বিলেতের স্ন্যাপশট-মূলধারার স্কুল, ক্লাসরুমেই বাংলা by শামীম আজাদ

আমার ছেলে সজীব অনেক ছোট বয়সে এ দেশে আসে। মেয়ে ঈশিতার বয়স তখন ১৪ বছর। গোপনে গোপনে বাংলা কবিতা, গল্প লেখে। সে যে বাংলা ভুলবে না, জানতাম। সমস্যায় পড়লাম সজীবকে নিয়ে। সে তো আর কবিতা লেখে না।
বিলেতে তখন মাধ্যমিক স্কুলে ঠিক এখনকার মতোই একটি দ্বিতীয় ভাষা নিতে হতো।

আমি বলছি আজ থেকে দুই দশক আগের কথা। রেডব্রিজের ভ্যালেনটাইন স্কুলে ভাগ্যক্রমে দুজনেরই জায়গা হলো। ঈশিতা বাংলা নেবে বলায় আঁতকে উঠল স্কুল। আমরা প্রধান শিক্ষককে জোর দিয়ে বললাম, মেয়ের অন্যান্য বিষয়ের অবস্থান দেখো, সে ফেল করবে না। আমরা তাকে প্রাইভেট পড়িয়ে নেব। তোমরা শুধু স্কুল থেকে চিঠি লিখে দাও—মেয়ের মা-বাবা তাকে স্কুল থেকে বাংলা পরীক্ষার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করছে। অবাক হয়ে দেখলাম, কাজ হলো।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান বেণু বাংলা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমার বন্ধু, লেখক, গবেষক ও ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বোন জাহিদা সাত্তার তখন টাওয়ার হ্যামলেটসে ছেলেদের মাধ্যমিক স্কুল স্টেপনি গ্রিনে পড়ান। বাঙালিদের দুর্বার আন্দোলনের ফলে সেখানে মাধ্যমিক স্কুলে জিসিএসইতে, এমনকি উচ্চমাধ্যমিকেও বাংলা নেওয়া যায় এমন ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য এ এক অপূর্ব সুযোগ। কারিকুলাম দেখে জাহিদার পরামর্শে মার্লবেরি গার্লস স্কুল থেকে তথ্য নিয়ে এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে, দেশ থেকে বই আনিয়ে আমার কাছেই পড়তে লাগল ঈশিতা। তারপর জিসিএসইতে এক অসামান্য ফল করে ফেলল। আমরা অবাক হলাম না, কিন্তু অনেক খুশি হলাম।
এবার পড়লাম সজীবকে নিয়ে। রোজ গার্ডিয়ান থেকে এক কলাম দাগিয়ে দিয়ে রাখতাম, পরদিন স্কুল থেকে এসে চেক করতাম তার করা বাংলা অনুবাদ। বাসার নিয়ম, কেউ বাংলা ছাড়া ইংরেজি বলবে না। সিলেটি থাকল পাশাপাশি। একটু বড় হলে দেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদের বাংলা বই এনে দিলাম। পড়াটা ভালো হতে থাকল কিন্তু বাংলা অনুবাদের দশা খারাপ হতে লাগল। ‘যদি’, ‘যাব’ লিখতে লাগল বর্গীয় জ দিয়ে। ‘সকাল’ বানান করতে লাগল তালব্য শ দিয়ে। আর এমন সব প্রশ্ন করতে লাগল, যা নিজে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেও কখনো ভাবিনি। ওর নানা উদ্ভট প্রশ্নের কারণে খুঁজে বের করলাম শহীদজননী জাহানারা ইমামের লেখা বিদেশিদের বাংলা শিক্ষার বই। আমি বিলেতে আসার সময় তিনি বইটি হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি বিলেতের স্কুলে সে দেশের ছেলেমেয়েদের পড়াতে যাচ্ছ, দেখো, তোমার ছেলেমেয়েরা না বাংলা ভুলে যায়।’
তারপর শরতের এক সুশ্রী সকালে সজীব জিসিএসইর ফলাফলে আমাদের হতবাক করে দিল। বাংলা মিলে তার সমগ্র ফলাফল এমন হলো যে প্রাইভেট এক স্কুলে বৃত্তিই পেয়ে গেল। ঈশিতাকে দিয়ে যে স্কুলে বাংলা শুরু হয়েছিল, সেখানে প্রতিবছরই বেশ কয়েকজন বাংলায় পাস করছে। টাওয়ার হ্যামলেটসসহ এ দেশের যেখানে বাঙালিরা আছে, সেখানেই বাংলা স্কুল আছে। হয় স্কুল শেষে, নয় সপ্তাহান্তে মা-বাবার পরম উৎসাহে তারা বাংলা স্কুলে যায়। কিন্তু এখন এসেছে আরও বৃহত্তর সুযোগ। ২০০৭ সালে লর্ড ডেয়ারিংয়ের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্কুল থেকেই ইংরেজির পাশাপাশি আরেকটি ভাষা পড়ার আইন হয়েছে। সে এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বুঝে একটি কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজও হতে পারে। সুতরাং, এ দেশে এখন প্রাইমারি স্কুলে আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখতে পারবে, মূল ক্লাসঘরেই। বিলেতের প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে এখন ইংরেজির পাশাপাশি আরেকটি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়েছে। এখন অভিভাবকদের তা শুধু চাইতে হবে। আমাদের দেশে একটা প্রবচন আছে ‘কাঁচাতে না নোয়ালে বাঁশ/ পরে করে ঠাস ঠাস’। এ ছাড়া ওই প্রাইমারি বয়সই তো ভাষা আয়ত্ত করার কুসুম সময়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক এবং তারপর উচ্চমাধ্যমিকের এই ভিন্ন ভাষা শিক্ষার জন্য রয়েছে অত্যন্ত আধুনিক ও যথাযথ কারিকুলাম। তাতে পড়া, শোনা, বলা, লেখা—এই চতুর্মাত্রিক ব্যবস্থাপনা। এ শুধু এখন বলে নয়, টাওয়ার হ্যামলেটসে যখন থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকেই। তবে ক্রমেই অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এরও হয়েছে আধুনিকায়ন। হাতেখড়ি হচ্ছে আমাদের দেশের সবুজ পাঠসহ গোলাম মুরশিদ ও ব্র্যাকের বই দিয়ে। এখন এই এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭১ শতাংশ ছেলেমেয়েরই ইংরেজি মাতৃভাষা নয়। আর এর সংখ্যাগরিষ্ঠই বাঙালি। তবে লন্ডনের ভেতরে ক্যামডেন, নিউহ্যামেও অনেক বাঙালি। আর সারা দেশের কথা ভাবলে বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ, হার্ডফোর্ডশায়ার, স্যান্ডারল্যান্ড, নিউ ক্যাসল, লুটন—এসব স্থানেই বাংলাদেশিদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। এ দেশে তিন-তিনটি স্থায়ী শহীদ মিনারই আছে। আর থাকবে না-ই বা কেন—বিলেত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাচীনতম অভিবাসন লক্ষ্য। স্বাধীনতার পবিত্র সংগ্রামেও বহির্বিশ্বে এ দেশের বাংলাদেশিরাই ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়।
তাই হয়তো এখন থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা মূল ক্লাসঘরে বাংলা শিখে একদিন বিশ্বের জন্য আবারও রোল মডেল হবে। এখন দ্বিভাষী বাঙালি শিক্ষকের আর অভাব নেই। এখন বাংলা শেখানোর সময় ব্যবহূত হবে ইন্টারেক্টিভ বোর্ড, রং, তুলি, বালি, বাগান, বাদ্য, ক্যাসেট, কম্পিউটার কত কী! স্প্যানিশ, জার্মান, ম্যান্ডারিনে সমান মর্যাদায় ও সময়ে পড়ানো হবে বাংলা। কেবল আমাদের মা-বাবাকে তা চাইতে হবে। ব্যাপারটি কত সহজ হয়ে গেছে! এ দেশে আমাদের সব আন্দোলন ও অর্জনের পেছনে যেমন পূর্ব লন্ডনের উদ্যোগই অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে, এ ব্যাপারেও তা-ই। এবার জাতীয়ভাবে এ আন্দোলনে সোচ্চার আবার আমরাই। বিলেতের সব বাংলা কাগজ আর টিভি রয়েছে আমাদের সঙ্গে। এবারের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক মেয়র গোলাম মর্তুজা, প্যারেন্টস সেন্টারের পরিচালক আবদুল হান্নান, সম্মানিত অগ্রজগণ এবং সঙ্গে আছেন আমার মতো শিক্ষকেরা। আগামী শনিবার ‘ওয়াটার লিলি’তে হচ্ছে তারই পাবলিক মিটিং।
বাঙালি নেই এমন কোনো স্থান সারা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া আজ কঠিন। বাঙালি আজ অনেক দেশেই উচ্চপদে আসীন। নিজ জাতিসত্তা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সম্পত্তি রক্ষা—বাংলা কোথায় না লাগে?
লন্ডন, জুন ২০১১
শামীম আজাদ: কবি, সাহিত্যিক।
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.