আমায় ক্ষমো হে-চল্লিশ বছরের ব্যাংকিং শিল্প by মামুন রশীদ

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭৩ সালে। একটি ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করব। তাই একটি 'ডিমান্ড ড্রাফট' (ডিডি) করতে গিয়েছিলাম। সিলেটের এই ব্যাংকটি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। সে সময় কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের 'ব্যাংক ম্যানেজার সাহেব' বা শাখা ব্যবস্থাপকের চাকরিটি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক। পরবর্তী সময়ে আমরা সবাই চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম।


বোঝার চেষ্টা করেছিলাম, 'ড্রাফট ইস্যু' করার মাধ্যমে আন্তজেলা পরিশোধ কিংবা 'ক্লিয়ারিং' কাকে বলে। এ পর্যন্তই।
১৯৮৪ সালের শেষ দিকে প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকে যোগদানের পরই আমি বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কী, তা বুঝতে শুরু করলাম। সে সময় ব্যাংক মানেই ছিল নগদ অর্থ জমা রাখা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে তা লগি্ন করা। আর তা ছিল মূলত হাতে লেখা লেজার ও জার্নাল পরিচালিত ব্যাংকিং। গ্রাহকদের অবস্থান ছিল গ্রহণ প্রান্তে এবং তাঁরা বরাবরই ব্যাংক ম্যানেজারের আনুকূল্য আশা করতেন। ১৯৮৭ সালের প্রথম দিকে আমি একটি বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকে যোগ দিই। এমনকি সেখানেও অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ছিল খুবই সাধারণ মানের। আমাদের যিনি 'ক্লিয়ারিং' করতেন তিনি দাবি নিষ্পন্ন করতেন কোনো ক্যালকুলেটরের সাহায্য ছাড়া, কেবল হাতে গণনা করে। আর এখন? গুটিকয়েক ছাড়া বাকি সব ব্যাংকই প্রায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলে। কিছু ব্যাংক আবার সর্বাধুনিক সেবা প্রদানকারী প্লাটফর্ম এবং বিকল্প বিতরণ ব্যবস্থায় চলে এসেছে। 'সিন্ডিকেশন', 'ক্লাব ডিলস', 'কনভার্টিবল বন্ডস' বা 'সিকিউরিটাইজেশন'_এসব কোনোটাই আজ আর অপরিচিত শব্দ নয়। ক্রমেই অধিকসংখ্যক ব্যাংকে 'রিটেইল ব্যাংকিং', 'ইন্টারনেট ব্যাংকিং' এবং পুঁজিবাজারসহ 'ইনভেস্টমেন্ট' ব্যাংকিংয়ের বিস্তার ঘটছে।
৪০ বছর ধরেই বাংলাদেশে ব্যাংকিং শিল্পের প্রসার ঘটছে, মুনাফার হার দুই অঙ্কের ঘরেই থাকছে, বেশির ভাগ ব্যাংকই বিকাশ ধরে রাখছে এবং গলাকাটা প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে শেয়ার হোল্ডারদের মুনাফা জোগাতে পারছে।
যা-ই হোক, ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের রাজনীতিতে জড়িত থাকা এবং ব্যাংকের সুনামকে কাজে লাগিয়ে নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়ে প্রকাশিত খবরাখবরে ব্যাংকগুলোর স্বাধীন কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে আজ অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ফলে বার্ষিক প্রতিবেদন এবং অন্যান্য বিধিবদ্ধ কাগজপত্রের ঘোষণার সত্যতা নিয়েও সন্দেহ জাগছে। কখনো কখনো আমার মনেও এমন প্রশ্ন জেগেছে যে ব্যাংকিং খাতে ভালো করার আবরণে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে কি না, অথবা সেখানে অন্যান্য অনিয়ম, অসংগতি অথবা ঘাটতি রয়েছে কি না, যা ব্যাংকগুলোকে বিদ্যমান অবস্থার সুযোগ নিতে দিচ্ছে। মালিকদের হস্তক্ষেপ, কার্যক্রম পরিচালনার ত্রুটি অথবা ঋণজনিত ব্যর্থতা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদন ব্যাংকিং ভাবমূর্তিকেই ম্লান করেছে। যথেষ্ট অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের ব্যাংকিং খাতের কর্মকাণ্ড এখনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের ব্যাংকগুলোর সফল ও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার পথে কেবল ভাবমূর্তির বিষয়টিই একমাত্র বাধা নয়। এ ছাড়া এই পথের অন্যান্য অন্তরায়ের মধ্যে রয়েছে দুটি 'পি' (পিপল ও প্রডাক্ট), তিনটি 'সি' (কমপ্লায়েন্স এবং এথিকস, কমপিটিশন এবং চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট) এবং একটি 'টি' (টেকনোলজি)। কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, তার পরও বাংলাদেশে প্রতিযোগিতাটাকেই সবচেয়ে মারাত্মক বলে মনে হয়। এটি শুধু ইতিবাচক পরিবর্তনই আনেনি, অনিয়মকেও উৎসাহিত করেছে। আর এ প্রতিযোগিতা কেবল অন্যান্য ব্যাংকের তরফ থেকেই হচ্ছে না, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) এবং মাইক্রো ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের (MFI) পক্ষ থেকেও আসছে। শুধু যে প্রতিষ্ঠানই প্রতিযোগিতা করছে তা নয়, নিয়ন্ত্রক ও গ্রাহকরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই এমন জটিল হয়ে উঠছে যে আপনার মনে হতেই পারে যেন পাথর ও দেয়ালে ঠোকাঠুকি চলছে। গ্রাহকরা বিধিবদ্ধ শর্ত বা নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে অন্য ব্যাংক বা ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত সুবিধার কথা বলে পরিস্থিতির সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে চাইছেন।
ব্যাংকাররা যেকোনো মূল্যে তাঁদের ওপর আরোপিত টার্গেট পূরণ করতে সচেষ্ট থাকেন, আর এর ফল হয় বিধিবিধান এড়িয়ে চলা। একজন চান যেকোনো মূল্যে আরেকজনকে ছাড়িয়ে যেতে এবং এতে পুরো নেটওয়ার্কে অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ে আর এটিই একসময় নিয়মে পরিণত হয়।
অর্থ জোগানের জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু ক্রমবর্ধমান হারে পুঁজিবাজারে যাচ্ছে বা যেতে চাচ্ছে, তাই পুঁজিবাজারের দিক থেকেও ব্যাংকিং শিল্পে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি যে কেবল ব্যাংকের মূল ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা নয়, বরং পরোক্ষভাবে বাজারের ওপরও প্রভাব ফেলছে। অধিকন্তু মুনাফার জন্য ব্যাংকগুলো ক্রমেই অতিরিক্ত পরিমাণে উদ্বায়ী পুঁজিবাজারে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
আমরা সবাই ব্যাংকিং শিল্পে আরো দক্ষ মানবসম্পদের খুব বেশি প্রয়োজন অনুভব করছি, যারা কেবল সেবার পুরনো পণ্যই বিক্রি করবে না বরং উদ্ভাবনমূলক নতুন ও আগামী দিনের উপযোগী পণ্য নিয়ে আসতে পারবে। নতুন পণ্য নিয়ে আসার এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রধান শর্ত হচ্ছে বাজারকে প্রশিক্ষিত করা। বাজার ও পণ্যের পাশাপাশি দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি এবং বিধিবদ্ধ শর্তের প্রতিও সর্বদা নজর রাখতে হবে।
বিধিবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রকরা হঠাৎ করে একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তাড়াহুড়া শুরু করে দেন। তাঁরা যথাযথ গবেষণা ছাড়া অথবা সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী হবে এবং সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর আছে কি না তা বিবেচনায় না নিয়েই কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন শুরু করে দেন। এর ফলাফল যা হয় তা হলো, বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়, সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং বিধিবিধানকে এড়িয়ে যাওয়ার নতুন নতুন উপায় বের হতে থাকে। ফলে যারা বিধিবিধান মেনে চলে এবং যারা বিধিবিধান না মেনে চালাকির সঙ্গে 'ম্যানেজ' করে উভয়ের মধ্যে খেলার মাঠটি আর এক রকম সমতল থাকে না। এ সময় অনেক বেশি কথা এবং অল্প কাজ উদ্দেশ্যের সততা নিয়েই সন্দেহ সৃষ্টি করে।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক হিসেবে আপনি অবাক হবেন এবং আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে, অসুবিধাগুলো 'ম্যানেজ' করা এত সহজ কেন? চূড়ান্ত প্রশ্নটি হলো, এতে কার ক্ষতি হচ্ছে? চূড়ান্ত বিচারে, দেশ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন দেশের প্রতিটি নাগরিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৭২ সালে আমাদের সদ্যস্বাধীন দেশটি দুর্বল ও ছোট পরিধির ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল এবং সেগুলোর প্রায় সবই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। বর্তমানে দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে বেসরকারি ব্যাংকই বাজারের অধিকাংশটা দখল করে আছে। এখন ট্রানজেকশন ব্যাংকিং, করপোরেট অ্যাডভাইজারি অথবা পুঁজিবাজারের সেবা গুরুত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেটার অব ক্রেডিট, ক্যাশ ক্রেডিট এবং শর্তসাপেক্ষ ঋণের পাশাপাশি প্রতিদিনই বাড়ছে এটিএম বা ক্রেডিট কার্ড, গৃহ ঋণ বা জীবনযাত্রা ঋণের পরিমাণ। ব্যাংকগুলো এখন উচ্চ মূল্যসম্পন্ন বা শীর্ষ গ্রাহকদের সেবা দিতে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাচ্ছে।
যা-ই হোক, 'এম কমার্স' ও 'ই-কমার্স'-এর সুবিধা অনুযায়ী নতুন নতুন পণ্যের উদ্ভাবন, 'গ্রিন ব্যাংকিং' এবং সেবা পরিধির বাইরে থাকা গ্রাহকদের সেবা প্রদানকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে এবং বাজারের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে পণ্য তৈরি করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। 'বিশ্ব মান'-এর পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশমুখী হচ্ছে, পাশাপাশি ব্যাংকিং সেবার ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। 'নিয়ন্ত্রক' সংস্থা ক্রমেই এগুলোকে ম্যানেজ করার, গাইড করার এবং সম্প্রসারণশীল ব্যাংকিং বিশ্বকে সহযোগিতা করার ক্ষমতা ও উপায় হারিয়ে ফেলছে। ভবিষ্যৎ আরো বেশি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে। আমরা কি পারব এই খেলায় অংশ নিতে এবং টিকে থাকতে?
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.