দেশের শাড়ি
সুন্দর নকশা, আরাম, ঐতিহ্যকে ধারণ—সবই পাওয়া যায় দেশি শাড়িতে। তাই তো দেশি শাড়ির চাহিদা দিনে দিনে বেড়েছেই। ঢাকাই জামদানি, টাঙ্গাইল শাড়ি, রাজশাহীর সিল্ক, মণিপুরি তাঁতের শাড়ি আর পাবনা-সিরাজগঞ্জের গামছা শাড়ি—সবই তো পছন্দের, অহংকারের।
দেশি শাড়িগুলো কেন পছন্দের তালিকায় থাকছে সব সময়, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করে জানান ডিজাইনার ও গবেষক চন্দ্রশেখর সাহা। ‘প্রতি এলাকা একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে শাড়িগুলোতে। একেকটি এলাকার ব্র্যান্ডিং হচ্ছে। শুধু মণিপুরি শাড়ির ক্ষেত্রে ঘটছে ব্যতিক্রম। এখানে একটা জাতি বা সম্প্রদায়কে তুলে ধরা হচ্ছে।
জামদানির ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক পটভূমি কাজ করেছে’, বলেন চন্দ্রশেখর সাহা। তিনি জানান, অনেক আগে বেনারসি শাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জামদানির শুরু। সেই সময় বিয়েতে বেনারসি থাকলে জামদানিও থাকত। ঢাকার আশপাশের এলাকায় তাঁতশিল্পীদের বোনা জামদানি যেন হয়ে উঠেছে আভিজাত্য ও অহংকারের প্রতীক। এর মোটিফ, জমিন—সবকিছুতেই জামদানির নিজস্বতা আছে।
টাঙ্গাইলের শাড়ি গরমে পরার জন্য বিশেষ উপযোগী হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় বলে মনে করেন চন্দ্রশেখর সাহা। সুতি, আরামদায়ক—এ কারণেই খ্যাতি টাঙ্গাইল শাড়ির। পরে অবশ্য এর ধারায় পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে জ্যকার্ড পাড় আর বুটি থেকে সরে আসেন তাঁতিরা। টাঙ্গাইল শাড়ির যে কোমলতা ছিল, এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখন নানা ধারার কারণে কোমলতা কিছুটা কমে গেছে। সিল্ক ঢুকে গেছে টাঙ্গাইলে। যেটা দিয়ে হচ্ছে হাফসিল্ক শাড়ি। এ হাফসিল্ককে মসলিনের আরেক সংস্করণ বলা যায়।
আগে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি শুধু এক ধারায় তৈরি হতো। বলেন চন্দ্রশেখর সাহা। জানান, সেই ধারা হচ্ছে গরদ—লাল পাড় কোড়া জমিন। রাজশাহী সিল্ক দামি শাড়ি হিসেবে জনপ্রিয়। এর সঙ্গে নানা কিছু যোগ করে দামি শাড়িগুলো তৈরি করে বুটিক হাউসগুলো। সিল্কে আরামের চেয়ে আভিজাত্যই বেশি ফুটে ওঠে। সিল্কের চাহিদা মূল উপকরণ হিসেবে এখনো বেশি।
মণিপুরি শাড়ির বুনন একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে। এ শাড়ির নকশাকার বা তাঁতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যময় নকশার সুতি শাড়ি হিসেবে এর কদর এখনো আছে।
রাজশাহীর সিল্ক
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
গুটিপোকা থেকে উৎপন্ন রেশম সুতা থেকে আগে সিল্ক কাপড় তৈরি করা হতো। সরকারের সেরি কালচার বিভাগও এ বিষয়ে কাজ করত। এখন এভাবে সিল্ক তৈরি কমে গেছে। এ সময়ে সাধারণত তাঁত ও মেশিনে—দুভাবেই সিল্ক বোনা হয়। তাঁতে বুনন একটু সময়সাপেক্ষ। ফলে যান্ত্রিক তাঁতে বুননের চাহিদা বেশি বাজারে। থান কাপড় কিনে এখন নানা নকশা করে বাজারে আনা হচ্ছে। অনেকে আবার ‘র সিল্ক’ কিনতে আগ্রহী।
আগে মূলত সিল্ক দিয়ে তৈরি গরদ শাড়ির প্রচলন বেশি ছিল। লাল পাড় কোড়া জমিন—এই হলো গরদ। এ ধরনের শাড়ি এখনো আছে, তবে সিল্ক থান প্রিন্ট করে তৈরি শাড়ির প্রচলন এখন বেশি। একটু দামি শাড়ি হিসেবেই সিল্কের কদর।
ঐতিহ্যবাহী এ সিল্ক ছাড়াও হালকা একধরনের সিল্ক এখন হচ্ছে, তা মসলিনের মতোই। রাজশাহীর কারিগরেরা সিল্কের থান এবং শাড়িকে ওজন ও মানের দিক দিয়ে মসলিনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। রাজশাহীর সপুরা সিল্ক মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সদর আলী বলেন, বছর দুয়েক আগে তাঁরা মসলিন সিল্কের আদলে সিল্কের থান ও শাড়ি তৈরি শুরু করেন। এ থান কাপড়ের ওপরে স্থানীয় বুটিক হাউসগুলো কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেয়। আস্তে আস্তে ঢাকার অনেক বুটিক হাউসও এ ধরনের কাজ শুরু করে।
রাজশাহীর ব্যবসায়ী শেখ আলী ফয়সাল হালকা সিল্কের থানে হাতের কাজ করেন। তিনি বলেন, ঢাকার বুটিক হাউসের ৪০ জন কারিগরকে রাজশাহীতে এনে কাজ করানো হচ্ছে। তাঁরা শাড়িতে কাজ করে আবার সপুরা সিল্ক মিলসে জমা দেন। সম্প্রতি রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরে সপুরা সিল্ক মিলসে গিয়ে দেখা যায়, উপহারের জন্য এ মসলিন সিল্কের চাহিদাও অনেক।
জনপ্রিয়তায় এ হালকা সিল্কের পরই আছে অ্যান্ডি সিল্ক। সিল্ক সুতার বর্জ্য (ওয়েস্টেজ) থেকে তৈরি হয় এ অ্যান্ডি সিল্ক। এ সিল্কের শাড়ি এখনো হাতের তাঁতে তৈরি হচ্ছে।
শাড়ি: সপুরা সিল্ক
টাঙ্গাইলের শাড়ি
পল্লব মোহাইমেন
টাঙ্গাইলের শাড়িতে যত বৈচিত্র্য ততটা আর কোথাও পাবেন না। বললেন যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক। আর তাই টাঙ্গাইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল সারা বছরই জমজমাট। সুতি তো বটেই, সিল্ক, হাফসিল্ক নানা কিছু নিয়ে শাড়ির নকশা করছেন তাঁতশিল্পীরা। ডিজাইনে নতুনত্ব আনা, ক্রেতার পছন্দ বোঝা—মূলত এসব কারণেই টাঙ্গাইল শাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। জানান রঘুনাথ বসাক।
নতুন প্রজন্মের তাঁতশিল্পী সুবীর বসাক সীতানাথ রণজিৎ বসাকের ব্যবসা দেখছেন। তিনি বলেন, ‘মৌসুম আর উৎসবভিত্তিক শাড়ি আমরা এখন তৈরি করি। এখন যেমন চলছে পয়লা বৈশাখের শাড়ি তৈরি। কয় দিন আগেই ২৬ মার্চ ধরে শাড়ি তৈরি হলো। বৈশাখের পর শুরু হয়ে যাবে ঈদের কাজ। ফলে সারা বছরই টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির অবস্থা জমজমাট।’
তাঁতিরা জানান, সুতির মধ্যে এখন বালুচরি, বুটি জামদানি, কাটা জামদানি ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে। সিল্কের মধ্যে আছে হাফসিল্ক, জুট সিল্ক, পিওর সিল্ক, র সিল্ক, সফট সিল্ক, হার্ড সিল্ক, নেট, সুপারনেট, কাতান ইত্যাদি। রঘুনাথ বসাকের মতো নারীদের মন জয় করার জন্য যা যা লাগে টাঙ্গাইলের শাড়িতে সব সময়ই তা থাকে।
মণিপুরি শাড়ি
উজ্জ্বল মেহেদী
‘বেড়াতে গিয়েছিলেন? কোথায়?’ এমন প্রশ্নে কোনো কথা না বলেই কিন্তু জবাব দেওয়া হয়ে যায়। কীভাবে? তা-ই বলছিলেন সিলেটের হরেন্দ্র সিংহ। ‘যদি হাতে থাকে মণিপুরি শাড়ি অথবা এক প্যাকেট খোলা চা-পাতা, তাহলে আর বলতেই হয় না—সিলেট!’
চা, সাতকরা তো আছেই। সিলেট জেলার সঙ্গে জুড়ে আছে আরও একটি শব্দ—মণিপুরি শাড়ি। সিলেট নগরের লামাবাজার ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্রগুলোর পোশাকের দোকানগুলোতে মেলে মণিপুরি শাড়িসহ মৌসুমভিত্তিক নানা রকম পোশাক।
সিলেট শহরের ভিআইপি সড়কের লামাবাজার মোড়ে শতাধিক কাপড়ের দোকান। সবগুলোই মণিপুরি শাড়িসহ পোশাকসামগ্রীর। সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহনকারী নানা নামের দোকানগুলো পরিচালনায় রয়েছেন মণিপুরিরা।
লামাবাজারের পুরোনো দোকানের মালিক হরেন্দ্র সিংহ জানান, ফ্যাশনের সঙ্গে দেশি ঐতিহ্য—মানুষের এমন চাহিদায় কদর বাড়ছে মণিপুরি পোশাকের। অন্য বিক্রেতারা জানান, মণিপুরি সব পোশাকসামগ্রী তাঁতের তৈরি। শাড়ি ছাড়াও বিছানার চাদর, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, গামছা বছরজুড়ে বিক্রি হয়। চাদর বিক্রি হয় কেবল শীতকালেই। সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় মেলে শাড়ি। আরও পছন্দের প্রায় সব রংই পাবেন। হয়তো একজনের কালো শাড়িতে লাল পাড় পছন্দ, আবার আরেক জনের কালো শাড়িতে হলুদ পাড়। দুই রকমই দেখিয়ে দিতে পারবেন দোকানিরা।
নিজস্ব নকশায় মণিপুরি পোশাক পেতে সরাসরি মণিপুরি পল্লিতেও যোগাযোগ করা যায়। সিলেট নগরে সুরমা নদীর তীরের মাছিমপুর ও কুশিঘাটের একাংশ ছাড়াও মণিপুরিদের বসতি শিবগঞ্জ, আম্বরখানার বড়বাজার, সাগরদীঘির পাড় ও খাদিম ইউনিয়নের দক্ষিণগাঁওয়ে ১২টি মণিপুরি পল্লি রয়েছে। এসব পল্লিতে চলে তাঁত বুননের কর্মযজ্ঞ। কুশিঘাটের বাসিন্দা পূর্ণিমা দেবী জানান, সংসারের কাজের অবসরে বুননের কাজ চলে। একটি চাদর বুনতে চার দিন লাগে। পূর্ণিমা দেবীর ঘরে এভাবে জোগান দিতে আসা শান্তনা দেবী বলেন, ‘রোজগারের জন্য নয়, ঐতিহ্যের খাতিরে মণিপুরি পীতে এ কাজ করি।’ বাবলা দেবী বলেন, ‘আগে মণিপুরি পল্লিতে কনে দেখার সময় বলা হতো—কনে বুনন কাজ জানে কি? না জানলে বিয়েও হতো না।’
ঢাকাই জামদানি
ফারহানা আলম
জামদানি একান্তই ঢাকার নিজস্ব কাঁচামালের তৈরি এবং ঢাকার তাঁতশিল্পীদের মৌলিক শিল্পবোধ ও ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি। পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতিদের পক্ষে এ শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। আদিকাল থেকেই এ গুণী তাঁতিদের ঢাকার কাছে ডেমরা ও রূপগঞ্জ উপজেলার কিছু অঞ্চলে বংশানুক্রমে বসবাস। জামদানি তাঁতিদের অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে শাড়ি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কারণ, এ শাড়ি কেবল একজন তাঁতি বুনে যাবেন, তা নয়। বরং শাড়ি প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে চাই পারিবারিক সহযোগিতা। হাতে সুতা কাটা, সেই সুতায় রং দেওয়া, নাটাইয়ে সুতা পেঁচানো, তারপর সেটা মাকু করা। এ ধাপগুলো তো বাড়ির বউঝিয়েরাই করে থাকে। এরপর মাটির গর্তে যে খটাখট তাঁত চালানো চলত, তাতে ওস্তাদের পাশে যে শাগরেদ বসে থাকত, সে তো নিজের পরিবার কিংবা জ্ঞাতি থেকেই আসত। তাই সানার টানে মাকু চালিয়ে যখন জামদানি শাড়ির নকশা ফুটতে শুরু করে, তা শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর শাড়ি থাকে না। বরং হয়ে ওঠে তাঁতশিল্পের শিল্পিত ক্যানভাস। শাড়ি শেষ হলে মাড় দিতেও চাই পারিবারিক সহযোগিতা। তা ছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উঠে আসা বাষ্প সুতার প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার জন্য খুব জরুরি।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর নকশা বা মোটিফে। এ নকশা সাধারণত কাগজে এঁকে নেওয়া হয় না। জামদানির শিল্পীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো সুতায় শাড়ির বুননে বুননে। তাঁরা এমনি পারদর্শী যে মন থেকে ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকেন। পাড়ের নকশায় বহুল ব্যবহূত হচ্ছে করলা পাড়। এ ছাড়া আছে ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুলতা, গোলাপচর, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠপাড়, আঙুরলতা ইত্যাদি। শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, তেছরী, কলার ফানা, আদার ফানা, সাগুদানা, মালা ইত্যাদি নকশা বোনা হয়। এ নকশা তোলার পদ্ধতিও বেশ মজার। শিল্পীদের মুখস্থ কিছু বুলি রয়েছে। এসব বুলি ওস্তাদ শাগরেদকে বলতে থাকেন আর শাগরেদ তা থেকেই বুঝতে পারেন যে ওস্তাদ কোন নকশা তুলতে যাচ্ছেন। এ ধরনের একটি বুলি হলো: হইরে বাড়ে/গ্যাডে বাড়ে/গ্যাডের খেও বাঁধে গ্যাডে/গ্যাডের খেও বাঁধে প্যাচে/প্যাডে বাড়ে...পুরো জমিনে নকশা করা একটি শাড়ি তৈরি করতে ন্যূনতম সময় লাগে দুই মাস। জামদানি শাড়ির দাম নির্ভর করে শাড়ির গাঁথুনি এবং সুতার কাউন্টের ওপর। যত বেশি কাউন্টের সুতা, শাড়ির দামও তত বেশি। সেই সঙ্গে নকশা তোলার সুতার কাউন্ট ও হতে হবে কম এবং নকশাও হতে হবে ছোট ছোট।
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার শীতলক্ষ্যার পাড়ে ভোর রাত থেকে জামদানির যে হাট বসে, তা যেন দেখার মতো। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, আসমানি কোন রং নেই সে হাটে!
গামছার শাড়ি
পুরো শাড়িই মস্ত একটা গামছা। এমন শাড়ি দেড়-দুই দশক আলোচনায় আসে, ফ্যাশনেও দেখা যায় ভালোভাবে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে পয়লা বৈশাখের উৎসবে গামছার শাড়ি চোখে পড়ত। এখনো উৎসবে চোখে পড়ে গামছার শাড়ি। পাবনা-সিরাজগঞ্জের তাঁতিদের হাতেই তৈরি হতো এ শাড়ি। ডিজাইনার বিবি রাসেলের কল্যাণে বিদেশেও গেছে গামছার শাড়ি ও অন্য পোশাক। আড়ং, প্রবর্তনাও গামছার শাড়ি বা গামছা দিয়ে অনুষঙ্গ তৈরি করেছে। আজিজ মার্কেটের যে টি-শার্টের জোয়ার, সেখানেও গামছার ব্যবহার দেখা গেছে।
এখন গামছা দিয়ে শাড়ি তৈরিই হয় কম। সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলের বেলকুচি এবং এনায়েতপুরে গামছার শাড়ি নিয়ে কিছু কিছু কাজ এখনো করা হয় বলে জানা যায়। উৎপাদন কম হওয়ার কারণে ফ্যাশন-বাজারে এর উপস্থিতি কম। তার পরও নগরে বাঙালির উৎসবগুলোতে গামছার শাড়ি অনেকেই পরেন।
জামদানির ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক পটভূমি কাজ করেছে’, বলেন চন্দ্রশেখর সাহা। তিনি জানান, অনেক আগে বেনারসি শাড়ির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জামদানির শুরু। সেই সময় বিয়েতে বেনারসি থাকলে জামদানিও থাকত। ঢাকার আশপাশের এলাকায় তাঁতশিল্পীদের বোনা জামদানি যেন হয়ে উঠেছে আভিজাত্য ও অহংকারের প্রতীক। এর মোটিফ, জমিন—সবকিছুতেই জামদানির নিজস্বতা আছে।
টাঙ্গাইলের শাড়ি গরমে পরার জন্য বিশেষ উপযোগী হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় বলে মনে করেন চন্দ্রশেখর সাহা। সুতি, আরামদায়ক—এ কারণেই খ্যাতি টাঙ্গাইল শাড়ির। পরে অবশ্য এর ধারায় পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে জ্যকার্ড পাড় আর বুটি থেকে সরে আসেন তাঁতিরা। টাঙ্গাইল শাড়ির যে কোমলতা ছিল, এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখন নানা ধারার কারণে কোমলতা কিছুটা কমে গেছে। সিল্ক ঢুকে গেছে টাঙ্গাইলে। যেটা দিয়ে হচ্ছে হাফসিল্ক শাড়ি। এ হাফসিল্ককে মসলিনের আরেক সংস্করণ বলা যায়।
আগে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি শুধু এক ধারায় তৈরি হতো। বলেন চন্দ্রশেখর সাহা। জানান, সেই ধারা হচ্ছে গরদ—লাল পাড় কোড়া জমিন। রাজশাহী সিল্ক দামি শাড়ি হিসেবে জনপ্রিয়। এর সঙ্গে নানা কিছু যোগ করে দামি শাড়িগুলো তৈরি করে বুটিক হাউসগুলো। সিল্কে আরামের চেয়ে আভিজাত্যই বেশি ফুটে ওঠে। সিল্কের চাহিদা মূল উপকরণ হিসেবে এখনো বেশি।
মণিপুরি শাড়ির বুনন একটা বিশেষ সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে। এ শাড়ির নকশাকার বা তাঁতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৈচিত্র্যময় নকশার সুতি শাড়ি হিসেবে এর কদর এখনো আছে।
রাজশাহীর সিল্ক
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
গুটিপোকা থেকে উৎপন্ন রেশম সুতা থেকে আগে সিল্ক কাপড় তৈরি করা হতো। সরকারের সেরি কালচার বিভাগও এ বিষয়ে কাজ করত। এখন এভাবে সিল্ক তৈরি কমে গেছে। এ সময়ে সাধারণত তাঁত ও মেশিনে—দুভাবেই সিল্ক বোনা হয়। তাঁতে বুনন একটু সময়সাপেক্ষ। ফলে যান্ত্রিক তাঁতে বুননের চাহিদা বেশি বাজারে। থান কাপড় কিনে এখন নানা নকশা করে বাজারে আনা হচ্ছে। অনেকে আবার ‘র সিল্ক’ কিনতে আগ্রহী।
আগে মূলত সিল্ক দিয়ে তৈরি গরদ শাড়ির প্রচলন বেশি ছিল। লাল পাড় কোড়া জমিন—এই হলো গরদ। এ ধরনের শাড়ি এখনো আছে, তবে সিল্ক থান প্রিন্ট করে তৈরি শাড়ির প্রচলন এখন বেশি। একটু দামি শাড়ি হিসেবেই সিল্কের কদর।
ঐতিহ্যবাহী এ সিল্ক ছাড়াও হালকা একধরনের সিল্ক এখন হচ্ছে, তা মসলিনের মতোই। রাজশাহীর কারিগরেরা সিল্কের থান এবং শাড়িকে ওজন ও মানের দিক দিয়ে মসলিনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। রাজশাহীর সপুরা সিল্ক মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সদর আলী বলেন, বছর দুয়েক আগে তাঁরা মসলিন সিল্কের আদলে সিল্কের থান ও শাড়ি তৈরি শুরু করেন। এ থান কাপড়ের ওপরে স্থানীয় বুটিক হাউসগুলো কাজ করার জন্য প্রস্তাব দেয়। আস্তে আস্তে ঢাকার অনেক বুটিক হাউসও এ ধরনের কাজ শুরু করে।
রাজশাহীর ব্যবসায়ী শেখ আলী ফয়সাল হালকা সিল্কের থানে হাতের কাজ করেন। তিনি বলেন, ঢাকার বুটিক হাউসের ৪০ জন কারিগরকে রাজশাহীতে এনে কাজ করানো হচ্ছে। তাঁরা শাড়িতে কাজ করে আবার সপুরা সিল্ক মিলসে জমা দেন। সম্প্রতি রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরে সপুরা সিল্ক মিলসে গিয়ে দেখা যায়, উপহারের জন্য এ মসলিন সিল্কের চাহিদাও অনেক।
জনপ্রিয়তায় এ হালকা সিল্কের পরই আছে অ্যান্ডি সিল্ক। সিল্ক সুতার বর্জ্য (ওয়েস্টেজ) থেকে তৈরি হয় এ অ্যান্ডি সিল্ক। এ সিল্কের শাড়ি এখনো হাতের তাঁতে তৈরি হচ্ছে।
শাড়ি: সপুরা সিল্ক
টাঙ্গাইলের শাড়ি
পল্লব মোহাইমেন
টাঙ্গাইলের শাড়িতে যত বৈচিত্র্য ততটা আর কোথাও পাবেন না। বললেন যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক। আর তাই টাঙ্গাইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল সারা বছরই জমজমাট। সুতি তো বটেই, সিল্ক, হাফসিল্ক নানা কিছু নিয়ে শাড়ির নকশা করছেন তাঁতশিল্পীরা। ডিজাইনে নতুনত্ব আনা, ক্রেতার পছন্দ বোঝা—মূলত এসব কারণেই টাঙ্গাইল শাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। জানান রঘুনাথ বসাক।
নতুন প্রজন্মের তাঁতশিল্পী সুবীর বসাক সীতানাথ রণজিৎ বসাকের ব্যবসা দেখছেন। তিনি বলেন, ‘মৌসুম আর উৎসবভিত্তিক শাড়ি আমরা এখন তৈরি করি। এখন যেমন চলছে পয়লা বৈশাখের শাড়ি তৈরি। কয় দিন আগেই ২৬ মার্চ ধরে শাড়ি তৈরি হলো। বৈশাখের পর শুরু হয়ে যাবে ঈদের কাজ। ফলে সারা বছরই টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির অবস্থা জমজমাট।’
তাঁতিরা জানান, সুতির মধ্যে এখন বালুচরি, বুটি জামদানি, কাটা জামদানি ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলে। সিল্কের মধ্যে আছে হাফসিল্ক, জুট সিল্ক, পিওর সিল্ক, র সিল্ক, সফট সিল্ক, হার্ড সিল্ক, নেট, সুপারনেট, কাতান ইত্যাদি। রঘুনাথ বসাকের মতো নারীদের মন জয় করার জন্য যা যা লাগে টাঙ্গাইলের শাড়িতে সব সময়ই তা থাকে।
মণিপুরি শাড়ি
উজ্জ্বল মেহেদী
‘বেড়াতে গিয়েছিলেন? কোথায়?’ এমন প্রশ্নে কোনো কথা না বলেই কিন্তু জবাব দেওয়া হয়ে যায়। কীভাবে? তা-ই বলছিলেন সিলেটের হরেন্দ্র সিংহ। ‘যদি হাতে থাকে মণিপুরি শাড়ি অথবা এক প্যাকেট খোলা চা-পাতা, তাহলে আর বলতেই হয় না—সিলেট!’
চা, সাতকরা তো আছেই। সিলেট জেলার সঙ্গে জুড়ে আছে আরও একটি শব্দ—মণিপুরি শাড়ি। সিলেট নগরের লামাবাজার ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্রগুলোর পোশাকের দোকানগুলোতে মেলে মণিপুরি শাড়িসহ মৌসুমভিত্তিক নানা রকম পোশাক।
সিলেট শহরের ভিআইপি সড়কের লামাবাজার মোড়ে শতাধিক কাপড়ের দোকান। সবগুলোই মণিপুরি শাড়িসহ পোশাকসামগ্রীর। সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহনকারী নানা নামের দোকানগুলো পরিচালনায় রয়েছেন মণিপুরিরা।
লামাবাজারের পুরোনো দোকানের মালিক হরেন্দ্র সিংহ জানান, ফ্যাশনের সঙ্গে দেশি ঐতিহ্য—মানুষের এমন চাহিদায় কদর বাড়ছে মণিপুরি পোশাকের। অন্য বিক্রেতারা জানান, মণিপুরি সব পোশাকসামগ্রী তাঁতের তৈরি। শাড়ি ছাড়াও বিছানার চাদর, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, গামছা বছরজুড়ে বিক্রি হয়। চাদর বিক্রি হয় কেবল শীতকালেই। সর্বোচ্চ দুই হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় মেলে শাড়ি। আরও পছন্দের প্রায় সব রংই পাবেন। হয়তো একজনের কালো শাড়িতে লাল পাড় পছন্দ, আবার আরেক জনের কালো শাড়িতে হলুদ পাড়। দুই রকমই দেখিয়ে দিতে পারবেন দোকানিরা।
নিজস্ব নকশায় মণিপুরি পোশাক পেতে সরাসরি মণিপুরি পল্লিতেও যোগাযোগ করা যায়। সিলেট নগরে সুরমা নদীর তীরের মাছিমপুর ও কুশিঘাটের একাংশ ছাড়াও মণিপুরিদের বসতি শিবগঞ্জ, আম্বরখানার বড়বাজার, সাগরদীঘির পাড় ও খাদিম ইউনিয়নের দক্ষিণগাঁওয়ে ১২টি মণিপুরি পল্লি রয়েছে। এসব পল্লিতে চলে তাঁত বুননের কর্মযজ্ঞ। কুশিঘাটের বাসিন্দা পূর্ণিমা দেবী জানান, সংসারের কাজের অবসরে বুননের কাজ চলে। একটি চাদর বুনতে চার দিন লাগে। পূর্ণিমা দেবীর ঘরে এভাবে জোগান দিতে আসা শান্তনা দেবী বলেন, ‘রোজগারের জন্য নয়, ঐতিহ্যের খাতিরে মণিপুরি পীতে এ কাজ করি।’ বাবলা দেবী বলেন, ‘আগে মণিপুরি পল্লিতে কনে দেখার সময় বলা হতো—কনে বুনন কাজ জানে কি? না জানলে বিয়েও হতো না।’
ঢাকাই জামদানি
ফারহানা আলম
জামদানি একান্তই ঢাকার নিজস্ব কাঁচামালের তৈরি এবং ঢাকার তাঁতশিল্পীদের মৌলিক শিল্পবোধ ও ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি। পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতিদের পক্ষে এ শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়নি। আদিকাল থেকেই এ গুণী তাঁতিদের ঢাকার কাছে ডেমরা ও রূপগঞ্জ উপজেলার কিছু অঞ্চলে বংশানুক্রমে বসবাস। জামদানি তাঁতিদের অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে শাড়ি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে অসংখ্যবার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। কারণ, এ শাড়ি কেবল একজন তাঁতি বুনে যাবেন, তা নয়। বরং শাড়ি প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে চাই পারিবারিক সহযোগিতা। হাতে সুতা কাটা, সেই সুতায় রং দেওয়া, নাটাইয়ে সুতা পেঁচানো, তারপর সেটা মাকু করা। এ ধাপগুলো তো বাড়ির বউঝিয়েরাই করে থাকে। এরপর মাটির গর্তে যে খটাখট তাঁত চালানো চলত, তাতে ওস্তাদের পাশে যে শাগরেদ বসে থাকত, সে তো নিজের পরিবার কিংবা জ্ঞাতি থেকেই আসত। তাই সানার টানে মাকু চালিয়ে যখন জামদানি শাড়ির নকশা ফুটতে শুরু করে, তা শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর শাড়ি থাকে না। বরং হয়ে ওঠে তাঁতশিল্পের শিল্পিত ক্যানভাস। শাড়ি শেষ হলে মাড় দিতেও চাই পারিবারিক সহযোগিতা। তা ছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উঠে আসা বাষ্প সুতার প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার জন্য খুব জরুরি।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর নকশা বা মোটিফে। এ নকশা সাধারণত কাগজে এঁকে নেওয়া হয় না। জামদানির শিল্পীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো সুতায় শাড়ির বুননে বুননে। তাঁরা এমনি পারদর্শী যে মন থেকে ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকেন। পাড়ের নকশায় বহুল ব্যবহূত হচ্ছে করলা পাড়। এ ছাড়া আছে ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুলতা, গোলাপচর, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠপাড়, আঙুরলতা ইত্যাদি। শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, তেছরী, কলার ফানা, আদার ফানা, সাগুদানা, মালা ইত্যাদি নকশা বোনা হয়। এ নকশা তোলার পদ্ধতিও বেশ মজার। শিল্পীদের মুখস্থ কিছু বুলি রয়েছে। এসব বুলি ওস্তাদ শাগরেদকে বলতে থাকেন আর শাগরেদ তা থেকেই বুঝতে পারেন যে ওস্তাদ কোন নকশা তুলতে যাচ্ছেন। এ ধরনের একটি বুলি হলো: হইরে বাড়ে/গ্যাডে বাড়ে/গ্যাডের খেও বাঁধে গ্যাডে/গ্যাডের খেও বাঁধে প্যাচে/প্যাডে বাড়ে...পুরো জমিনে নকশা করা একটি শাড়ি তৈরি করতে ন্যূনতম সময় লাগে দুই মাস। জামদানি শাড়ির দাম নির্ভর করে শাড়ির গাঁথুনি এবং সুতার কাউন্টের ওপর। যত বেশি কাউন্টের সুতা, শাড়ির দামও তত বেশি। সেই সঙ্গে নকশা তোলার সুতার কাউন্ট ও হতে হবে কম এবং নকশাও হতে হবে ছোট ছোট।
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার শীতলক্ষ্যার পাড়ে ভোর রাত থেকে জামদানির যে হাট বসে, তা যেন দেখার মতো। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, আসমানি কোন রং নেই সে হাটে!
গামছার শাড়ি
পুরো শাড়িই মস্ত একটা গামছা। এমন শাড়ি দেড়-দুই দশক আলোচনায় আসে, ফ্যাশনেও দেখা যায় ভালোভাবে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে পয়লা বৈশাখের উৎসবে গামছার শাড়ি চোখে পড়ত। এখনো উৎসবে চোখে পড়ে গামছার শাড়ি। পাবনা-সিরাজগঞ্জের তাঁতিদের হাতেই তৈরি হতো এ শাড়ি। ডিজাইনার বিবি রাসেলের কল্যাণে বিদেশেও গেছে গামছার শাড়ি ও অন্য পোশাক। আড়ং, প্রবর্তনাও গামছার শাড়ি বা গামছা দিয়ে অনুষঙ্গ তৈরি করেছে। আজিজ মার্কেটের যে টি-শার্টের জোয়ার, সেখানেও গামছার ব্যবহার দেখা গেছে।
এখন গামছা দিয়ে শাড়ি তৈরিই হয় কম। সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলের বেলকুচি এবং এনায়েতপুরে গামছার শাড়ি নিয়ে কিছু কিছু কাজ এখনো করা হয় বলে জানা যায়। উৎপাদন কম হওয়ার কারণে ফ্যাশন-বাজারে এর উপস্থিতি কম। তার পরও নগরে বাঙালির উৎসবগুলোতে গামছার শাড়ি অনেকেই পরেন।
No comments