ধর নির্ভয় গান-শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা by আলী যাকের
যে রাজনীতিবিদ গণমানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করছেন, তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনবিরোধী কাজ করছেন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই জাতিই কিন্তু ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে একাট্টা হয়ে পাকিস্তানের মতো এমন এক দুর্বিনীত উপনিবেশবাদীকে উচ্ছেদ করেছিল আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি থেকে
আমার এই শিরোনামের তাৎপর্য বোঝা যাবে গত ছয় মাসে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে নানারকম অঘটনের একটি চিত্র তুলে ধরলে। তুলে ধরারও প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল পত্রপত্রিকার দিকে চোখ রাখা অথবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলোর ওপরে নজর রাখা। আমরা লক্ষ্য করব যে, সড়কের অব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সর্বত্র ভেজালের বেসাতি, হত্যা, খুন, রাহাজানি_ এসব প্রতিবেদনই প্রাধান্য পাচ্ছে এখন গণমাধ্যমে। এ সম্বন্ধে এত লেখা হচ্ছে, এত বলা হচ্ছে যে, বাহুল্য কথা বলার প্রবৃত্তি আর নেই আমার। তবুও আজকের কলামটি ওইসব বিষয়ের ওপরেই প্রাধান্য দিয়ে লিখতে শুরু করলাম। কেননা অঘটন এবং দুর্ঘটনাই একটি জাতির সব দুর্বলতার কারণগুলোকে উন্মোচন করে দেয়।
আমরা সবাই জানি অতিসম্প্রতি আমাদের দু'জন ক্ষণজন্মা মানুষ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর এক বীভৎস দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। সেই সঙ্গে একই যান্ত্রিক শকটে আরও তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে। তাদের চলে যাওয়ার পরপরই খবর এলো পাবনা থেকে নগরবাড়ী যাওয়ার পথে আরও একটি বাস খাদে পড়ে গেছে এবং বেশ কিছু যাত্রী মৃত্যুবরণ করেছে। আমি নিশ্চিত, এই ঘটনার আগে-পরে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে এই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, যার ফলে আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। তারা যদিও, আমি নিশ্চিত, তারেক বা মিশুকের সঙ্গে তুল্যমূল্য নন, তবুও মানুষ তো বটেই। অমৃতের সন্তান। হয়তো সম্ভাবনা ছিল তাদের অনেকের, পৌঁছতে পারতেন বহুদূর। সম্ভাবনা তো সবারই থাকে, থাকতে পারে। সুযোগের অভাবে বেশিদূর যাওয়া হয় না। সে যাকগে। আমি একটু আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে বিশদ আলোচনায় যেতে চাই এবং এই আলোচনা শুরু করার জন্য ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে আমি সাঁকোর প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যবহার করেছি মাত্র। আমাদের গত ৪০ বছরের জীবনে আমরা আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে গেছি। আমি আমার বন্ধুকে চিনতে পারি না, ভাইয়ের চেহারা দেখলে মনে হয় অন্য মানুষ, সন্তানের চেহারায় দেখি বিষণ্নতার ছাপ। অর্থাৎ কেউই ভালো নেই। ভালো নেই বিভিন্ন কারণে। এই কলামের সীমাবদ্ধতার মাঝে এমন একটি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করার চেষ্টা বৃথা। তবুও কিছু বিষয়ে তো অবশ্যই আলোকপাত করা যায়। হয়তো আগ্রহী কেউ এ বিষয়ে বিশদ এবং গভীর আলোচনা করবেন, যাতে করে আমরা উপকৃত হবো।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ঠধষঁব ংুংঃবস. সহজ বাংলায় এর অর্থ হয়তো করা যেতে পারে মূল্যবোধের রীতি। এই বিষয়টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এখন আমাদের সমাজে। এখানে কোনো আইন নেই। থাকলেও আইনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। সভ্যতা-ভব্যতা বলে সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি আমরা। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে কত দ্রুত আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঐশ্বর্যের মালিক হতে পারি। এ বিষয়টি অবশ্যই একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তারাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং তারাই জনগণকে পথ দেখানোর চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষ তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে দিকনির্দেশনার জন্য। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী যদি আগাগোড়া দুর্নীতির দ্বারা আবৃত হয় তবে সে দেশের কপালে দুর্ভোগ আছে বৈকি। আমাদের সমাজ আজ এমন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দু'বেলা সুষম আহার, একটি সম্মানজনক বাসস্থান, রোগ-জরায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে যখন বঞ্চিত তখন কতিপয় নগরবাসী আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি নামাচ্ছি আমাদের রাজধানীর রাস্তায়। এ রকম একটি কৃত্রিম সমাজে, যেখানে কোনো কিছুর জন্যই কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, যে কোনো অন্যায় অবলীলায় সাঙ্গ করে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, সেই সমাজে সড়ক এবং ভবন নির্মাণের চরম দুর্নীতি থেকে শুরু করে নির্মাণ ত্রুটির জন্য বীভৎস দুর্ঘটনা, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হত্যা এবং রাহাজানি, এমনকি সন্তানের বক্ষে পিতার ছুরি চালানো থেকে শুরু করে নারীর বদনে এসিড নিক্ষেপ এবং বাচ্চা শিশুর ধর্ষণ নিত্যই ঘটে যায় অবলীলায়। এসব অনাচার, দুরাচার দেখতে দেখতে আমাদের শহরগুলোর অতি সাধারণ মানুষও কখন যেন মানবিকতার ঊধর্ে্ব উঠে যায়।
প্রসঙ্গত, আমি আবারও দৃষ্টি ফেরাই আমাদের মহাসড়কের অব্যবস্থার দিকে। এর পেছনে কেবল কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন মানুষ নয়, অতি সাধারণ মানুষেরও অবদান কোনো অংশে কম নয়। আমি ঢাকার বাইরে আন্তঃনগর সড়কগুলোতে লক্ষ্য করেছি একটি বাস কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ায় এক থেকে দেড় কিলোমিটারের যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যদি আমাদের জনসাধারণ সোচ্চার হতো, তাহলে অনেকাংশে আমরা চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম। কিন্তু বাসের ভেতরে যেসব যাত্রী থাকেন তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন সমাজের বাসিন্দা বলে এই অনিয়ম বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের প্রতি উদাসীন থাকেন। নিত্যই বাসে চলাচল করেন আমার পরিচিত অনেক মানুষের কাছে আমি শুনেছি যে বেপরোয়াভাবে চলাচলকারী বাসকে যদি কোনো যাত্রী সংযতভাবে চালাতে বলেন তাহলে তাকে তার সহযাত্রীদেরই ধমক শুনতে হয়। এমনও শুনেছি যে, কোনো বাসচালক যদি সংযতভাবে বাস চালান তাহলে কিছু কিছু যাত্রীই বলেন যে, 'আমরা কি বাসে যাচ্ছি, না গরুর গাড়িতে?' তারা মাঝে মধ্যে সামনের গাড়িকে বেআইনিভাবে ওভারটেক করারও হুকুম দেন বাসচালককে। তার মানে হচ্ছে বাসের চালক এবং যাত্রীর মধ্যে এই নিয়মবহির্ভূতভাবে বাস চালানোর একটা অদৃশ্য চুক্তি আছে। বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তোলেন, আমি শুনেছি, বাসের মালিকরা। তারা অতি অল্প সময়ে আরও অধিকসংখ্যক ট্রিপের ব্যাপারে বাসচালককে কঠোর নির্দেশ দেন। ফলে লালবাতির ইশারায় যানবাহনের যে লাইন হয় সেটিকে বেআইনিভাবে ভেঙে মোড়ের মাথায় একটি জট পাকিয়ে তোলার দৃশ্য ঢাকায় অথবা ঢাকার বাইরে নিত্যই দেখা যায়। এই যে বেআইনি আচরণ এ বিষয়ে বাস ছাড়াও অন্যান্য ছোট যানবাহনও প্রায় সমানভাবে দায়ী। তবে সর্বাগ্রে বাসের কথাই আমি উল্লেখ করব। আইন অমান্য করা, যেমন বলেছি, আমাদের মজ্জাগত, সব বিষয়ে। অথচ এই যানজটের জন্য আমরা অহরহ সরকারকে দোষ দিচ্ছি। গোটা বিষয়টিতে আমরা অর্থাৎ দেশের জনসাধারণের যে দায়বদ্ধতা সে সম্বন্ধে একটুও ভেবে দেখি না। যখন যানবাহন এই ধরনের বেআইনি আচরণ করে তখন আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের ট্রাফিক পুলিশ থাকে নির্বিকার। এর পেছনে একটি বৈধ কারণ আছে। এক-দু'জন ট্রাফিক পুলিশের দ্বারা এতগুলো যন্ত্রদানবের প্রকাশ্য হুমকি রুখে দাঁড়ানো অসম্ভব। তাই তারা এ রকম একটি পরিস্থিতি থেকে কিছু আয় অর্জনের চেষ্টা করেন। বিশ্বের সর্বত্র পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় শহরের ভেতরের যে কোনো রাস্তায়। আমাদের দেশে এ বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষ একেবারে উদাসীন। আমাদের জন্য কোনো রাজপথে হেঁটে চলাচল করার মতো উপযুক্ত ফুটপাতের বড়ই অভাব। ফুটপাতগুলো ক্রমে কৃশকায় হতে হতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমরা হাঁটব কোথায়? আমাদের কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল শহরের রাজপথগুলোর দু'পাশে ফুটপাতগুলোকে সংরক্ষিত করে সব মানুষকে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাওয়া-আসা করায় আগ্রহী করা। কিন্তু সে রকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। আমাদের পথচারীদেরও বেআইনি আচরণ করা প্রায় মজ্জাগত। ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দেখা যায় দলবদ্ধ হয়ে সব যানবাহন থামিয়ে ব্যস্ত রাস্তাগুলোর এপার থেকে ওপারে যেতে। এখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশও তাদের ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে সড়ক পারাপার করতে অনুরোধ না করে সাহায্য করেন এ রকম বেআইনিভাবে সড়ক পার হতে। এসবই কিন্তু ঘটছে আমাদেরই অর্থাৎ নাগরিকদের আইন না মানা অথবা আইনকে অবজ্ঞা করার কারণে। অথচ দোষ দেওয়ার সময় আমরা সবসময় প্রশাসন ও সরকারকেই দোষ দিয়ে থাকি।
আসলে আমাদের বর্তমানের অরাজক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ধরায় নেমে আসতে হবে। পা দুটি মাটিতে শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। গণমানুষকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উদাত্ত আহ্বান জানাতে হবে এই বলে যে, 'মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে/ যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে/ যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে/ যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে/ দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার/ মুখ করে আস্টম্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।'
কিন্তু এ বড় সহজ কাজ নয়। এর জন্য শহরবাসী, অবস্থাপন্ন, সুবিধাবাদী, স্বার্থপর আমাদের প্রথমে নিজেদেরই আত্মশুদ্ধিতে প্রবৃত্ত হতে হবে। যে ব্যবসায়ী চরম অন্যায় করে চলেছেন তার পেশায়, তাকে চিহ্নিত করতে হবে। যে রাজনীতিবিদ গণমানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করছেন, তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনবিরোধী কাজ করছেন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই জাতিই কিন্তু ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে একাট্টা হয়ে পাকিস্তানের মতো এমন এক দুর্বিনীত উপনিবেশবাদীকে উচ্ছেদ করেছিল আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি থেকে। এখন আমার নিজ বাসভূমে একটি স্বাভাবিক, সৎ, সুন্দর এবং বাসযোগ্য দেশ গড়ে তোলার সময় এসেছে আবার। আহ্বান থাকবে আমাদের সৎ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আপনাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এগিয়ে আসুন, সত্য কথাটি বলুন, নেতৃত্ব দিন। কারণ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলেই 'শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা'।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমরা সবাই জানি অতিসম্প্রতি আমাদের দু'জন ক্ষণজন্মা মানুষ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর এক বীভৎস দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। সেই সঙ্গে একই যান্ত্রিক শকটে আরও তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে। তাদের চলে যাওয়ার পরপরই খবর এলো পাবনা থেকে নগরবাড়ী যাওয়ার পথে আরও একটি বাস খাদে পড়ে গেছে এবং বেশ কিছু যাত্রী মৃত্যুবরণ করেছে। আমি নিশ্চিত, এই ঘটনার আগে-পরে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে এই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, যার ফলে আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। তারা যদিও, আমি নিশ্চিত, তারেক বা মিশুকের সঙ্গে তুল্যমূল্য নন, তবুও মানুষ তো বটেই। অমৃতের সন্তান। হয়তো সম্ভাবনা ছিল তাদের অনেকের, পৌঁছতে পারতেন বহুদূর। সম্ভাবনা তো সবারই থাকে, থাকতে পারে। সুযোগের অভাবে বেশিদূর যাওয়া হয় না। সে যাকগে। আমি একটু আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে বিশদ আলোচনায় যেতে চাই এবং এই আলোচনা শুরু করার জন্য ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাকে আমি সাঁকোর প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যবহার করেছি মাত্র। আমাদের গত ৪০ বছরের জীবনে আমরা আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে গেছি। আমি আমার বন্ধুকে চিনতে পারি না, ভাইয়ের চেহারা দেখলে মনে হয় অন্য মানুষ, সন্তানের চেহারায় দেখি বিষণ্নতার ছাপ। অর্থাৎ কেউই ভালো নেই। ভালো নেই বিভিন্ন কারণে। এই কলামের সীমাবদ্ধতার মাঝে এমন একটি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করার চেষ্টা বৃথা। তবুও কিছু বিষয়ে তো অবশ্যই আলোকপাত করা যায়। হয়তো আগ্রহী কেউ এ বিষয়ে বিশদ এবং গভীর আলোচনা করবেন, যাতে করে আমরা উপকৃত হবো।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ঠধষঁব ংুংঃবস. সহজ বাংলায় এর অর্থ হয়তো করা যেতে পারে মূল্যবোধের রীতি। এই বিষয়টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এখন আমাদের সমাজে। এখানে কোনো আইন নেই। থাকলেও আইনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই। সভ্যতা-ভব্যতা বলে সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি আমরা। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে কত দ্রুত আমরা ব্যক্তিগতভাবে ঐশ্বর্যের মালিক হতে পারি। এ বিষয়টি অবশ্যই একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তারাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং তারাই জনগণকে পথ দেখানোর চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষ তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে দিকনির্দেশনার জন্য। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী যদি আগাগোড়া দুর্নীতির দ্বারা আবৃত হয় তবে সে দেশের কপালে দুর্ভোগ আছে বৈকি। আমাদের সমাজ আজ এমন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দু'বেলা সুষম আহার, একটি সম্মানজনক বাসস্থান, রোগ-জরায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে যখন বঞ্চিত তখন কতিপয় নগরবাসী আমরা প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি নামাচ্ছি আমাদের রাজধানীর রাস্তায়। এ রকম একটি কৃত্রিম সমাজে, যেখানে কোনো কিছুর জন্যই কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, যে কোনো অন্যায় অবলীলায় সাঙ্গ করে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, সেই সমাজে সড়ক এবং ভবন নির্মাণের চরম দুর্নীতি থেকে শুরু করে নির্মাণ ত্রুটির জন্য বীভৎস দুর্ঘটনা, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হত্যা এবং রাহাজানি, এমনকি সন্তানের বক্ষে পিতার ছুরি চালানো থেকে শুরু করে নারীর বদনে এসিড নিক্ষেপ এবং বাচ্চা শিশুর ধর্ষণ নিত্যই ঘটে যায় অবলীলায়। এসব অনাচার, দুরাচার দেখতে দেখতে আমাদের শহরগুলোর অতি সাধারণ মানুষও কখন যেন মানবিকতার ঊধর্ে্ব উঠে যায়।
প্রসঙ্গত, আমি আবারও দৃষ্টি ফেরাই আমাদের মহাসড়কের অব্যবস্থার দিকে। এর পেছনে কেবল কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন মানুষ নয়, অতি সাধারণ মানুষেরও অবদান কোনো অংশে কম নয়। আমি ঢাকার বাইরে আন্তঃনগর সড়কগুলোতে লক্ষ্য করেছি একটি বাস কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ায় এক থেকে দেড় কিলোমিটারের যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যদি আমাদের জনসাধারণ সোচ্চার হতো, তাহলে অনেকাংশে আমরা চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম। কিন্তু বাসের ভেতরে যেসব যাত্রী থাকেন তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন সমাজের বাসিন্দা বলে এই অনিয়ম বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের প্রতি উদাসীন থাকেন। নিত্যই বাসে চলাচল করেন আমার পরিচিত অনেক মানুষের কাছে আমি শুনেছি যে বেপরোয়াভাবে চলাচলকারী বাসকে যদি কোনো যাত্রী সংযতভাবে চালাতে বলেন তাহলে তাকে তার সহযাত্রীদেরই ধমক শুনতে হয়। এমনও শুনেছি যে, কোনো বাসচালক যদি সংযতভাবে বাস চালান তাহলে কিছু কিছু যাত্রীই বলেন যে, 'আমরা কি বাসে যাচ্ছি, না গরুর গাড়িতে?' তারা মাঝে মধ্যে সামনের গাড়িকে বেআইনিভাবে ওভারটেক করারও হুকুম দেন বাসচালককে। তার মানে হচ্ছে বাসের চালক এবং যাত্রীর মধ্যে এই নিয়মবহির্ভূতভাবে বাস চালানোর একটা অদৃশ্য চুক্তি আছে। বিষয়টিকে আরও কঠিন করে তোলেন, আমি শুনেছি, বাসের মালিকরা। তারা অতি অল্প সময়ে আরও অধিকসংখ্যক ট্রিপের ব্যাপারে বাসচালককে কঠোর নির্দেশ দেন। ফলে লালবাতির ইশারায় যানবাহনের যে লাইন হয় সেটিকে বেআইনিভাবে ভেঙে মোড়ের মাথায় একটি জট পাকিয়ে তোলার দৃশ্য ঢাকায় অথবা ঢাকার বাইরে নিত্যই দেখা যায়। এই যে বেআইনি আচরণ এ বিষয়ে বাস ছাড়াও অন্যান্য ছোট যানবাহনও প্রায় সমানভাবে দায়ী। তবে সর্বাগ্রে বাসের কথাই আমি উল্লেখ করব। আইন অমান্য করা, যেমন বলেছি, আমাদের মজ্জাগত, সব বিষয়ে। অথচ এই যানজটের জন্য আমরা অহরহ সরকারকে দোষ দিচ্ছি। গোটা বিষয়টিতে আমরা অর্থাৎ দেশের জনসাধারণের যে দায়বদ্ধতা সে সম্বন্ধে একটুও ভেবে দেখি না। যখন যানবাহন এই ধরনের বেআইনি আচরণ করে তখন আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের ট্রাফিক পুলিশ থাকে নির্বিকার। এর পেছনে একটি বৈধ কারণ আছে। এক-দু'জন ট্রাফিক পুলিশের দ্বারা এতগুলো যন্ত্রদানবের প্রকাশ্য হুমকি রুখে দাঁড়ানো অসম্ভব। তাই তারা এ রকম একটি পরিস্থিতি থেকে কিছু আয় অর্জনের চেষ্টা করেন। বিশ্বের সর্বত্র পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় শহরের ভেতরের যে কোনো রাস্তায়। আমাদের দেশে এ বিষয়টিতে কর্তৃপক্ষ একেবারে উদাসীন। আমাদের জন্য কোনো রাজপথে হেঁটে চলাচল করার মতো উপযুক্ত ফুটপাতের বড়ই অভাব। ফুটপাতগুলো ক্রমে কৃশকায় হতে হতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমরা হাঁটব কোথায়? আমাদের কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল শহরের রাজপথগুলোর দু'পাশে ফুটপাতগুলোকে সংরক্ষিত করে সব মানুষকে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাওয়া-আসা করায় আগ্রহী করা। কিন্তু সে রকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। আমাদের পথচারীদেরও বেআইনি আচরণ করা প্রায় মজ্জাগত। ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের দেখা যায় দলবদ্ধ হয়ে সব যানবাহন থামিয়ে ব্যস্ত রাস্তাগুলোর এপার থেকে ওপারে যেতে। এখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশও তাদের ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে সড়ক পারাপার করতে অনুরোধ না করে সাহায্য করেন এ রকম বেআইনিভাবে সড়ক পার হতে। এসবই কিন্তু ঘটছে আমাদেরই অর্থাৎ নাগরিকদের আইন না মানা অথবা আইনকে অবজ্ঞা করার কারণে। অথচ দোষ দেওয়ার সময় আমরা সবসময় প্রশাসন ও সরকারকেই দোষ দিয়ে থাকি।
আসলে আমাদের বর্তমানের অরাজক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ধরায় নেমে আসতে হবে। পা দুটি মাটিতে শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। গণমানুষকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উদাত্ত আহ্বান জানাতে হবে এই বলে যে, 'মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে/ যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে/ যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে/ যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে/ দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার/ মুখ করে আস্টম্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।'
কিন্তু এ বড় সহজ কাজ নয়। এর জন্য শহরবাসী, অবস্থাপন্ন, সুবিধাবাদী, স্বার্থপর আমাদের প্রথমে নিজেদেরই আত্মশুদ্ধিতে প্রবৃত্ত হতে হবে। যে ব্যবসায়ী চরম অন্যায় করে চলেছেন তার পেশায়, তাকে চিহ্নিত করতে হবে। যে রাজনীতিবিদ গণমানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করছেন, তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনবিরোধী কাজ করছেন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই জাতিই কিন্তু ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে একাট্টা হয়ে পাকিস্তানের মতো এমন এক দুর্বিনীত উপনিবেশবাদীকে উচ্ছেদ করেছিল আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি থেকে। এখন আমার নিজ বাসভূমে একটি স্বাভাবিক, সৎ, সুন্দর এবং বাসযোগ্য দেশ গড়ে তোলার সময় এসেছে আবার। আহ্বান থাকবে আমাদের সৎ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি, ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আপনাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এগিয়ে আসুন, সত্য কথাটি বলুন, নেতৃত্ব দিন। কারণ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মিলেই 'শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা'।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments