লন্ডনে বাংলাদেশের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন by ফারুক যোশী

ত ডিসেম্বরে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ তেল-গ্যাস খনিজ-সম্পদ ও বন্দর রক্ষা কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা নামের সংগঠন। তাদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কম্পানি 'গ্লোবাল কুল ম্যানেজমেন্ট' (জিসিএম) বাংলাদেশে তার পরিকল্পনায় যেন পরিবর্তন আনে। জিসিএম মূলত এশিয়া এনার্জির পরিবর্তিত নাম।


এশিয়া এনর্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়িতে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে স্থানীয় জনগণের প্রবল প্রতিরোধ করে এবং তা করতে গিয়ে একসময় প্রাণহানিও ঘটে। সে কারণে ২০০৬ সালে এই নামটি দুনিয়াব্যাপী দুর্নাম কুড়ালে তারা তাদের নাম পরিবর্তন করে এখন 'গ্লোবাল কুল ম্যানেজম্যান্ট' কিংবা জিসিএম করেছে। গত মাসের ১৫ তারিখে এই কম্পানিটির বার্ষিক সভা (এজিএম) ছিল। ২০০৮ সালের পর থেকে প্রতি এজিএম চলাকালে এ দিন তেল-গ্যাস খনিজ-সম্পদ ও বন্দর রক্ষা কমিটি যুক্তরাজ্য শাখা এ রকম বিক্ষোভের আয়োজন করে। গত মাসের বিক্ষোভেও তারা দিনাজপুরের ফুলবাড়ি এলাকার মানুষের আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এমনকি সভা চলাকালে বিক্ষোভকারীদের দু-একজন ওই কম্পানির শেয়ার হোল্ডার জিসিএমের পরিচালকদের প্রশ্নবাণেও বিদ্ধ করেন। বিক্ষোভকারীরা জিসিএম কিংবা এশিয়া এনার্জির বাংলাদেশে তাদের কয়লা উত্তোলনের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে এলাকার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধনসহ পরিবেশের চরম বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরেন। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে সেখানে ৬৬০ একর তিন ফসলি জমি তার উৎপাদন ক্ষমতা হারাবে। সেখানে সৃষ্টি হবে পানির সংকট। আর অন্যদিকে এই কয়লা উৎপাদনে বাংলাদেশ পাবে মূল লভ্যাংশের ছয় শতাংশ এবং জিসিএম লুটে নিয়ে আসবে ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ হিসাব করে দেখা গেছে, জিসিএম লুট করবে ২০০ কোটি ডলার এবং বাংলাদেশ চুষতে থাকবে মাত্র সাত কোটি ডলারের রস-কষহীন আমের ছোলা।
২. এখন সারা দেশে টিপাইমুখ রাজনীতিকদের এক প্রধান ইস্যু। ইস্যুটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং জনগণের এতে সমর্থন থাকাটাই উচিত। দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদেশেও এ ইস্যু এখন বিরোধী দলের আন্দোলনের বর্ম। কারণ বিভিন্ন সমীক্ষার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে ভারতের বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধ হয়ে গেলে সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিরান হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই টিপাইমুখের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের এই এলাকা দেশের সবচেয়ে নিম্নাঞ্চল। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ না থাকলে তাতে এ মৌসুমে একেবারেই শুকিয়ে যাবে গোটা এলাকা। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ (দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ) এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এই টিপাইমুখ এলাকা। সে কারণেই এখানে বাঁধ নির্মিত হলে সব সময়ই এখানে যেন অপেক্ষা করবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যর হাতছানি। কোনো কারণে ভূমিকম্প হয়ে গেলে বৃহত্তর সিলেটের কত লোক মারা যাবে তার হিসাব তো কষা দায় হয়ে পড়বে। হাল আমলের জাপান পর্যন্ত তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়েও ঠেকাতে পারেনি মানবতার এ রকম বিপর্যয়। আর সে কারণে আমাদের সবাইকে এ কথাটা তো স্বীকার করতেই হবে, এ রকম বিপর্যয় সামনে জেনেও কেন-ইবা বৃহত্তর সিলেট জেলার লাখ-কোটি মানুষের সঙ্গে তথা বাংলার মানুষের সঙ্গে এই হত্যাখেলা? ৩. লন্ডনে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও চলছে জোর আন্দোলন। বিএনপি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অগণিত মানুষের কাছে যে চিত্রটি তুলে ধরছে, তা হলো আওয়ামী লীগ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতকে সহযোগিতা করছে। অথচ আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, টিপাইমুখ বাঁধের প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই ভারত নেয়। এবং সে সময়ই বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়াটি মূলত সবচেয়ে বেশি এগিয়েছিল ভারত। ২০০১ সালে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার যখন টিপাইমুখ বাঁধটি অনুমোদন দেয় কিংবা ২০০৩ বা ২০০৫ সালে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে ভারতের মণিপুর ও মিজোরামে এবং বাংলাদেশের ঢাকাসহ সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী বা বিভিন্ন নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন দুঃখজনকভাবে চারদলীয় জোট সরকার এ সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনও আজকের সরকারের মতো শুধু এ কথাটাই বলেছিলেন যে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কিছু করা থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকবে সরকার। সুতরাং টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করতে যদি ভারত সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, তাহলে এটা রোধ করতে রাষ্ট্রীয় সমঝোতা যে অনেক আগেই ব্যর্থ হয়েছে, তা স্পষ্ট। সে কারণে এ ব্যর্থতাটা আগের জোট সরকারেরও এবং এখন মহাজোট সরকারেরও। অথচ দুই দলই তাদের ব্যর্থতা মানতে নারাজ। আজ বিএনপি এবং মৌলবাদী দলগুলো সভায়-টকশোতে টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলছে। আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্যের মূল নেতারা টিভি টক শোতে বলছেন টিপাইমুখ মূলত কোনো ইস্যুই না, এটা বিরোধী দল শুধু শুধু একটা ইস্যু তৈরি করেছে। আর এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুটো দলই টিপাইমুখ নিয়ে মূলত জনগণের সঙ্গে একটি খেলা খেলছে, তাদের আন্দোলন জনস্বার্থে কিছুই নয়। টিপাইমুখ ইস্যুটি যেমন একটি ভিন দেশ কিংবা প্রতিবেশী দেশ নিয়ে তৈরি হওয়া, ঠিক তেমনি জিসিএম কিংবা কনোকো-ফিলিপসের ইস্যুটাও বিদেশি দ্বারা সৃষ্ট দুটো ইস্যু। ফুলবাড়ীর ইস্যুতে আছে পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো ব্যাপার, আবার জিসিএম এমনকি হালের কনোকো-ফিলিপসের মাধ্যমে আছে বাংলাদেশ থেকে শত-সহস্র কোটি ডলার লুট করে নিয়ে যাওয়ার বিদেশি বেনিয়াদের প্রকাশ্য ফাঁদ। টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে পারে বিএনপি কিংবা মৌলবাদী দলগুলো কিন্তু একটি বারের জন্যও কনোকো-ফিলিপস কিংবা জিসিএম নিয়ে তারা কথা বলে না এই ব্রিটেনে। সেদিনের টাওয়ার হিলের সেই বিক্ষোভের সময় কিংবা তার পরও সেই বিশাল সংগঠনগুলোর কাউকে কোনো দিন কিছু উচ্চারণ করতে দেখা যায়নি। বিদেশি চাপ সৃষ্টি করতে এমপি-মন্ত্রীদের প্রয়োজন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর পরও প্রয়োজন সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক পরিকল্পনা। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছরের ক্রমাগত বিক্ষোভের কারণেই এশিয়া এনার্জি তথা জিসিএম এখন ব্রিটিশ মিডিয়ায়ও উচ্চারিত হচ্ছে, অন্যদিকে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা সোস্যালিস্ট পার্টিগুলোও দিয়ে যাচ্ছে অব্যাহত সমর্থন। আর সে কারণেই আজ এই কম্পানিটির ব্যবসায়িক ভিতে কিছুটা হলেও কাঁপন ধরেছে। যে কম্পানিটির শেয়ার মূল্য ছিল ১৬৬ পেন্স, সেই কম্পানিটির শেয়ার মূল্য ২০১০ সালের বিক্ষোভের পরই হয়ে যায় ১৩০ পেন্স এবং গত এক বছরে তা হ্রাস পেতে পেতে বর্তমান বাজারে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৫.৬০ পেন্সে। সে হিসেবে এটা কম্পানির জন্য এক বড় ধরনের ধসনামা। অন্যদিকে বাংলাদেশের তেল-গ্যাস খনিজ-সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকারীদের জন্য এ এক সফলতা।
৪. বিদেশি বিশেষত পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের হাতে আমাদের জাতীয় সম্পদ লুট হওয়ার পাঁয়তারা যখন চলে, তখন আমাদের প্রধান দলগুলো চুপ করে বসে থাকে। এক অদ্ভুত নীরবতা তখন তাদের ভর করে। তাদের অনেকেই থাকেন তখন নীরব দর্শক। বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে, টিপাইমুখ নিয়েও ইস্যু তৈরি করা যেতে পারে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীব্যাপী জনমত তৈরিতেও জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। সেই রোশনারা আলীসহ পরিবেশবাদীদের দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি জনমত সৃষ্টির কাজ করতে পারে বিরোধী দলগুলো। ব্রিটেনের বাঙালিদের মধ্যে এ নিয়ে জনমত তৈরি করে মূলত কিছুই হবে না, যা করতে হবে তা হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সে দায়িত্ব কি নেবে তারা, নাকি শুধুই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতায় লেগে থাকবে?
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.