স্মরণ-আমাদের মা-মণি by মুহ. আব্দুর রহীম খান
আমাদের মা-মণি ড. নীলিমা ইব্রাহিম ২০০২ সালের ১৮ জুন সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। সময়ের হিসাবে আজ তাঁর নবম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘ ৮১ বছরের জীবনবৃত্তে তাঁর সব কর্মের মুখ্য চালিকাশক্তি ছিল মানবকল্যাণকামী দর্শন। বরিশালের মতো মফস্বল শহরের গৃহবধূ নীলিমা ইব্রাহিম মূলত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর আহ্বানে ১৯৫৬
সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮২ সালের ৩০ জুন সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা-জীবন শেষ করেন। মানুষের প্রতি অমোঘ ভালোবাসার টানে তিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না এবং জীবনে কোনো দিন রাজনীতি করেননি, কিন্তু তাঁর চিন্তাচেতনার আরাধনায় চিরজাগরূক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে স্মৃতিচারণা করে লিখেছিলেন অগ্নিস্নাত বঙ্গবন্ধুর ভস্মাচ্ছাদিত কন্যা আমি বইটি। ষাটের দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী নেতা-কর্মীদের তিনি ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় পরিবার-পরিজন এবং অসংখ্য বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও এমনকি জেনারেল টিক্কা খানের লিখিত হুমকিতেও (জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত) তিনি মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেননি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভাগের ছাত্রদের নিয়ে খুঁজতে নেমেছিলেন সতীর্থ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর লাশ। মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বধ্যভূমিতে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছেন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জহির রায়হানকে। মৃত্যু এবং ধর্ষণ—স্বাধীনতার এই দুই ক্ষতচিহ্নকে তিনি আপন অন্তরের তাড়নায় ধারণ করেছিলেন নিজের মাঝে। হতভাগ্য বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসনে তাঁর কর্মতৎপরতা ছিল এক ধরনের নীরব বিপ্লব। পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে লাঞ্ছিত নারীদের বিপন্ন, বিপর্যস্ত অবস্থার গভীরতা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছিল আমি বীরাঙ্গনা বলছির মতো একটি অসামান্য বই।
মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যবস্থা এবং ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন ও প্রচলন—এ দেশে তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছিল। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে যে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ উদ্যাপিত হয়, তার প্রস্তাবকও তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলা বিভাগ, রোকেয়া হল, বাংলা একাডেমী এবং মহিলা সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন। তিন দশক কাল স্বাধীন বাংলাদেশে নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্যতম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি বা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি কিংবা পার্থিব উন্নতির জন্য ব্যবহার করেননি। আক্ষরিক অর্থে সেগুনবাগিচায় মাত্র ৬০০ বর্গফুটের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া বিষয়-সম্পত্তি বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। কোনো কিছুর প্রত্যাশায় নয়, কোনো কিছুর প্রাপ্তির জন্য নয়, আসলে তিনি ছিলেন কর্মজীবী; কর্মই ছিল তাঁর ধর্ম। কর্মব্যস্ত জীবনযাপন করতে করতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অনেক দেরিতে হলেও এ বছরই তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত একটি হলের নামকরণ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাঁর নামে কোনো ‘চেয়ার’, চালু হয়নি কোনো বৃত্তি, সম্মাননা কিংবা কোনো স্মারক বক্তৃতামালা। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি হলেন তিনি। বাংলা একাডেমীও এখন পর্যন্ত সময় করে উঠতে পারেনি তাঁর রচনাবলি মুদ্রণ ও প্রকাশ করতে।
এই মহীয়সী নারীকে পুরস্কৃত করে আর কোনো নতুন সম্মান দেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানি না। তিনি তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তবে আমরা নিজেরাই মহিমান্বিত হওয়ার সুযোগ এখনো নিতে পারি। আমাদের সামনে এখন প্রতিবন্ধকতার পাহাড় জমছে, ইতিহাস-ঐতিহ্য-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমেই বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। অপপ্রচারের রমরমার মধ্য দিয়ে সত্য-মিথ্যা বোঝা যাচ্ছে না, শত্রু-মিত্র চেনা যাচ্ছে না। সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিও আজ অসত্যের ঘেরাটোপে আক্রান্ত হচ্ছে। এ সময় বড় বেশি প্রয়োজন ছিল অনন্যসাধারণ, অকুতোভয় বিদুষী নীলিমা ইব্রাহিমের। প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ভাষায়, ‘যিনি মায়ের মতো মঙ্গলপ্রদীপ হতে দাঁড়িয়ে থাকতেন সন্তানের জন্য; বলতেন, পেছনে ফিরে তাকাস না। থমকে দাঁড়াস না। এগিয়ে যেতে হবে। এমন মানুষ শয়ে শয়ে জন্মায় না। দু-একজনই থাকেন। যাঁরা অন্যদের প্রদীপের নিচে ডাকেন। একটি আলোক শিখার নিচে সমবেত হয় শতজন। এই একজনই নমস্য, বরেণ্য। নীলিমা ইব্রাহিম তেমনই একজন। এই তেমনই একজনের উপস্থিতি অক্ষয় হোক সমগ্রের জীবনে।’
মুহ. আব্দুর রহীম খান
প্রয়াত ড. নীলিমা ইব্রাহিমের সর্বকনিষ্ঠ জামাতা।
মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যবস্থা এবং ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন ও প্রচলন—এ দেশে তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছিল। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে যে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ উদ্যাপিত হয়, তার প্রস্তাবকও তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলা বিভাগ, রোকেয়া হল, বাংলা একাডেমী এবং মহিলা সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন। তিন দশক কাল স্বাধীন বাংলাদেশে নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্যতম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি বা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি কিংবা পার্থিব উন্নতির জন্য ব্যবহার করেননি। আক্ষরিক অর্থে সেগুনবাগিচায় মাত্র ৬০০ বর্গফুটের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া বিষয়-সম্পত্তি বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। কোনো কিছুর প্রত্যাশায় নয়, কোনো কিছুর প্রাপ্তির জন্য নয়, আসলে তিনি ছিলেন কর্মজীবী; কর্মই ছিল তাঁর ধর্ম। কর্মব্যস্ত জীবনযাপন করতে করতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অনেক দেরিতে হলেও এ বছরই তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত একটি হলের নামকরণ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাঁর নামে কোনো ‘চেয়ার’, চালু হয়নি কোনো বৃত্তি, সম্মাননা কিংবা কোনো স্মারক বক্তৃতামালা। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি হলেন তিনি। বাংলা একাডেমীও এখন পর্যন্ত সময় করে উঠতে পারেনি তাঁর রচনাবলি মুদ্রণ ও প্রকাশ করতে।
এই মহীয়সী নারীকে পুরস্কৃত করে আর কোনো নতুন সম্মান দেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানি না। তিনি তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তবে আমরা নিজেরাই মহিমান্বিত হওয়ার সুযোগ এখনো নিতে পারি। আমাদের সামনে এখন প্রতিবন্ধকতার পাহাড় জমছে, ইতিহাস-ঐতিহ্য-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমেই বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। অপপ্রচারের রমরমার মধ্য দিয়ে সত্য-মিথ্যা বোঝা যাচ্ছে না, শত্রু-মিত্র চেনা যাচ্ছে না। সত্যানুসন্ধানী দৃষ্টিও আজ অসত্যের ঘেরাটোপে আক্রান্ত হচ্ছে। এ সময় বড় বেশি প্রয়োজন ছিল অনন্যসাধারণ, অকুতোভয় বিদুষী নীলিমা ইব্রাহিমের। প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ভাষায়, ‘যিনি মায়ের মতো মঙ্গলপ্রদীপ হতে দাঁড়িয়ে থাকতেন সন্তানের জন্য; বলতেন, পেছনে ফিরে তাকাস না। থমকে দাঁড়াস না। এগিয়ে যেতে হবে। এমন মানুষ শয়ে শয়ে জন্মায় না। দু-একজনই থাকেন। যাঁরা অন্যদের প্রদীপের নিচে ডাকেন। একটি আলোক শিখার নিচে সমবেত হয় শতজন। এই একজনই নমস্য, বরেণ্য। নীলিমা ইব্রাহিম তেমনই একজন। এই তেমনই একজনের উপস্থিতি অক্ষয় হোক সমগ্রের জীবনে।’
মুহ. আব্দুর রহীম খান
প্রয়াত ড. নীলিমা ইব্রাহিমের সর্বকনিষ্ঠ জামাতা।
No comments