আরব গণবিপ্লব-আমাদের শিক্ষণীয় কিছুই কি নেই? by সুভাষ সাহা

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বিরাট এক ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল এই আরব বিপ্লব। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী শ্রেণী, এমনকি মধ্যবিত্তদের একাংশ এর তাৎপর্যকে অনুধাবন
করতে পারেনি

ইসলাম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুকূল নয়_ এমন একটা ধারণা এতদিন পশ্চিমা মানসে প্রায় শিকড় গেড়ে বসেছিল। কিন্তু ইয়েমেন, মিসর, আরব আমিরাত, লিবিয়া, সিরিয়াসহ গোটা আরব দুনিয়ায় বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মারফত শাসন পরিচালনা তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে আধুনিক মানুষ নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। তাহলে কি ইসলাম এবং গণতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলতে পারে? এমন জিজ্ঞাসা আজ ইউরোপ-আমেরিকাসহ আধুনিক বিশ্বের সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে। লন্ডন তো এই প্রথম আরব শিল্প-সংস্কৃতির মেলা বসাচ্ছে। আর বসাবেই না কেন! চরম রক্ষণশীল সমাজের অবগুণ্ঠনের মধ্যেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সৌদি মেয়েরা যখন টুইটার ও ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে রাস্তায় গাড়ি চালানোর অধিকার দাবি করার প্রচণ্ড সাহস দেখাতে পারে, তখন আধুনিকতার দাবিদাররা কি এর আবেদনকে অস্বীকার করতে পারে?
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রচনা এবং সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের সর্বস্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ধারণ করেও তুরস্ককে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মৈত্রীকে পুরোপুরি অটুট করার জন্য এই সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেনা নিয়ন্ত্রণবিহীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদ ও প্রেসিডেন্সির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা করে তারা এখন ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এভাবেই তারা নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে গেছে। তাদের এই রূপান্তরটা আরব বিপ্লবের কারণে এখন উদাহরণ হিসেবে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি কাড়ছে। আধুনিক বিশ্ব সবিস্ময়ে দেখছে, ইসলাম মানে একটি বিশেষ পোশাক ও বেশভূষার স্মারক নয়, এটি কেবল লাদেন বা আল কায়দা-তালেবানের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করে না, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী বিশাল জনজোয়ারও সৃষ্টি করতে পারে। শুধু অন্ধকারের বদ্ধ আগলটা খুলে দিলে সেখানেও দেখা মেলে মুক্তির আলো।
আরব দুনিয়ার জনবিপ্লব তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারবে কি-না বা সেখানে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কতটুকু সক্ষম হবে, এর উত্তরের জন্য আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই বিপ্লব বিশ্ববাসীর মানসে ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে সাবেকী বদ্ধ ধারণায় যে বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মুসলমান মানেই দাড়ি-টুপি-পাগড়ি পরিহিত একদল রক্ষণশীল মানসিকতার লোক নয়। ফতোয়া জারি করে মেয়েদের অবগুণ্ঠনের মধ্যে আটকে রাখা নয়। সেখানেও নারীরা অধিকার দাবিতে সোচ্চার হয়। মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। দাড়ি-টুপি-পাগড়ি পরলেই মানুষ রক্ষণশীল বা জঙ্গি হয়ে যায় না। একজন পরহেজগার মানুষ অপরের কল্যাণে খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের লোকের মতো পরহিতে প্রাণাতিপাত করতে পারে। মিসরের রাস্তায় সন্তান কোলে নিয়ে কি অনেক মহিলাকে পুরুষ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সঙ্গিনের সামনে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলতে আমরা উত্তাল বিপ্লবের সময় দেখিনি! তবে নারীর পূর্ণ অধিকার তুরস্কের মতো ইসলামী অন্য দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগতে পারে। তার মানে এই নয়, অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশে নারীদের শেষ পর্যন্ত সমঅধিকারবঞ্চিত অবস্থাতেই থাকতে হবে। ধর্মীয় বিধানের সত্যিকার অর্থ আধুনিক মুসলমান যেদিন স্থান ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করতে শিখবে, সেদিন তারা লিঙ্গভেদে সমঅধিকারের মর্ম বুঝতে শিখবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বব্যাপী অগ্রসরমানতা অতীত অন্ধকারের অবগুণ্ঠনকে সরিয়ে প্রতিটি ধর্মের মানুষকেই মনুষ্যত্বের আলোয় উদ্ভাসিত করবে।
আরবের গণবিপ্লব আরও একটি বড় কাজ করেছে। এই বিপ্লব বিশ্বের অপরাপর উন্নয়নশীল দেশের স্বৈরাচারী শাসকদের শঙ্কিত করে থাকবে। তারাও এখন নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজেদের ধন-মান-প্রাণ বাঁচানোর উপায় খুঁজছে। বিশেষ করে লাগাতার বিক্ষোভের মুখে মিসরের লৌহমানব হোসনি মোবারক ও তার সাঙ্গাতদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সে দেশের সেনা পরিচালিত অন্তর্বর্তী প্রশাসন বাধ্য হওয়ার পর বিশ্বের তাবৎ লৌহমানবের এখন ঘুম হারাম। স্বৈরশাসনকবলিত দেশগুলোর মানুষের মধ্যে রেডিও, টিভি, পত্রপত্রিকা আরব বিপ্লবের বার্তাকে ভালোভাবেই পেঁৗছে দিয়েছে। যে মানুষ তাদের শাসকের ক্রমিক লৌহ-শাসনকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছিল, সেই মানুষ আরব বিপ্লবে তার মতো মানুষদের অকুতোভয়ে শামিল হতে দেখে উদ্বেলিত হয়ে থাকবে। তারাও ভবিষ্যৎ বিদ্রোহী হওয়ার অপেক্ষায়। আরব বিপ্লবের এই সর্বব্যাপী অ্যাফেক্ট একবিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ইউরোপ-আমেরিকার মানসে মুসলমান মানেই ভীতিকর-জঙ্গি বা প্রতিক্রিয়াশীল বা রক্ষণশীল কোনো টোটেম সমাজের মতো_ আদিম সমাজের একটা বদ্ধ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। আরব বিপ্লব এই মানসে আঘাত হানতে সমর্থর্ হয়েছে। এখানেই এই বিপ্লবের সর্বব্যাপী সাফল্য। শুধু তা-ই নয়, এই গণজোয়ার চীনের মতো দেশকেও বলতে বাধ্য করেছে যে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও একদিন বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে তাদের নিজেদের মতো করেই। অর্থাৎ মানুষ নিজেরাই নিজেদের শাসক হবে_ এই শাশ্বত ধারণাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে আরব বিপ্লব ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাবধারাকে বজায় রেখেও আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিজস্ব আদল খুঁজে নেওয়া সম্ভব_ এই ধারণাও আরব বিপ্লব সামনে নিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের শাশ্বত ধারণাকে এই বিপ্লব এক অর্থে আরও পুষ্ট করেছে বলা যায়।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আরব বিপ্লবের তাৎপর্য কী? দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক হানাহানি এখনও দুষ্টক্ষতের মতো সমাজের ঐক্য-সংহতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ দেশের শাসকরা নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত হলেও এখনও বাক-ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুশাসন নিশ্চিত হয়নি। প্রায় সব দেশেই দলবাজি, দুর্নীতি সমাজের উন্নতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। কোথাও কোথাও মৌলবাদ জঙ্গিবাদের রূপ নিয়ে সামাজিক সংহতির সুতোকে হুমকিগ্রস্ত করছে। আরব বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ার সুশাসন প্রদানে ব্যর্থ সরকারগুলোর জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশের জনগণ অতীতে একনায়কত্ববাদী শাসন মেনে নেয়নি এবং আরব বিপ্লব তাদের এই বিদ্রোহী মনস্তত্ত্বকে আরও শাণিত করবে নিশ্চয়। যেসব দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ এখনও বিরাট হুমকি হয়ে রয়েছে, সেসব দেশের সাধারণ মানুষকে গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে রুখ দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরও জোরদার করবে আরব বিপ্লব। আরব বিপ্লবের প্রভাবে ভারতে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সুশাসন প্রত্যাশী জনজোয়ার হিসেবে দেখা দিতে পারে।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বিরাট এক ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল এই আরব বিপ্লব। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দল, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী শ্রেণী, এমনকি মধ্যবিত্তদের একাংশ এর তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে পারেনি। বিরোধী দলের তো এই ভাবনা বোধেরও অগম্য। আমাদের তো নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা রয়েছেই। আরব বিপ্লব সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক করার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো বাহ্যিক প্রণোদনা জুগিয়েছিল। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণীর কারণে সেটা জাতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্ক যেমন আগে ধর্মনিরপেক্ষতা অর্জন করে পরে গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে, আমরাও প্রথমে গণতন্ত্র ও পরে সাংবিধাানিক সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুরোপুরি প্র্যাকটিস করতে পারতাম। আরব বিপ্লবের প্রভাব সুদূরপ্রসারী বিধায় সময়-সুযোগ আবারও আমাদের সামনে আসতে পারে। তখন যেন আমরা সে সুযোগ হেলায় না হারাই।
আরব বিপ্লব সারা দুনিয়াকেই ঝাঁকুনি দিয়েছে। তবে এর প্রভাবটা বেশি পড়বে ইসলামী ও উন্নয়নশীল দুনিয়ায়। উন্নত বিশ্বে এর প্রভাবটা হবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। ইসলামী জঙ্গিবাদের প্রসারের ফলে ব্যাপকভাবে চর্চিত হাটিংটনের সভ্যতার সংঘাতের রূপকল্পটি আরব বিপ্লব এক ধাক্কায় সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সেটি কালের গর্ভে ঠাঁই নেবে কি-না সেটা নির্ভর করবে আরব বিপ্লবের যুগান্তকারী প্রভাবকে বুকে ধারণ করে মুসলিম বিশ্ব কতটা আধুনিকতাকে ধারণ করতে পারে তার ওপর।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
subashsaha@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.