স্মরণ-কমরেড অমল সেন: এই নষ্ট সময়ে অনুকরণীয় একজন by রাশেদ খান মেনন
আজ থেকে নয় বছর আগে, ২০০৩ সালে ১৭ জানুয়ারি মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল এই বাংলার এক অনন্য বিপ্লবীর, কমরেড অমল সেনের। কয় বছর পর একই দিনে মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল ওপার বাংলার আরেক অনন্য বিপ্লবীর, কমরেড জ্যোতি বসুর। কমরেড জ্যোতি বসু কেবল বাংলার নন, সারা ভারতের নেতা ছিলেন। কমরেড অমল সেন সেই হিসাবে কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না।
কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সর্বোপরি তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে তিনি এই উপমহাদেশের বিপ্লবীদের মধ্যে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কোনো প্রচার ছিল না। সংগঠন হিসেবেও তাঁর পার্টি বড় কিছু ছিল না। কিন্তু সারা জীবন লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের যে শ্রদ্ধা-ভক্তি অর্জন করেছিলেন, তা-ই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম তাঁর মৃত্যুর পর। ঢাকা থেকে যশোর-নড়াইল সীমান্ত গ্রাম বাকড়ী পর্যন্ত মানুষের যে ঢল নেমেছিল তাঁকে একবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, সেটাই তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের কী প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ ছিল তার প্রমাণ দিয়েছিল।
বস্তুত এই যশোর-নড়াইল সীমান্ত গ্রাম বাকড়ীকে কেন্দ্র করেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তেভাগার সেই অনন্য সংগ্রাম। এখানেই সেই ব্রিটিশ আমলের শেষ ভাগে কৃষকসংগ্রামীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বাধীন ভূখণ্ডের, যেখানে ব্রিটিশ শাসন এসে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে কৃষকের তেভাগার লড়াইয়ের যশোর-নড়াইল অঞ্চলের নেতা ছিলেন তিনি। যৌবনে আফরার জমিদারবাড়ির বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তিনি যে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেখান থেকে আর ফিরে যাননি। বাকড়ীর নিম্নজাতের মানুষগুলোর বাড়িই তাঁর বাড়ি হয়ে উঠেছিল। ওই মানুষগুলোকে উন্নত জীবনবোধের লেখাপড়া শিক্ষার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার, ভালো রান্না করার এবং সর্বোপরি সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন তিনি। তেভাগা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও এই অঞ্চলের মানুষ কমরেড অমল সেনকে স্মরণ করেন। স্মরণ করেন তাঁদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায়। নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামে। রাজনীতির ভাবনায়। গ্রামীণ সংগঠনের নানাবিধ কাজে।
তেভাগার আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ ভাগে এসে সর্বভারতীয় রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে সাম্প্রদায়িকতা, দেশ বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে এই সংগ্রামের বিকাশ ঘটেছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দিয়ে যাওয়া পোকায় খাওয়া স্বাধীনতার তোড়ে কৃষকের ওই সংগ্রাম ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু নড়াইলের তেভাগার সংগ্রাম—যার নেতা ছিলেন কমরেড অমল সেন, সেই সংগ্রাম থেকে সহজে পিছু হটেনি। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম ছিল এক প্রবল প্রতিরোধ। ভারত বিভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস দিনগুলোতে নড়াইলের তেভাগা অঞ্চল ছিল হিন্দু-মুসলিম কৃষকের এক আনন্দ সম্মিলনের অঞ্চল, যেখানে তারা জমি ও ফসলের ওপর কেবল নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ও তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সূচনা করেছিল।
পাকিস্তান-পরবর্তী সময়ে এ দেশে যে নতুন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তারও সামনের কাতারে ছিলেন কমরেড অমল সেন। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তান আমলের প্রায় অর্ধেক সময়ই জেলখানায় জীবন কাটাতে হয়। কিন্তু কমরেড অমল সেন সরকারের ছুড়ে দেওয়া প্রলোভনে, অথবা দেশ ছেড়ে নিরুপদ্রব জীবনের হাতছানিতে কোথাও আত্মসমর্পণ করেননি। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ এত প্রবল ছিল যে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ওপার বাংলায় পাড়ি জমানো দূরে থাক, এমনকি চিকিৎসার জন্যও সেখানে গিয়ে অবস্থান করতে রাজি হননি। কতখানি দৃঢ় মনোভাব থাকলে পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় কেবল দেশের মানুষের ভালোবাসার ওপর নির্ভর করে এ দেশে তিনি থেকে যেতে পেরেছিলেন।
৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কমরেড অমল সেনের দীর্ঘ কারাজীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল। সেখান থেকে বেরিয়েই তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বিষয়ে বাম-কমিউনিস্টদের বিভ্রান্তিকে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম করে তিনি প্রায় নিঃসঙ্গভাবে মুক্তযুদ্ধে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে এক হয়ে গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি। এই সমন্বয় কমিটিই প্রবাসী সরকারের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দেশের অভ্যন্তরে মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়েছিল এ দেশের মানুষের শোষণ-বঞ্চনাবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে।
বাংলাদেশ-পরবর্তীকালের ঘটনা। এবার কমরেড অমল সেন মনোযোগ দিয়েছিলেন এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পুনর্গঠিত করার কাজে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। তারপর বহু আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে সেই ঐক্যের বিস্তৃতি ঘটান, যার সর্বশেষ রূপ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। কমরেড অমল সেন এই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দুই হাজার সাল পর্যন্ত। এত দিনে তাঁর বয়স এগিয়েছে। দুই হাজার সালের পর সংগঠনের মূল দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও কমরেড অমল সেনই ছিলেন এই ওয়ার্কার্স পার্টির মূল প্রাণ।
এ ধরনের একজন মানুষকে নিশ্চয়ই আমরা গম্ভীর, কাঠখোট্টা, নিরস ব্যক্তি বলে ভাবব। বস্তুত এ দেশের কমিউনিস্টদের সম্পর্কে, বিপ্লবীদের সম্পর্কে সে ধরনের ধারণাই ছিল। এখন অবশ্য যুগের হাওয়ায় কমিউনিস্টরা নিজেদের এমনভাবে পাল্টে ফেলেছেন যে তাঁদের একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না। তবে কমরেড অমল সেন সম্পর্কে সে ধরনের অবাস্তব ধারণা কেউ বলতে পারে না। ভোগে নয়, জীবনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সহজ বিচরণ করে জীবনকে উপভোগ করেছেন তিনি। অসামান্য জীবনবোধ ও রসবোধের অধিকারী কমরেড অমল সেন জীবনঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। সন্ন্যাসীর নয়, কর্মীর আত্মত্যাগ ছিল তাঁর জীবনদর্শন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও কলা, দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র—সব শাখাতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি। কোথাও থেমে থাকেননি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক সময়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্ঞান আহরণ করেছেন। আর সেসব সহজ-সরল ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমানে এ ধরনের একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ এবং পৃথিবীতেও এখন নষ্ট সময়। রাজনৈতিক আদর্শ এখন অতীতের বিষয়। ন্যায়, নীতিনিষ্ঠা, জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ—এ সবকিছুই আর রাজনৈতিককর্মীদের সেভাবে আকৃষ্ট করে না। আর সে ক্ষেত্রে কমরেড অমল সেন বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীদের আকর্ষণ করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী জীবিতকালে, আর কী মৃত্যুর পর—এ দেশের তরুণরা দলে দলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সেই তরুণদের তাঁর সংগঠনে ধরে রাখা গেছে কি না, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কমরেড অমল সেন তাঁদের কাছে প্রিয় নাম হিসেবে রয়ে গেছেন, থাকবেন।
কমরেড অমল সেন চলে গেছেন নয় বছর হয়। বাকড়ীতে তাঁর তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্রে তিনি সমাহিত আছেন। সেখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রাম-সংগঠনের প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টসহ সব বাম গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তির দায়িত্ব অমল সেনের রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে অনুসরণ করা। আর তার মধ্য দিয়ে এই অনন্য বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
রাশেদ খান মেনন: সংসদ সদস্য, সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
বস্তুত এই যশোর-নড়াইল সীমান্ত গ্রাম বাকড়ীকে কেন্দ্র করেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তেভাগার সেই অনন্য সংগ্রাম। এখানেই সেই ব্রিটিশ আমলের শেষ ভাগে কৃষকসংগ্রামীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বাধীন ভূখণ্ডের, যেখানে ব্রিটিশ শাসন এসে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে কৃষকের তেভাগার লড়াইয়ের যশোর-নড়াইল অঞ্চলের নেতা ছিলেন তিনি। যৌবনে আফরার জমিদারবাড়ির বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে তিনি যে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেখান থেকে আর ফিরে যাননি। বাকড়ীর নিম্নজাতের মানুষগুলোর বাড়িই তাঁর বাড়ি হয়ে উঠেছিল। ওই মানুষগুলোকে উন্নত জীবনবোধের লেখাপড়া শিক্ষার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার, ভালো রান্না করার এবং সর্বোপরি সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন তিনি। তেভাগা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও এই অঞ্চলের মানুষ কমরেড অমল সেনকে স্মরণ করেন। স্মরণ করেন তাঁদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রায়। নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামে। রাজনীতির ভাবনায়। গ্রামীণ সংগঠনের নানাবিধ কাজে।
তেভাগার আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ ভাগে এসে সর্বভারতীয় রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে সাম্প্রদায়িকতা, দেশ বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে এই সংগ্রামের বিকাশ ঘটেছিল, তা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দিয়ে যাওয়া পোকায় খাওয়া স্বাধীনতার তোড়ে কৃষকের ওই সংগ্রাম ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু নড়াইলের তেভাগার সংগ্রাম—যার নেতা ছিলেন কমরেড অমল সেন, সেই সংগ্রাম থেকে সহজে পিছু হটেনি। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম ছিল এক প্রবল প্রতিরোধ। ভারত বিভাগের সময়ের সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস দিনগুলোতে নড়াইলের তেভাগা অঞ্চল ছিল হিন্দু-মুসলিম কৃষকের এক আনন্দ সম্মিলনের অঞ্চল, যেখানে তারা জমি ও ফসলের ওপর কেবল নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর গরিব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ও তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সূচনা করেছিল।
পাকিস্তান-পরবর্তী সময়ে এ দেশে যে নতুন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তারও সামনের কাতারে ছিলেন কমরেড অমল সেন। এ জন্য তাঁকে পাকিস্তান আমলের প্রায় অর্ধেক সময়ই জেলখানায় জীবন কাটাতে হয়। কিন্তু কমরেড অমল সেন সরকারের ছুড়ে দেওয়া প্রলোভনে, অথবা দেশ ছেড়ে নিরুপদ্রব জীবনের হাতছানিতে কোথাও আত্মসমর্পণ করেননি। দেশের মানুষের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ এত প্রবল ছিল যে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ওপার বাংলায় পাড়ি জমানো দূরে থাক, এমনকি চিকিৎসার জন্যও সেখানে গিয়ে অবস্থান করতে রাজি হননি। কতখানি দৃঢ় মনোভাব থাকলে পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় কেবল দেশের মানুষের ভালোবাসার ওপর নির্ভর করে এ দেশে তিনি থেকে যেতে পেরেছিলেন।
৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কমরেড অমল সেনের দীর্ঘ কারাজীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল। সেখান থেকে বেরিয়েই তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে। ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের বিষয়ে বাম-কমিউনিস্টদের বিভ্রান্তিকে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম করে তিনি প্রায় নিঃসঙ্গভাবে মুক্তযুদ্ধে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে এক হয়ে গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি। এই সমন্বয় কমিটিই প্রবাসী সরকারের অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দেশের অভ্যন্তরে মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়েছিল এ দেশের মানুষের শোষণ-বঞ্চনাবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে।
বাংলাদেশ-পরবর্তীকালের ঘটনা। এবার কমরেড অমল সেন মনোযোগ দিয়েছিলেন এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পুনর্গঠিত করার কাজে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। তারপর বহু আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে সেই ঐক্যের বিস্তৃতি ঘটান, যার সর্বশেষ রূপ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। কমরেড অমল সেন এই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দুই হাজার সাল পর্যন্ত। এত দিনে তাঁর বয়স এগিয়েছে। দুই হাজার সালের পর সংগঠনের মূল দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও কমরেড অমল সেনই ছিলেন এই ওয়ার্কার্স পার্টির মূল প্রাণ।
এ ধরনের একজন মানুষকে নিশ্চয়ই আমরা গম্ভীর, কাঠখোট্টা, নিরস ব্যক্তি বলে ভাবব। বস্তুত এ দেশের কমিউনিস্টদের সম্পর্কে, বিপ্লবীদের সম্পর্কে সে ধরনের ধারণাই ছিল। এখন অবশ্য যুগের হাওয়ায় কমিউনিস্টরা নিজেদের এমনভাবে পাল্টে ফেলেছেন যে তাঁদের একজন সাধারণ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না। তবে কমরেড অমল সেন সম্পর্কে সে ধরনের অবাস্তব ধারণা কেউ বলতে পারে না। ভোগে নয়, জীবনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় সহজ বিচরণ করে জীবনকে উপভোগ করেছেন তিনি। অসামান্য জীবনবোধ ও রসবোধের অধিকারী কমরেড অমল সেন জীবনঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। সন্ন্যাসীর নয়, কর্মীর আত্মত্যাগ ছিল তাঁর জীবনদর্শন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও কলা, দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র—সব শাখাতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি। কোথাও থেমে থাকেননি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক সময়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্ঞান আহরণ করেছেন। আর সেসব সহজ-সরল ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমানে এ ধরনের একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ এবং পৃথিবীতেও এখন নষ্ট সময়। রাজনৈতিক আদর্শ এখন অতীতের বিষয়। ন্যায়, নীতিনিষ্ঠা, জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ—এ সবকিছুই আর রাজনৈতিককর্মীদের সেভাবে আকৃষ্ট করে না। আর সে ক্ষেত্রে কমরেড অমল সেন বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীদের আকর্ষণ করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী জীবিতকালে, আর কী মৃত্যুর পর—এ দেশের তরুণরা দলে দলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সেই তরুণদের তাঁর সংগঠনে ধরে রাখা গেছে কি না, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কমরেড অমল সেন তাঁদের কাছে প্রিয় নাম হিসেবে রয়ে গেছেন, থাকবেন।
কমরেড অমল সেন চলে গেছেন নয় বছর হয়। বাকড়ীতে তাঁর তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্রে তিনি সমাহিত আছেন। সেখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রাম-সংগঠনের প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টসহ সব বাম গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তির দায়িত্ব অমল সেনের রেখে যাওয়া জীবনাদর্শকে অনুসরণ করা। আর তার মধ্য দিয়ে এই অনন্য বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
রাশেদ খান মেনন: সংসদ সদস্য, সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
No comments