জাতীয় নিরাপত্তা-সামরিক বিশ্বায়ন নতুন ঘটনা নয় by তারাক বারকাবি
বিশ্বায়নে যাঁদের বিশ্বাস অকৃত্রিম, তাঁদের কাছে এটা শান্তির শক্তি। এটা যোগাযোগপ্রযুক্তির বিশ্বায়ন। নানা রকমের মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে বহু-সাংস্কৃতিক ইউটোপিয়ার ভেতরে, যেখানে টুইট আর পোস্ট গদি থেকে নামিয়ে আনে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকদের।
সমালোচকদের কাছে বিশ্বায়ন হলো নয়া-উদারবাদের লৌহপিঞ্জর। এখানে স্যুট পরা নির্বাহীরা বিমানের বিজনেস ক্লাসে চড়ে বেড়ান। আর মজদুরেরা মাকিলাদোরায় (রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত কারখানায়) বন্দী থাকেন; তাঁদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার থাকে না; অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয় কঠোর শ্রমশাসনের।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সামরিক বাহিনীকে সম্পৃক্ত করে আলোচিত কমই হয়। অথচ বহু শতাব্দী ধরে সৈন্যদের আনাগোনা চলছে বিশ্বজুড়ে। সস্তা বিমানযাত্রার সুযোগ আসার বহু আগে থেকে সৈন্যরা নানা বিচিত্র জায়গায় গেছে।
বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি প্রসঙ্গেই সচরাচর সামরিক বাহিনী ও বিশ্বায়নের শব্দদ্বয় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আর-টুর নতুন উদ্যোগের কথা বলা যায়। সেখানে মূলত কলম্বিয়ান সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি বিদেশি ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে প্রায়শই যেমন ঘটে, যা কিছু নতুন মনে হয়, তা আসলে আরেকটু পুরোনো ছাঁচ ও ইতিহাসের প্রতিফলিত। দেশাত্মবোধক যুদ্ধ-সিনেমা ও স্মৃতিকথার ছলনে ভুলে এবং জাতীয়তাবাদীরা সবখানে সামরিক বাহিনীকে নিজেদের বাহিনী দাবি করার ফলে সশস্ত্র বাহিনীতে বিদেশিদের উপস্থিতিও অনেক সময় চোখে পড়ে না। বাস্তব সত্যি হলো, সামরিক বাহিনীর মতো ‘কসমোপলিটান’ প্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে। আরব, কলম্বিয়ান ও মার্কিন নাগরিক একসঙ্গে কাজ করার এমন দৃষ্টান্ত আর কোথায় পাওয়া যাবে?
সরকার স্বদেশবাসীর হুমকির মুখে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি সৈন্যরা খুব কাজে আসে। বাহরাইনকে আর-টু ভাড়া করতে হয়নি। কেননা, বাহরাইনের সামরিক বাহিনীতে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি বেলুচ সৈন্য আছে, যারা নির্দেশ অনুসারে গুলি ছুড়তে প্রস্তুত। সৌদি সহায়তার পাশাপাশি বেলুচ সৈন্যের আধিক্য সাম্প্রতিক অসন্তোষের মাঝে বর্তমান শাসককে রক্ষায় নিশ্চায়ক প্রমাণিত হয়েছে।
তবে বিদেশি সৈন্যরা স্থানীয় শাসকদের কেবল ব্যক্তিগত পাহারাদার নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বাহরাইনও সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেলের মজুদ, অন্যদিকে মার্কিন পঞ্চম রণতরীর সদর দপ্তর বাহরাইনে অবস্থিত।
আদিতে এসব বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল ইউরোপীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বৈশ্বিক নেটওয়ার্কগুলোর দরকার পড়ে সুনম্য, বন্ধুসুলভ স্থানীয় শাসক, যারা আন্তর্জাতিক উদ্বেগে সাড়া দেয়। বিপরীতে এসব শাসকেরও ক্ষমতা ধরে রাখতে দরকার পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর। আর তাই প্রতিটি সাম্রাজ্য বিদেশি সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা দিতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ নিয়োজিত করে। বাহরাইনের বহু সামরিক কর্মকর্তা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর বাদবাকি পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া করা হয়।
আনুষ্ঠানিক উপনিবেশ স্থাপনের যুগে ইউরোপীয়রা বড় উপনিবেশী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল, সেসব বাহিনীতে শ্বেতাঙ্গরা পেত কর্মকর্তার মর্যাদা। ব্রিটিশরা ভারতকে কবজায় রেখেছে ভারতীয় বাহিনী দিয়েই। আর উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা শাসন করেছে ফ্রান্স সেখানকারই মানুষ দিয়ে গঠিত রেজিমেন্টের দ্বারা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর সামরিক উপদেশ ও সহায়তা আরও জটিল রূপে, অনেক ক্ষেত্রে আবরণের মোড়কে জারি রয়েছে।
গত শতকের ষাটের দশকে ব্রিটেনের মক্কেল ওমানের সুলতানের বিরুদ্ধে ধোফার অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একে ‘কমিউনিস্ট’ বিদ্রোহকে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আজকের ‘টেররিজম’ শব্দের মতোই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমা স্বার্থকে হুমকিতে ফেলে এমন সবকিছু গাথা হতো এক শব্দে—সেটি ‘কমিউনিস্ট’। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুলতানকে সরাসরি সহায়তা প্রদান করা হলে তাঁকে পশ্চিমাদের মক্কেল বলেই মনে হতো। আর তাতে তাঁর অবস্থান আরও নাজুক হতো।
তখন দরকার ছিল দেশজ চেহারার ‘ওমানি’ বাহিনী। তখন এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। সব ব্রিটিশ সৈন্য এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক নন-কমিশনড কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে ন্যস্ত হয়। সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া বাদবাকি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই হয়তো কিছুদিন আগে ভারতীয় বাহিনীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের পরও তো ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা অব্যাহত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের বলে সুলতান বেলুচদের নিয়োগ দিতে পারতেন। ১৯৬১ সালে সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীর ৬৭ শতাংশ সদস্যই ছিল বেলুচ। অন্যদিকে ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশিকে নিয়োগ করা হয়েছিল নৌ ও বিমানবাহিনীতে।
ধোফার বিদ্রোহীরা তাদের প্রচারপত্রে এসব কথাই বলেছিল। জবাবে সুলতান ১৯৭২ সালে এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘সবাই জানেন, বিমানবাহিনী ওমানি বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী ওমানি নৌবাহিনী আর আমাদের জাতীয় ভূখণ্ডের রক্ষক কেবল আমাদের ওমানি সেনাবাহিনী।’
একসময় তারা বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সুলতান ও তাঁর ব্রিটিশ উপদেষ্টারা আরও ওমানিদের নিয়োগদানের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে ‘ওমানীকরণের’ কর্মসূচি নেয়। ভিয়েতনামীকরণ, আফগানিস্তানীকরণ ও ইরাকীকরণের মতোই এমন দেশজ নিরাপত্তা বাহিনী, যারা নিজেরা দেশকে ধরে রাখতে সক্ষম, তেমন বাহিনী গড়ে তোলা পশ্চিমাদের সৈন্য প্রত্যাহারের এবং সস্তা সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি। প্রয়োজনমতো স্থানীয় বাহিনীতে বিদেশিদের যুক্ত করে শক্তিশালী করে নেওয়া যায়, নিজেদের কর্মকর্তা পর্যায়ের সদস্যদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা যায়।
শৃঙ্খলা তৈরির এসব প্রকল্প সব সময় সফল হয় না। তবে নানাভাবে এসব দৃষ্টান্ত উন্মোচিত করে দেয় বিশ্বায়নের ইস্পাত-কাঠামো, যে কাঠামো বিশ্বব্যাপী সামরিক ও নিরাপত্তা পেশাজীবীদের সঞ্চালনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এসব সামরিক ও নিরাপত্তা পেশাজীবীদের কাজ বৈশ্বিক কায়েমি স্বার্থের প্রতি স্থানীয় কোনো সশস্ত্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
আর-টু ব্যাটালিয়নের আরেকটি ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অভিবাসী শ্রমিকদের অসন্তোষ দমন। ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে সব কালেই বিশ্বায়নের জন্য দরকার পড়েছে মেরুদণ্ড-ভাঙা, আত্মবিনাশী কায়িক শ্রম, কি আখ চাষে বা খনিতে কিংবা অন্য কোনোখানে।
আজকের মতোই তখনো মজদুরেরা কখনো কখনো বিদ্রোহ করেছে। অন্যদিকে, বাজার ও জোগানদাতার যোগাযোগের পথ রাখতে হয়েছে নিরাপদ। আজকের মতোই তখনো সে উদ্দেশ্য হাসিল করার সবচেয়ে সস্তা উপায় ছিল দেশজ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা।
আধুনিক, আন্তসংযুক্ত দুনিয়া গড়ে উঠেছে, টিকে আছে বাদামি ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে যুদ্ধের ন্যায় বিন্যস্ত করে, যেন সে অন্য বাদামি ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে হত্যা করে চলে। অর্থনীতি কিংবা যোগাযোগ—যেকোনো হিসাবেই বিশ্বায়নের জন্য বিপুল ‘নিরাপত্তা’ আবশ্যক।
আল জাজিরা ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
তারাক বারকাবি: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সামরিক বাহিনীকে সম্পৃক্ত করে আলোচিত কমই হয়। অথচ বহু শতাব্দী ধরে সৈন্যদের আনাগোনা চলছে বিশ্বজুড়ে। সস্তা বিমানযাত্রার সুযোগ আসার বহু আগে থেকে সৈন্যরা নানা বিচিত্র জায়গায় গেছে।
বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি প্রসঙ্গেই সচরাচর সামরিক বাহিনী ও বিশ্বায়নের শব্দদ্বয় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আর-টুর নতুন উদ্যোগের কথা বলা যায়। সেখানে মূলত কলম্বিয়ান সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি বিদেশি ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে প্রায়শই যেমন ঘটে, যা কিছু নতুন মনে হয়, তা আসলে আরেকটু পুরোনো ছাঁচ ও ইতিহাসের প্রতিফলিত। দেশাত্মবোধক যুদ্ধ-সিনেমা ও স্মৃতিকথার ছলনে ভুলে এবং জাতীয়তাবাদীরা সবখানে সামরিক বাহিনীকে নিজেদের বাহিনী দাবি করার ফলে সশস্ত্র বাহিনীতে বিদেশিদের উপস্থিতিও অনেক সময় চোখে পড়ে না। বাস্তব সত্যি হলো, সামরিক বাহিনীর মতো ‘কসমোপলিটান’ প্রতিষ্ঠান খুব কমই আছে। আরব, কলম্বিয়ান ও মার্কিন নাগরিক একসঙ্গে কাজ করার এমন দৃষ্টান্ত আর কোথায় পাওয়া যাবে?
সরকার স্বদেশবাসীর হুমকির মুখে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি সৈন্যরা খুব কাজে আসে। বাহরাইনকে আর-টু ভাড়া করতে হয়নি। কেননা, বাহরাইনের সামরিক বাহিনীতে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি বেলুচ সৈন্য আছে, যারা নির্দেশ অনুসারে গুলি ছুড়তে প্রস্তুত। সৌদি সহায়তার পাশাপাশি বেলুচ সৈন্যের আধিক্য সাম্প্রতিক অসন্তোষের মাঝে বর্তমান শাসককে রক্ষায় নিশ্চায়ক প্রমাণিত হয়েছে।
তবে বিদেশি সৈন্যরা স্থানীয় শাসকদের কেবল ব্যক্তিগত পাহারাদার নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বাহরাইনও সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেলের মজুদ, অন্যদিকে মার্কিন পঞ্চম রণতরীর সদর দপ্তর বাহরাইনে অবস্থিত।
আদিতে এসব বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল ইউরোপীয় ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বৈশ্বিক নেটওয়ার্কগুলোর দরকার পড়ে সুনম্য, বন্ধুসুলভ স্থানীয় শাসক, যারা আন্তর্জাতিক উদ্বেগে সাড়া দেয়। বিপরীতে এসব শাসকেরও ক্ষমতা ধরে রাখতে দরকার পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর। আর তাই প্রতিটি সাম্রাজ্য বিদেশি সশস্ত্র বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তা দিতে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ নিয়োজিত করে। বাহরাইনের বহু সামরিক কর্মকর্তা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর বাদবাকি পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া করা হয়।
আনুষ্ঠানিক উপনিবেশ স্থাপনের যুগে ইউরোপীয়রা বড় উপনিবেশী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল, সেসব বাহিনীতে শ্বেতাঙ্গরা পেত কর্মকর্তার মর্যাদা। ব্রিটিশরা ভারতকে কবজায় রেখেছে ভারতীয় বাহিনী দিয়েই। আর উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা শাসন করেছে ফ্রান্স সেখানকারই মানুষ দিয়ে গঠিত রেজিমেন্টের দ্বারা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর সামরিক উপদেশ ও সহায়তা আরও জটিল রূপে, অনেক ক্ষেত্রে আবরণের মোড়কে জারি রয়েছে।
গত শতকের ষাটের দশকে ব্রিটেনের মক্কেল ওমানের সুলতানের বিরুদ্ধে ধোফার অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একে ‘কমিউনিস্ট’ বিদ্রোহকে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আজকের ‘টেররিজম’ শব্দের মতোই স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পশ্চিমা স্বার্থকে হুমকিতে ফেলে এমন সবকিছু গাথা হতো এক শব্দে—সেটি ‘কমিউনিস্ট’। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুলতানকে সরাসরি সহায়তা প্রদান করা হলে তাঁকে পশ্চিমাদের মক্কেল বলেই মনে হতো। আর তাতে তাঁর অবস্থান আরও নাজুক হতো।
তখন দরকার ছিল দেশজ চেহারার ‘ওমানি’ বাহিনী। তখন এক ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বিশেষ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। সব ব্রিটিশ সৈন্য এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক নন-কমিশনড কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে ন্যস্ত হয়। সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া বাদবাকি ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই হয়তো কিছুদিন আগে ভারতীয় বাহিনীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের পরও তো ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা অব্যাহত ছিল। সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের বলে সুলতান বেলুচদের নিয়োগ দিতে পারতেন। ১৯৬১ সালে সুলতানের সশস্ত্র বাহিনীর ৬৭ শতাংশ সদস্যই ছিল বেলুচ। অন্যদিকে ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশিকে নিয়োগ করা হয়েছিল নৌ ও বিমানবাহিনীতে।
ধোফার বিদ্রোহীরা তাদের প্রচারপত্রে এসব কথাই বলেছিল। জবাবে সুলতান ১৯৭২ সালে এক বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘সবাই জানেন, বিমানবাহিনী ওমানি বিমানবাহিনী আর নৌবাহিনী ওমানি নৌবাহিনী আর আমাদের জাতীয় ভূখণ্ডের রক্ষক কেবল আমাদের ওমানি সেনাবাহিনী।’
একসময় তারা বিদ্রোহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সুলতান ও তাঁর ব্রিটিশ উপদেষ্টারা আরও ওমানিদের নিয়োগদানের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে ‘ওমানীকরণের’ কর্মসূচি নেয়। ভিয়েতনামীকরণ, আফগানিস্তানীকরণ ও ইরাকীকরণের মতোই এমন দেশজ নিরাপত্তা বাহিনী, যারা নিজেরা দেশকে ধরে রাখতে সক্ষম, তেমন বাহিনী গড়ে তোলা পশ্চিমাদের সৈন্য প্রত্যাহারের এবং সস্তা সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি। প্রয়োজনমতো স্থানীয় বাহিনীতে বিদেশিদের যুক্ত করে শক্তিশালী করে নেওয়া যায়, নিজেদের কর্মকর্তা পর্যায়ের সদস্যদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা যায়।
শৃঙ্খলা তৈরির এসব প্রকল্প সব সময় সফল হয় না। তবে নানাভাবে এসব দৃষ্টান্ত উন্মোচিত করে দেয় বিশ্বায়নের ইস্পাত-কাঠামো, যে কাঠামো বিশ্বব্যাপী সামরিক ও নিরাপত্তা পেশাজীবীদের সঞ্চালনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এসব সামরিক ও নিরাপত্তা পেশাজীবীদের কাজ বৈশ্বিক কায়েমি স্বার্থের প্রতি স্থানীয় কোনো সশস্ত্র চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
আর-টু ব্যাটালিয়নের আরেকটি ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অভিবাসী শ্রমিকদের অসন্তোষ দমন। ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে সব কালেই বিশ্বায়নের জন্য দরকার পড়েছে মেরুদণ্ড-ভাঙা, আত্মবিনাশী কায়িক শ্রম, কি আখ চাষে বা খনিতে কিংবা অন্য কোনোখানে।
আজকের মতোই তখনো মজদুরেরা কখনো কখনো বিদ্রোহ করেছে। অন্যদিকে, বাজার ও জোগানদাতার যোগাযোগের পথ রাখতে হয়েছে নিরাপদ। আজকের মতোই তখনো সে উদ্দেশ্য হাসিল করার সবচেয়ে সস্তা উপায় ছিল দেশজ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা।
আধুনিক, আন্তসংযুক্ত দুনিয়া গড়ে উঠেছে, টিকে আছে বাদামি ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে যুদ্ধের ন্যায় বিন্যস্ত করে, যেন সে অন্য বাদামি ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে হত্যা করে চলে। অর্থনীতি কিংবা যোগাযোগ—যেকোনো হিসাবেই বিশ্বায়নের জন্য বিপুল ‘নিরাপত্তা’ আবশ্যক।
আল জাজিরা ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
তারাক বারকাবি: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত।
No comments