মত দ্বিমত-হরতাল যৌক্তিকতা হারাচ্ছে by সুলতানা কামাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল এখন মুখোমুখি। ইতিমধ্যে বিরোধী দল দুই দফায় ৪৮ ঘণ্টা হরতাল পালন করেছে। সরকারি দল বলছে, সমস্যার সমাধান চাইলে আলোচনায় বসতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই সাবেক উপদেষ্টার লেখা প্রকাশ করা হলো।
সম্প্রতি হরতালে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়া। ২০০৯ সালে এ-সংক্রান্ত একটি আইন পাস করা হয়েছিল। এর আগে এ ধরনের আদালত খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অপরাধে শাস্তি দিতেন। পরে নারীদের উত্ত্যক্ত করার বিরুদ্ধে এ আদালত কাজ করেছেন। তখন আমরা এ আইনকে সমর্থনও করেছি, সেই সঙ্গে সতর্ক থাকতে বলেছি, যাতে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত না হয়।
কিন্তু হরতালকে কেন্দ্র করে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠনের বিষয়টি নতুন। বিষয়টি রাজনৈতিক বলে অপব্যবহারের সুযোগও বেশি থাকে। খাদ্যে ভেজালের ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু এখানে সরাসরি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকারের প্রথম কথা হলো, বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে। আইনেও সেই সুরক্ষা রয়েছে। আইন অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতে কাউকে শাস্তি দিতে হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনাতে হবে। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করলে অন্তত দুজন সাক্ষী থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, ভ্রাম্যমাণ আদালতে যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সেগুলো অনুসরণ করা হয়েছে কি না। এ কারণেই আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। যেকোনো আইন যেকোনো স্থানে ব্যবহার করা যায় না। যেমন—আমার কাছে কাঁচি ও করাত আছে। কাপড় কাটতে আমি কোনটিকে ব্যবহার করব? নিশ্চয়ই করাত নয়। খুনের আসামিকেও কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়। কেউ এসে বলল, অমুক খুন করেছে, অমনি তাকে ধরে শাস্তি দেওয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে আমি আরও একটি কথা বলব। হরতাল করার অধিকার যেমন একজনের আছে, তেমনি হরতাল না করারও অধিকার আছে। একসময় হরতাল ছিল অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে অহরহ হরতাল ডাকা হচ্ছে, যার সঙ্গে বৃহত্তর মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই।
এর ফলে হরতাল যৌক্তিকতা হারাচ্ছে। এর অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আর হরতালের নামে গাড়ি ভাঙচুর বা আগুন জ্বালানো কিংবা মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। অযৌক্তিক হরতাল দিয়ে আসলে রাজনৈতিক আন্দোলনের এই মোক্ষম অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে ফেলা হয়েছে। মানুষ এখন হরতালে বিরক্ত হয়। যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে হরতাল পালন করছেন, তাঁরা তাঁদের দাবির কথাটি সংসদে গিয়ে বলতে পারেন। যে সমস্যা সংসদে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়, সেই সমস্যার জন্য হরতাল দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? সংসদ তো সরকারের নিজস্ব বাসভবন নয়। বিরোধী দল সেখানে যাবে না কেন?
আরেকটি কথা, যাঁরা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁরা যখন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তখন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে মেনে নিয়েছিলেন? তাঁরা বলেছেন, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, অমুককে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে অসম্মান করা হয়েছে।
তবে এ কথাও ঠিক, সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো তো এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেনি। যখনই যারা হেরেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে। শাস্তিও দাবি করেছে। তা ছাড়া অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে পছন্দের লোকজনকে এমন সব স্থানে বসানো হয়েছে, যাঁরা দল ও ব্যক্তির পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁরা দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেননি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসবে, একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে সক্ষম হবে। আর তারা যদি সেটি করতে না পারে, তাহলে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। গণতন্ত্র হলো অভ্যাস, চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়। গায়ের জোরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়।
সুলতানা কামাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী।
কিন্তু হরতালকে কেন্দ্র করে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠনের বিষয়টি নতুন। বিষয়টি রাজনৈতিক বলে অপব্যবহারের সুযোগও বেশি থাকে। খাদ্যে ভেজালের ক্ষেত্রে সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু এখানে সরাসরি কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকারের প্রথম কথা হলো, বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে। আইনেও সেই সুরক্ষা রয়েছে। আইন অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতে কাউকে শাস্তি দিতে হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে শোনাতে হবে। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করলে অন্তত দুজন সাক্ষী থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, ভ্রাম্যমাণ আদালতে যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সেগুলো অনুসরণ করা হয়েছে কি না। এ কারণেই আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। যেকোনো আইন যেকোনো স্থানে ব্যবহার করা যায় না। যেমন—আমার কাছে কাঁচি ও করাত আছে। কাপড় কাটতে আমি কোনটিকে ব্যবহার করব? নিশ্চয়ই করাত নয়। খুনের আসামিকেও কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হয়। কেউ এসে বলল, অমুক খুন করেছে, অমনি তাকে ধরে শাস্তি দেওয়া যায় না।
এ প্রসঙ্গে আমি আরও একটি কথা বলব। হরতাল করার অধিকার যেমন একজনের আছে, তেমনি হরতাল না করারও অধিকার আছে। একসময় হরতাল ছিল অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে অহরহ হরতাল ডাকা হচ্ছে, যার সঙ্গে বৃহত্তর মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই।
এর ফলে হরতাল যৌক্তিকতা হারাচ্ছে। এর অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আর হরতালের নামে গাড়ি ভাঙচুর বা আগুন জ্বালানো কিংবা মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। অযৌক্তিক হরতাল দিয়ে আসলে রাজনৈতিক আন্দোলনের এই মোক্ষম অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে ফেলা হয়েছে। মানুষ এখন হরতালে বিরক্ত হয়। যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবিতে হরতাল পালন করছেন, তাঁরা তাঁদের দাবির কথাটি সংসদে গিয়ে বলতে পারেন। যে সমস্যা সংসদে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়, সেই সমস্যার জন্য হরতাল দেওয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে? সংসদ তো সরকারের নিজস্ব বাসভবন নয়। বিরোধী দল সেখানে যাবে না কেন?
আরেকটি কথা, যাঁরা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁরা যখন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, তখন কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে মেনে নিয়েছিলেন? তাঁরা বলেছেন, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, অমুককে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে অসম্মান করা হয়েছে।
তবে এ কথাও ঠিক, সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো তো এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেনি। যখনই যারা হেরেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে। শাস্তিও দাবি করেছে। তা ছাড়া অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে পছন্দের লোকজনকে এমন সব স্থানে বসানো হয়েছে, যাঁরা দল ও ব্যক্তির পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁরা দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেননি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক নেতৃত্ব আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসবে, একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে সক্ষম হবে। আর তারা যদি সেটি করতে না পারে, তাহলে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। গণতন্ত্র হলো অভ্যাস, চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়। গায়ের জোরে কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়।
সুলতানা কামাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী।
No comments