মত দ্বিমত-সরকারি দলই প্রস্তাব দিক by এম হাফিজউদ্দিন খান
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল এখন মুখোমুখি। ইতিমধ্যে বিরোধী দল দুই দফায় ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে। সরকারি দল বলছে, সমস্যার সমাধান চাইলে আলোচনায় বসতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই সাবেক উপদেষ্টার লেখা প্রকাশ করা হলো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তার শুরু গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে। তৎকালীন বিএনপি সরকার মাগুরায় জবরদস্তির উপনির্বাচন করেই সমস্যা তৈরি করল। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে সেই আন্দোলন জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধে রূপ নেয় এবং বিএনপি সরকার বিরোধী দলের দাবি মেনে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ভালো কি খারাপ, সংবিধানসম্মত কি সংবিধানপরিপন্থী; সেই বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। যদিও পরাজিত দল সেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি।
দ্বিতীয় দফায়ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বিগত বিএনপি সরকার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে। বিচারকদের খুশি করার জন্য এটি করা হয়নি, করা হয়েছিল নিজেদের সুবিধার জন্য। এর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দল আন্দোলন করেছে। এবং সেই আন্দোলনের একপর্যায়ে ১/১১-এর ঘটনা ঘটে; যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এখন আবার সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। আদালতের রায়ে কিন্তু সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি। রায়ে বলা হয়েছে, আগামীতে এই ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না; তবে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।
এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার যে সুযোগ ছিল, তা ক্ষমতাসীনেরাই নষ্ট করেছে। আদালতের রায়ের পর সমঝোতার স্বার্থে সরকার রিভিউ আবেদন করতে পারত। অন্যদিকে বিএনপিও আলোচনায় না এসে হরতাল দিয়েছে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি যে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিরোধী দল বলেছে, হরতাল করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু হরতাল না করার অধিকারও জনগণের আছে। বিরোধী দল হরতাল ডেকে তো জনগণের ওপর ভরসা রাখছে না। তারা জবরদস্তি করছে। আমি তো পিকেটারদের ভয়ে রাস্তায় গাড়ি নামাতে পারছি না। আবার হরতাল বন্ধের নামে সরকারও বাড়াবাড়ি করছে। গত হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাইকারি ধরপাকড় করেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
আমি মনে করি, সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। সরকারি দল বিরোধী দলকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু আলোচনার ভিত্তি তো ঠিক করতে হবে। মঙ্গলবার ডেইলি স্টার-এর খবরে দেখলাম, সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার নতুন মডেলের কথা ভাবছে। এটি ইতিবাচক বলেই মনে করি। সরকারি দলের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব আসা উচিত। সেই প্রস্তাব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। এটাই শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায়। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান যদি হয় সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার—তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, এ কথা ঠিক। বর্তমান কমিশন অনেক ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনী আইন সংশোধন করেছে। নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার উদ্যোগও প্রশংসনীয়। কিন্তু আমরা মনে করি, এখনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই। দলীয় সরকারের অধীনে তা করা সম্ভব নয়। এর আরেকটি কারণ হলো, সিভিল প্রশাসন মারাত্মকভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? পথ একটাই—আলোচনা, সমঝোতা। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকলে পরিণতি কারও জন্য ভালো হবে না। এ কথাটি তাদের বুঝতে হবে। আমি মনে করি, নাগরিক সমাজ উভয় পক্ষকে বসানোর উদ্যোগ নিতে পারে। তা না হলে আমরা সামনে অন্ধকার দেখছি। দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ভালো কি খারাপ, সংবিধানসম্মত কি সংবিধানপরিপন্থী; সেই বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। যদিও পরাজিত দল সেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি।
দ্বিতীয় দফায়ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বিগত বিএনপি সরকার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে। বিচারকদের খুশি করার জন্য এটি করা হয়নি, করা হয়েছিল নিজেদের সুবিধার জন্য। এর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দল আন্দোলন করেছে। এবং সেই আন্দোলনের একপর্যায়ে ১/১১-এর ঘটনা ঘটে; যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এখন আবার সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। আদালতের রায়ে কিন্তু সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি। রায়ে বলা হয়েছে, আগামীতে এই ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে না; তবে দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।
এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার যে সুযোগ ছিল, তা ক্ষমতাসীনেরাই নষ্ট করেছে। আদালতের রায়ের পর সমঝোতার স্বার্থে সরকার রিভিউ আবেদন করতে পারত। অন্যদিকে বিএনপিও আলোচনায় না এসে হরতাল দিয়েছে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি যে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিরোধী দল বলেছে, হরতাল করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু হরতাল না করার অধিকারও জনগণের আছে। বিরোধী দল হরতাল ডেকে তো জনগণের ওপর ভরসা রাখছে না। তারা জবরদস্তি করছে। আমি তো পিকেটারদের ভয়ে রাস্তায় গাড়ি নামাতে পারছি না। আবার হরতাল বন্ধের নামে সরকারও বাড়াবাড়ি করছে। গত হরতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাইকারি ধরপাকড় করেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
আমি মনে করি, সমঝোতার সুযোগ এখনো আছে। সরকারি দল বিরোধী দলকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু আলোচনার ভিত্তি তো ঠিক করতে হবে। মঙ্গলবার ডেইলি স্টার-এর খবরে দেখলাম, সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার নতুন মডেলের কথা ভাবছে। এটি ইতিবাচক বলেই মনে করি। সরকারি দলের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব আসা উচিত। সেই প্রস্তাব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। এটাই শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায়। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান যদি হয় সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার—তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।
নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, এ কথা ঠিক। বর্তমান কমিশন অনেক ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনী আইন সংশোধন করেছে। নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার উদ্যোগও প্রশংসনীয়। কিন্তু আমরা মনে করি, এখনো জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প নেই। দলীয় সরকারের অধীনে তা করা সম্ভব নয়। এর আরেকটি কারণ হলো, সিভিল প্রশাসন মারাত্মকভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? পথ একটাই—আলোচনা, সমঝোতা। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকলে পরিণতি কারও জন্য ভালো হবে না। এ কথাটি তাদের বুঝতে হবে। আমি মনে করি, নাগরিক সমাজ উভয় পক্ষকে বসানোর উদ্যোগ নিতে পারে। তা না হলে আমরা সামনে অন্ধকার দেখছি। দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments