গণশার চিঠি by লীলা মজুমদার
ভাই সন্দেশ, অনেক দিন পর তোমায় চিঠি লিখছি। এর মধ্যে কত কী যে ঘটে গেল যদি জানতে, তোমার গায়ের লোম ভাই খাড়া হয়ে গেঞ্জিটা উঁচু হয়ে যেত, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসত, হাঁটুতে হাঁটুতে ঠকাঠক হয়ে কড়া পড়ে যেত!
আজকাল আমি মামাবাড়ি থাকি। আমার মনে হয়, ওঁরা কেউ ভালো লোক নন।
আজকাল আমি মামাবাড়ি থাকি। আমার মনে হয়, ওঁরা কেউ ভালো লোক নন।
ওঁদের মধ্যে মাস্টারমশাই তো আবার ম্যাজিক জানেন। আমি ম্যাজিক করতে দেখিনি, কিন্তু মনদা বলেছে, ওঁর স্কুলে বছরের প্রথম প্রথম মেলাই ছেলেপুলে থাকে, আর বছরের শেষের দিকে গুটিকয় টিমটিম করে। এদিকে মাস্টারমশাইয়ের ছাগলের ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কিন্তু বাবা সুবিধের কথা নয়! ছেলেগুলো যায় কোথা?
মাস্টারমশাইয়ের চেহারাটাও ভাই কী রকম যেন। সরু-ঠ্যাং পেন্টালুন উনি কখনো ধোপার বাড়ি দেন না। সাদা-কালো চৌকো-কাটা কোট পরেছেন তো পরেছেনই। আবার চুলগুলো সামনের দিকে খুদে খুদে আর পেছন দিকে লম্বা মতন, পাশের গোঁফ ঝুলো-ঝুলো। ওঁর জুতোগুলো কে জানে বাবা কিসের চামড়ায়, কিসের তেলে ডুবিয়ে কিসের লোম দিয়ে সেলাই করা!
বাবা গো! মা গো! ইচ্ছে করে ওঁর স্কুলে কে যাবে? মানকে স্বচক্ষে দেখেছে, প্রথম সপ্তাহে ঘরের ভেতরে সাতটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে দুটো ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই গা নাচাচ্ছেন। পরের সপ্তাহে মানকে আবার দেখেছে, ঘরের ভেতরে ছয়টা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে তিনটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই জিভ দিয়ে দাঁতের ফোকর থেকে পানের কুচি বের করছেন। আবার তার পরের সপ্তাহে হয়তো দেখবে, ঘরের ভেতর পাঁচটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর বাইরে চারটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই সেফটিপিন দিয়ে কান চুলকোচ্ছেন। শেষটা হয়তো ঘরের দরজায় তালা মারা থাকবে আর ঘরের বাইরে নয়টা ছাগল নটে চিবিয়ে দিন কাটাবে; মাস্টারমশাই খাঁড়ায় শান দেবেন।
তা ছাড়া সেই যে বিভু আরশোলা পুষত, একবার গুবরে পোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে—মাস্টারমশাইয়ের বাক্সে হলদেটে তুলোট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে। ওর লেবুর গাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না; পেঁপেগাছে সেই গোল-চোখ চকচক জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের বোকা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝাঁটা বেঁধে দিন-রাত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিছুই বলা যায় না; মনদা তো ও-বাড়িতে কোনোমতেই যায় না, মেজও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না আর ছোট ছেলে ধনা, তার তো ও-বাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি-কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত ও-বাড়ির কুল খায় না, গুড়িয়ার মা সজনে ডাঁটা নেয় না।
মামা কিন্তু ওঁদের কুমড়ো-ডাঁটা দিব্যি খান; আর বড় মামা তো ওঁরই দাদা, ওই একই ধাত। ওঁরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কি ম্যাজিক কি মন্তর-পড়া—এসব একেবারে বিশ্বাস করেন না। কে জানে কোনোদিন হয়তো কানে ধরে ওই স্কুলেই আমাকে ভর্তি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারাজীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবোব? স্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড় মামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের ওপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি। কেঁউ কেঁউ, ফোঁৎ ফোঁৎ! কান্না পেয়ে গেল ভাই!
এদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড় মামা যখন-তখন আমার দিকে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচর ফ্যাচর হাসেন। বুঝছি, গতিক ভালো নয়। দুয়েকবার তিনতলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না, খানকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি; বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুঁয়োপোকা ছিল। খোকনকে বলেছি, গলায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হলো না। এদিকে অভ্যাস না থাকলে কী যে হবে তা-ও তো জানি না!
এসব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিখতে পারিনি বুঝতেই পারছ!
একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। কেডস পায়ে দিয়ে সুট-সুট মাস্টারমশাইয়ের বেড়া টপকে, ছাগলদাঁড় ডিঙিয়ে, জানালার গরাদ খামচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়ি মাছের মতন ডান্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারলাম।
দেখলাম, মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুঁকো খেতে চেষ্টা করছেন আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন—কোনোটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন; কোনোটা আধ-খ্যাঁচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বলে সারাক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড় ভালো লাগল।
কিন্তু আনন্দের চোটে যে-ই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চমকে বললেন—ওটা কী রে? ভাবলুম, এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন, নখ দিয়ে খামচে দিয়ে গিরগিটির মতো মুখ করে বললেন—ও বাঁদর! বললুম, আজ্ঞে স্যার, ছাগল বানাবেন না স্যার! বললেন, বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে? গিন্নিও ফিসফিস করে বললেন, ওটিকে রাখো, আমি পুষব!
ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কি না দেখে বললেন—তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, তার কী হলো? বললেন, এখন তার দাড়ি গজিয়েছে। বলে বড় বড় বাতাসা খেতে দিলেন, তারপর বাড়ি চলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না, দাড়ির সঙ্গে ক্ষুরও গজিয়েছিল কি না।
স্কুলের কথা এখনো কিছু ঠিক হয়নি, এই ফাঁকে তোমাকে লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো না। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে-টোঁয়াড়ে খোঁজ কোরো।
লীলা মজুমদার: প্রখ্যাত লেখিকা।
জন্ম: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৮; মৃত্যু: ৫ এপ্রিল, ২০০৭
মাস্টারমশাইয়ের চেহারাটাও ভাই কী রকম যেন। সরু-ঠ্যাং পেন্টালুন উনি কখনো ধোপার বাড়ি দেন না। সাদা-কালো চৌকো-কাটা কোট পরেছেন তো পরেছেনই। আবার চুলগুলো সামনের দিকে খুদে খুদে আর পেছন দিকে লম্বা মতন, পাশের গোঁফ ঝুলো-ঝুলো। ওঁর জুতোগুলো কে জানে বাবা কিসের চামড়ায়, কিসের তেলে ডুবিয়ে কিসের লোম দিয়ে সেলাই করা!
বাবা গো! মা গো! ইচ্ছে করে ওঁর স্কুলে কে যাবে? মানকে স্বচক্ষে দেখেছে, প্রথম সপ্তাহে ঘরের ভেতরে সাতটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে দুটো ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই গা নাচাচ্ছেন। পরের সপ্তাহে মানকে আবার দেখেছে, ঘরের ভেতরে ছয়টা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর ঘরের বাইরে তিনটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই জিভ দিয়ে দাঁতের ফোকর থেকে পানের কুচি বের করছেন। আবার তার পরের সপ্তাহে হয়তো দেখবে, ঘরের ভেতর পাঁচটা ছেলে পেনসিল চিবুচ্ছে আর বাইরে চারটে ছাগল নটে চিবুচ্ছে; মাস্টারমশাই সেফটিপিন দিয়ে কান চুলকোচ্ছেন। শেষটা হয়তো ঘরের দরজায় তালা মারা থাকবে আর ঘরের বাইরে নয়টা ছাগল নটে চিবিয়ে দিন কাটাবে; মাস্টারমশাই খাঁড়ায় শান দেবেন।
তা ছাড়া সেই যে বিভু আরশোলা পুষত, একবার গুবরে পোকাও খেয়েছিল, সে বলেছে সে দেখেছে—মাস্টারমশাইয়ের বাক্সে হলদেটে তুলোট কাগজে লাল দিয়ে লেখা খাতা আছে, সে লাল কালিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে। ওর লেবুর গাছে মাকড়সারা কেন জানি জাল বোনে না; পেঁপেগাছে সেই গোল-চোখ চকচক জন্তু নেই, দেয়ালে টিকটিকি নেই। একটা হতে পারে মাস্টারমশাইয়ের বোকা গিন্নি মোটা বাঁশের ডগায় ঝাঁটা বেঁধে দিন-রাত ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিছুই বলা যায় না; মনদা তো ও-বাড়িতে কোনোমতেই যায় না, মেজও বাড়ির ছায়াটি মাড়ায় না আর ছোট ছেলে ধনা, তার তো ও-বাড়ির হাওয়া গায়ে লাগলেই সর্দি-কাশি হয়ে যায়। রামশরণ পর্যন্ত ও-বাড়ির কুল খায় না, গুড়িয়ার মা সজনে ডাঁটা নেয় না।
মামা কিন্তু ওঁদের কুমড়ো-ডাঁটা দিব্যি খান; আর বড় মামা তো ওঁরই দাদা, ওই একই ধাত। ওঁরা চমৎকার গল্প বলতে পারেন, কিন্তু ভূত কি ম্যাজিক কি মন্তর-পড়া—এসব একেবারে বিশ্বাস করেন না। কে জানে কোনোদিন হয়তো কানে ধরে ওই স্কুলেই আমাকে ভর্তি করে দেবেন, আর শেষটা কি সারাজীবন ব্যা-ব্যা করে নটে চিবোব? স্কুল থেকে ফিরতে দেরি দেখে বড় মামা হয়তো চটি পায়েই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখবেন, পাথরের ওপর শিং ঘষে শান দিচ্ছি। কেঁউ কেঁউ, ফোঁৎ ফোঁৎ! কান্না পেয়ে গেল ভাই!
এদ্দিনে তোমায় লিখছি ভাই, আর হয়তো লেখা হবে না। দিব্যি টের পাচ্ছি দিন ঘনিয়ে আসছে। বড় মামা যখন-তখন আমার দিকে তাকিয়ে গোঁফের ফাঁকে বিশ্রী ফ্যাচর ফ্যাচর হাসেন। বুঝছি, গতিক ভালো নয়। দুয়েকবার তিনতলার ছাদে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে ডেকে দেখেছি, সে আমার ঠিক হয় না। কেউ যখন দেখছে না, খানকতক দুব্বো ঘাস চিবিয়ে দেখেছি; বদ খেতে, তাতে আবার ছোট্ট শুঁয়োপোকা ছিল। খোকনকে বলেছি, গলায় দড়ি বেঁধে একটু টেনে বেড়াতে, ও কিন্তু রাজি হলো না। এদিকে অভ্যাস না থাকলে কী যে হবে তা-ও তো জানি না!
এসব নানা কারণে এতকাল চিঠি লিখতে পারিনি বুঝতেই পারছ!
একদিন সন্ধ্যাবেলা আর তর সইল না। কেডস পায়ে দিয়ে সুট-সুট মাস্টারমশাইয়ের বেড়া টপকে, ছাগলদাঁড় ডিঙিয়ে, জানালার গরাদ খামচে ধরে, পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়িয়ে চিংড়ি মাছের মতন ডান্ডার আগায় চোখ বাগিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মারলাম।
দেখলাম, মাস্টারমশাই গলাবন্ধ কোট খুলে রেখে মোড়ায় বসে হুঁকো খেতে চেষ্টা করছেন আর গিন্নি মাটিতে বসে কুলো থেকে খাবলা খাবলা শুকনো বড়ি তুলছেন—কোনোটা আস্ত উঠছে, গিন্নি হাসছেন; কোনোটা আধ-খ্যাঁচড়া উঠছে, গিন্নি দাঁত কিড়মিড় করছেন। আর মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙেছেন বলে সারাক্ষণ বকবক করছেন ভাই, বড় ভালো লাগল।
কিন্তু আনন্দের চোটে যে-ই খচমচ করে উঠেছি, মাস্টারমশাই চমকে বললেন—ওটা কী রে? ভাবলুম, এবার তো গেছি! কান ধরে ঝুলিয়ে ঘরে টেনে আনলেন, নখ দিয়ে খামচে দিয়ে গিরগিটির মতো মুখ করে বললেন—ও বাঁদর! বললুম, আজ্ঞে স্যার, ছাগল বানাবেন না স্যার! বললেন, বাঁদর আবার কবে ছাগল হয় রে? গিন্নিও ফিসফিস করে বললেন, ওটিকে রাখো, আমি পুষব!
ভয়ের চোটে কেঁদে ফেললুম। গিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে শিং আছে কি না দেখে বললেন—তোমার মতন আমার একটি খোকা ছিল। জিজ্ঞেস করলুম, তার কী হলো? বললেন, এখন তার দাড়ি গজিয়েছে। বলে বড় বড় বাতাসা খেতে দিলেন, তারপর বাড়ি চলে গেলাম। জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না, দাড়ির সঙ্গে ক্ষুরও গজিয়েছিল কি না।
স্কুলের কথা এখনো কিছু ঠিক হয়নি, এই ফাঁকে তোমাকে লিখছি। এ চিঠির আর উত্তর দিয়ো না। দেখা করতে চাও তো খোঁয়াড়ে-টোঁয়াড়ে খোঁজ কোরো।
লীলা মজুমদার: প্রখ্যাত লেখিকা।
জন্ম: ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৮; মৃত্যু: ৫ এপ্রিল, ২০০৭
No comments