিক আলোচনায় হরহামেশা ব্যক্তির নিজস্ব চারিত্রিক মাত্রাটাকে গৌণ করে দেখা হয়, যেটি আবার সমাজবিষয়ক সাহিত্যপাঠে করা হয় না।
পরিবারের যে ছেলে নিরুদ্যমী, তাকে আমেরিকায় পাঠিয়েও দেখা যায় যে সে বাপের টাকা নষ্ট করে কিছু করতে না পেরে দেশে ফিরে এসেছে। যে ছেলে উদ্যমী, সে রিকশাওয়ালার ছেলে হলেও একদিন শিল্পপতি হয়েছে—এ রকম বহু দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেও আছে। ব্যাপারটা হচ্ছে বৃত্ত ভাঙার। মানবিক জঙ্গম সমাজে কোনো পরিচয়ই স্থায়ী নয়। সাংস্কৃতিকভাবে তেমন না হলেও অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীপরিচয় বদলায় মানুষ। সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণীপরিচয় বদলাতে পুরুষাণুক্রমে সময় লাগলেও অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণী বদলাতে সময় লাগে না। আজকের বাংলাদেশ এরই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট আমার এ জন্য পছন্দ হয়েছে যে জাতিকে উদ্যমী ও পরিশ্রমী হওয়া ছাড়া এই ঘাটতি পূরণের কোনো উপায় নেই। কিন্তু বড় প্রশ্নটি আসবে, উদ্যমকে বাস্তবায়ন করতে গেলে সংকট তৈরি হবে প্রধানত পরিবেশগত। তা-ও দুর্নীতির মাধ্যমে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এখন বিশ্বব্যাপী অন্যতম স্লোগান। বাংলাদেশ আল গোরের প্রামাণিক চলচ্চিত্র অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ অনুযায়ী সবচেয়ে বিষম হুমকির মধ্যে আছে। বলা হচ্ছে, আগামী ৫০ বছরে বিশ্ব উষ্ণতার প্রভাবে এর দক্ষিণাঞ্চল সম্পূর্ণ সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত হবে।
তাই ঘাটতি বাজেট পূরণের লক্ষ্যে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে কীভাবে মানুষের উদ্যমকে প্রশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। অর্থাৎ, দুর্নীতি রোধপূর্বক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাটা কোথায় অবস্থিত হবে, এটা সরকারকে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্ণয় করতে হবে। যেমন ঢাকা হলো একটি উদাহরণ। ঢাকা নগর ও চারপাশের জলাশয়গুলো অক্ষুণ্ন রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য রাখতে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে জনবহুলতার চাপ কমানোর জন্য আবাসনশিল্পের বিকাশকেও মসৃণ রাখতে হবে। আরেকটা উদাহরণ হলো জাহাজশিল্প। পরিবেশদূষণ রোধ করতে জাহাজভাঙা শিল্পকে নিবৃত্ত করা দরকার। কিন্তু জাহাজ ভাঙার ওপর রাশ টানার কারণে লৌহ, রড ও ইস্পাতশিল্প কাঁচামাল সংকটে পড়ে গেছে। এতে এই পেশার শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তার চেয়েও সমস্যায় পড়েছে আবাসনশিল্প। কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এই শিল্পটা প্রচুর ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট চিন্তায় অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রয়োগের ক্ষেত্রটি হতে হবে এমন, যেন এটা দুর্নীতির বিকাশ ঘটাবে না, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উদ্যম ও উৎপাদনশীলতাকে বিকশিত করতে সাহায্য করবে।
অর্থাৎ, রোমান্টিকতা বা স্বপ্নবাজিতার অবকাশ রাখতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে পা থাকতে হবে মাটিতে।
কঠিন পরীক্ষা অবশ্যই।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও প্রধান,
ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments