কূটনীতিক হত্যা-ডালপালা মেলার আগেই সুরাহা হোক by শেখ আবদুস সালাম

দেশে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সুনির্দিষ্টভাবে উদ্ঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা-বিশেল্গষণ দাঁড় করাবে এটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির খুনের ঘটনার বিশেল্গষণও এখন বিভিন্নভাবে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে।

সৌদি কূটনীতিকের খুনিকেও যদি খুঁজে বের করে অতি দ্রুত আইনে সোপর্দ করা না যায় তাহলে এটিও অচিরেই ডালপালা মেলতে শুরু করবে। সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা তথা গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলোর প্রতি এখনই গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ
পদক্ষেপ নিতে হবে

সম্প্রতি সৌদি দূতাবাসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ঢাকায় খুন হয়েছেন। ৬ মার্চ রাতে ডিপেল্গামেটিক এলাকায় তার গুলিবিদ্ধ দেহ বাসার কাছে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর এই প্রথম একজন কূটনীতিক এ দেশে খুন হলেন। এ ঘটনা বাংলাদেশ এবং সৌদি আরব তথা মুসলিম বিশ্বসহ পৃথিবীব্যাপী এক আলোচিত ঘটনায় রূপ নিয়েছে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। সে সময় দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই সমর্থন জানায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে। আমেরিকা, চীন এবং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে সৌদি আরবও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করে সর্বপ্রকার সমর্থন জোগায় পাকিস্তানি শাসকদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার পর ১৯৭৫-৭৬ সালে সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বিশেষ করে জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া তাদের শাসনামলে সৌদি-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক এক বিশেষ মাত্রা পায়। জোরালো হয় বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। ১৯৭০ দশকে তেল সম্পদকে কেন্দ্র করে আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব একটি শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান তৈরি করে নেয়। এ সময় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক কাজের সন্ধানে সৌদি আরব গমন শুরু করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ভাগ্যের সন্ধানে বাংলাদেশের মানুষের সৌদি আরব গমনের ধারাটি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২ থেকে ২.৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক সে দেশে কর্মরত রয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশে আসা ফরেন রেমিট্যান্সের প্রায় ২৮ থেকে ৩০ ভাগ আসে সৌদি আরব থেকে। ২০১০-১১ অর্থবছরে আমাদের ফরেন রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১১৬৫০.৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সৌদি আরবের অংশ ছিল প্রায় ৩২৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কয়েক মাস আগে সৌদি সরকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে প্রায় সাড়ে চার লাখ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মূলত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং ভারত থেকে তারা এসব কর্মী নেবে। ইতিমধ্যে ভারত এবং পাকিস্তান থেকে তারা এসব শ্রমিক-কর্মী নেওয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে এখনও শুরু হয়নি। ঢাকায় সৌদি কূটনীতিকের এ হত্যাকাণ্ড এ সুযোগের ওপর প্রভাব ফেললে তা হবে বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্যের কারণ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়ন কর্মসূচির জন্যও সৌদি আরব আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বর্তমান সরকারের আমলেই প্রায় ৩৭৩ কোটি টাকার একটি ঋণচুক্তি হয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গে। এ টাকায় নির্মিত হবে মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার। প্রায় ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে এ প্রকল্পে। বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য 'সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (ঝউঋ)' ছাড়াও 'গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (এঈঈ)' থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও সৌদি সহায়তা আমাদের খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। এসব দুর্যোগকালে সৌদি রিলিফের বিষয়টিও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া আমাদের তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট বিনিয়োগ স্কিমের আওতায় সৌদি আরবের দাম্মামের 'আশারকিয়া চেম্বার' কিংবা জ্বালানি এবং রিফাইনারি ক্ষেত্রে সৌদি সরকার পরিচালিত 'আরামকো'সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগ আগ্রহ রয়েছে বলে মাঝে মধ্যেই পত্রপত্রিকায় আমরা খবর দেখতে পাই। মোট কথা, চলমান এবং সম্ভাবনা মিলিয়ে সৌদি আরব বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার। বাংলাদেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে সৌদি আরবের ভূমিকা বাংলাদেশের বিদেশনীতি এবং সম্পর্কের জন্য খুবই জরুরি।
এসব প্রেক্ষাপটে ঢাকায় সৌদি কূটনীতিকের হত্যার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি বিরাট উদ্বেগের কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে এ খুনের খবরটি সারাবিশ্বসহ আরব দেশগুলোর গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। কাতারের নিউজ চ্যানেল আল-জাজিরা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের খালিজ টাইমস, সৌদি আরবের দৈনিক আরব নিউজ, জাকার্তা পোস্ট ইত্যাদিসহ বিবিসি, রয়টার্স প্রভৃতি গণমাধ্যমের কাছ থেকে আরব বিশ্বসহ সারা দুনিয়ার মানুষ এ খবরটি জেনেছে। বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এবং খানিকটা শঙ্কা ব্যক্ত করে এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য খুব সম্প্রতি বাংলাদেশে সৌদি রাষ্ট্রদূত এবং আমাদের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, শ্রম এবং খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিবর্গসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হয়েছে যে, এটি একটি নিছক দুর্ভাগ্যজনক এবং নিষ্ঠুর খুনের ঘটনা_ এতে দু'দেশের সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে না কিংবা সৌদিতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমরা আমজনতাও এ প্রত্যাশাই করি।
এ খুনের ঘটনাটি ঘটেছে ৬ মার্চ রাতে। বেশ কয়েক দিন গত হলেও সরকারের সংশিল্গষ্ট বিভাগগুলো এখনও পর্যন্ত এর কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি। পত্রপত্রিকা মারফত জানা গেছে, ৪৫ বছর বয়সী এই সৌদি কূটনীতিক খালাফ আল-আলী কয়েক বছর ধরেই তার এই বাসায় একা বসবাস করতেন। রাতে ভ্রমণ তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল। কোনো কোনো রাতে তিনি মধ্যরাত কিংবা তারও পরে বাসায় ফিরতেন। অর্থাৎ তিনি নিশ্চয়ই তার এই অবস্থান এবং রাতবেরাত রাস্তায় বের হওয়াকে নিরাপত্তাহীন মনে করতেন না। তাছাড়া কূটনীতিক জোন এমনিতেই একটা বাড়তি নিরাপত্তা এলাকা_ বিদেশি এসব কূটনীতিকের ব্যক্তিগত শত্রু তেমনটি থাকার কথা নয়। তথাপি একজন কূটনীতিক কেন খুন হলেন? বিশেষ করে তিনি সৌদি কূটনীতিক হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন কারণে এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়।
রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, ক্লাবে-আড্ডায় মানুষের মুখে এই খুনের ঘটনার কারণ কী তার নানামুখী বিশেল্গষণ শোনা যায়। একদল বলতে চান, সম্প্রতি মিসরীয় এক নাগরিককে হত্যার দায়ে সৌদি সরকার ৮ জন বাংলাদেশিকে শিরশ্ছেদ করায় কারও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। একদল বলছেন, এটি একটি নেহাত খুন কিংবা বড়জোর ব্যক্তিগত শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ অর্থাৎ এটি একটি 'জাস্ট ক্রিমিনাল অ্যাক্ট'।
সমাজের একটি বড় অংশ এ ঘটনার রাজনৈতিক কূটকৌশলগত সংশেল্গষ খুঁজে বের করারও প্রয়াস পাচ্ছেন। আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী এটিকে রাজনীতির খেলা কি-না সেই সন্দেহ করে তার এক বক্তৃতায় তিনি অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই মতের লোকজনের ধারণা বাংলাদেশে বিরাজমান দুই ধারার রাজনীতির বিরোধী ধারার সঙ্গে সৌদি আরবের সখ্য অপেক্ষাকৃত বেশি। বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি এই ধারায় সমবেত এবং একাট্টা। বর্তমানে এদের অনেকে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটনের দায়ে বিচারের সম্মুখীন। সরকারের এ বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তারা দেশ-বিদেশে নানাভাবে চাল চালছে। বাংলাদেশের শক্তিশালী বিরোধী দল বিএনপিও এই শক্তিকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের ১২ মার্চের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি ও এর তোড়জোড়কে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সংসদে যাওয়া না যাওয়া, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইস্যু প্রভৃতি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ-জ্বালানি, দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা, শেয়ারবাজারের অবস্থা কাম্য পর্যায়ে না থাকা প্রভৃতি নিয়ে সরকার তেমন স্বস্তিতে নেই। বিশ্বব্যাংকের এক ধরনের অবস্থান গ্রহণের ফলে পদ্মা সেতুর অনিশ্চয়তা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে একটি কালো ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। এসব অবস্থার মধ্যে কোনোভাবে সরকারকে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক দুরবস্থায় ফেলতেও সৌদি কূটনীতিক খুন হতে পারেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাদের মতে, এ সময় যদি সৌদি আরব কোনোভাবে বাংলাদেশকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে দেশে যদি নতুন কোনো শ্রমিক না যেতে পারে কিংবা সে দেশে কর্মরত শ্রমিকদের যদি সৌদি সরকার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে শুরু করে, তাহলে বর্তমান সরকার এক মহাসংকটে পড়ে যেতে পারে। আর এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশের বিরোধী শক্তির আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টি অধিকতর সহজ হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমটি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে একদল বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছে এভাবে যে, সরকারই এ ধরনের কাজ করিয়ে বিরোধী শিবিরের ওপর নাশকতা ঘটানোর দায় চাপানোর জন্যও এমনটি করে থাকতে পারে।
দেশে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সুনির্দিষ্টভাবে উদ্ঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ তার নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা-বিশেল্গষণ দাঁড় করাবে এটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির খুনের ঘটনার বিশেল্গষণও এখন বিভিন্নভাবে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। সৌদি কূটনীতিকের খুনিকেও যদি খুঁজে বের করে অতি দ্রুত আইনে সোপর্দ করা না যায় তাহলে এটিও অচিরেই ডালপালা মেলতে শুরু করবে। সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা তথা গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলোর প্রতি এখনই গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
skasalam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.