খোলা চোখে-সৈয়দ সেলিম শাহজাদের সাহসিকতা by হাসান ফেরদৌস
মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা জেনেও যখন কেউ সামনে পা বাড়ায়, তেমন লোককে আমরা হয় ভাবি বোকা, নয়তো দারুণ সাহসী। কিন্তু এমন যদি হয়—লোকটা বীরও নয়, বোকাও নয়, কেবল নিজের দায়িত্ব পালন করছিল, তা হলে?
সৈয়দ সেলিম শাহজাদ সেই রকম একজন মানুষ।
সৈয়দ সেলিম শাহজাদ সেই রকম একজন মানুষ।
পাকিস্তানি নাগরিক, পেশায় সাংবাদিক। তিনি খুন হয়েছেন। কে খুন করেছে, তার কোনো প্রমাণ মেলেনি, তবে সবার চোখ সে দেশের সেনাবাহিনী, বিশেষত তার অত্যন্ত শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআইয়ের ওপর। এশিয়া টাইমস অনলাইন নামের একটি ওয়েবভিত্তিক পত্রিকায় তিনি বেশ কিছুদিন ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভেতরের নানা কেচ্ছা ফাঁস করে দিচ্ছিলেন।
সেনাবাহিনীর ভেতরে যে বিভীষণ ঢুকেছে, এ কথা তিনি নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন। আল-কায়েদার একাধিক গোপন সেল যে সেনাদলের ভেতর রয়েছে, ওপর মহলের কর্তাব্যক্তিরা যে সে কথা জানেন, শাহজাদের প্রতিবেদনে সে কথাই বলা হয়েছিল। তাঁর এসব রিপোর্ট স্বাভাবিকভাবেই সেসব কর্তাব্যক্তিকে খুশি করেনি। বার কয়েক তাঁকে ডেকে সাবধানও করে দেওয়া হয়।
তাঁর মৃত্যুর আশু কারণ সম্ভবত এশিয়া টাইমস অনলাইন পত্রিকায় পাঠানো এক হাজার শব্দের সর্বশেষ প্রতিবেদনটি। বিষয়: গত ২২ মে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর অত্যন্ত সুরক্ষিত এয়ার বেস পিএনএস মেহরিনে এক দুঃসাহসী হামলার ঘটনা। সম্ভবত আল-কায়েদার একটি তুখোড় সন্ত্রাসী দল কড়া পাহারা উপেক্ষা করে, এয়ার বেসের দেয়াল টপকে সেই আক্রমণ চালায়। সব মিলিয়ে ছয় বা দশজনের বাহিনীর সেই আক্রমণের মুখে পুরো এয়ার বেসের পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রায় ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আক্রমণকারীদের দুজন পালিয়ে যায়, বাকি চারজন নিহত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ১০ বা তার চেয়েও বেশি। এই হামলার কারণে এয়ার বেসে রাখা দুটি মার্কিন অত্যাধুনিক গোয়েন্দা বিমান ধ্বংস হয়, যার প্রতিটির মূল্য ৩৬ মিলিয়ন ডলার।
সেলিম শাহজাদের অপরাধ, তিনি দাবি করেছিলেন, এই হামলার পেছনে নৌবাহিনীর নিজের লোকেরা জড়িত ছিল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে আল-কায়েদার সমর্থকদের অভাব নেই, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু সেলিমই প্রথম জানালেন, নৌবাহিনীর ভেতর আল-কায়েদার একটি সেল কার্যত খোলামেলাভাবেই সচল ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগে এই সেলের কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলে আল-কায়েদার তরফ থেকে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করা হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু কথা তেমন এগোয়নি। সেলিম দাবি করেন, সেনাবাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই আল-কায়েদা এ রকম একটি দুঃসাহসী অভিযানের পরিকল্পনা নেয়। নৌ-দপ্তরের ভেতর থেকেই কেউ একজন পুরো এয়ার বেসের মানচিত্র, সেনা পাহারার অবস্থান ইত্যাদির সচিত্র বিবরণ আল-কায়েদার হাতে পৌঁছে দেয়।
এই প্রতিবেদন ছাপা হতে না-হতেই সেলিম নিখোঁজ হন। দিন কয়েক পর তাঁর ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের সন্ধান মেলে। পরিচিতজনেরা, যাঁরা সেই মৃতদেহ দেখেছেন, জানান, প্রচণ্ড অত্যাচারের কারণেই সেলিম নিহত হন।
সেলিম হামলার মুখে পড়তে পারেন, সে ভয় তাঁর জানা ছিল। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর ওপর নজর রাখছে, সে কথাও তিনি জানতেন। তাঁর এ সন্দেহের কথা স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে চিঠি লিখে জানিয়েও ছিলেন তিনি। হয়তো ভীতও হয়েছিলেন, কিন্তু নিজ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। আমরা জানি, পাকিস্তান এখন গভীর এক সংকটের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। সেখানে সরকার থেকেও নেই। সরকারের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী সে দেশের সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা বিভাগ। নিজেদের হালুয়া-রুটির সরবরাহ নিশ্চিত করাই তাদের আসল কাজ, দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা কখনোই তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। অধিকাংশ রাজনীতিকও হয় তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছেন, নয়তো ঘরে খিল দিয়ে পা তুলে বসে। এই অবস্থায় দেশের মানুষের হয়ে কথা বলে, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেসব দুর্লভ মানুষের একজন ছিলেন সেলিম।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা ১ জুনের সংখ্যায় সেলিমকে সম্মান জানিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে। তার শিরোনাম, ‘সৈয়দ সেলিম শাহজাদের সাহসিকতা’। পরদিন, ২ জুন, পাকিস্তানি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকা প্রায় একই ভাষায় একটি উপসম্পাদকীয় ছাপে। তাতেও সেলিমের সাহসিকতার কথা উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় করে সেখানে যা বলা হয়েছে তা হলো, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ—যারা একদিকে অথর্ব সরকার, দুর্নীতিগ্রস্ত সেনাবাহিনী ও খুনে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি—তাদের দৈনন্দিন অসহায়তার কথা। আমি তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি:
‘আমরা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছি সন্ত্রাসীদের হাতে। আমরা হত হচ্ছি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে, যারা নিজেদের মহল্লার দখল বজায় রাখতে নির্বিচারে গুলি চালায়। আমরা খুন হচ্ছি সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর গুন্ডাদের হাতে, যারা নিজেদের অযোগ্যতা লুকাতে নির্বিচারে খুন করে। প্রতিদিন হাজারোভাবে আমরা হতাহত হচ্ছি। কিন্তু তার পরও আমরা, সাধারণ পাকিস্তানিরা, টিকে আছি, বাঁচার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করছি। আমাদের রক্ষা করে এমন কোনো ব্যারিকেড নেই। কোথাও পালাব, এমন কোনো জায়গা নেই। আমাদের নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়, তার সবই কঠোর সমালোচনা। সেসবই সত্যি কথা, কিন্তু আরও যে সত্য কথাটা লেখা হয় না, তা হলো সাধারণ পাকিস্তানিদের সাহসিকতা। অন্য অনেক দেশ এর চেয়ে কম দুর্যোগের মুখে ভেঙে পড়ত। আমরা পড়িনি।’
সাধারণ পাকিস্তানিদের এই সাহসের প্রমাণ সৈয়দ সেলিম শাহজাদ। তিনি রাজনীতিক নন, সেনা কমান্ডার নন, অতি বাচাল টিভি উপস্থাপকও নন। একদম সাধারণ একজন সাংবাদিক, ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ ও তা পরিবেশন সেলিমের একমাত্র কাজ। এ জন্য কখনো কেউ তাঁকে পুরস্কৃত করেনি, তেমন কোনো পুরস্কারের অপেক্ষাতেও তিনি ছিলেন না। তাঁকে যদি বোকা বলেন, আপত্তি করব না। একদিকে কামান-বন্দুক, অন্যদিকে তাঁর কলম—এই দুইয়ের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তিনি যে জিতবেন না, এ তো জানা কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এ রকম দু-চারজন বোকা মানুষ থেকে যায়, যাদের সাহসিকতা আমাদের বাঁচতে সাহস জোগায়। সেলিমের একমাত্র অপরাধ—সত্য উদ্ধারের চেষ্টা এবং তাঁর উদ্ধারকৃত সত্য পৃথিবীর মানুষকে জানানো। সত্যি কথাটা জেনে তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন। অধিকাংশ মানুষই তা-ই করে। কিন্তু পৃথিবীটা যে এখনো বসবাসযোগ্য, তার কারণ, সত্যকে রক্ষা করতে আগ্রহী এমন কিছু লোক এখনো আছেন।
এই কথা লেখার সময় আমি লিমনের কথা ভাবছি। হতভাগ্য বালক, সম্ভবত নিরাপত্তারক্ষীদের অযোগ্যতা ও ভুলের শিকার সে। কিন্তু সে ভুল স্বীকারের বদলে নানা মহলের চেষ্টা হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণে। সে একটি নেহাত সাধারণ বালক, যার ব্যাংকে টাকার জোর নেই, নিজস্ব লাঠিয়াল নেই, নেই রাজনৈতিক মাস্তানদের সমর্থন। রাষ্ট্রের মতো মহাপরাক্রম যন্ত্র যখন তাকে আঘাত করতে চায়, কে তাকে রক্ষা করবে?
আমি ভাবছি সেলিম শাহজাদের কথা। আমাদেরও সেলিম শাহজাদ আছে। না থাকলে এ ছেলেটি মর্গে লাশ হতো। সে লাশ পা দিয়ে ঠেলে দেখারও লোক থাকত না।
ব্রেখট বলতেন, আঁধার-ভরা সময়েও শোনা যায় গান—আঁধার-ভরা সময়ের গান। সেলিম শাহজাদ সেই রকম একটি গান। আছে, আমাদেরও সেলিম শাহজাদ আছে।
১২ জুন ২০১১, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সেনাবাহিনীর ভেতরে যে বিভীষণ ঢুকেছে, এ কথা তিনি নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন। আল-কায়েদার একাধিক গোপন সেল যে সেনাদলের ভেতর রয়েছে, ওপর মহলের কর্তাব্যক্তিরা যে সে কথা জানেন, শাহজাদের প্রতিবেদনে সে কথাই বলা হয়েছিল। তাঁর এসব রিপোর্ট স্বাভাবিকভাবেই সেসব কর্তাব্যক্তিকে খুশি করেনি। বার কয়েক তাঁকে ডেকে সাবধানও করে দেওয়া হয়।
তাঁর মৃত্যুর আশু কারণ সম্ভবত এশিয়া টাইমস অনলাইন পত্রিকায় পাঠানো এক হাজার শব্দের সর্বশেষ প্রতিবেদনটি। বিষয়: গত ২২ মে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর অত্যন্ত সুরক্ষিত এয়ার বেস পিএনএস মেহরিনে এক দুঃসাহসী হামলার ঘটনা। সম্ভবত আল-কায়েদার একটি তুখোড় সন্ত্রাসী দল কড়া পাহারা উপেক্ষা করে, এয়ার বেসের দেয়াল টপকে সেই আক্রমণ চালায়। সব মিলিয়ে ছয় বা দশজনের বাহিনীর সেই আক্রমণের মুখে পুরো এয়ার বেসের পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রায় ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আক্রমণকারীদের দুজন পালিয়ে যায়, বাকি চারজন নিহত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ১০ বা তার চেয়েও বেশি। এই হামলার কারণে এয়ার বেসে রাখা দুটি মার্কিন অত্যাধুনিক গোয়েন্দা বিমান ধ্বংস হয়, যার প্রতিটির মূল্য ৩৬ মিলিয়ন ডলার।
সেলিম শাহজাদের অপরাধ, তিনি দাবি করেছিলেন, এই হামলার পেছনে নৌবাহিনীর নিজের লোকেরা জড়িত ছিল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে আল-কায়েদার সমর্থকদের অভাব নেই, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু সেলিমই প্রথম জানালেন, নৌবাহিনীর ভেতর আল-কায়েদার একটি সেল কার্যত খোলামেলাভাবেই সচল ছিল। কয়েক সপ্তাহ আগে এই সেলের কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলে আল-কায়েদার তরফ থেকে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করা হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু কথা তেমন এগোয়নি। সেলিম দাবি করেন, সেনাবাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই আল-কায়েদা এ রকম একটি দুঃসাহসী অভিযানের পরিকল্পনা নেয়। নৌ-দপ্তরের ভেতর থেকেই কেউ একজন পুরো এয়ার বেসের মানচিত্র, সেনা পাহারার অবস্থান ইত্যাদির সচিত্র বিবরণ আল-কায়েদার হাতে পৌঁছে দেয়।
এই প্রতিবেদন ছাপা হতে না-হতেই সেলিম নিখোঁজ হন। দিন কয়েক পর তাঁর ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহের সন্ধান মেলে। পরিচিতজনেরা, যাঁরা সেই মৃতদেহ দেখেছেন, জানান, প্রচণ্ড অত্যাচারের কারণেই সেলিম নিহত হন।
সেলিম হামলার মুখে পড়তে পারেন, সে ভয় তাঁর জানা ছিল। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর ওপর নজর রাখছে, সে কথাও তিনি জানতেন। তাঁর এ সন্দেহের কথা স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে চিঠি লিখে জানিয়েও ছিলেন তিনি। হয়তো ভীতও হয়েছিলেন, কিন্তু নিজ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি। আমরা জানি, পাকিস্তান এখন গভীর এক সংকটের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। সেখানে সরকার থেকেও নেই। সরকারের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী সে দেশের সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা বিভাগ। নিজেদের হালুয়া-রুটির সরবরাহ নিশ্চিত করাই তাদের আসল কাজ, দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা কখনোই তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়। অধিকাংশ রাজনীতিকও হয় তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছেন, নয়তো ঘরে খিল দিয়ে পা তুলে বসে। এই অবস্থায় দেশের মানুষের হয়ে কথা বলে, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেসব দুর্লভ মানুষের একজন ছিলেন সেলিম।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা ১ জুনের সংখ্যায় সেলিমকে সম্মান জানিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে। তার শিরোনাম, ‘সৈয়দ সেলিম শাহজাদের সাহসিকতা’। পরদিন, ২ জুন, পাকিস্তানি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকা প্রায় একই ভাষায় একটি উপসম্পাদকীয় ছাপে। তাতেও সেলিমের সাহসিকতার কথা উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় করে সেখানে যা বলা হয়েছে তা হলো, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ—যারা একদিকে অথর্ব সরকার, দুর্নীতিগ্রস্ত সেনাবাহিনী ও খুনে সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি—তাদের দৈনন্দিন অসহায়তার কথা। আমি তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি:
‘আমরা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছি সন্ত্রাসীদের হাতে। আমরা হত হচ্ছি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে, যারা নিজেদের মহল্লার দখল বজায় রাখতে নির্বিচারে গুলি চালায়। আমরা খুন হচ্ছি সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর গুন্ডাদের হাতে, যারা নিজেদের অযোগ্যতা লুকাতে নির্বিচারে খুন করে। প্রতিদিন হাজারোভাবে আমরা হতাহত হচ্ছি। কিন্তু তার পরও আমরা, সাধারণ পাকিস্তানিরা, টিকে আছি, বাঁচার জন্য নিরন্তর যুদ্ধ করছি। আমাদের রক্ষা করে এমন কোনো ব্যারিকেড নেই। কোথাও পালাব, এমন কোনো জায়গা নেই। আমাদের নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়, তার সবই কঠোর সমালোচনা। সেসবই সত্যি কথা, কিন্তু আরও যে সত্য কথাটা লেখা হয় না, তা হলো সাধারণ পাকিস্তানিদের সাহসিকতা। অন্য অনেক দেশ এর চেয়ে কম দুর্যোগের মুখে ভেঙে পড়ত। আমরা পড়িনি।’
সাধারণ পাকিস্তানিদের এই সাহসের প্রমাণ সৈয়দ সেলিম শাহজাদ। তিনি রাজনীতিক নন, সেনা কমান্ডার নন, অতি বাচাল টিভি উপস্থাপকও নন। একদম সাধারণ একজন সাংবাদিক, ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ ও তা পরিবেশন সেলিমের একমাত্র কাজ। এ জন্য কখনো কেউ তাঁকে পুরস্কৃত করেনি, তেমন কোনো পুরস্কারের অপেক্ষাতেও তিনি ছিলেন না। তাঁকে যদি বোকা বলেন, আপত্তি করব না। একদিকে কামান-বন্দুক, অন্যদিকে তাঁর কলম—এই দুইয়ের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তিনি যে জিতবেন না, এ তো জানা কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এ রকম দু-চারজন বোকা মানুষ থেকে যায়, যাদের সাহসিকতা আমাদের বাঁচতে সাহস জোগায়। সেলিমের একমাত্র অপরাধ—সত্য উদ্ধারের চেষ্টা এবং তাঁর উদ্ধারকৃত সত্য পৃথিবীর মানুষকে জানানো। সত্যি কথাটা জেনে তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন। অধিকাংশ মানুষই তা-ই করে। কিন্তু পৃথিবীটা যে এখনো বসবাসযোগ্য, তার কারণ, সত্যকে রক্ষা করতে আগ্রহী এমন কিছু লোক এখনো আছেন।
এই কথা লেখার সময় আমি লিমনের কথা ভাবছি। হতভাগ্য বালক, সম্ভবত নিরাপত্তারক্ষীদের অযোগ্যতা ও ভুলের শিকার সে। কিন্তু সে ভুল স্বীকারের বদলে নানা মহলের চেষ্টা হচ্ছে তাকে সন্ত্রাসী প্রমাণে। সে একটি নেহাত সাধারণ বালক, যার ব্যাংকে টাকার জোর নেই, নিজস্ব লাঠিয়াল নেই, নেই রাজনৈতিক মাস্তানদের সমর্থন। রাষ্ট্রের মতো মহাপরাক্রম যন্ত্র যখন তাকে আঘাত করতে চায়, কে তাকে রক্ষা করবে?
আমি ভাবছি সেলিম শাহজাদের কথা। আমাদেরও সেলিম শাহজাদ আছে। না থাকলে এ ছেলেটি মর্গে লাশ হতো। সে লাশ পা দিয়ে ঠেলে দেখারও লোক থাকত না।
ব্রেখট বলতেন, আঁধার-ভরা সময়েও শোনা যায় গান—আঁধার-ভরা সময়ের গান। সেলিম শাহজাদ সেই রকম একটি গান। আছে, আমাদেরও সেলিম শাহজাদ আছে।
১২ জুন ২০১১, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments