নারী নির্যাতন-রুমানার ঘটনা কি ‘চাঞ্চল্যকর’? by নাসরিন খন্দকার
নিপীড়ক সাইদকে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমের সামনে আনা হলো। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে বারবার দেখানো হলো তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন। মিডিয়ার সামনে তদন্ত কর্মকর্তা ‘চাঞ্চল্যকর’ মামলা হিসেবে ঘোষণা দিলেন পারিবারিক নির্যাতনের নৃশংস উদাহরণ ‘স্বামী’ সাইদ কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরের নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা। তদন্ত কর্মকর্তা এখন এই মামলার সবদিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
রুমানা এখন অন্ধত্বের সঙ্গে লড়ছে। ৫ জুনের ঘটনা এটি। ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর পত্রিকায় খবরটি আসে। ঘটনার পরদিনই নির্যাতিতার বাবা থানায় মামলা করেন। তখন তাঁকে খুঁজে পাওয়ার কী চেষ্টা করেছে পুলিশ, তা জানা না গেলেও এটা জানা গেছে যে নির্যাতক ‘পলাতক’। তখন পর্যন্ত এটি ছিল একজন স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের ‘নীরস’ মামলা। সে সময় আসামি ধরার বিষয়ে পুলিশের তেমন কোনো চাঞ্চল্য দেখা যায়নি। অবশেষে নিপীড়ককে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না—মর্মে আদালতের রুল জারির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের নড়াচড়া শুরু হয়। আদালতের তাগাদা পেয়ে এই নড়াচড়ার ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার হন নির্যাতক। পারিবারিক নির্যাতনের নীরস মামলায় নির্যাতিত নারীর চরিত্রকেন্দ্রিক আলোচনা ঘটনাটিকে সফলভাবে ‘চাঞ্চল্যকর’ করে তুলতে পেরেছে। বোঝা গেল কোন মামলা কোন মসলায়, কোন আলোচনায়, কাদের কাছে, কোন সময়ে চাঞ্চল্যকর হয়ে ওঠে।
অনেকের কাছেই এটি বিস্ময়কর একটি ঘটনা। তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন কীভাবে একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ এমন নির্যাতন করতে পারেন, কীভাবেই বা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ওপর এমন হামলা হতে পারে? আবার আমার চারপাশের বেশির ভাগ নারীকে কিন্তু অবাক হতে দেখি না, অনেকেই স্বগতোক্তির মতো করে বলতেও থাকেন, ‘রুমানার ক্ষত দৃশ্যমান, আর ঘরে ঘরে প্রতিদিন হাজারো নারী এমন ক্ষত নিয়ে থাকেন, যা দেখা যায় না।’ আমরা এই ক্ষত দেখতে পাই না বলেই কি বিস্মিত হই, রুমানার ওপর নৃশংস হামলাকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়?
রুমানা যে কত ভালো, কত জনপ্রিয়, কত মেধাবী—পরিচিত ব্যক্তিরা বারবার বলে গেছেন। প্রশ্নাতীতভাবে তিনি মেধাবী ও মিষ্টভাষী। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখি একবারও, নিপীড়নের ঘটনায় নির্যাতিতার চরিত্র কেন এত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে? নিপীড়নে রক্তাক্ত নারীর পাশে দাঁড়াতে কি আরও কোনো কারণ প্রয়োজন পড়ে? রুমানার নিপীড়নকে বুঝতে, তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, তাঁর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে কি রুমানার ‘ভালো’ মেয়ে হওয়া জরুরি? তিনি ভালো না হলে কি এই নিপীড়ন যৌক্তিক হয়ে যায়? নির্যাতনের পর রুমানা ‘ভালো’ মেয়ে, এই আলোচনা আসে সেই সামাজিক মন থেকে, যেখানে ধরে নেওয়া হয়, ভালো মেয়ে নয়, ‘খারাপ’ মেয়ের প্রতি নির্যাতন হয়। কেননা ‘খারাপ’ মেয়ে নিপীড়ন একভাবে আহ্বান করে, নির্যাতনের কারণ সৃষ্টি করে।
রুমানা ভালো কি খারাপ, সেই প্রসঙ্গ এই অপরাধের আলোচনায় তাই অপ্রাসঙ্গিক। বরং যদি কিছু প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা হলো রুমানার নীরবতার। তাহলে যাঁরা রুমানার ভালোত্বকে তুলে ধরতে চাইছেন, তাঁরা কি তাঁর এই নীরবতাকেও উদ্যাপন করবেন? আমরা কি আমাদের কন্যাসন্তানদের এমন নীরব ‘ভালো’ হতে উৎসাহ দেব? যে সামাজিক পরিস্থিতি রুমানাকে মুখ খুলতে দেয়নি, আমরা কি সেই পরিস্থিতি বহাল রাখব? আর কত রুমানার মতো নীরব ‘ভালো’ মেয়ে রক্ত দিলে তবে ভালো মেয়ের এই সংজ্ঞা পাল্টাবে?
সাইদ গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নানাজনকে এই নৃশংসতার কারণ খুঁজতে দেখা গেছে। সমাজের অধিপতিসুলভ পুরুষতান্ত্রিক সহানুভূতি অর্জনের জন্য সাইদ ১০ দিন সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। পুলিশও গ্রেপ্তারে গড়িমসি করে এই সময় তাঁকে দিয়েছে। সমাজের অনেকের মনে সাইদের ভাষ্যে রুমানার চরিত্র জানার আগ্রহ দানা বেঁধেছে। কী ধরনের গল্প ফাঁদলে পুরুষতান্ত্রিক ‘আগ্রহ’ মিটিয়ে সহানুভূতি পাওয়া যায়, তা বুঝতে সাইদের ধারালো মস্তিষ্ক ভুল করেনি। বুঝেশুনেই তাই তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন এই সমাজে নারীর সবচেয়ে বড় ভীতিকে, নারীর প্রতি ব্যবহূত সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র কুৎসা ও চরিত্র হননকে।
প্রথমে তিনি পুরুষের শারীরিক শক্তির দাপটে স্ত্রীকে পদানত করতে না পারার প্রতিশোধ নিতে জ্ঞানী স্ত্রীকে অন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি নেমেছেন স্ত্রীর ‘চরিত্র’ নষ্ট করার চেষ্টায়। প্রথমে দেখিয়েছেন গায়ের জোর, পরে ব্যবহার করেছেন সামাজিক শক্তি। হাসান সাইদ পুরুষের এই দুই শক্তি, যা দিয়ে নারী নির্যাতিত হয়, সে সম্পর্কে দারুণ সচেতন। তাই ধারালো মস্তিষ্কের, ঠান্ডা মাথার নিপীড়ক সাইদ এখন নিজেকে মানসিক অসুস্থ হিসেবে দেখানোর রাস্তা পাকা করছেন। এই রাস্তা একইভাবে তাঁর অপরাধের কারণ খোঁজার আগ্রহ থেকে বা তাঁর অপরাধকে সাইকিক কেস হিসেবে দেখার পাবলিক প্রবণতা থেকেও সমান্তরালে তৈরি হচ্ছে। রুমানার প্রতি সহানুভূতির জন্য তাঁর ‘ভালোত্ব’ তুলে ধরা বা নির্যাতক সাইদের প্রতি সহানুভূতি টানার জন্য রুমানাকে ‘খারাপ’ মেয়ে প্রমাণ করা, উভয়েই তাই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দুই দিক, মুদ্রার দুই পিঠ মাত্র।
এখন তাই পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক চেতনায় নিপীড়ক হাসান সাইদের পরিচিতি ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’, আর রুমানা ‘ভালো’ মেয়ে হতে ‘স্খলিত/নিপীড়ন আহ্বানকারী নারী’ পরিচয়ে বদলাতে থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় তাই চিহ্নিত নিপীড়ক আর সমাজে বিদ্যমান পুরুষালি নিপীড়ন মানসিকতা হাতে হাত ধরে কাজ করে যাবে। বরাবরের মতোই নিপীড়িতের ভালোত্ব/মন্দত্ব আলোচনার মুখরোচক বিষয়ে পরিণত হবে। বেশ কিছুদিন পত্রিকার পাতা গরম থাকবে রুমানা আর সাইদের দাম্পত্য বিশ্লেষণে, পরকীয়ার আবশ্যিক অনুসন্ধানে, রুমানার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদে। সাইদ নয়, রুমানাকেই এখন তাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত করা হবে, আরেকভাবে নিপীড়ন করা হবে তাঁকে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় রুমানার নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র, নিপীড়নের চরম দৃষ্টান্ত চাপা পড়ে যাবে তাদের দাম্পত্যের রসাল আলোচনায়।
আমরা কি তা হতে দেব?
নাসরিন খন্দকার: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
nasrin.khandoker@gmail.com
অনেকের কাছেই এটি বিস্ময়কর একটি ঘটনা। তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন কীভাবে একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ এমন নির্যাতন করতে পারেন, কীভাবেই বা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার ওপর এমন হামলা হতে পারে? আবার আমার চারপাশের বেশির ভাগ নারীকে কিন্তু অবাক হতে দেখি না, অনেকেই স্বগতোক্তির মতো করে বলতেও থাকেন, ‘রুমানার ক্ষত দৃশ্যমান, আর ঘরে ঘরে প্রতিদিন হাজারো নারী এমন ক্ষত নিয়ে থাকেন, যা দেখা যায় না।’ আমরা এই ক্ষত দেখতে পাই না বলেই কি বিস্মিত হই, রুমানার ওপর নৃশংস হামলাকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়?
রুমানা যে কত ভালো, কত জনপ্রিয়, কত মেধাবী—পরিচিত ব্যক্তিরা বারবার বলে গেছেন। প্রশ্নাতীতভাবে তিনি মেধাবী ও মিষ্টভাষী। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখি একবারও, নিপীড়নের ঘটনায় নির্যাতিতার চরিত্র কেন এত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে? নিপীড়নে রক্তাক্ত নারীর পাশে দাঁড়াতে কি আরও কোনো কারণ প্রয়োজন পড়ে? রুমানার নিপীড়নকে বুঝতে, তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, তাঁর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে কি রুমানার ‘ভালো’ মেয়ে হওয়া জরুরি? তিনি ভালো না হলে কি এই নিপীড়ন যৌক্তিক হয়ে যায়? নির্যাতনের পর রুমানা ‘ভালো’ মেয়ে, এই আলোচনা আসে সেই সামাজিক মন থেকে, যেখানে ধরে নেওয়া হয়, ভালো মেয়ে নয়, ‘খারাপ’ মেয়ের প্রতি নির্যাতন হয়। কেননা ‘খারাপ’ মেয়ে নিপীড়ন একভাবে আহ্বান করে, নির্যাতনের কারণ সৃষ্টি করে।
রুমানা ভালো কি খারাপ, সেই প্রসঙ্গ এই অপরাধের আলোচনায় তাই অপ্রাসঙ্গিক। বরং যদি কিছু প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা হলো রুমানার নীরবতার। তাহলে যাঁরা রুমানার ভালোত্বকে তুলে ধরতে চাইছেন, তাঁরা কি তাঁর এই নীরবতাকেও উদ্যাপন করবেন? আমরা কি আমাদের কন্যাসন্তানদের এমন নীরব ‘ভালো’ হতে উৎসাহ দেব? যে সামাজিক পরিস্থিতি রুমানাকে মুখ খুলতে দেয়নি, আমরা কি সেই পরিস্থিতি বহাল রাখব? আর কত রুমানার মতো নীরব ‘ভালো’ মেয়ে রক্ত দিলে তবে ভালো মেয়ের এই সংজ্ঞা পাল্টাবে?
সাইদ গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নানাজনকে এই নৃশংসতার কারণ খুঁজতে দেখা গেছে। সমাজের অধিপতিসুলভ পুরুষতান্ত্রিক সহানুভূতি অর্জনের জন্য সাইদ ১০ দিন সময় নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। পুলিশও গ্রেপ্তারে গড়িমসি করে এই সময় তাঁকে দিয়েছে। সমাজের অনেকের মনে সাইদের ভাষ্যে রুমানার চরিত্র জানার আগ্রহ দানা বেঁধেছে। কী ধরনের গল্প ফাঁদলে পুরুষতান্ত্রিক ‘আগ্রহ’ মিটিয়ে সহানুভূতি পাওয়া যায়, তা বুঝতে সাইদের ধারালো মস্তিষ্ক ভুল করেনি। বুঝেশুনেই তাই তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন এই সমাজে নারীর সবচেয়ে বড় ভীতিকে, নারীর প্রতি ব্যবহূত সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র কুৎসা ও চরিত্র হননকে।
প্রথমে তিনি পুরুষের শারীরিক শক্তির দাপটে স্ত্রীকে পদানত করতে না পারার প্রতিশোধ নিতে জ্ঞানী স্ত্রীকে অন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এরপর তিনি নেমেছেন স্ত্রীর ‘চরিত্র’ নষ্ট করার চেষ্টায়। প্রথমে দেখিয়েছেন গায়ের জোর, পরে ব্যবহার করেছেন সামাজিক শক্তি। হাসান সাইদ পুরুষের এই দুই শক্তি, যা দিয়ে নারী নির্যাতিত হয়, সে সম্পর্কে দারুণ সচেতন। তাই ধারালো মস্তিষ্কের, ঠান্ডা মাথার নিপীড়ক সাইদ এখন নিজেকে মানসিক অসুস্থ হিসেবে দেখানোর রাস্তা পাকা করছেন। এই রাস্তা একইভাবে তাঁর অপরাধের কারণ খোঁজার আগ্রহ থেকে বা তাঁর অপরাধকে সাইকিক কেস হিসেবে দেখার পাবলিক প্রবণতা থেকেও সমান্তরালে তৈরি হচ্ছে। রুমানার প্রতি সহানুভূতির জন্য তাঁর ‘ভালোত্ব’ তুলে ধরা বা নির্যাতক সাইদের প্রতি সহানুভূতি টানার জন্য রুমানাকে ‘খারাপ’ মেয়ে প্রমাণ করা, উভয়েই তাই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দুই দিক, মুদ্রার দুই পিঠ মাত্র।
এখন তাই পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক চেতনায় নিপীড়ক হাসান সাইদের পরিচিতি ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’, আর রুমানা ‘ভালো’ মেয়ে হতে ‘স্খলিত/নিপীড়ন আহ্বানকারী নারী’ পরিচয়ে বদলাতে থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় তাই চিহ্নিত নিপীড়ক আর সমাজে বিদ্যমান পুরুষালি নিপীড়ন মানসিকতা হাতে হাত ধরে কাজ করে যাবে। বরাবরের মতোই নিপীড়িতের ভালোত্ব/মন্দত্ব আলোচনার মুখরোচক বিষয়ে পরিণত হবে। বেশ কিছুদিন পত্রিকার পাতা গরম থাকবে রুমানা আর সাইদের দাম্পত্য বিশ্লেষণে, পরকীয়ার আবশ্যিক অনুসন্ধানে, রুমানার চরিত্রের ব্যবচ্ছেদে। সাইদ নয়, রুমানাকেই এখন তাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত করা হবে, আরেকভাবে নিপীড়ন করা হবে তাঁকে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় রুমানার নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র, নিপীড়নের চরম দৃষ্টান্ত চাপা পড়ে যাবে তাদের দাম্পত্যের রসাল আলোচনায়।
আমরা কি তা হতে দেব?
নাসরিন খন্দকার: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
nasrin.khandoker@gmail.com
No comments