এই দিনে-বাবার জন্য ভালোবাসা by শারমিন নাহার
ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ পড়তেই মনটা আবার খারাপ হয়ে যায় বন্যার। আর মাত্র কদিন বাদেই সে চলে যাবে দূরে। কথাগুলো মনে হলেই চোখটা ভরে ওঠে জলে। নিছক বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়, পড়াশোনার জন্য মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে সুদূরে। ঝুলবারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছিল বন্যা।
কীভাবে থাকবে সে? বিশেষ করে বাবার সঙ্গে ক্রিকেট খেলা দেখা, কখনো বা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জম্পেশ আড্ডা! একটু থেমে তারপর বলে চলে বন্যা, ‘আবার জন্মদিনে প্রথম প্রহরে বাবার হাঁকডাকেই তো ঘুম ভাঙে। আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় দেখি, শিয়রে কেক নিয়ে বাবা হাজির, মুখে সেই চিরচেনা স্মিত হাসি।’ একজন বাবা যে কতটা কাছের বন্ধু হতে পারেন, তা বন্যার কথাগুলোই বলে দেয়।
আজ বাবা দিবস। তারিখের হিসাবে নয়, বরং বারের হিসাবে জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস। যান্ত্রিক এই জীবনে বাবার কথা কি একবার আলাদাভাবে মনে পড়ে আমাদের? কাজের ফাঁকে একবার কি থমকে গিয়ে ভাবি, কেমন আছেন বাবা? কীভাবে কাটছে তাঁর অবসর, সারা বেলা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শর্মিষ্ঠা বলেন, ‘মায়ের চেয়ে বাবাকে বোধ হয় একটু বেশি ভালোবাসি। এ জন্য সময় আর সুযোগ মিললেই বাড়িতে যাই। যাওয়ার সময় চলন্ত ট্রেনে বসে বারবার বাবার মুখটা মনে পড়ে। আর বাড়িতে যাব শুনলেই বাবা বিকেল অবধি অপেক্ষা করেন। না খেয়ে বসে থাকেন। কিংবা পরীক্ষার কথা শুনলেই সারা দিন উপোস দেন সৃষ্টিকর্তার নামে আমার মঙ্গল কামনায়।’
বাবাকে বুঝি মেয়েরা একটু বেশি ভালোবাসে, কিংবা বাবার সঙ্গে মেয়ের সখ্য বোধ করি বেশি হয়? এ কথার ঘোর বিরোধী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তানজিল। ‘মোটেই নয়, বাবার সঙ্গে আমার ঢের মিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি আগ্রহটা তো বাবা থেকেই বর্তেছে। আবার প্রেমের কথা তো বাবাকেই প্রথম জানিয়েছি।’
বাবাকে নিয়ে নানা কাব্য তো আছেই। তবে এই দিবস উদ্যাপনের ইতিহাসটা একবার জেনে নেওয়া যাক।
মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয় ১৯০৯ সাল থেকে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে যখন মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয়, তখন সোনোরা স্মার্ট ডড নামে একটি মেয়ে বাবা দিবস উদ্যাপনের কথা ভাবেন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকারে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হয় বাবা দিবস। কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ তখন দিনটি স্বীকার করে নিতে পারেনি। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্কে ‘বাবা দিবস উদ্যাপন কমিটি গঠিত’ হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাবা দিবস উদ্যাপন শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। ১৯৭২ সালে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। সেই থেকে এখন জুন মাসের তৃতীয় রোববার উদ্যাপিত হয়ে আসছে বাবা দিবস।
ইতিহাসের ঘেরাটোপ থেকে আবার একটু বাস্তবে ফেরা যাক। ‘বাবা’—মাত্র দুই বর্ণের শব্দ। অথচ এই শব্দের মধ্যে আছে নির্ভরতা, আছে গভীরতা।
‘বাবার পায়ের ওপর পা রেখে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখা। এরপর বাবার হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডল চেনা। সবকিছুতেই বাবার আধিপত্য। প্রথম চাকরি পেয়ে মনে পড়েছিল বাবার মুখখানা।’ কথাগুলো সরকারি চাকুরে সাজেদুর রহমানের।
বাবাকে নিয়ে ইতিহাসে আছে নানা উদাহরণ। ইন্দিরা গান্ধীর সামনে বিশ্ব ইতিহাস জানার দরজা খুলে দিলেন তো বাবা নেহরু।
বাবার জন্য সাহিত্যে স্তুতি আছে ঢের। ঘুরে আসা যাক সেই সাহিত্যের জগৎ থেকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তো বলেছেন, জ্ঞানী বাবা সেই জন, যিনি তাঁর সন্তানকে জানেন।
আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ইউরিপিডিস বলেন, বিজ্ঞ পিতার সন্তান বিজ্ঞই হয়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতে, ’বাবা’— এই শব্দটার যতটুকু পবিত্রতা, তা তো ঈশ্বরই দিয়ে রেখেছেন।
বাবাকে নিয়ে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ছেলেদের। শৈশবে বাবাকে মনে হয় সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ; একটু বয়স হলেই মনে হয় বাবা কিছু বিষয় জানেন, কিছু বিষয় জানেন না। তারপর বয়স যখন আরেকটু বাড়ে, তখন মনে হয় বাবার ভাবনা-চিন্তা সবই সেকেলে। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন মনে হয় বাবার সঙ্গে আরেকটু আলাপ করে নিলে হতো। কিছু কিছু বিষয়ে তো বাবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। বয়স বাড়তে থাকলেই মনে হয়, বাবা যে কথাগুলো বলেছেন, সে কথার সত্যিই মূল্য আছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে বাবা ও মেয়ের দারুণ সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি কি আমাদের মনে পড়ে না? কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের দীপু নাম্বার টু তে বাবা-ছেলের যে সম্পর্ক, তা নিশ্চয় আমাদের ভাবায়। নিন্দুকেরা আবার বলে বসেন, বাবাকে কি কেবল একটা দিন ভালোবাসব?
উত্তরটা বেশ জোরালোভাবেই দেওয়া যায়। বাবাকে আমরা দিনমান ভালোবাসি এবং বাসব। তবে যেখানে বাবার জন্যই গোটা দিনটা, সেখানে বাবাকে একটিবারের জন্য আলাদাভাবে মনে করলে ক্ষতি কী? অন্তত একবার বলি, ‘বাবা, তোমাকে কিন্তু সত্যিই ভালোবাসি।’
শারমিন নাহার
আজ বাবা দিবস। তারিখের হিসাবে নয়, বরং বারের হিসাবে জুনের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস। যান্ত্রিক এই জীবনে বাবার কথা কি একবার আলাদাভাবে মনে পড়ে আমাদের? কাজের ফাঁকে একবার কি থমকে গিয়ে ভাবি, কেমন আছেন বাবা? কীভাবে কাটছে তাঁর অবসর, সারা বেলা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শর্মিষ্ঠা বলেন, ‘মায়ের চেয়ে বাবাকে বোধ হয় একটু বেশি ভালোবাসি। এ জন্য সময় আর সুযোগ মিললেই বাড়িতে যাই। যাওয়ার সময় চলন্ত ট্রেনে বসে বারবার বাবার মুখটা মনে পড়ে। আর বাড়িতে যাব শুনলেই বাবা বিকেল অবধি অপেক্ষা করেন। না খেয়ে বসে থাকেন। কিংবা পরীক্ষার কথা শুনলেই সারা দিন উপোস দেন সৃষ্টিকর্তার নামে আমার মঙ্গল কামনায়।’
বাবাকে বুঝি মেয়েরা একটু বেশি ভালোবাসে, কিংবা বাবার সঙ্গে মেয়ের সখ্য বোধ করি বেশি হয়? এ কথার ঘোর বিরোধী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তানজিল। ‘মোটেই নয়, বাবার সঙ্গে আমার ঢের মিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি আগ্রহটা তো বাবা থেকেই বর্তেছে। আবার প্রেমের কথা তো বাবাকেই প্রথম জানিয়েছি।’
বাবাকে নিয়ে নানা কাব্য তো আছেই। তবে এই দিবস উদ্যাপনের ইতিহাসটা একবার জেনে নেওয়া যাক।
মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয় ১৯০৯ সাল থেকে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে যখন মা দিবস উদ্যাপন শুরু হয়, তখন সোনোরা স্মার্ট ডড নামে একটি মেয়ে বাবা দিবস উদ্যাপনের কথা ভাবেন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকারে প্রথমবারের মতো উদ্যাপিত হয় বাবা দিবস। কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ তখন দিনটি স্বীকার করে নিতে পারেনি। ১৯২৬ সালে নিউইয়র্কে ‘বাবা দিবস উদ্যাপন কমিটি গঠিত’ হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাবা দিবস উদ্যাপন শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। ১৯৭২ সালে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। সেই থেকে এখন জুন মাসের তৃতীয় রোববার উদ্যাপিত হয়ে আসছে বাবা দিবস।
ইতিহাসের ঘেরাটোপ থেকে আবার একটু বাস্তবে ফেরা যাক। ‘বাবা’—মাত্র দুই বর্ণের শব্দ। অথচ এই শব্দের মধ্যে আছে নির্ভরতা, আছে গভীরতা।
‘বাবার পায়ের ওপর পা রেখে হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটা শেখা। এরপর বাবার হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিমণ্ডল চেনা। সবকিছুতেই বাবার আধিপত্য। প্রথম চাকরি পেয়ে মনে পড়েছিল বাবার মুখখানা।’ কথাগুলো সরকারি চাকুরে সাজেদুর রহমানের।
বাবাকে নিয়ে ইতিহাসে আছে নানা উদাহরণ। ইন্দিরা গান্ধীর সামনে বিশ্ব ইতিহাস জানার দরজা খুলে দিলেন তো বাবা নেহরু।
বাবার জন্য সাহিত্যে স্তুতি আছে ঢের। ঘুরে আসা যাক সেই সাহিত্যের জগৎ থেকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তো বলেছেন, জ্ঞানী বাবা সেই জন, যিনি তাঁর সন্তানকে জানেন।
আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ইউরিপিডিস বলেন, বিজ্ঞ পিতার সন্তান বিজ্ঞই হয়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতে, ’বাবা’— এই শব্দটার যতটুকু পবিত্রতা, তা তো ঈশ্বরই দিয়ে রেখেছেন।
বাবাকে নিয়ে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় ছেলেদের। শৈশবে বাবাকে মনে হয় সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ; একটু বয়স হলেই মনে হয় বাবা কিছু বিষয় জানেন, কিছু বিষয় জানেন না। তারপর বয়স যখন আরেকটু বাড়ে, তখন মনে হয় বাবার ভাবনা-চিন্তা সবই সেকেলে। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন মনে হয় বাবার সঙ্গে আরেকটু আলাপ করে নিলে হতো। কিছু কিছু বিষয়ে তো বাবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। বয়স বাড়তে থাকলেই মনে হয়, বাবা যে কথাগুলো বলেছেন, সে কথার সত্যিই মূল্য আছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে বাবা ও মেয়ের দারুণ সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি কি আমাদের মনে পড়ে না? কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের দীপু নাম্বার টু তে বাবা-ছেলের যে সম্পর্ক, তা নিশ্চয় আমাদের ভাবায়। নিন্দুকেরা আবার বলে বসেন, বাবাকে কি কেবল একটা দিন ভালোবাসব?
উত্তরটা বেশ জোরালোভাবেই দেওয়া যায়। বাবাকে আমরা দিনমান ভালোবাসি এবং বাসব। তবে যেখানে বাবার জন্যই গোটা দিনটা, সেখানে বাবাকে একটিবারের জন্য আলাদাভাবে মনে করলে ক্ষতি কী? অন্তত একবার বলি, ‘বাবা, তোমাকে কিন্তু সত্যিই ভালোবাসি।’
শারমিন নাহার
No comments