হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী by রবীন্দ্রনাথ অধিকারী
আজ মঙ্গলবার পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২০০তম জন্মবার্ষিকী। প্রতি বছরের মতো এবারও তার লীলাভূমি কাশিয়ানীর শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে অনুষ্ঠিত হবে স্নান উৎসব ও মহাবারুণীর মেলা। হবে লাখ লাখ মতুয়া ভক্তের সমাবেশ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা_ ব্রিটিশ শাসনের সূর্য তখন মধ্যগগনে।
ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণ বিভেদ, জাতপাত ও ধর্মের হানাহানির কারণে এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে এ ভূখণ্ডের ধর্ম সংস্কৃতির তখন দুরবস্থা। মানবিকতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধ তখন ভূলুণ্ঠিত। উচ্চবর্গীয়দের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনে নিম্নবর্গীয় ব্রাত্যজনরা নিদারুণ নিষ্পেষিত। যুগের এ তমসাচ্ছন্ন সময়ে ধর্মের গ্গ্নানিকালে যুগবতার রূপে আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হলেন পূর্ণব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। তিনি ছিলেন বিভেদবাদী ধর্ম-বর্ণের সমন্বয়ক এবং ঐক্যের প্রতীক, অহিংসা ও মানবতাবাদী। পূর্ণাঙ্গ প্রেমময় সত্তা ও পরম পুরুষ। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার সাফলীডাঙ্গা গ্রামে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রাম ছিল তার লীলাভূমি ও সাধনক্ষেত্র। এ ওড়াকান্দিতে তিনি ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। এ শ্রীধাম ওড়াকান্দি এখন একটি হিন্দুদের অন্যতম তীর্থ কেন্দ্র। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের বাবার নাম যশোবন্ত ঠাকুর, মায়ের নাম অন্নপূর্ণা দেবী। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতৃকুল ব্রাহ্মণ এবং মাতৃকুল নমঃশূদ্র। তিনি আজীবন মানুষের সেবা করেছেন। ধর্ম ও সমাজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন লোকনায়ক এবং লোকগুরু। তার সহজ সাধন পথের নাম মতুয়াবাদ। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বলা হয় 'মতুয়া'। মতুয়া শব্দের অর্থ হলো মাতোয়ারা বা মেতে থাকা। যারা এ নামে মাতোয়ারা বা অনুরাগী তারা মতুয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, যারা তার মতের অনুসারী তারাই মতুয়া। বিশ্বে হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মাতুয়াবাদে বিশ্বাসীরা মতুয়া সম্প্রদায় নামে পরিচিত। হরিনাম সংকীর্তন হচ্ছে তাদের ভজনের পথ। তারা শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরকে বিষ্ণুর অবতার বলে জ্ঞান করে। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর বিভিন্ন ধর্মের লোককে তার ধারায় একত্র করেছিলেন। তার ভাবাদর্শের অনুসারী হয়েছিলেন খ্রিস্টীয় ধর্মীয় যাজক ডা. সিএস মিড। তিনি খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকের কাজ করতে এসে ঠাকুরের আদর্শে উজ্জীবিত হন। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ অক্ষয় চক্রবর্তী ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের অন্যতম অনুসারী। বৈশ্য সম্প্রদায়ের মালঞ্চ সাহা ছিলেন তার বিশিষ্ট ভক্ত। মুসলিম ধর্মাবলম্বী তিনকড়ি মিয়া ছিলেন তার অনুগামী। নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের হীরামন, দশরথ, মৃত্যুঞ্জয়, লোচন, গোলক ছিলেন তার পার্ষদ। এভাবেই তিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন সেতু তৈরি করে মানবতার ধারায় একই সূত্রে সম্মিলিত করেছিলেন। আলোকিত সমাজ গড়েছিলেন। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিশ্বে তার প্রায় ২ কোটি অনুসারী রয়েছে। বাংলাদেশের পদ্মার দক্ষিণ পাড়ের অংশে তার প্রভাব খুবই প্রবল। এ অঞ্চলে রয়েছে তার অসংখ্য ভক্ত ও মন্দির। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন ও আদর্শের বাণী নিয়ে কবি রসরাজ তারকচন্দ্র সরকার রচনা করেছেন 'শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত গ্রন্থ'। হরিভক্তদের কাছে যা অনবদ্য শাস্ত্র হিসেবে নিত্যপাঠ্য। শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ছিলেন অবহেলিত, বঞ্চিত ও হতভাগ্য শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং সমাজ চিন্তাবিদ ও লোকগুরু। তার মতুয়া আন্দোলন এ অঞ্চলের কৃষকদের অধিকার আদায়ে, শোষণ, বঞ্চনা, ঘৃণার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে এবং আপসহীন সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে।
পতিত জমি উদ্ধার ও আবাদ করার কাজে কৃষকরা যাতে উদ্যোগী হন সে জন্য নিজেই লাঙল নিয়ে পতিত জমি কর্ষণ করে তিনি আবাদের আন্দোলন করেছিলেন। নীল কুঠিয়াল ডিক সাহেবের বিরুদ্ধে জোনাশুর কুঠি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গের সব নিষ্পেষিত ও অবহেলিত মানুষকে হরিনামের একতামন্ত্রে উদ্বোধিত করে গেছেন। তার ধর্মীয় আদর্শ ও মানবতার মাহাত্ম্যে তার লীলাভূমি ওড়াকান্দি মহাপবিত্র ধাম হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী স্নান উৎসব হয় এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে দলে দলে ভক্তরা এ স্নান উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। লাখ লাখ ভক্তের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে শ্রীধাম ওড়াকান্দির হরি মন্দির ও মেলাঙ্গন। ঠাকুরের শুভ জন্মতিথির মহতীলগ্নে তার ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। যেন তার কৃপায় পাপমোচন হয়, আত্মশুদ্ধি হয়, ঘটে আত্মোন্নতি। যেন তার প্রদর্শিত আলোক ছটায় হৃদয় অন্দরকে আলোকিত করে_ ভক্তরা সেই প্রার্থনা করেন। তিনি যেন অজ্ঞতার হৃদয়রাজ্যে ও কূপমণ্ডূকতায় জ্ঞানের আলো, জীবনের দীপ ও ভক্তির নবারুণ জ্বেলে দেন, ভক্তরা সে কামনাই করেন।
রবীন্দ্রনাথ অধিকারী : কবি ও সাংবাদিক
পতিত জমি উদ্ধার ও আবাদ করার কাজে কৃষকরা যাতে উদ্যোগী হন সে জন্য নিজেই লাঙল নিয়ে পতিত জমি কর্ষণ করে তিনি আবাদের আন্দোলন করেছিলেন। নীল কুঠিয়াল ডিক সাহেবের বিরুদ্ধে জোনাশুর কুঠি আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গের সব নিষ্পেষিত ও অবহেলিত মানুষকে হরিনামের একতামন্ত্রে উদ্বোধিত করে গেছেন। তার ধর্মীয় আদর্শ ও মানবতার মাহাত্ম্যে তার লীলাভূমি ওড়াকান্দি মহাপবিত্র ধাম হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী স্নান উৎসব হয় এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে দলে দলে ভক্তরা এ স্নান উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। লাখ লাখ ভক্তের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে শ্রীধাম ওড়াকান্দির হরি মন্দির ও মেলাঙ্গন। ঠাকুরের শুভ জন্মতিথির মহতীলগ্নে তার ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান। যেন তার কৃপায় পাপমোচন হয়, আত্মশুদ্ধি হয়, ঘটে আত্মোন্নতি। যেন তার প্রদর্শিত আলোক ছটায় হৃদয় অন্দরকে আলোকিত করে_ ভক্তরা সেই প্রার্থনা করেন। তিনি যেন অজ্ঞতার হৃদয়রাজ্যে ও কূপমণ্ডূকতায় জ্ঞানের আলো, জীবনের দীপ ও ভক্তির নবারুণ জ্বেলে দেন, ভক্তরা সে কামনাই করেন।
রবীন্দ্রনাথ অধিকারী : কবি ও সাংবাদিক
No comments