প্রস্তাবিত পানি আইন-জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে বাণিজ্যিকীকরণ? by ম. ইনামুল হক
বাংলাদেশ পানিতে ভাসা দেশ। সাগর থেকে জাগা দেশ। অবিরাম বৃষ্টিপাতের দেশ। উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটির দেশ। উত্তরের সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণের সাগরপারের বনভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীর উর্বরতম দেশ। এখানে সারা বছর ফসল হয়, মাছ হয়। জমিতে ধান, গাছে ফল। সুজলা-সুফলা এই বাংলা তাই পৃথিবীর ঘনবসতিতম দেশ।
এর সমতল পলিমাটির বুক চিরে বয়ে চলেছে অজস্র নদ-নদী। এটাই ছিল বাংলার রূপ। কিন্তু বাংলার সেই রূপ আর নেই। বাংলা এখন দূষণে পরিপূর্ণ। গ্রাম ও বনভূমিতে লাগানো হয়েছে নিষ্ফল বিজাতীয় গাছ। শহরাঞ্চলের নদীগুলো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত শিল্পবর্জ্যে পূর্ণ, গ্রামাঞ্চলের নদীগুলো মরা, যেখানে আগে বৈশাখ মাসেও হাঁটুজল থাকত। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের ভূমি ও পানির যখন এই দুরবস্থা, তখনই অত্যন্ত সংগত কারণেই পানি আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছে।
আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি, কৃষি, অর্থনীতি ও যাতায়াতব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রথমত, উজানে অবস্থিত ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ প্রকল্পে এবং নৌপথ সচল রাখার কাজে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর প্রবাহের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে সেচকাজে লাগানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, নদীর হাঁটুজল প্রবাহের উৎস বিল ও জলাশয়গুলোকে অতি নিষ্কাশন করে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চতুর্থত, সারা দেশে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের জন্য পানি অতি উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পঞ্চমত, নদীগুলোর পাড়ের খাসজমি দখল করে ভরাট করে বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, নদী, খাল ও জলাভূমিতে শিল্পবর্জ্য ও শহুরে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে এবং চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে।
এই বাস্তবতায় আমরা আশা করেছিলাম, প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’ কার্যত ‘পানি ব্যবহার আইন’ এবং এই আইনের মাধ্যমে পানির উৎস নদী বা বিল থেকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার বা নিষ্কাশন করা যাবে না, নদী দখল ও ভরাট করা যাবে না, পানির অবিরাম দূষণ বন্ধ করা যাবে। এবং এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের নদীগুলোর প্রবাহ ফিরে আসবে, ঢাকা নগরসহ দেশের সব শহর ও বন্দর সন্নিহিত নদীগুলো দূষণমুক্ত হয়ে প্রাণ ফিরে পাবে। প্রশ্ন হলো, প্রস্তাবিত পানি আইনে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি, নাকি রয়েছে অন্য কোনো কিছু?
‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’-এর খসড়া ওয়েবসাইটে পাওয়ামাত্রই পরিবেশবাদীরা আপত্তি জানিয়ে বলছেন যে আইনটি পানির ওপর জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের এই আপত্তি অবশ্যই সংগত। কারণ এই প্রস্তাবিত আইনটিতে (১২ জানুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত সংশোধিত) পানিসম্পদের ওপর মালিকানা, পানি ব্যবহারের অধিকার, সরকারি গেজেটে প্রাধিকারপ্রাপ্ত অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্তদের প্রবেশাধিকার, পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার ও সংরক্ষণ, পানির মূল্য নির্ধারণ, জলাধার ভরাট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পরিচ্ছেদ ও ধারা আছে, কিন্তু নাগরিকের পানির ওপর জন্মগত অধিকারের কথা বলা নেই। বর্তমানে গ্রামের সাধারণ জনগণ নিজ উদ্যোগে অথবা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় ইঁদারা, অগভীর কূপ, গভীর নলকূপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে থাকে। প্রবহমান নদী বা জলাধারের পানির ওপর জনগণের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রস্তাবিত পানি আইনের ১৪ ও ১৫ ধারায় সব ধরনের পানিসম্পদের মালিক রাষ্ট্র, ১৬ ধারায় যার বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ১৭ ধারায় পানি পান করাসহ গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য পানি বণ্টনও (‘বরাদ্দ’ বললে ভালো হতো) ওই কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’-এর ২২ ও ২৩ ধারায় নদী বা জলাধারের কূলে প্রবেশাধিকারও লাইসেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। আইনের ৩৫ ধারায় তফসিল ১-এ বর্ণিত পানি ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদানের কথা আছে। আইনের ৬৫ ধারায় পানির যেকোনো ব্যবহারের ওপর মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে। ৬৬, ৬৭, ৬৮ ও ৬৯ ধারায় পানি ব্যবহারকারী সমিতি বা কোনো কর্তৃপক্ষকে পানির মূল্য আদায়ের ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং ভূমির মালিকসহ পানি ব্যবহারকারীকে সুদসহ ওই মূল্য পরিশোধে বাধ্য করা হবে। এ ছাড়া অন্য ধারাগুলোর মাধ্যমে এমন একটি আইন প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে এতকাল ধরে জনগণের পানির ওপর যে জন্মগত অধিকার, তা হরণ হয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের মালিকানায় চলে যাচ্ছে। এই ধারাগুলোর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের দেশের পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস তথা নদী জলাশয়ের অংশগুলো বা একেকটি এলাকার পানিসম্পদ ব্যবহারের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স দেওয়া হবে, অতঃপর জনগণকে ওই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পানি কিনে খেতে বাধ্য করা হবে। এভাবে ২০০০ সালের জলাধার আইনকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
আমাদের দেশে পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বিগত কালের আওয়ামী লীগের সরকারের সময় ‘জাতীয় পানিনীতি, ১৯৯৯’ প্রণীত হয়েছিল। এই নীতির ধারাগুলো এতই চমৎকার ছিল যে ওই সময় তা বিভিন্ন মহল থেকে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু একই আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’ যেভাবে প্রস্তাবিত হচ্ছে, তাতে এটি একটি কালাকানুন হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে, কিন্তু অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য যে দেশব্যাপী নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, তা দূর করার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ধারা বা কঠোর শাস্তি বিধানের কথা ‘প্রস্তাবিত পানি আইন, ২০১১’-তে নেই।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রয়োজন, যা এই আইনের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে লেখা দরকার। এবং জনগণ তথা গ্রাম ও শহরবাসীর পানির ওপর যে মৌলিক ও জন্মগত অধিকার আছে, সেই বিষয়টি এই আইনে উল্লেখ থাকা দরকার। উন্মুক্ত জলাধার এবং প্রবাহিত নদী ও খালের ওপর দেশের জনগণের অধিকার কোনোক্রমেই হরণ করা যাবে না। বরং রাষ্ট্রকে উন্মুক্ত কি বদ্ধ—সব জলাধার এবং প্রবাহিত নদীগুলোর দূষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রস্তাবিত পানি আইনের কয়েকটি ধারায় দূষণ প্রতিরোধের কথা উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু তা অত্যন্ত দায়সারা গোছের। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ পানির দূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর, তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানির দূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করতে হবে। কেবল তা-ই নয়, পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস যথা—বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি নদী ও ঝরনার পানি, পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ের পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, আন্তর্জাতিক নদীর পানি, সমতলের নদীর পানি, হাওর ও বিলের পানি, মোহনার পানি, সুন্দরবনের পানি এবং সাগরের পানির ব্যবহার, প্রবাহ সংরক্ষণ ও গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকা দরকার।
ম. ইনামুল হক: প্রকৌশলী, সাবেক মহাপরিচালক, ওয়ারপ্রো।
Email: minamul@gmail.com.
আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি, কৃষি, অর্থনীতি ও যাতায়াতব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রথমত, উজানে অবস্থিত ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ প্রকল্পে এবং নৌপথ সচল রাখার কাজে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর প্রবাহের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে সেচকাজে লাগানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, নদীর হাঁটুজল প্রবাহের উৎস বিল ও জলাশয়গুলোকে অতি নিষ্কাশন করে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চতুর্থত, সারা দেশে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের জন্য পানি অতি উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পঞ্চমত, নদীগুলোর পাড়ের খাসজমি দখল করে ভরাট করে বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, নদী, খাল ও জলাভূমিতে শিল্পবর্জ্য ও শহুরে কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করা হয়েছে এবং চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে।
এই বাস্তবতায় আমরা আশা করেছিলাম, প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’ কার্যত ‘পানি ব্যবহার আইন’ এবং এই আইনের মাধ্যমে পানির উৎস নদী বা বিল থেকে যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার বা নিষ্কাশন করা যাবে না, নদী দখল ও ভরাট করা যাবে না, পানির অবিরাম দূষণ বন্ধ করা যাবে। এবং এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের নদীগুলোর প্রবাহ ফিরে আসবে, ঢাকা নগরসহ দেশের সব শহর ও বন্দর সন্নিহিত নদীগুলো দূষণমুক্ত হয়ে প্রাণ ফিরে পাবে। প্রশ্ন হলো, প্রস্তাবিত পানি আইনে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি, নাকি রয়েছে অন্য কোনো কিছু?
‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’-এর খসড়া ওয়েবসাইটে পাওয়ামাত্রই পরিবেশবাদীরা আপত্তি জানিয়ে বলছেন যে আইনটি পানির ওপর জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের এই আপত্তি অবশ্যই সংগত। কারণ এই প্রস্তাবিত আইনটিতে (১২ জানুয়ারি ২০১১ পর্যন্ত সংশোধিত) পানিসম্পদের ওপর মালিকানা, পানি ব্যবহারের অধিকার, সরকারি গেজেটে প্রাধিকারপ্রাপ্ত অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্তদের প্রবেশাধিকার, পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার ও সংরক্ষণ, পানির মূল্য নির্ধারণ, জলাধার ভরাট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি পরিচ্ছেদ ও ধারা আছে, কিন্তু নাগরিকের পানির ওপর জন্মগত অধিকারের কথা বলা নেই। বর্তমানে গ্রামের সাধারণ জনগণ নিজ উদ্যোগে অথবা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় ইঁদারা, অগভীর কূপ, গভীর নলকূপ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করে থাকে। প্রবহমান নদী বা জলাধারের পানির ওপর জনগণের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রস্তাবিত পানি আইনের ১৪ ও ১৫ ধারায় সব ধরনের পানিসম্পদের মালিক রাষ্ট্র, ১৬ ধারায় যার বণ্টনকারী কর্তৃপক্ষ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ১৭ ধারায় পানি পান করাসহ গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য পানি বণ্টনও (‘বরাদ্দ’ বললে ভালো হতো) ওই কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’-এর ২২ ও ২৩ ধারায় নদী বা জলাধারের কূলে প্রবেশাধিকারও লাইসেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। আইনের ৩৫ ধারায় তফসিল ১-এ বর্ণিত পানি ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদানের কথা আছে। আইনের ৬৫ ধারায় পানির যেকোনো ব্যবহারের ওপর মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে। ৬৬, ৬৭, ৬৮ ও ৬৯ ধারায় পানি ব্যবহারকারী সমিতি বা কোনো কর্তৃপক্ষকে পানির মূল্য আদায়ের ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং ভূমির মালিকসহ পানি ব্যবহারকারীকে সুদসহ ওই মূল্য পরিশোধে বাধ্য করা হবে। এ ছাড়া অন্য ধারাগুলোর মাধ্যমে এমন একটি আইন প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে এতকাল ধরে জনগণের পানির ওপর যে জন্মগত অধিকার, তা হরণ হয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের মালিকানায় চলে যাচ্ছে। এই ধারাগুলোর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের দেশের পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস তথা নদী জলাশয়ের অংশগুলো বা একেকটি এলাকার পানিসম্পদ ব্যবহারের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে লাইসেন্স দেওয়া হবে, অতঃপর জনগণকে ওই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পানি কিনে খেতে বাধ্য করা হবে। এভাবে ২০০০ সালের জলাধার আইনকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
আমাদের দেশে পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বিগত কালের আওয়ামী লীগের সরকারের সময় ‘জাতীয় পানিনীতি, ১৯৯৯’ প্রণীত হয়েছিল। এই নীতির ধারাগুলো এতই চমৎকার ছিল যে ওই সময় তা বিভিন্ন মহল থেকে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু একই আওয়ামী লীগের বর্তমান আমলে ‘বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১১’ যেভাবে প্রস্তাবিত হচ্ছে, তাতে এটি একটি কালাকানুন হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে, কিন্তু অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য যে দেশব্যাপী নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, তা দূর করার ব্যাপারে কোনো কার্যকর ধারা বা কঠোর শাস্তি বিধানের কথা ‘প্রস্তাবিত পানি আইন, ২০১১’-তে নেই।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রয়োজন, যা এই আইনের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে লেখা দরকার। এবং জনগণ তথা গ্রাম ও শহরবাসীর পানির ওপর যে মৌলিক ও জন্মগত অধিকার আছে, সেই বিষয়টি এই আইনে উল্লেখ থাকা দরকার। উন্মুক্ত জলাধার এবং প্রবাহিত নদী ও খালের ওপর দেশের জনগণের অধিকার কোনোক্রমেই হরণ করা যাবে না। বরং রাষ্ট্রকে উন্মুক্ত কি বদ্ধ—সব জলাধার এবং প্রবাহিত নদীগুলোর দূষণকারীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রস্তাবিত পানি আইনের কয়েকটি ধারায় দূষণ প্রতিরোধের কথা উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু তা অত্যন্ত দায়সারা গোছের। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন, ১৯৯৫ পানির দূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর, তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানির দূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করতে হবে। কেবল তা-ই নয়, পানিসম্পদের বিভিন্ন উৎস যথা—বৃষ্টির পানি, পাহাড়ি নদী ও ঝরনার পানি, পুকুর ও বদ্ধ জলাশয়ের পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, আন্তর্জাতিক নদীর পানি, সমতলের নদীর পানি, হাওর ও বিলের পানি, মোহনার পানি, সুন্দরবনের পানি এবং সাগরের পানির ব্যবহার, প্রবাহ সংরক্ষণ ও গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকা দরকার।
ম. ইনামুল হক: প্রকৌশলী, সাবেক মহাপরিচালক, ওয়ারপ্রো।
Email: minamul@gmail.com.
No comments