সময়ের প্রতিধ্বনি-সংকটে পাকিস্তান : কলকাঠি নাড়ছেন প্রধান বিচারপতি by মোস্তফা কামাল

শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল আস্থা ভোটে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানের সংকট মোটেই দূর হয়নি। পাকিস্তানের উচ্চ আদালত জারদারি সরকারকে বেশ ঘাঁটাবে বলেই মনে হয়। আদালত অবমাননার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিকে সুপ্রিম কোর্টে তলব করায় তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। পাকিস্তান বিষয়ে লেখার শুরুতে আমি ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরতে চাই।


১৪ জানুয়ারি ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে পাকিস্তান সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'পাকিস্তানে কী ঘটতে পারে?' প্রতিবেদনে তিন বিকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, প্রথমত সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি কিংবা রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি পদত্যাগ করতে পারেন। সেটা ঘটলে পাকিস্তানের জন্য চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। এ ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এ ছাড়া জারদারি দুর্নীতির বিচারের হাত থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করতে পারেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে জারদারিই বর্তমান সেনাবাহিনী কিংবা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান টার্গেট, গিলানি নন।
দ্বিতীয়ত, সরকার ও বিচার বিভাগের লড়াই চলতে থাকবে এবং আগস্টে সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। সরকার সুপ্রিম কোর্টকে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কোর্ট চাইবে দ্রুত সুরাহা।
তৃতীয়ত, সরকার ও বিচার বিভাগ কেউ কারো কথা না শুনে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী গোটা সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেবে। তারপর অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হতে পারে।
যদিও পাকিস্তানের এই সংকটের সূচনা হয় ২০১১ সালের মে মাসে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন ইসলামাবাদের অ্যাবোটাবাদে নিহত হওয়ার পর। ওই ঘটনায় দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। আর এতে দেশের জনগণ এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে বলে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে দেশটিতে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান রোধ এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কাটছাঁটে সহযোগিতা চেয়ে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দেওয়া হয়। সেই গোপন চিঠির বিষয়টি গত অক্টোবরে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে জারদারি সরকার ও সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।
জেনারেল কায়ানি গোপন চিঠির ঘটনা তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। ফলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী সরকারকে চাপে রাখতে আরো একটি অস্ত্র পেয়ে যান। এমনিতেই রাষ্ট্রপতি জারদারির সঙ্গে প্রধান বিচারপতির দ্বন্দ্ব মারাত্মক রূপ নিয়েছে। জারদারির মাথার ওপর ঝুলছে দুর্নীতির খৰ। তার ওপর নতুন যুক্ত হয় সেনাপ্রধানের অভিযোগ।
সংগত কারণেই সেনাপ্রধানের বাড়াবাড়ির বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ক্ষমতাসীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী গিলানি গত ৯ জানুয়ারি চীন সফরের সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গোপন চিঠির ঘটনা তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে সেনাপ্রধান আশফাক কায়ানি ও আইএসআই প্রধান লে. জেনারেল আহমেদ সুজা পাশা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান কায়ানি প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের জবাবে বলেন, এর ফলে দেশে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
পাকিস্তানের চলমান এই সংকট উত্তরণে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সরকার এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এবং প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি জারদারির সঙ্গে বৈঠক করে সেনাপ্রধান সরাসরি তাঁর সম্পর্কে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। এর এক দিন পরই প্রধানমন্ত্রী গিলানি কিছুটা 'নমনীয় পন্থা' অবলম্বন করেন। সেনাপ্রধান সম্পর্কে তাঁর দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার না করলেও তিনি সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেছেন, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী অনন্য ভূমিকা রাখছে। তিনি এও বলেছেন, তিনি কোনো ব্যক্তির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। দেশের সংবিধান অনুযায়ী তিনি কেবল পার্লামেন্টের কাছেই জবাবদিহি করবেন। এর ফলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পার্লামেন্টে আস্থা ভোট দেয় সরকার। পাকিস্তানে গণতন্ত্র্র থাকবে, নাকি সামরিক শাসন জারি হবে তা নির্ধারণ করতেই আস্থা ভোটের ব্যবস্থা।
পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিক ও বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠকের পর দেশটির রাজনৈতিক সংকট আপাতত কাটলেও ঝুঁকি এখনো রয়েই গেছে। জারদারি সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলে অনেক আগেই সরকারকে বিদায় নিতে হতো। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে সরকার এখনো টিকে আছে। তবে পাকিস্তানে এখন কলকাঠি নাড়ছেন সে দেশের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির দ্বন্দ্ব পুরনো।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় থাকাকালে ইফতেখার চৌধুরীকে বরখাস্ত করেন। পরে তাঁকে গৃহবন্দিও করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আইনজীবী ও বিচারকদের খেপিয়ে তুলেছিলেন এবং তাঁদের আন্দোলনে পেছন থেকে হাওয়া দিচ্ছিলেন। তাই তাঁকে পুনঃ নিয়োগ করতে রাজি ছিলেন না বর্তমান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতির পদে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি বিচারক ও আইনজীবীদের আন্দোলনকে উসকে দিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে তিনিই নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
অবশ্য এ কথাও ঠিক, পারভেজ মোশাররফের পতনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ইফতেখার চৌধুরী। এ কথা জারদারি সরকারও স্বীকার করবে। কিন্তু বিচার বিভাগের শৃঙ্খলার স্বার্থে জারদারি তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে নিতে চাননি। তিনি এও বলেছেন, ইফতেখার চৌধুরী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরিয়ে নেওয়া হলে বিচার বিভাগ রাজনীতির দোষে দুষ্ট হবে।
রাষ্ট্রপতির এই যুক্তি মানলেন না মুসলিম লীগ প্রধান নওয়াজ শরিফ। তিনি বললেন, প্রধান বিচারপতি পদে ইফতেখার চৌধুরীকে পুনঃ নিয়োগ দেওয়া না হলে সরকারের ওপর থেকে তাঁর দলের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন। নওয়াজ শরিফের চাপের মুখেই ইফতেখার চৌধুরীকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হলেন জারদারি। আর সেই নিয়োগ এখন তাঁর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন জারদারিকে সরানোর জন্য তিনিই সেনাপ্রধানের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। পাকিস্তানের ক্ষমতার নাটাইটা এখন তাঁর হাতে। তিনি সুতা ছাড়ছেন আবার টানছেন। তিনি সরকারের সঙ্গে একধরনের খেলা শুরু করেছেন।
পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে বলা হতো 'শেয়ানা আদমি'। সেই শেয়ানা আদমিকে হটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইফতেখার চৌধুরী। তাঁর কাছে 'অপরিপক্ব জারদারি' কোনো ব্যাপারই না। একটু নড়চড় করলেই তাঁর কলমের এক খোঁচাতে জেনারেল কায়ানিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়া হবে। সে রকম একটা অবস্থান নিয়ে বসে আছেন প্রধান বিচারপতি। তা ছাড়া সেনাপতি ও বিচারপতি দ্বয়ের সম্পর্ক যে মধুর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা দুজনে মিলেই নাস্তানাবুদ করছেন নির্বাচিত সরকারকে। আদালত অবমাননার অভিযোগে গত সোমবার প্রধান বিচারপতি প্রধানমন্ত্রীকে তলব করে বুঝিয়ে দিলেন, পাকিস্তানের নাটাই এখন তাঁর হাতে। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে 'সৎ নন' মন্তব্য করেছেন।
অবশ্য এখন পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র কী চায় তা বোঝার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনী। শেষ পর্যন্ত যদি যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার না করে, তাহলে জারদারির দুর্নীতির ফাইল ওপরে উঠে আসতে পারে। সেই ফাইলটিও এখন প্রধান বিচারপতির টেবিলে।
আসলে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে চায়, পাকিস্তানে জারদারি সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা আল কায়েদা-তালেবান জঙ্গিদের হাতে চলে যেতে পারে কি না! যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিরা পাঁচ বছর শাসনও করেছে। আফগানিস্তানে বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে মোল্লা ওমরকে ক্ষমতার অংশীদার না করলে আবারও তারা ক্ষমতা দখল করতে পারে। তবে এখন তালেবান জঙ্গিদের টার্গেট পাকিস্তান। কোনো কারণে পাকিস্তান জঙ্গিদের হাতে চলে গেলে বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সেটা কোনোভাবেই মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের 'দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকার'কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। জারদারি সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন কত দিন থাকবে তার ওপর নির্ভর করছে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। এ মুহূর্তে পাকিস্তানে জারদারি সরকার ব্যর্থ হলে স্বৈরতন্ত্র আবার দেশটির ওপর চেপে বসবে। যদিও পাকিস্তানের রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ইমরান খান এবং তিনি তাতে সফলও হচ্ছেন। তাঁকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে পাকিস্তানি জনগণ। কয়েক মাসে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে লাহোর এবং করাচিতে তাঁর জনসভায় লাখো মানুষের জমায়েত দেখে পিপিপি এবং মুসলিম লীগ (এন) কিছুটা বিচলিতই হয়েছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.