সংঘাত-তাল-বেতালের হরতাল by ফারুক ওয়াসিফ
বেশ ঈদের দিনের মতো চলছে হরতাল। রাস্তাঘাটে যান ও মানুষ কম। ঘরে ঘরে ছুটির আমেজ, চাকরিজীবীদের জন্য ‘অঘোষিত’ ছুটির মওকা। ব্যবসায়ীদেরও যাঁরা পারছেন, দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে গৃহেই সময় কাটাচ্ছেন। ৩৬ ঘণ্টার হরতালের সুবাদে অনেকে ঢাকার বাইরে হরতালমুক্ত নিরিবিলি রিসোর্টে অবকাশ উপভোগ করতে গেছেন।
কেবল পুলিশ, পিকেটার আর সাংবাদিকদের ছুটি নেই। প্রথম দুই পক্ষ ঢাকাই সিনেমার আঙ্গু বনাম মাঙ্গু কাবিলার মতো পরস্পরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। উভয়েই মহা ব্যস্ত। মাঝখানে পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে বেশ কজন সাংবাদিক পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হলেন। রেহাই নেই পথচারীদেরও। যাঁরা দিনে এনে দিনে খান, সেসব দিনমজুর আর রিকশাচালককে ঝুঁকি নিয়ে হলেও পেটের টানে হরতাল ভাঙতে হচ্ছে।
অতএব, সংকটের পাথর গড়াতে শুরু করেছে। ঘরপোড়া গরু মোরা, সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় লাগলেও বাইরের দিক থেকে সব ‘স্বাভাবিক স্বাভাবিক’ লাগছে। জি, আমরা তো জ্বালাও-পোড়াওসমৃদ্ধ হরতালের মধ্যে শত শত দিন কাটাতে অভ্যস্ত। অবস্থাটা চামড়ার কারখানার কাছে বসবাসকারী সেই মানুষটির মতো। কারও ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আবার কারও চামড়ার গন্ধ ছাড়া স্বাভাবিক ঘুমের পরিবেশ তৈরি হয় না। সেই লোকটা অবশেষে চামড়ার জুতো নাকের কাছে রেখে তবে ঘুমাতে পেরেছিল। সত্যিই, এত দিনে দেশ ‘স্বাভাবিক’ হলো, গণতন্ত্রকে সত্যিই এখন সতেজ ও স্বাস্থ্যে ভরা লাগছে। বিদেশি কূটনীতিকেরা যেমন পিঠ চাপড়ে বলেন, এ দেশে গণতন্ত্র বেশ ভাইব্রান্ট বা তাজা হয়ে উঠছে। সেই তাজা গণতন্ত্রই রাজপথে তাজা শক্তির প্রদর্শনীতে নেমেছে। রা-রা-রা ডেমোক্রেসি, লা-লা-লা গণতন্ত্র বলতে বলতে পিকেটাররা গাড়ি পোড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের পেটাচ্ছে। সরকারি দলের তাজা-তাগড়া কর্মীদের গণতন্ত্রের মহড়া এখনো শুরু হয়নি। অচিরেই তারাও দম মওলা বলে হাজির হবে। আর আমরা দেখতে থাকব।
এই ‘আমরা’ কারা—হরতাল যাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সরকারি দলও যাদের পুছছে না? হরতাল চায় কি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে কি না, তা বলার অধিকার এই ‘আমরা’র নেই। ‘টক শো’র কণ্ঠসাহিত্যিক আর সংবাদপত্রের কলমচিরাই তাদের হয়ে যা বলার বলছেন। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ কি অন্য শ্রেণীর কথা বলতে পারে? গণতন্ত্র যদি জনগণেরই হবে, তাহলে সেই গণতন্ত্র রক্ষা বা কায়েমের কারবারিদের কি জনগণকে দরকার নেই? কেবল ভোটের দিনই শুধু তাদের দরকার?
ইতিহাস সাক্ষী, দুটি নির্বাচনের মাঝখানে বিরোধী দলের গণতন্ত্রদেবী হরতালের বেশ ধরেন, আর সরকারি দলের উনি নেন আপসহীনতার সাজ। হরতাল অক্ষয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবির হরতাল, নির্বাচনের ফল অস্বীকার করার হরতাল, সংসদ কার্যকর করার হরতাল আবার অকার্যকর করতেও হরতাল হয়। হরতাল দিতে পারাই যেন গণতন্ত্রের মূল কথা। জরুরি অবস্থার সময় হরতাল দেওয়া যেত না, অতএব তখন গণতন্ত্রও ছিল না। গণতন্ত্র তাই সংবিধান বা সংসদের ধার ধারে না বাংলাদেশে, তার বাস রাজপথে কিংবা মসনদে। দুইখানেই জবাবদিহির বালাই নেই। তাই জনপ্রতিনিধিরা সংসদে জনগণের কথা বলার সময় বা সুযোগ পান না, করমুক্ত গাড়ির সুযোগ পান। সেসব গাড়িতে করে আমরা গণতন্ত্রকে ছুটে যেতে দেখি রাজপথে। জাতীয় সংসদ ভবন কেবল স্থপতি লুই কানের অলৌকিক সুন্দর স্থাপত্য হয়েই পড়ে থাকে। লৌকিক কাজে, অর্থাৎ জনস্বার্থে তার ব্যবহার খুবই কম।
ঠিক এ রকম অবস্থাতেই, সরকারি ক্ষমতার উৎস সংসদের মাইক থেকে বন্দুকের নলের দিকে চলে গিয়েছিল। গণতন্ত্র বন্দী বলে আহাজারি উঠেছিল। গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী দুই নেত্রী সংসদবর্তী দুটি ভবনে আটক থেকে গণতন্ত্রের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মুক্ত হলেও গণতন্ত্র পুরো মুক্ত হলো না।
এ এমন এক কঠিন গণতন্ত্র যে বিরোধী দল ছাড়াই সংসদের অধিবেশনের পর অধিবেশন আসে আর চলে যায়। সংসদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সংবিধানের কাটাছেঁড়া চলতে পারে আদালতের নির্দেশে। এটা এমন এক গণতন্ত্র, যা বারবার প্রমাণ করে, নির্বাচিতদের থেকে অনির্বাচিত মনোনীতদের দিয়েই নাকি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। একইভাবে বাজেট মানে, জনগণের করের টাকা জনগণের মধ্যে পুনর্বণ্টন করার প্রতিযোগিতা নয়; বরং কে কতটা বেশি জনগণের সম্পদ নিজেদের হাতে আনতে পারে, তারই কাড়াকাড়ি। তাই রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা নেই, সংঘাত আছে। বিতর্ক নেই, বিষোদগার আছে। জনমত জানা ও জানানোর কর্মসূচি নেই, বলপ্রয়োগের হরতাল আছে। এটাই নাকি সংসদীয় গণতন্ত্র।
প্রশ্নগুলো তাই জ্বলছে আর ভোগাচ্ছে: কীভাবে সরকার পরিবর্তনের শাসনতান্ত্রিক গোঁজামিলের মীমাংসা হবে, সংবিধান অনুযায়ী কীভাবে সব পর্যায়ে নির্বাচিতদের দেশ পরিচালন অটুট হবে, এসবের ফয়সালা যদি আদালতেই হবে, তাহলে রাজনীতিবিদ ও সাংসদদের কী প্রয়োজন? সমস্যার জন্ম রাজনীতির মধ্যে, সমাধানটা সেখানেই করতে হবে। দায়িত্বটা রাজনৈতিক সমাজ আর জনপ্রতিনিধিদের। বাকিরা তাদের সহায়তা দেবেন। দুটি দল কীভাবে পালা করে দেশ শাসন করবে, খেলার সেই নিয়ম ঠিক করা নিয়েই তো সব সমস্যা। ব্যবসায়ীরা তো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার নিয়ম ঠিক করতে পেরেছেন? রাজনীতিবিদেরা পারছেন না কেন? নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে কারও মাথা তেমন ব্যথা করছে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠাচ্ছি না। কথাটা এই—কেন রাজনৈতিক এই কাবিলা-যুদ্ধে অর্থনীতি স্থবির হবে, অধিকার হারিয়ে জনগণকে মাঝেমধ্যে জরুরি-জীবন কাটাতে হবে, ২০০৬-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মতো যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতির ক্রসফায়ারে পড়বে ভবিষ্যৎ। দলীয়স্বার্থে দেশসুদ্ধ মানুষকে এমন ভোগানোর অধিকার কারও নেই।
সরকার কেন শাসনতান্ত্রিক সমস্যাকে আইনি প্যাঁচের জটিল রাস্তায় পাঠিয়ে দিয়ে ‘কেমন প্যাঁচে ফেলেছি, হুম্ম’ বলে হামবড়ামি করবে? কেনই বা বিরোধী দল হালুম বলে আড়াই বছর বয়সী সরকারের খুঁটি ধরে ঝাঁকাতে থাকবে? আর পার পেয়ে যাবে জাতীয় বাজেটসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়? কথায় বলে, জনগণ যেমন-তেমন রাজনীতি তারা পায়। কিন্তু জনমতের যতটা আন্দাজ জরিপে মেলে, তা বলে না যে দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত নতুন যুগের বিপুলসংখ্যক তরুণেরা এমন রাজনীতি ও তার নেতা-নেত্রীদের নিয়ে গর্ব বোধ করে। স্বদেশের এমন হালচাল তো আত্মসম্মানেও লাগে। জনমানুষের রুচি ও চিন্তাকে এতটা অস্বীকার করে রাজনীতির খেলা বেশিদিন চলতে পারবে কি আসলে?
আসল কথা এই, যেভাবে নদী-বন-পাহাড় বা জনগণের সম্পত্তি ও আয় দখলের কার্যক্রম অর্থনীতির মধ্যে চলছে, যেভাবে মেঘনার মতো বড় নদীর বুকে কয়েক লাখ বাঁশ পুঁতে দখলের চেষ্টা হয়েছে, সেভাবে কয়েক লাখ কর্মী দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখা বা দখল করাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃহৎ দলীয় শক্তিগুলোর রাজনীতি। প্রধান দুটি দলের সব শক্তিই সম্পদ ও ক্ষমতা দখলের কাজে ব্যয় হয়। মানসিকতাটা দখলের—জনপ্রতিনিধিত্বের জোরে, জনস্বার্থ রক্ষার দাবিতে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের নয়। সে জন্যই কারও ক্ষমতা নিরাপদ রাখার জন্য খুঁটি পোঁতা, আর কারও ক্ষমতাকে অনিরাপদ করে তোলার জন্য খুঁটি গাড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ‘দেশের সিংহভাগ অর্থের মালিক কয়েক হাজার পরিবার... সম্পদশালী কয়েক শ পরিবার সরকারকে পরিচালনা করে।’ এরাই আবার একজোট হয়ে ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’ বলে কাবিলাযুদ্ধে জয়ীর নামে জয়ধ্বনি দেয়। দিন আর বদলায়না। হরতালের আমেজে সেই জয়ধ্বনি শুনে আমরা তাই ভীত হচ্ছি।
অন্য এক হরতালের কথা বলে শেষ করি। আগামী ১৭ জুন নারায়ণগঞ্জের যাত্রী অধিকার ফোরাম বাসভাড়া অযৌক্তিক হারে বাড়ানোর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক হরতাল ডেকেছে। তাদের দাবির পক্ষে তারা পদযাত্রা করে প্রচার করছে, ফেসবুক আর ব্লগে জনসংযোগ চালাচ্ছে। সাধারণ ছাত্র-তরুণদের এই বাঁচার হরতাল আর ক্ষমতার জন্য দুর্ভোগ দেওয়ার হরতালের মধ্যে কত ব্যবধান! হয়তো, নতুন দিনের রাজনীতির পথ এই সাধারণেরাই দেখাবেন, অসাধারণ নেতা-নেত্রীরা হয়তো কেবলই হতাশ করবেন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
অতএব, সংকটের পাথর গড়াতে শুরু করেছে। ঘরপোড়া গরু মোরা, সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় লাগলেও বাইরের দিক থেকে সব ‘স্বাভাবিক স্বাভাবিক’ লাগছে। জি, আমরা তো জ্বালাও-পোড়াওসমৃদ্ধ হরতালের মধ্যে শত শত দিন কাটাতে অভ্যস্ত। অবস্থাটা চামড়ার কারখানার কাছে বসবাসকারী সেই মানুষটির মতো। কারও ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, আবার কারও চামড়ার গন্ধ ছাড়া স্বাভাবিক ঘুমের পরিবেশ তৈরি হয় না। সেই লোকটা অবশেষে চামড়ার জুতো নাকের কাছে রেখে তবে ঘুমাতে পেরেছিল। সত্যিই, এত দিনে দেশ ‘স্বাভাবিক’ হলো, গণতন্ত্রকে সত্যিই এখন সতেজ ও স্বাস্থ্যে ভরা লাগছে। বিদেশি কূটনীতিকেরা যেমন পিঠ চাপড়ে বলেন, এ দেশে গণতন্ত্র বেশ ভাইব্রান্ট বা তাজা হয়ে উঠছে। সেই তাজা গণতন্ত্রই রাজপথে তাজা শক্তির প্রদর্শনীতে নেমেছে। রা-রা-রা ডেমোক্রেসি, লা-লা-লা গণতন্ত্র বলতে বলতে পিকেটাররা গাড়ি পোড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের পেটাচ্ছে। সরকারি দলের তাজা-তাগড়া কর্মীদের গণতন্ত্রের মহড়া এখনো শুরু হয়নি। অচিরেই তারাও দম মওলা বলে হাজির হবে। আর আমরা দেখতে থাকব।
এই ‘আমরা’ কারা—হরতাল যাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সরকারি দলও যাদের পুছছে না? হরতাল চায় কি না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকবে কি না, তা বলার অধিকার এই ‘আমরা’র নেই। ‘টক শো’র কণ্ঠসাহিত্যিক আর সংবাদপত্রের কলমচিরাই তাদের হয়ে যা বলার বলছেন। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ কি অন্য শ্রেণীর কথা বলতে পারে? গণতন্ত্র যদি জনগণেরই হবে, তাহলে সেই গণতন্ত্র রক্ষা বা কায়েমের কারবারিদের কি জনগণকে দরকার নেই? কেবল ভোটের দিনই শুধু তাদের দরকার?
ইতিহাস সাক্ষী, দুটি নির্বাচনের মাঝখানে বিরোধী দলের গণতন্ত্রদেবী হরতালের বেশ ধরেন, আর সরকারি দলের উনি নেন আপসহীনতার সাজ। হরতাল অক্ষয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবির হরতাল, নির্বাচনের ফল অস্বীকার করার হরতাল, সংসদ কার্যকর করার হরতাল আবার অকার্যকর করতেও হরতাল হয়। হরতাল দিতে পারাই যেন গণতন্ত্রের মূল কথা। জরুরি অবস্থার সময় হরতাল দেওয়া যেত না, অতএব তখন গণতন্ত্রও ছিল না। গণতন্ত্র তাই সংবিধান বা সংসদের ধার ধারে না বাংলাদেশে, তার বাস রাজপথে কিংবা মসনদে। দুইখানেই জবাবদিহির বালাই নেই। তাই জনপ্রতিনিধিরা সংসদে জনগণের কথা বলার সময় বা সুযোগ পান না, করমুক্ত গাড়ির সুযোগ পান। সেসব গাড়িতে করে আমরা গণতন্ত্রকে ছুটে যেতে দেখি রাজপথে। জাতীয় সংসদ ভবন কেবল স্থপতি লুই কানের অলৌকিক সুন্দর স্থাপত্য হয়েই পড়ে থাকে। লৌকিক কাজে, অর্থাৎ জনস্বার্থে তার ব্যবহার খুবই কম।
ঠিক এ রকম অবস্থাতেই, সরকারি ক্ষমতার উৎস সংসদের মাইক থেকে বন্দুকের নলের দিকে চলে গিয়েছিল। গণতন্ত্র বন্দী বলে আহাজারি উঠেছিল। গণতন্ত্রের অতন্দ্রপ্রহরী দুই নেত্রী সংসদবর্তী দুটি ভবনে আটক থেকে গণতন্ত্রের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা মুক্ত হলেও গণতন্ত্র পুরো মুক্ত হলো না।
এ এমন এক কঠিন গণতন্ত্র যে বিরোধী দল ছাড়াই সংসদের অধিবেশনের পর অধিবেশন আসে আর চলে যায়। সংসদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সংবিধানের কাটাছেঁড়া চলতে পারে আদালতের নির্দেশে। এটা এমন এক গণতন্ত্র, যা বারবার প্রমাণ করে, নির্বাচিতদের থেকে অনির্বাচিত মনোনীতদের দিয়েই নাকি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। একইভাবে বাজেট মানে, জনগণের করের টাকা জনগণের মধ্যে পুনর্বণ্টন করার প্রতিযোগিতা নয়; বরং কে কতটা বেশি জনগণের সম্পদ নিজেদের হাতে আনতে পারে, তারই কাড়াকাড়ি। তাই রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা নেই, সংঘাত আছে। বিতর্ক নেই, বিষোদগার আছে। জনমত জানা ও জানানোর কর্মসূচি নেই, বলপ্রয়োগের হরতাল আছে। এটাই নাকি সংসদীয় গণতন্ত্র।
প্রশ্নগুলো তাই জ্বলছে আর ভোগাচ্ছে: কীভাবে সরকার পরিবর্তনের শাসনতান্ত্রিক গোঁজামিলের মীমাংসা হবে, সংবিধান অনুযায়ী কীভাবে সব পর্যায়ে নির্বাচিতদের দেশ পরিচালন অটুট হবে, এসবের ফয়সালা যদি আদালতেই হবে, তাহলে রাজনীতিবিদ ও সাংসদদের কী প্রয়োজন? সমস্যার জন্ম রাজনীতির মধ্যে, সমাধানটা সেখানেই করতে হবে। দায়িত্বটা রাজনৈতিক সমাজ আর জনপ্রতিনিধিদের। বাকিরা তাদের সহায়তা দেবেন। দুটি দল কীভাবে পালা করে দেশ শাসন করবে, খেলার সেই নিয়ম ঠিক করা নিয়েই তো সব সমস্যা। ব্যবসায়ীরা তো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার নিয়ম ঠিক করতে পেরেছেন? রাজনীতিবিদেরা পারছেন না কেন? নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা নিয়ে কারও মাথা তেমন ব্যথা করছে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠাচ্ছি না। কথাটা এই—কেন রাজনৈতিক এই কাবিলা-যুদ্ধে অর্থনীতি স্থবির হবে, অধিকার হারিয়ে জনগণকে মাঝেমধ্যে জরুরি-জীবন কাটাতে হবে, ২০০৬-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মতো যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতির ক্রসফায়ারে পড়বে ভবিষ্যৎ। দলীয়স্বার্থে দেশসুদ্ধ মানুষকে এমন ভোগানোর অধিকার কারও নেই।
সরকার কেন শাসনতান্ত্রিক সমস্যাকে আইনি প্যাঁচের জটিল রাস্তায় পাঠিয়ে দিয়ে ‘কেমন প্যাঁচে ফেলেছি, হুম্ম’ বলে হামবড়ামি করবে? কেনই বা বিরোধী দল হালুম বলে আড়াই বছর বয়সী সরকারের খুঁটি ধরে ঝাঁকাতে থাকবে? আর পার পেয়ে যাবে জাতীয় বাজেটসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়? কথায় বলে, জনগণ যেমন-তেমন রাজনীতি তারা পায়। কিন্তু জনমতের যতটা আন্দাজ জরিপে মেলে, তা বলে না যে দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষত নতুন যুগের বিপুলসংখ্যক তরুণেরা এমন রাজনীতি ও তার নেতা-নেত্রীদের নিয়ে গর্ব বোধ করে। স্বদেশের এমন হালচাল তো আত্মসম্মানেও লাগে। জনমানুষের রুচি ও চিন্তাকে এতটা অস্বীকার করে রাজনীতির খেলা বেশিদিন চলতে পারবে কি আসলে?
আসল কথা এই, যেভাবে নদী-বন-পাহাড় বা জনগণের সম্পত্তি ও আয় দখলের কার্যক্রম অর্থনীতির মধ্যে চলছে, যেভাবে মেঘনার মতো বড় নদীর বুকে কয়েক লাখ বাঁশ পুঁতে দখলের চেষ্টা হয়েছে, সেভাবে কয়েক লাখ কর্মী দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখা বা দখল করাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃহৎ দলীয় শক্তিগুলোর রাজনীতি। প্রধান দুটি দলের সব শক্তিই সম্পদ ও ক্ষমতা দখলের কাজে ব্যয় হয়। মানসিকতাটা দখলের—জনপ্রতিনিধিত্বের জোরে, জনস্বার্থ রক্ষার দাবিতে নির্বাচিত হয়ে দেশ শাসনের নয়। সে জন্যই কারও ক্ষমতা নিরাপদ রাখার জন্য খুঁটি পোঁতা, আর কারও ক্ষমতাকে অনিরাপদ করে তোলার জন্য খুঁটি গাড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ‘দেশের সিংহভাগ অর্থের মালিক কয়েক হাজার পরিবার... সম্পদশালী কয়েক শ পরিবার সরকারকে পরিচালনা করে।’ এরাই আবার একজোট হয়ে ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’ বলে কাবিলাযুদ্ধে জয়ীর নামে জয়ধ্বনি দেয়। দিন আর বদলায়না। হরতালের আমেজে সেই জয়ধ্বনি শুনে আমরা তাই ভীত হচ্ছি।
অন্য এক হরতালের কথা বলে শেষ করি। আগামী ১৭ জুন নারায়ণগঞ্জের যাত্রী অধিকার ফোরাম বাসভাড়া অযৌক্তিক হারে বাড়ানোর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক হরতাল ডেকেছে। তাদের দাবির পক্ষে তারা পদযাত্রা করে প্রচার করছে, ফেসবুক আর ব্লগে জনসংযোগ চালাচ্ছে। সাধারণ ছাত্র-তরুণদের এই বাঁচার হরতাল আর ক্ষমতার জন্য দুর্ভোগ দেওয়ার হরতালের মধ্যে কত ব্যবধান! হয়তো, নতুন দিনের রাজনীতির পথ এই সাধারণেরাই দেখাবেন, অসাধারণ নেতা-নেত্রীরা হয়তো কেবলই হতাশ করবেন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments