শেয়ারবাজার-উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে by ফারুক মঈনউদ্দীন
পত্রিকার প্রথম পাতায় একটা ছবি দেখে এই লেখাটা শুরু করার একটা প্রসঙ্গ মিলে যায়। ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা একটা ব্যানার হাতে দাঁড়ানো, ব্যানারের আংশিক ছবি দেখে অনুমান করা যায় যে তাঁরা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করছেন।
বিক্ষোভকারীদের হাতে সুদৃশ্য ব্যানার দেখে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে বিক্ষোভ প্রদর্শন তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়, বরং পরিকল্পিত ও প্রস্তুতিসম্পন্ন। বছরের শুরু থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে এ রকম বিক্ষোভ প্রদর্শন এখন আর নতুন ঘটনা নয়। পাঁচ-ছয় মাস ধরে দৃশ্যটা মানুষের একরকম গা সওয়া হয়ে গেছে। সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন, বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছেন—তাতে এই বিক্ষোভ তাঁদের অধিকার। বছরের প্রথম থেকে দেশের শেয়ারবাজারে ধস নামার পর থেকে একটা বিষয় লক্ষ করা যায় যে এসব বিক্ষোভের ফলে বাজারকে কৃত্রিমভাবে ফাঁপিয়ে তোলা এবং এর সুযোগে বিশাল অঙ্কের লাভ তুলে নিয়ে সটকে পড়ার যাঁরা মূল হোতা, তাঁরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছেন। ধসের জন্য সবার রোষ যেন কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অথচ সবাই জানেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামের প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, শেয়ারবাজারের মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে ২০১০-এর প্রথম দিকেই শেয়ারবাজারে বড় কোনো বিপর্যয়ের আভাস দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যেহেতু শেয়ারবাজার একটা স্পর্শকাতর জায়গা, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে এক সেমিনারে আমন্ত্রণ করে ব্যাংকের পরিচালিত এক গবেষণা সমীক্ষাপত্রের তথ্য-উপাত্ত ও সুপারিশগুলো প্রকাশ করেছিল। বাজারের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে এমনকি এই সেমিনারের খবর সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে জানা গেছে, এই গবেষণায় বাজার যে অতিমূল্যায়িত, সেই সত্যও স্বীকার করতে আপত্তি ছিল দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের। আমেরিকায় ১৯২৯ সালের মার্চে যখন একবার বাজারে ধসের লক্ষণসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিছু ব্যাংক মার্জিন ঋণ অব্যাহত রেখে সেই আসন্ন পতন ঠেকাতে চেয়েছিল, তবে শেষাবধি তা আর সম্ভব হয়নি। এ সময় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি বাজারের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের আভাস দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও তেমন কিছুই ঘটে না। ফলে স্বভাবতই তাঁদের সাবধানবাণী উপেক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে সেই রুদ্ধদ্বার সেমিনারে শেয়ারবাজারের মতিগতি বিশ্লেষণ করে একটা ধসের পূর্বাভাস দিতে চেয়েছিল এবং স্পষ্টতই সেটা উপেক্ষিত হয়। ফলে মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে অপ্রতিরোধ্যভাবে পতন ঘটে বাজারে।
তবে বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অন্য অংশীদারেরা এই গবেষণালব্ধ, অভিজ্ঞানলব্ধ পূর্বাভাসকে উপেক্ষা করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার-সম্পৃক্ততা বিষয়ে তদারকি আরও নিবিড় করেছিল। সেই নিবিড় তদারকির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নয়, বরং সামষ্টিক অর্থনীতি ও মুদ্রাবাজারকেন্দ্রিক। পুঁজিবাজারের দ্রুত উত্থান ও আকস্মিক পতন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, সেটা নিরসন করা উচিত। কারণ এবারের বাজার ধসের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়েছে, এমনকি বাজার কারসাজির হোতা হিসেবে যাঁদের বিরুদ্ধে সন্দেহের আঙুল ওঠানো আছে, তাঁরাই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো বাংলাদেশ ব্যাংককে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেভাবে দোষারোপ করা হয়েছে, শেয়ারবাজার ধসের ঘটনায় এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। গত বিশ-ত্রিশের দশকে সহজলভ্য ঋণের টাকায় শেয়ারবাজার যাতে অতিমূল্যায়িত হয়ে না পড়ে, তার জন্য আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুদ্রানীতি কঠোর করেছিল। ঠিক একই উদ্দেশ্যে ব্রোকার হাউসগুলোকে দেওয়া ব্যাংকঋণের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছিল সে সময়। সে কারণে ১৯২৯ সালের মহাধসের পর আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এ রকম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কঠোর মুদ্রানীতি চালু করার জন্য। তাই ধসের পর থেকে বাজারে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ফেডারেল রিজার্ভকে ক্রমে ক্রমে সুদের হার কমিয়ে আনতে হয়েছিল প্রায় দুই শতাংশ। এর ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আবারও স্টক ব্রোকার ও ডিলারদের ঋণ দেওয়া শুরু করে। অতএব, কঠোর মুদ্রানীতির জন্য আমেরিকার মতো দেশে ৮০ বছর আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করা উচিত, যদি মানুষের হাতে বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ট কিংবা সহজলভ্য ঋণের টাকা থাকে, তাহলে মানুষ একটা উঠতি বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে; আর বাজারে যদি দ্রুত লোভের হাতছানি থাকে, তাহলে মানুষ পতঙ্গের মতো ছুটে যাবে সেই বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য। শেয়ারবাজারের এই প্রবণতা যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায় মানুষ যখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পূর্বাপর বিবেচনা না করে কোম্পানির মৌল ভিত্তিগুলো উপেক্ষা করে কেবল অন্যের প্ররোচনায় কিংবা গুজবের সূত্র ধরে ক্রমাগত কিনতে থাকে, তখন বাজার চাঙা থেকে উত্তপ্ত হয়, সৃষ্টি হয় বুদ্বুদের। বাজারের এই প্রবণতা এবং মানুষের এ রকম আচরণ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও ঘটতে দেখা গেছে। যদিও শেয়ারবাজার একটা বিশেষ ধরনের বাজার, তবু অর্থনীতির চাহিদা সরবরাহের নিয়মগুলো এখানে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। বাজারে শেয়ারের দাম যখন কম থাকে, তখন ক্রেতাদের বেশি করে কিনতে আগ্রহী হওয়ার কথা, যাতে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি ঘটে। এভাবে চাহিদার চাপে দাম বাড়তে বাড়তে বুদ্বুদ বড় হতে থাকে এবং একসময় বিস্ফোরিত হয়। বাজারের চাহিদা ও মূল্যতত্ত্বের সঙ্গে এখানে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে যে সাধারণত পণ্যবাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে চাহিদা কমে, কিন্তু শেয়ারবাজারে চাহিদাতত্ত্বের এই মূলনীতিটা লঙ্ঘিত হয়। বরং একটা চাঙা বাজারে শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন মানুষের চাহিদা না কমে বরং বেড়ে যায় এবং আরও বেশি দামে দ্রুত বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তোলার লোভে মানুষ চাহিদাতত্ত্ব লঙ্ঘন করে। এমনকি বাজার যখন তুঙ্গে, যখন আর কেনার সময় নয়, তখনো মানুষ আরও লাভের আশায় সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কিনতে থাকে। এটা আমাদের দেশে ১৯৯৫-৯৬ সালে ঘটেছে এবং ঘটেছে ২০১০-এর শেষেও। বিশ্বের বড় বড় সব বাজার ধসের আগেও অর্থাৎ সেই সপ্তদশ শতাব্দীর টিউলিপ বিকারের সময় কিংবা অষ্টাদশ শতাব্দীর সাউথ সিজ বাবলের উন্মত্ততায়, ১৯২৯ সালের মহাধসের আগে অথবা ডটকম বাবল বা আমেরিকান হাউজিং বাবলের সময় ঠিক এ রকম আচরণই করছিলেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজারে লোভ ও আতঙ্ক দুটোই পরিহার্য বিষয়; অথচ দেশে দেশে কালে কালে মানুষ এই দুই আচরণ পরিহার না করে বাজারের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
আজ লাখ লাখ বিনিয়োগকারী অজ্ঞানতা কিংবা লোভের বশবর্তী হয়ে—যেভাবেই হোক বাজার করসাজির শিকার হয়ে প্রচুর লোকসানের মুখোমুখি। বাজারে যে কারসাজি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহও নেই। এই কারসাজি রোধ করার দায়িত্ব ছিল পুঁজিবাজারের মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির, যাতে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতা বলাও বোধকরি এখানে সঠিক হচ্ছে না; বরং বলা উচিত, কারসাজি রোধ করার জন্য সংস্থাটির কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে আর্থবাজারের আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার অধীন প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক ও স্বীকৃত নিয়মানুযায়ী পুঁজিবাজারে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু বেশ কয়েকটি ব্যাংকের তখন ছুঁচো গেলার অবস্থা। সেদিন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারের সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতা থেকে বিরত না রাখত, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতে যে বিপর্যয় নেমে আসত, তা কল্পনাতীত। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সীমা লঙ্ঘনকারী ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিংবা নিরুপায় হয়ে যখন বাজার থেকে হাত গুটিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সংকোচনের অমোঘ অস্ত্রটি প্রয়োগ করে, অর্থাৎ নগদ তারল্য সংরক্ষণের হার বাড়িয়ে দেয়, যাতে ব্যাংকগুলোর ঋণদানের ক্ষমতা কমে যায়। এই অস্ত্রটি অবশ্য প্রয়োগ করা হয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য। কারণ মুদ্রাস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যেমন সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায়িত্ব মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার কারসাজির মূল হোতাদের রোষানলে যেমন পড়েছে, তেমনি ভুল বোঝানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। অথচ বাজারের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী একটা বিষয়, কিছু বড় বিনিয়োগকারীর অতি তৎপরতায় সেটা কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে মাত্র। বছর শেষে ব্যাংকসহ অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আকাশচুম্বী বাজার থেকে লাভ তুলে নিয়ে হিসাব মেলাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
অতএব, বাজারের পতনের জন্য উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপিয়ে এখন সবার উচিত বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া। তবে কেউ যদি মনে করেন, স্বাভাবিক অবস্থার অর্থ বাজারের মূল্যসূচক আট হাজারের ঘরে গিয়ে পৌঁছা, সেটাও হবে অযৌক্তিক। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তাই সবাই তাকিয়ে আছে পুনর্গঠিত এসইসির দিকে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে ২০১০-এর প্রথম দিকেই শেয়ারবাজারে বড় কোনো বিপর্যয়ের আভাস দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যেহেতু শেয়ারবাজার একটা স্পর্শকাতর জায়গা, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে এক সেমিনারে আমন্ত্রণ করে ব্যাংকের পরিচালিত এক গবেষণা সমীক্ষাপত্রের তথ্য-উপাত্ত ও সুপারিশগুলো প্রকাশ করেছিল। বাজারের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে এমনকি এই সেমিনারের খবর সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে জানা গেছে, এই গবেষণায় বাজার যে অতিমূল্যায়িত, সেই সত্যও স্বীকার করতে আপত্তি ছিল দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের। আমেরিকায় ১৯২৯ সালের মার্চে যখন একবার বাজারে ধসের লক্ষণসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কিছু ব্যাংক মার্জিন ঋণ অব্যাহত রেখে সেই আসন্ন পতন ঠেকাতে চেয়েছিল, তবে শেষাবধি তা আর সম্ভব হয়নি। এ সময় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি বাজারের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের আভাস দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও তেমন কিছুই ঘটে না। ফলে স্বভাবতই তাঁদের সাবধানবাণী উপেক্ষিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে সেই রুদ্ধদ্বার সেমিনারে শেয়ারবাজারের মতিগতি বিশ্লেষণ করে একটা ধসের পূর্বাভাস দিতে চেয়েছিল এবং স্পষ্টতই সেটা উপেক্ষিত হয়। ফলে মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে অপ্রতিরোধ্যভাবে পতন ঘটে বাজারে।
তবে বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অন্য অংশীদারেরা এই গবেষণালব্ধ, অভিজ্ঞানলব্ধ পূর্বাভাসকে উপেক্ষা করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার-সম্পৃক্ততা বিষয়ে তদারকি আরও নিবিড় করেছিল। সেই নিবিড় তদারকির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নয়, বরং সামষ্টিক অর্থনীতি ও মুদ্রাবাজারকেন্দ্রিক। পুঁজিবাজারের দ্রুত উত্থান ও আকস্মিক পতন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, সেটা নিরসন করা উচিত। কারণ এবারের বাজার ধসের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা হয়েছে, এমনকি বাজার কারসাজির হোতা হিসেবে যাঁদের বিরুদ্ধে সন্দেহের আঙুল ওঠানো আছে, তাঁরাই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো বাংলাদেশ ব্যাংককে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছেন। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যেভাবে দোষারোপ করা হয়েছে, শেয়ারবাজার ধসের ঘটনায় এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। গত বিশ-ত্রিশের দশকে সহজলভ্য ঋণের টাকায় শেয়ারবাজার যাতে অতিমূল্যায়িত হয়ে না পড়ে, তার জন্য আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুদ্রানীতি কঠোর করেছিল। ঠিক একই উদ্দেশ্যে ব্রোকার হাউসগুলোকে দেওয়া ব্যাংকঋণের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছিল সে সময়। সে কারণে ১৯২৯ সালের মহাধসের পর আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এ রকম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কঠোর মুদ্রানীতি চালু করার জন্য। তাই ধসের পর থেকে বাজারে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ফেডারেল রিজার্ভকে ক্রমে ক্রমে সুদের হার কমিয়ে আনতে হয়েছিল প্রায় দুই শতাংশ। এর ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আবারও স্টক ব্রোকার ও ডিলারদের ঋণ দেওয়া শুরু করে। অতএব, কঠোর মুদ্রানীতির জন্য আমেরিকার মতো দেশে ৮০ বছর আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।
এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করা উচিত, যদি মানুষের হাতে বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ট কিংবা সহজলভ্য ঋণের টাকা থাকে, তাহলে মানুষ একটা উঠতি বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবে; আর বাজারে যদি দ্রুত লোভের হাতছানি থাকে, তাহলে মানুষ পতঙ্গের মতো ছুটে যাবে সেই বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য। শেয়ারবাজারের এই প্রবণতা যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায় মানুষ যখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পূর্বাপর বিবেচনা না করে কোম্পানির মৌল ভিত্তিগুলো উপেক্ষা করে কেবল অন্যের প্ররোচনায় কিংবা গুজবের সূত্র ধরে ক্রমাগত কিনতে থাকে, তখন বাজার চাঙা থেকে উত্তপ্ত হয়, সৃষ্টি হয় বুদ্বুদের। বাজারের এই প্রবণতা এবং মানুষের এ রকম আচরণ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও ঘটতে দেখা গেছে। যদিও শেয়ারবাজার একটা বিশেষ ধরনের বাজার, তবু অর্থনীতির চাহিদা সরবরাহের নিয়মগুলো এখানে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। বাজারে শেয়ারের দাম যখন কম থাকে, তখন ক্রেতাদের বেশি করে কিনতে আগ্রহী হওয়ার কথা, যাতে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি ঘটে। এভাবে চাহিদার চাপে দাম বাড়তে বাড়তে বুদ্বুদ বড় হতে থাকে এবং একসময় বিস্ফোরিত হয়। বাজারের চাহিদা ও মূল্যতত্ত্বের সঙ্গে এখানে একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে যে সাধারণত পণ্যবাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে চাহিদা কমে, কিন্তু শেয়ারবাজারে চাহিদাতত্ত্বের এই মূলনীতিটা লঙ্ঘিত হয়। বরং একটা চাঙা বাজারে শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন মানুষের চাহিদা না কমে বরং বেড়ে যায় এবং আরও বেশি দামে দ্রুত বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তোলার লোভে মানুষ চাহিদাতত্ত্ব লঙ্ঘন করে। এমনকি বাজার যখন তুঙ্গে, যখন আর কেনার সময় নয়, তখনো মানুষ আরও লাভের আশায় সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কিনতে থাকে। এটা আমাদের দেশে ১৯৯৫-৯৬ সালে ঘটেছে এবং ঘটেছে ২০১০-এর শেষেও। বিশ্বের বড় বড় সব বাজার ধসের আগেও অর্থাৎ সেই সপ্তদশ শতাব্দীর টিউলিপ বিকারের সময় কিংবা অষ্টাদশ শতাব্দীর সাউথ সিজ বাবলের উন্মত্ততায়, ১৯২৯ সালের মহাধসের আগে অথবা ডটকম বাবল বা আমেরিকান হাউজিং বাবলের সময় ঠিক এ রকম আচরণই করছিলেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজারে লোভ ও আতঙ্ক দুটোই পরিহার্য বিষয়; অথচ দেশে দেশে কালে কালে মানুষ এই দুই আচরণ পরিহার না করে বাজারের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
আজ লাখ লাখ বিনিয়োগকারী অজ্ঞানতা কিংবা লোভের বশবর্তী হয়ে—যেভাবেই হোক বাজার করসাজির শিকার হয়ে প্রচুর লোকসানের মুখোমুখি। বাজারে যে কারসাজি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহও নেই। এই কারসাজি রোধ করার দায়িত্ব ছিল পুঁজিবাজারের মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির, যাতে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতা বলাও বোধকরি এখানে সঠিক হচ্ছে না; বরং বলা উচিত, কারসাজি রোধ করার জন্য সংস্থাটির কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে আর্থবাজারের আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার অধীন প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংকগুলোকে স্বাভাবিক ও স্বীকৃত নিয়মানুযায়ী পুঁজিবাজারে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু বেশ কয়েকটি ব্যাংকের তখন ছুঁচো গেলার অবস্থা। সেদিন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারের সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতা থেকে বিরত না রাখত, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতে যে বিপর্যয় নেমে আসত, তা কল্পনাতীত। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সীমা লঙ্ঘনকারী ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিংবা নিরুপায় হয়ে যখন বাজার থেকে হাত গুটিয়ে আনতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সংকোচনের অমোঘ অস্ত্রটি প্রয়োগ করে, অর্থাৎ নগদ তারল্য সংরক্ষণের হার বাড়িয়ে দেয়, যাতে ব্যাংকগুলোর ঋণদানের ক্ষমতা কমে যায়। এই অস্ত্রটি অবশ্য প্রয়োগ করা হয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য। কারণ মুদ্রাস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যেমন সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা, তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায়িত্ব মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই অত্যাবশ্যকীয় কাজটি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার কারসাজির মূল হোতাদের রোষানলে যেমন পড়েছে, তেমনি ভুল বোঝানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। অথচ বাজারের পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী একটা বিষয়, কিছু বড় বিনিয়োগকারীর অতি তৎপরতায় সেটা কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে মাত্র। বছর শেষে ব্যাংকসহ অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আকাশচুম্বী বাজার থেকে লাভ তুলে নিয়ে হিসাব মেলাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
অতএব, বাজারের পতনের জন্য উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপিয়ে এখন সবার উচিত বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া। তবে কেউ যদি মনে করেন, স্বাভাবিক অবস্থার অর্থ বাজারের মূল্যসূচক আট হাজারের ঘরে গিয়ে পৌঁছা, সেটাও হবে অযৌক্তিক। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তাই সবাই তাকিয়ে আছে পুনর্গঠিত এসইসির দিকে।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments