স্মরণ-তোমায় নতুন করে পাব বলে by বিপ্লব বালা
আমাদের সব লেখা ও বলা দিনে দিনেই হয়ে উঠেছে কেবল যেন কথার কথা। তা সে যা কিছু আর যাকে নিয়েই হোক না কেন। তাই কি কেউ কারও কথা ঠিক আমলে নিই না। ধরেই নিই, যা কিছু লিখেছে, তা লিখতে হয় বলেই লিখেছে। লেখার জন্যই লেখা।
নিকটজনকে নিয়ে লিখতে তাই বড় সংকোচ হয়। গত ১৮ জুন ছিল বাবা গৌরচন্দ্র বালার মৃত্যুদিন। বাবার জন্ম বা মৃত্যুদিনে তাঁকে নিয়ে লিখতে কেমন বাধো-বাধো ঠেকে। কীভাবে সবাই নেবে তা—এই ভেবে। নিজের সন্তান তো তার বাবার গুণকীর্তন কিছু করবেই প্রথামতো, তাতে আর সবার কী আসে যায়।
যদিও জানি, বাবাকে নিয়ে কিছু কথা বলা যায় সত্যিই। অন্যকে বলার মতোও সেসব। আমরা তো আজ অদ্ভুত এক সময়ে বাস করছি, যেখানে কেউ কারও ঠিক নই আর। কোনো কিছুর সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক নেই কারও। কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না কারও তাই। তাই কি বলে যাওয়া চাই না যত যা কিছু স্মৃতি আছে—সম্পর্কের, ভালোবাসার? একদিন মানুষ সত্যই যে কেবল নিজের কথাই ভাবত না। নিজের পরিবার নিয়েই তার জীবন ছিল না একদিন। বংশের, সমাজের আর দশজনের ভালো-মন্দের কথাও ভাবত সে। গরিব ঘরের সন্তান লেখাপড়া শিখে গ্রামের আর পাঁচজনও যাতে তা পারে, তার জন্য ভাবত, করত। অনেক পাস করে গ্রামে ফিরলে সবাই তাকে মাথায় তুলে নাচত। সেও বড়দের পায়ের ধুলা নিয়ে ধন্য হতো। গ্রামের কোনো আসরে ঢুকত সবাইকে প্রণাম করে, বিনয়ে মাথা নোয়ায়ে। রাজনীতি সেদিনও ক্ষমতারই বিষয় ছিল, তবু সমাজের দশজনের ভালোর কথাটাও ছিল তাতে। ভোটে জিতলে তাদের সেবা করার কথাটা আজকের মতো এমন মিথ্যা ছিল না।
জীবিকা বা চাকরির জন্য শহরে থাকলেও গ্রামের মানুষজন, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সত্যিই এক ধরনের সম্পর্ক ছিল সবার। আসা-যাওয়া ছিল। গ্রামের কেউ যেকোনো প্রয়োজনে শহরে এলে নির্দ্বিধায় উঠত আত্মীয়বাড়িতে। তাদের জন্য সাধ্যমতো করা হতো, যদিও তা নিয়ে অভিযোগের কমতিও থাকত না। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বা দূরসম্পর্কের কুটুমবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আজ যে কতই বিস্মৃতকালের রূপকথা! আমার বাবা জীবিকা আর রাজনীতি নিয়ে বড়ই ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তাঁর মন তবু পড়ে থাকত গ্রামেই। সেই যেন তাঁর নিজের বাড়ি ছিল চিরকাল। সেই বাড়ির কেউ এলে তাঁর মনে কী যে আনন্দের বান ডাকত! আমরাও তা দেখে ভালো লাগায় বিভোর হতাম। গরিব-দুঃখী আত্মীয়কে নিয়েও সংকোচ করতে দেখিনি কোনো দিন তাঁকে। গ্রামদেশের সবাই তাঁকে ‘বাবু’ বলত—প্রথম শিক্ষিত, শহুরে মানীজন বলে। সেটা কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব তৈরি করত না। মানুষের সঙ্গে মানুষের কত রকম সম্পর্কই যে ছিল সেদিন, ভাবলে কেমন লাগে! লাগে কি আজও সবার? জীবতকালে কতই তবু ভুল বুঝেছি, সমালোচনা করেছি—শহরে বেমানান এই গ্রামের মানুষটির। মন্ত্রী-মিনিস্টার-নেতা-এমপি হয়ে কতক নিশ্চয় অন্য রকম হয়েছিলেন—ক্ষমতার অনিবার্য গতিকে। তবু ভেতরে ভেতরে ছিলেন যে গরিব চাষারই এক শিক্ষিত পুত। তাই নিয়েই ছিল তাঁর চিরকালের গৌরব-গর্ব। আধুনিক, প্রগতিশীল, যুক্তিবিজ্ঞানের হঠাৎ শিং গজানো বাছুর সেজে কতভাবেই না নাজেহাল করেছি তবু এই মাটির সরল-সিদা মানুষটিকেই। অস্থির অসহায়ের মতো ছটফট করেছেন আমাদের দায়িত্বহীন আচরণে। তাঁর সেই মর্মন্তুদ কষ্টটা একটু লাঘব করার জন্য দুটো কথাও বলিনি, সে ভাষাও শিখিনি যে এমনই ঘোর বুঝমান ছিলাম। আমাদের যত জ্ঞানগরিমা তো মানুষের ভেতরের মানুষটাকে নাস্তানাবুদ করার দুর্মর অহংবিকারে! কারোরই নিস্তার নেই তার হাত থেকে—‘কেবলি অপরের মুখ ম্লান করা ছাড়া/ সুখ নাই’ যে। তারই প্রথম শিকার বুঝি জনক-জননী আমাদের। জানি না, সব তার একদিন শোধ করে দিতে হবে। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে যত যা কিছু ঋণ আছে। পিতাই তো বয়ে চলেছেন এক পুত্রজন্ম নিয়ে এই আমারি মাঝারে। এই তো মানবের চিরসম্পর্কের অচ্ছেদ্য নাড়ির বন্ধন, ধারাবাহিকতা— একেই বলে বুঝি জন্ম-জন্মান্তর।
‘আমরা যে কেউ একা বাঁচি না’—রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে বলেছিল সুরঙ্গমা। এটা কি রাবীন্দ্রিক ভাবেরই কথা কেবল? সত্যই কি সম্পর্ক-বন্ধনেই কেবল আমরা খুঁজে পাই না নিজেকেই? আর তার ভিত্তিটা তো বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচির সঙ্গে সম্পর্ক দিয়েই শুরু হয়। সেই সে আদিমানবসম্বন্ধই আজ যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। আর তাতেই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে তাবৎ মানব-অস্তিত্ব। কেবলি স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের বাঁচা, আরও আরও ভোগে-লোভে মরিয়া হওয়া আজকের এই বাজার-প্রজন্ম উৎসাদন করে ছাড়ছে এতকালের যত যা কিছু মানবসভ্যতা-সংস্কৃতি-সমাজ। আমাদের বেলা তা যে আরও অমানুষিক! কোনো সম্পর্কের সম্বোধন বিনা আমরা যে চেনা-অচেনা কারও সঙ্গেই কথা বলতেও পারতাম না একদিন। আর আজ? ক্রেতা-বিক্রেতার বাজারি সম্বোধনে আমরা কেউ কারও কিছু ঠিক নই—পরস্পরকে ‘স্যার’ বলেই যে যতটা পারি ধান্দা হাসিল করতে হয়। এহেন অমানব বিশ্বে রূপকথা হয়ে গেছে আমাদের পিতা, পিতামহ—পূর্বপুরুষেরা।
তাই পিতৃস্মরণ আজ যেন আপন অস্তিত্বেরই স্মারক—সত্তার পিতৃমাতৃ দায়।যদিও জানি, বাবাকে নিয়ে কিছু কথা বলা যায় সত্যিই। অন্যকে বলার মতোও সেসব। আমরা তো আজ অদ্ভুত এক সময়ে বাস করছি, যেখানে কেউ কারও ঠিক নই আর। কোনো কিছুর সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক নেই কারও। কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না কারও তাই। তাই কি বলে যাওয়া চাই না যত যা কিছু স্মৃতি আছে—সম্পর্কের, ভালোবাসার? একদিন মানুষ সত্যই যে কেবল নিজের কথাই ভাবত না। নিজের পরিবার নিয়েই তার জীবন ছিল না একদিন। বংশের, সমাজের আর দশজনের ভালো-মন্দের কথাও ভাবত সে। গরিব ঘরের সন্তান লেখাপড়া শিখে গ্রামের আর পাঁচজনও যাতে তা পারে, তার জন্য ভাবত, করত। অনেক পাস করে গ্রামে ফিরলে সবাই তাকে মাথায় তুলে নাচত। সেও বড়দের পায়ের ধুলা নিয়ে ধন্য হতো। গ্রামের কোনো আসরে ঢুকত সবাইকে প্রণাম করে, বিনয়ে মাথা নোয়ায়ে। রাজনীতি সেদিনও ক্ষমতারই বিষয় ছিল, তবু সমাজের দশজনের ভালোর কথাটাও ছিল তাতে। ভোটে জিতলে তাদের সেবা করার কথাটা আজকের মতো এমন মিথ্যা ছিল না।
জীবিকা বা চাকরির জন্য শহরে থাকলেও গ্রামের মানুষজন, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সত্যিই এক ধরনের সম্পর্ক ছিল সবার। আসা-যাওয়া ছিল। গ্রামের কেউ যেকোনো প্রয়োজনে শহরে এলে নির্দ্বিধায় উঠত আত্মীয়বাড়িতে। তাদের জন্য সাধ্যমতো করা হতো, যদিও তা নিয়ে অভিযোগের কমতিও থাকত না। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বা দূরসম্পর্কের কুটুমবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আজ যে কতই বিস্মৃতকালের রূপকথা! আমার বাবা জীবিকা আর রাজনীতি নিয়ে বড়ই ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তাঁর মন তবু পড়ে থাকত গ্রামেই। সেই যেন তাঁর নিজের বাড়ি ছিল চিরকাল। সেই বাড়ির কেউ এলে তাঁর মনে কী যে আনন্দের বান ডাকত! আমরাও তা দেখে ভালো লাগায় বিভোর হতাম। গরিব-দুঃখী আত্মীয়কে নিয়েও সংকোচ করতে দেখিনি কোনো দিন তাঁকে। গ্রামদেশের সবাই তাঁকে ‘বাবু’ বলত—প্রথম শিক্ষিত, শহুরে মানীজন বলে। সেটা কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব তৈরি করত না। মানুষের সঙ্গে মানুষের কত রকম সম্পর্কই যে ছিল সেদিন, ভাবলে কেমন লাগে! লাগে কি আজও সবার? জীবতকালে কতই তবু ভুল বুঝেছি, সমালোচনা করেছি—শহরে বেমানান এই গ্রামের মানুষটির। মন্ত্রী-মিনিস্টার-নেতা-এমপি হয়ে কতক নিশ্চয় অন্য রকম হয়েছিলেন—ক্ষমতার অনিবার্য গতিকে। তবু ভেতরে ভেতরে ছিলেন যে গরিব চাষারই এক শিক্ষিত পুত। তাই নিয়েই ছিল তাঁর চিরকালের গৌরব-গর্ব। আধুনিক, প্রগতিশীল, যুক্তিবিজ্ঞানের হঠাৎ শিং গজানো বাছুর সেজে কতভাবেই না নাজেহাল করেছি তবু এই মাটির সরল-সিদা মানুষটিকেই। অস্থির অসহায়ের মতো ছটফট করেছেন আমাদের দায়িত্বহীন আচরণে। তাঁর সেই মর্মন্তুদ কষ্টটা একটু লাঘব করার জন্য দুটো কথাও বলিনি, সে ভাষাও শিখিনি যে এমনই ঘোর বুঝমান ছিলাম। আমাদের যত জ্ঞানগরিমা তো মানুষের ভেতরের মানুষটাকে নাস্তানাবুদ করার দুর্মর অহংবিকারে! কারোরই নিস্তার নেই তার হাত থেকে—‘কেবলি অপরের মুখ ম্লান করা ছাড়া/ সুখ নাই’ যে। তারই প্রথম শিকার বুঝি জনক-জননী আমাদের। জানি না, সব তার একদিন শোধ করে দিতে হবে। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে যত যা কিছু ঋণ আছে। পিতাই তো বয়ে চলেছেন এক পুত্রজন্ম নিয়ে এই আমারি মাঝারে। এই তো মানবের চিরসম্পর্কের অচ্ছেদ্য নাড়ির বন্ধন, ধারাবাহিকতা— একেই বলে বুঝি জন্ম-জন্মান্তর।
‘আমরা যে কেউ একা বাঁচি না’—রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে বলেছিল সুরঙ্গমা। এটা কি রাবীন্দ্রিক ভাবেরই কথা কেবল? সত্যই কি সম্পর্ক-বন্ধনেই কেবল আমরা খুঁজে পাই না নিজেকেই? আর তার ভিত্তিটা তো বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচির সঙ্গে সম্পর্ক দিয়েই শুরু হয়। সেই সে আদিমানবসম্বন্ধই আজ যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। আর তাতেই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে তাবৎ মানব-অস্তিত্ব। কেবলি স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের বাঁচা, আরও আরও ভোগে-লোভে মরিয়া হওয়া আজকের এই বাজার-প্রজন্ম উৎসাদন করে ছাড়ছে এতকালের যত যা কিছু মানবসভ্যতা-সংস্কৃতি-সমাজ। আমাদের বেলা তা যে আরও অমানুষিক! কোনো সম্পর্কের সম্বোধন বিনা আমরা যে চেনা-অচেনা কারও সঙ্গেই কথা বলতেও পারতাম না একদিন। আর আজ? ক্রেতা-বিক্রেতার বাজারি সম্বোধনে আমরা কেউ কারও কিছু ঠিক নই—পরস্পরকে ‘স্যার’ বলেই যে যতটা পারি ধান্দা হাসিল করতে হয়। এহেন অমানব বিশ্বে রূপকথা হয়ে গেছে আমাদের পিতা, পিতামহ—পূর্বপুরুষেরা।
বিপ্লব বালা
No comments