প্রান্তকথা-হিলি স্টেশন by শান্ত নূরুননবী
সেদিন বুধবার। রংপুর থেকে সৈয়দপুর যাওয়ার বাসটা মাঝপথে টায়ার ফাটিয়ে থেমে গেল। বাসযাত্রীরা আশ্বস্ত করলেন, সীমান্ত এক্সপ্রেস ছাড়তে দেরি আছে, টেনশন করবেন না। আমিও ভাবলাম, আজকাল আর সময়মতো রেলগাড়ি ছাড়ে কই! কিন্তু সৈয়দপুর স্টেশনে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই চোখের সামনে দিয়ে সীমান্ত এক্সপ্রেস ছেড়ে গেল।
আমি সৈয়দপুর স্টেশনের পাশ থেকে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের আগেই পার্বতীপুর পৌঁছে ট্রেনে উঠে বসতে সক্ষম হলাম। তারও আধা ঘণ্টা পর পার্বতীপুর থেকে সীমান্ত ছাড়ল।
আসন পড়েছে টয়লেটের পাশে। নাক চেপে তবু স্বস্তি নিয়ে বসে থাকলাম। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল কি আসেনি, পিঁপড়ার মতো মানুষ উঠে আসতে থাকল সেই চেয়ার কোচ কামরায়। জানালার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে দিলাম। আবছা অন্ধকার ভেদ করে বর্ডার গার্ডের ছাউনির সামনে সশস্ত্র দাঁড়িয়ে আছেন দেখলাম, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা। একজন সহযাত্রীর কাছ থেকে জানলাম, সেটা হিলি স্টেশন। এখানে ট্রেন আসতে না আসতেই রেললাইনের ধার বরাবর অপেক্ষা করতে থাকা সারি সারি মানুষ ট্রেনে উঠতে থাকে। শত শত নারী-পুরুষ। সীমান্ত এক্সপ্রেস কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই ছেড়ে দেয় হিলি থেকে। কিন্তু কামরায় উঠে আসতে থাকা মানুষের স্রোত যেন থামতে চায় না। বেশির ভাগই মহিলা। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, খুবই গরিব এই মানুষগুলো। ময়লা শাড়ি ঠেলে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ। কামরায় উঠে সবগুলো জানালা-দরজা দখল করে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ায়। চিৎকার, বিবাদ, অশ্লীল গালাগালি, রেলগাড়ির কামরা যেন নরক হয়ে ওঠে। যাত্রীরা বিব্রত, বিমূঢ়।
তখন সীমান্ত এক্সপ্রেস চলছিল হাঁটার চেয়েও ধীরগতিতে। ট্রেনের জানালা-দরজায় অসংখ্য টর্চ, মুঠোফোন ইত্যাদি থেকে নানা ভঙ্গিতে আলোর সংকেত ঝলকে ঝলকে ওঠে। চাপাচাপি দেহগুলোর প্রায় নিশ্ছিদ্র দেয়াল ঠেলে পথ করে নিয়ে মালের বস্তা, ফোলা ফোলা ব্যাগ, শাড়ি, ডাল, ওষুধ, মসলা ও কীটনাশক উঠে আসতে থাকল কামরার ভেতর। সব যাত্রীদের মতো হাঁ হয়ে দেখছিলাম। অভিজ্ঞ যাত্রীদের আলাপচারিতায় স্পষ্ট হলো, হিলি স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করা প্রতিটি ট্রেনেই এই হয়। ভারতীয় মালামাল আসে। যার অনেক কিছুই দেখা যায়, আবার অনেক কিছু দেখা যায় না। অনুমান করাও শক্ত, কী কী ভারতীয় মালামাল বহন করে চলে এই লাইনের ট্রেনগুলো। নিয়মিত যাত্রীরা নানা দ্রব্যের মোড়কে ফেনসিডিল আনার কথাও জানেন। ভারতের কীটনাশক বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কারণ, সেগুলো দ্রুত ক্ষতিকর কীট মেরে ফেলে বটে, উপকারী কীটও ধ্বংস করে। এটা ব্যবহারে মাটি ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে অবৈধভাবে হাজার হাজার ভারতীয় শাড়ি প্রতিদিন দেশে ঢুকে পড়ায় দেশীয় শাড়ি দেশেই বাজার হারাচ্ছে। হিলি স্টেশন বরাবর রেললাইনের পাশেই ভারত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদাসতর্ক সদস্যদের চোখ কী করে ফাঁকি দেয় আপাতদৃষ্টিতে অসহায় মানুষগুলো! তবে হ্যাঁ, ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম কয়েক মাস নাকি হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় অবৈধ মালামাল আসা বন্ধ ছিল।
কতক্ষণ ধরে চলন্ত ট্রেনে মালামাল উঠল, হিসাব রাখার চেতনা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ততক্ষণে সীমান্ত এক্সপ্রেসের গতি বেড়েছে। বর্ডার গার্ডের দায়িত্বশীল সদস্যরা রুটিন চেকিং করতে ট্রেনে উঠলেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক মহিলাকে ‘মা’ সম্বোধন করে যা যা আছে বের করে দিতে বললেন। মহিলা প্রথমে অস্বীকার করলেন। পরে বর্ডার গার্ডের একজন সদস্য মহিলার পরনের শাড়ির ভেতর থেকে একের পর এক শাড়ি বের করতে থাকলেন। এমনকি কোমরে, দুই পায়ের পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর রাবার দিয়ে বাঁধা শাড়ি আর শাড়ি। এভাবে এতগুলো ভাঁজ করা নতুন ভারতীয় শাড়ি সারা গায়ে আটকিয়ে তার ওপর নিখুঁতভাবে পরনের শাড়ি পেঁচিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সে নারীর দক্ষতা অনুমান করে অবাক হতে হয়। কিন্তু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বেশির ভাগই চোখের সামনে চোরাই পথে আসা ভারতীয় মালামাল গ্রহণ করেছে, একমাত্র ওই একজনকেই কেন ধরল বর্ডার গার্ড, সে এক রহস্য। মহিলা চিৎকার করে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ অপরাধীর হলেও মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। যাত্রীরা বলাবলি করছিলেন, নিরুপায় হয়ে তিনি অন্যায়টা করেছেন, এখন ধরা পড়ে সর্বস্বহারা হয়ে গেলেন।
তাহলে কি সীমান্তবর্তী হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা কেবল বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো জীবিকা না পেয়ে এই অন্যায়ের পথ বেছে নিয়েছে? নাকি আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বলতার উসকানিও আছে এই পরিস্থিতির পেছনে? তা ছাড়া রেলওয়ে পুলিশ, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ আর ওদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বহিনীর চোখের সামনে দিয়ে কী কৌশলেই বা প্রকাশ্য চোরাচালান ঘটে?
এই প্রশ্নগুলো কার কাছে করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে, সে তথ্যও আমরা নাগরিকেরা জানি না বললেই চলে!
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
আসন পড়েছে টয়লেটের পাশে। নাক চেপে তবু স্বস্তি নিয়ে বসে থাকলাম। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল কি আসেনি, পিঁপড়ার মতো মানুষ উঠে আসতে থাকল সেই চেয়ার কোচ কামরায়। জানালার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে দিলাম। আবছা অন্ধকার ভেদ করে বর্ডার গার্ডের ছাউনির সামনে সশস্ত্র দাঁড়িয়ে আছেন দেখলাম, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা। একজন সহযাত্রীর কাছ থেকে জানলাম, সেটা হিলি স্টেশন। এখানে ট্রেন আসতে না আসতেই রেললাইনের ধার বরাবর অপেক্ষা করতে থাকা সারি সারি মানুষ ট্রেনে উঠতে থাকে। শত শত নারী-পুরুষ। সীমান্ত এক্সপ্রেস কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েই ছেড়ে দেয় হিলি থেকে। কিন্তু কামরায় উঠে আসতে থাকা মানুষের স্রোত যেন থামতে চায় না। বেশির ভাগই মহিলা। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, খুবই গরিব এই মানুষগুলো। ময়লা শাড়ি ঠেলে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ। কামরায় উঠে সবগুলো জানালা-দরজা দখল করে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়ায়। চিৎকার, বিবাদ, অশ্লীল গালাগালি, রেলগাড়ির কামরা যেন নরক হয়ে ওঠে। যাত্রীরা বিব্রত, বিমূঢ়।
তখন সীমান্ত এক্সপ্রেস চলছিল হাঁটার চেয়েও ধীরগতিতে। ট্রেনের জানালা-দরজায় অসংখ্য টর্চ, মুঠোফোন ইত্যাদি থেকে নানা ভঙ্গিতে আলোর সংকেত ঝলকে ঝলকে ওঠে। চাপাচাপি দেহগুলোর প্রায় নিশ্ছিদ্র দেয়াল ঠেলে পথ করে নিয়ে মালের বস্তা, ফোলা ফোলা ব্যাগ, শাড়ি, ডাল, ওষুধ, মসলা ও কীটনাশক উঠে আসতে থাকল কামরার ভেতর। সব যাত্রীদের মতো হাঁ হয়ে দেখছিলাম। অভিজ্ঞ যাত্রীদের আলাপচারিতায় স্পষ্ট হলো, হিলি স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করা প্রতিটি ট্রেনেই এই হয়। ভারতীয় মালামাল আসে। যার অনেক কিছুই দেখা যায়, আবার অনেক কিছু দেখা যায় না। অনুমান করাও শক্ত, কী কী ভারতীয় মালামাল বহন করে চলে এই লাইনের ট্রেনগুলো। নিয়মিত যাত্রীরা নানা দ্রব্যের মোড়কে ফেনসিডিল আনার কথাও জানেন। ভারতের কীটনাশক বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কারণ, সেগুলো দ্রুত ক্ষতিকর কীট মেরে ফেলে বটে, উপকারী কীটও ধ্বংস করে। এটা ব্যবহারে মাটি ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে অবৈধভাবে হাজার হাজার ভারতীয় শাড়ি প্রতিদিন দেশে ঢুকে পড়ায় দেশীয় শাড়ি দেশেই বাজার হারাচ্ছে। হিলি স্টেশন বরাবর রেললাইনের পাশেই ভারত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদাসতর্ক সদস্যদের চোখ কী করে ফাঁকি দেয় আপাতদৃষ্টিতে অসহায় মানুষগুলো! তবে হ্যাঁ, ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম কয়েক মাস নাকি হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় অবৈধ মালামাল আসা বন্ধ ছিল।
কতক্ষণ ধরে চলন্ত ট্রেনে মালামাল উঠল, হিসাব রাখার চেতনা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ততক্ষণে সীমান্ত এক্সপ্রেসের গতি বেড়েছে। বর্ডার গার্ডের দায়িত্বশীল সদস্যরা রুটিন চেকিং করতে ট্রেনে উঠলেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক মহিলাকে ‘মা’ সম্বোধন করে যা যা আছে বের করে দিতে বললেন। মহিলা প্রথমে অস্বীকার করলেন। পরে বর্ডার গার্ডের একজন সদস্য মহিলার পরনের শাড়ির ভেতর থেকে একের পর এক শাড়ি বের করতে থাকলেন। এমনকি কোমরে, দুই পায়ের পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর রাবার দিয়ে বাঁধা শাড়ি আর শাড়ি। এভাবে এতগুলো ভাঁজ করা নতুন ভারতীয় শাড়ি সারা গায়ে আটকিয়ে তার ওপর নিখুঁতভাবে পরনের শাড়ি পেঁচিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সে নারীর দক্ষতা অনুমান করে অবাক হতে হয়। কিন্তু ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বেশির ভাগই চোখের সামনে চোরাই পথে আসা ভারতীয় মালামাল গ্রহণ করেছে, একমাত্র ওই একজনকেই কেন ধরল বর্ডার গার্ড, সে এক রহস্য। মহিলা চিৎকার করে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ অপরাধীর হলেও মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। যাত্রীরা বলাবলি করছিলেন, নিরুপায় হয়ে তিনি অন্যায়টা করেছেন, এখন ধরা পড়ে সর্বস্বহারা হয়ে গেলেন।
তাহলে কি সীমান্তবর্তী হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা কেবল বেঁচে থাকার জন্য আর কোনো জীবিকা না পেয়ে এই অন্যায়ের পথ বেছে নিয়েছে? নাকি আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বলতার উসকানিও আছে এই পরিস্থিতির পেছনে? তা ছাড়া রেলওয়ে পুলিশ, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ আর ওদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বহিনীর চোখের সামনে দিয়ে কী কৌশলেই বা প্রকাশ্য চোরাচালান ঘটে?
এই প্রশ্নগুলো কার কাছে করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে, সে তথ্যও আমরা নাগরিকেরা জানি না বললেই চলে!
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
No comments