'প্রাইড অব বাংলাদেশ' by শেখ রোকন

আমাদের অনেকের 'বিবি আপা'কে নিয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপ আছে_ 'বিবি রাসেল : প্রাইড অব বাংলাদেশ'। নিউইয়র্ক প্রবাসী এক বাঙালি তরুণী এর উদ্যোক্তা। বিশ্বে বিবির প্রভাব ও খ্যাতি কতটা বিস্তৃত, গ্রুপটির ওয়াল এর খণ্ডচিত্র। নানা প্রান্ত থেকে তাকে নিয়ে সেখানে থাকে চমৎকার সব কমেন্ট! ওয়ালে ভাষার বৈচিত্র্যও দেখার মতো।

বাংলা, ইংরেজি কিংবা রোমান হরফে বাংলা তো আছেই; ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ, হিন্দিও কম নয়। ফেসবুক ওয়ালটা যেন, শামসুর রাহমান থেকে ধার করে বলা যায় 'যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা'। এই অনুভূতি-বৈচিত্র্যের মধ্যেও যে ঐক্য, তার নাম মুগ্ধতা। সবাই বিবি রাসেলের গুণমুগ্ধ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক এ ফ্যাশন ব্যক্তিত্ব প্রথম দিকে নিজেকে নিয়ে তৈরি ফেসবুক গ্রুপটির খোঁজ জানতেন না। এখন ভাবতে ভালো লাগে যে, বছরতিনেক আগে কথাচ্ছলে আমিই তাকে জানিয়েছিলাম। পরে তার অংশগ্রহণে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সেটি। কেবল গ্রুপ নয়, যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, বিশ্বের ফ্যাশন ও ডিজাইন জগৎকে প্রাণবন্ত করে চলছেন বাংলাদেশের মেয়ে মাসুমা বিবি রাসেল।
শুনতে রূপকথার মতো মনে হয়, ইউরোপীয় মডেলিং ও ফ্যাশন ডিজাইনিং জগতের শীর্ষ সারিতে থাকা অবস্থায় নব্বই দশকের মাঝামাঝি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরেছিলেন বিবি রাসেল। উন্নত বিশ্বের পিছুটান ছিঁড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত তাঁতিপল্লীতে গিয়ে গামছা, খাদি কিংবা জামদানির মতো দেশীয় বস্ত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন। মনোযোগ দিয়েছিলেন পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা হস্তশিল্পকে বিশ্ববাজারে পরিচয় করিয়ে দিতে। চালিয়েছেন হারানো গর্ব মসলিন উদ্ধারের চেষ্টাও। কিছুটা সফলও হয়েছেন। প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়াতেও তিনি তৎপর। বাংলাদেশ ছাড়াও, সারা দুনিয়া বিশেষত পিছিয়ে পড়া এশিয়ার বস্ত্র ও হস্তশিল্প সুরক্ষায়ও তিনি সচেষ্ট। কয়েক বছরের চেষ্টায় ভারতের রাজস্থানের প্রাচীন কোটা শাড়ি পুনরুদ্ধার করেছেন। তবে বিবি রাসেল ম্যাজিক দেখিয়েছেন গামছা দিয়ে। বাংলাদেশের কৃষক-তাঁতির ঘাড়ে ও কোমরে অবহেলায় পড়ে থাকা গামছায় যে বিশ্ব মাতানো সম্ভব, তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন মেধা ও সৌন্দর্যবোধ যুক্ত হলে পুকুরের কচুরিপানায় তৈরি হস্তশিল্প ইউরোপ-আমেরিকার মেগাশপেরও শোভাবর্ধন করতে পারে।
বস্তুত বিবি রাসেলের সার্থকতা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সৌন্দর্য বিশ্বের দরবারে পরিচিত করিয়েছেন। গত বছর জানুয়ারিতে সানডে টাইমসের কাছে তিনি সে কথাই বলেছিলেন_ 'সবাই বাংলাদেশকে দরিদ্র দেশ হিসেবে দেখে; আমি এর সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যে মুগ্ধ। অন্যরা দেশের দারিদ্র্য বিক্রি করতে চায়, আমি দাম হাঁকি আমাদের সৌন্দর্যের।' বিবি রাসেল আসলে বিশ্বকে 'পজিটিভ বাংলাদেশ' দেখাতে চান।
বিবি রাসেল তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর বিশেষ দূত 'ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট' স্বীকৃতির কথা বলতেই হবে। বলতে হবে ২০০৮ সালে এইডস বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত হওয়ার কথা। আরও আগে, ২০০৪ সালে লাভ করেছিলেন ইউনেস্কো পিস প্রাইজ। ওই পুরস্কারে বিবির পূর্বসূরিদের মধ্যে রয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা ও মিখাইল গর্বাচেভের মতো ব্যক্তিত্ব। আর গত বছর পেয়েছেন স্পেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'ক্রস অব অফিসার অব দ্য অর্ডার অব কুইন ইসাবেলা'। পেয়েছেন জার্মানির 'ভিশন অ্যাওয়ার্ড ২০১১'।
আন্তর্জাতিকভাবে কেবল বড় স্বীকৃতিই নয়, ভালোবাসাও পেয়েছেন। দেশের মানুষ, বিশেষ করে তাঁতি ও হস্তশিল্পীদের ভালোবাসাও বিবি রাসেলের জন্য বড় সম্পদ। কিন্তু যিনি বাংলাদেশের সম্পদ ও সৌন্দর্য বিশ্বের দরবারে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছেন অক্লান্তভাবে, তার প্রাপ্য আরও বাড়তি কিছু। বৈশ্বিক ফ্যাশন ও ডিজাইনিং জগতে বাংলাদেশের দাপুটে মেয়ে বিবি রাসেলের জন্মদিনে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ংশৎড়শড়হ@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.